দূরের দূরবীনে-শতায়ু বটবৃক্ষ ও ছায়াহীন হওয়ার আগে by অজয় দাশগুপ্ত

য় দিনের ঝটিকা সফর। সফর বলা ঠিক হবে না, জরুরি কাজে স্বদেশভ্রমণ। জন্মদায়িনী মায়ের অসুস্থতা। রোগশয্যায় শায়িতা। দেখা হবে কি হবে না, হলেও চিনতে পারবেন কি না, সংশয়-সন্দেহ ঠেলে হঠাৎ যাওয়ার ভেতর আকস্মিকতা আছে, নেই পর্যাপ্ত সময়। ফলে চট্টগ্রামেই সীমাবদ্ধ ছিল বিচরণ। আর আসা-যাওয়ার জন্য ঢাকা এয়ারপোর্ট ওই পর্যন্তই, এর ভেতরই দুটো ঘটনা ঘটে গেছে।


একটি পরিকল্পিত অন্যটি আকস্মিক! আজ পরিকল্পিত ঘটনার কথাটাই বলব। মনে মনে স্থির করে রেখেছিলাম সময় পেলে একজন মানুষের সঙ্গে দেখা করবই। তিনি মানুষ হলেও এখন মনীষা, আমাদের পোড়ারমুখো, জ্বলন্ত সমাজে দ্রোহ আর স্বস্তির প্রতীক। একদা চট্টগ্রাম ছিল বীর প্রসবিনী। এই শহরে, এই অঞ্চলে জন্ম নিয়েছেন অকুতোভয় বীর, জন্মেছেন ইতিহাস রাঙিয়ে দেওয়ার মতো অনেক সাহসী বাঙালি। আমরা মনে রাখি বা না রাখি, চট্টগ্রাম ব্রিটিশ আমল থেকে শৌর্যবীর্যের সূতিকাগার। বিশেষত পরাধীন ও পদানত বঙ্গদেশে চট্টগ্রামই হয়ে উঠেছিল আলোকবর্তিকা। সে সূর্য বা আলোর উৎস ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবের পুরো ভাগে থাকা শিক্ষিত বাঙালি সূর্য সেন। যখন তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, যখন তাঁর চোখে স্বাধীন দেশের স্বপ্ন, তখনকার বাস্তবতায় সাম্প্রদায়িকতা এতটা প্রকট ও ভয়াবহ ছিল না। হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কও এতটা জটিল আর প্যাঁচের ভেতর ছিল না। দ্বিজাতিতত্ত্ব, ভারত ভেঙে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র কাঠামোর পত্তনে সূর্য সেন নন্দিত হওয়ার পরিবর্তে নিন্দিত ও উপেক্ষিত হয়ে রইলেন। আমাদের কৈশোরে তাঁর নাম উচ্চারণও ছিল ভয়ের। মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত দেশে চট্টগ্রাম শহরের প্রাণকেন্দ্রে আবক্ষ মূর্তি স্থাপন ও নানাবিধ স্মরণে উদ্ভাসিত হওয়ার কাজটিও থমকে গিয়েছিল একসময়। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর বৈরী সময়ে তাঁকে ডাকাত এবং প্রীতিলতার মতো সাহসী কন্যাকে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল বেশ্যা। আজ যিনি বিচারাধীন, যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত সেই জামায়াতি নেতা সাঈদী উল্লাসের সঙ্গে তা প্রচার করতেন। ওয়াজ মাহফিলের নামে জামায়াতিদের ধর্মান্ধ উন্মাদনা ও প্রচারণায় সূর্য সেন ও তাঁর সহযোগীরা ঢাকা পড়ে যাচ্ছিলেন বিস্মৃতি ও কালো ধুলোর অন্তরালে। কিন্তু সময় তো আর থেমে থাকে না। সময়ের হাত ধরে উঠে আসছিলেন