ভোজ্যতেলের দাম-স্বস্তির আশ্বাসে উদ্বেগের বীজ
বাংলাদেশে যে কয়েকটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অস্থির বাজারের কারণে ঘরে ঘরে ক্ষোভ তার মধ্যে বিশেষভাবে বলা যায় ভোজ্যতেলের কথা। এক সময় দেশীয় সরিষার তেলেই বাঙালির নিত্যদিনের সুস্বাদু নানা পদের রান্না হতো। এখন সরিষা ব্রাত্য, বাজার দখল করেছে আমদানিকৃত সয়াবিন ও পাম অয়েল। অপরিশোধিত এ তেল আমদানি করে কয়েকটি মিল শোধনের পর বাজারে ছাড়ে। এ প্রক্রিয়া ব্যবসার নিয়মের মধ্যে পড়ে।
কিন্তু গোল বাধে যখন নিত্যপ্রয়োজনীয় এ পণ্যের মূল্য বাজারে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণের কারণে অস্বাভাবিকভাবে চড়ে যায়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এমনটিই বারবার ঘটছে। ভোজ্যতেলের আমদানিকারক ও পরিশোধক মিলগুলোর তরফে এ ক্ষেত্রে অজুহাত দেওয়া হয় বিশ্ববাজারে পরিশোধিত ও অপরিশোধিত তেলের মূল্যবৃদ্ধির। সরকারও তাদের এ যুক্তি মেনে নিয়ে মূল্য পুনর্নির্ধারণের নামে আরেক দফা বৃদ্ধির প্রস্তাব মেনে নেয়। সামনে কোরবানির ঈদ। এ সময় ভোজ্যতেলের চাহিদা বৃদ্ধি পায় এবং ক্রেতারা মূল্য বাড়ার শঙ্কায় থাকে। এমন প্রেক্ষাপটে 'ভোজ্যতেলের দাম বাড়াবেন না মিল মালিকরা' খবরটি তাদের জন্য স্বস্তিদায়ক হতেই পারে। মঙ্গলবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে এ আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিশ্ববাজারের সামান্যতম খোঁজ যারা রাখেন তারা এ আশ্বাসে স্বস্তি নয়, বরং উদ্বেগের বীজই লুকায়িত দেখবেন। রয়টার্স বার্তা সংস্থা ১৯ অক্টোবর খবর দিয়েছে, সয়াবিনের ভালো ফলনের সম্ভাবনায় বিশ্ববাজারে সয়াবিন তেলের দাম পরপর তৃতীয় দিনের মতো কমে গেছে। আরও একটি পূর্বাভাস রয়েছে বাজারে : এ তেলের অন্যতম বড় ক্রেতা দেশ চীনের দিক থেকে চাহিদা কমার কারণে তাদের আমদানি কমবে। বাংলাদেশের আমদানিকারকরা এ প্রবণতা ভালো করেই জানেন। অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মে তাদের তরফে প্রতিশ্রুতি হওয়া উচিত_ ভোজ্যতেলের দাম কমবে। কিন্তু তারা প্রতিশ্রুতি দিলেন, দাম বাড়ানো হবে না। অর্থাৎ চড়া দামই বহাল থাকবে। স্পষ্টতই আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমার সুফল ক্রেতাদের দিতে আদৌ আগ্রহী নয়। বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশের বাজারে দাম সহনীয় রাখার জন্য গত ফেব্রুয়ারি মাসে আমদানি শুল্ক ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছিল। কিন্তু তার সুফল ভোক্তা পর্যায়ে আদৌ অনুভূত হয়নি। এখন বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম কমতে শুরু করেছে। বাজারে উচ্চমূল্য চলতে থাকলে আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের লাভের অঙ্কই কেবল বাড়বে এবং এ প্রক্রিয়ায় উপেক্ষিত থেকে যাবে কোটি কোটি ক্রেতার স্বার্থ। শুধু ভোজ্যতেল নয়, ডাল ও চিনিসহ আরও অনেক পণ্যের ক্ষেত্রেও একই ধরনের অভিযোগ রয়েছে। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি ভারত সরকার পেঁয়াজ রফতানির ওপর মাত্র কয়েক দিনের জন্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। সে খবর জানাজানি হতেই বাংলাদেশে এ পণ্যের দাম রাতারাতি দ্বিগুণ হয়ে যায়। অথচ ওই কয়েক দিনে বাংলাদেশে কোনো পেঁয়াজ আমদানি হয়নি। ভারত সরকারের ঘোষণার সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশের কিছু ব্যবসায়ী কয়েক দিন পেঁয়াজ নিয়ে ফাটকা খেলে বিপুল লাভ ঘরে তুলল এবং সরকার তা কেবল অসহায়ের মতো দেখে গেল। 'ব্যবসাবান্ধব' সরকার বলতে যা বোঝায়, এটা কিন্তু আদৌ তার লক্ষণ নয়। এভাবে বরং অনিয়মকেই প্রশ্রয় দেওয়া হয়।
No comments