সূর্য সেনের কনিষ্ঠ সহযোগী, জালালাবাদ যুদ্ধে গুলিবিদ্ধ ও দণ্ডিত স্বদেশি বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী। দেশের পরিবেশ বদলাতে শুরু করলে তিনি উঠে আসতে থাকেন পাদ-প্রদীপের আলোয়। তাঁর কীর্তি নিয়ে আমাদের যত দ্বিধাদ্বন্দ্ব আর তর্ক-বিতর্ক থাকুক না কেন বিনোদ বিহারী চৌধুরী ধীরে ধীরে নিজের অবস্থান ও আসনে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছেন। একসময় বাঙালির কৃতজ্ঞতা বোধ, বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা আর অসাম্প্রদায়িক বিবেকের স্পর্শে হয়ে উঠলেন মহীরুহ, খ্যাতি, যশ, পুরস্কার আর সম্মান লুটিয়ে পড়তে শুরু করল। যত বয়স বাড়ল, ততই তিনি বাংলাদেশ ও তার প্রগতির সমার্থক হয়ে উঠলেন। সংখ্যালঘু নির্যাতন, তাঁদের ধন-সম্পত্তি নিয়ে রাষ্ট্র ও সরকারের হঠকারিতা, প্রগতিশীল দেশজ আন্দোলনে বয়োবৃদ্ধ বিনোদবাবুই প্রতীক হয়ে দাঁড়ালেন। তাঁর বয়সী ছায়া ও অভিজ্ঞতার স্পর্শে অনেক আগুন প্রশমিত হয়ে পড়ল। অঙ্গার হলো ছাই। তার পরও কি রক্ষা আছে? প্রগতিশীল রাজনীতির ধারক-বাহক নামে পরিচিত আওয়ামী লীগের হাতেই হেনস্তা হতে হয়েছে তাঁকে। ভূতপূর্ব মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী ভেবেছিলেন ক্ষমতা হচ্ছে একচ্ছত্র আর চিরকালীন। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ জ্ঞান লুপ্ত হয়ে বয়সী এই বিপ্লবীকে তিনি ডাকতেন 'বিনোদ ভিখারী' নামে। ইতিমধ্যে কর্ণফুলীর জল গড়িয়েছে অনেক দূর। মেয়র মহিউদ্দিন আজ অতীত। নব মেয়র মঞ্জুর বিএনপির ক্যান্ডিডেট। তাঁর নির্বাচনী প্রচারণা বা অন্য কোনো সমাবেশে বিনোদ বিহারীর উপস্থিতি দেখে দূর প্রবাসেও অস্বস্তি আর যন্ত্রণা বোধ করেছি। একদিকে এর পেছনের তথ্য বা কারণ জানার আগ্রহ অন্যদিকে বয়সী, শতবর্ষ অতিক্রান্ত বিপ্লবীর দেখা পাওয়া এ দুই আকর্ষণে ছুটে গিয়েছিলাম পরিচিত সেই স্মৃতিময় গৃহকোণে। সূর্য সেনকে আমরা দেখিনি। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনও দেখিনি। কিন্তু ইতিহাসের জীবন্ত এই সাক্ষী তো এখনো বেঁচে। তিনিই বহন করছেন সেই উত্তরাধিকার আর ঐতিহ্য। গিনি্নকে নিয়ে যখন তাঁর দুয়ারে পেঁৗছুই তখন ঠিক মধ্যাহ্ন। প্রচণ্ড গরমের পর হঠাৎ হয়ে যাওয়া একপশলা বৃষ্টিতে খানিকটা শান্ত আর সজীব পরিবেশ। স্মৃতিময় বৃক্ষশোভিত টিনের চালার বাড়িটি আজ অন্য চেহারায়। ভাবছিলাম নোমান, খসরু বা মীর নাছিরের নাম উঠে আসবে। সত্যভাষী বিনোদ বিহারী তিনটি মাত্র নাম উচ্চারণ করলেন এবং তাঁর অনুমতি নিয়েই বলছি, তিনজনই অমুসলিম ও হিন্দু। ব্যবসায়ী মৃদুলবাবু, একদা জাসদ নেতা ইন্দুনন্দন দত্ত অন্যজন হারুবাবু নামে পরিচিত অখ্যাত এক সামাজিক নেতা। এই ত্রয়ীর প্ররোচনা আর উদ্যোগেই কাণ্ডটি ঘটেছিল। প্রশ্ন উঠতে পারে, 'তিনি কেন গেলেন'? মনে রাখা প্রয়োজন বিনোদ বিহারীর ন্যায্য ক্ষোভ, অভিমান ও তাঁর ওপর নেমে আসা শাব্দিক নির্যাতন ও অপমান বিষয়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও সুরাহার পথ বাতলে দিতে পারেননি। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, নাট্যজন আসাদুজ্জামান নূরের মতো মানুষ সমঝোতার দূত না হলে ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে পারত।
এক কিস্তিতে এই লেখা শেষ করা যাবে না। যেমন শেষ হবে না তাঁর স্নিগ্ধ সানি্নধ্য ও অন্তরঙ্গ স্নেহের পরশ। চলে আসার মুহূর্তে আমার অখ্যাত, সাধারণ পিতার কথা বলতেও ভুললেন না। কপালে দুহাত ঠেকিয়ে বললেন 'তোমার মায়ের মঙ্গল হোক'। বিমূঢ় স্তব্ধ আর পলকহীন চাওয়ায় আমি উৎস চেতনারহিত। এর আগেও আমি তাঁকে দেখেছি, ক্ষিপ্র, চঞ্চল, ধূতির গোছা হাতে নিয়ে বক্তৃতারত অথবা হন হন করে হেঁটে যেতে। আমার মনে হতো বিলেত প্রবাসী লেখক নীরদ মি চৌধুরীর কার্বনকপি। এখন তাঁর অন্য চেহারা, স্থির, অচঞ্চল, প্রশান্ত এক বাণীমূর্তি। খেদ করে বললেন, 'আমাকেও এরা সন্দেহ করে। সন্দেহ করে আমার বিপ্লবী চেতনাকে।' আমি নাকি মাস্টারদার সঙ্গী ছিলাম না। লজ্জায় মাথা নুয়ে আসে। নিজেদের অপমান আর হীনতায় হতবাক হয়ে থাকি। বলার কিছু থাকে না। অপমানে-লজ্জায় মুখ লুকানোরও বিকল্প নেই। তবু বললাম, 'দাদু, এই আমাদের চরিত্র। আমরা একযোগে একসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে মানি না। আপনাকে মানব কি উপায়ে?'
বৃষ্টি তখন ধরে এসেছে, গিনি্নর হাতটি হাতের ভেতর নিয়ে বললাম, 'একেই বলে পুণ্য।' চট্টগ্রামের আকাশ ভেঙে আবারও বৃষ্টির ধারা অথবা প্রকৃতির আশীর্বাদ নেমেছে তখন। শতবর্ষের বটবৃক্ষ ও তার ছায়া না থাকলে রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ে কোথায় দাঁড়াব আমরা? একদা সূর্য সেন-প্রীতিলতা ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবীদের অনেক অপমান ও সন্দেহ করেছি আমরা। আজ তো সে বাস্তবতা নেই। বিনোদ বিহারী চৌধুরীকে সত্যিকারের সম্মান ও শ্রদ্ধা জানাতে হলে আওয়ামী লীগ বা বিএনপির ঊধর্ে্ব উঠে স্মৃতি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। রক্ষা করতে হবে মূল্যবান দলিলপত্র, মাস্টারদা ও বিপ্লবের শেষ চিহ্নগুলো। তাঁর বয়স এক শর ওপরে।
লেখক : সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক
dasguptaajoy@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.