পানির জন্য হাহাকার অগত্যা কূপ খনন by অমিতোষ পাল ও নওশাদ জামিল

মূল সড়ক পার হয়ে ছোট গলি ধরে সামনে এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ল মানুষের জটলা। চারদিকে গোল হয়ে কী যেন দেখছে তারা। ঘটনাস্থলে যেতেই শোনা গেল উত্তেজিত কণ্ঠস্বর। 'আরো খুঁড়তে হবে। ১০ ফুট না, ১৫-২০ ফুট খুঁড়ো।' এ ধরনের কথা শুনে অনেকে বিচলিত হয়ে জানতে চাইল, 'কী খুঁড়তাছেন!' ঘটনাস্থলের খুব কাছে গিয়ে জানতে চাইলে উত্তর


এলো সরাসরি, 'কুয়া খুঁড়তাছি।' শাবল, খুন্তি, কোদাল নিয়ে মানুষ স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে কুয়া খনন করছে পানির জন্য। রাজধানীতে এমন দৃশ্য অভাবিত হলেও গতকাল মঙ্গলবার তা দেখা গেছে বাড্ডার একাধিক এলাকায়।
এলাকাবাসী জানায়, তিন সপ্তাহ ধরে বাড্ডা এলাকায় পানি নেই। পানির জন্য হাহাকার পড়ে গেছে গোটা এলাকায়। রাস্তায় ব্যারিকেড, ওয়াসার অফিস ঘেরাও, মিছিল, সমাবেশেও কাজ হচ্ছে না কিছু। ট্যাপে কখন পানি আসবে সে অপেক্ষায় সময় কাটে মানুষের।
বাড্ডার একটি এলাকার নাম জোয়ারসাহারা। 'সাহারা' নামটি কিভাবে হলো তা না জানলেও এলাকাবাসীর কথা, 'সাহারা মরুভূমি হইতে আর বাকি নাই। মাসের পর মাস পানি থাকে না।' বাড্ডার জগন্নাথপুরের শহীদ আবদুল আজিজ সড়কের ক/৪৯/২ বাসার গৃহিণী সুরাইয়া আকতার বলেন, 'পানি না পেলে বাঁচব কিভাবে? আমাদের তো প্রাণ যায় যায় অবস্থা।'
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, চলতি গরম মৌসুমের শুরু থেকেই বাড্ডার নদ্দা, জগন্নাথপুর, কালাচাঁদপুর, জোয়ারসাহারা, নতুন বাজার, কুড়িল, বসুন্ধরা, বারিধারাসহ আশপাশের প্রায় প্রতিটি এলাকায় এক মাস ধরে পানি নেই। একইভাবে মিরপুরের শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া, পল্লবী, কল্যাণপুর, আদাবর, মোহাম্মদপুর, লালবাগ, আজিমপুর, পুরান ঢাকা, নাখালপাড়া, বাড্ডা, রামপুরা, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, নদ্দা, মাণ্ডা প্রভৃতি এলাকায় চলছে তীব্র পানির সংকট। তাই সামর্থ্যবানদের কেউ কেউ ওয়াসার গাড়ির পানি কিনে ব্যবহার করছে। তবে এ ক্ষেত্রেও রয়েছে অভিযোগ।
ওয়াসার হিসাব থেকে জানা গেছে, প্রতিদিন রাজধানীসহ নারায়ণগঞ্জে পানির চাহিদা প্রায় ২৪০ কোটি লিটার। ২২৫ কোটি লিটার উৎপাদনক্ষমতার বিপরীতে প্রতিদিন উৎপাদন করা যাচ্ছে ২০৫ থেকে ২১০ কোটি লিটার। বাকি ৩০ থেকে ৩৫ কোটি লিটার ঘাটতি পূরণের কোনো বিকল্প ব্যবস্থা নেই। তার ওপর ওয়াসা পানি উৎপাদনের যে হিসাব দেয়, সেখানেও শুভঙ্করের একটি ফাঁকি আছে বলে অনেকের বিশ্বাস। ফলে পানি না পেয়ে নগরবাসী ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে।
বাড্ডায় বিক্ষোভ, বৈঠক : বাড্ডাবাসী ৩০ মার্চের পর থেকে কয়েক দিন ধরে দফায় দফায় পানির দাবিতে সড়ক
অবরোধ ও স্থানীয় ওয়াসা অফিস ঘেরাও করে। ২ মার্চ নর্দ্দা ও জগন্নাথপুরের শত শত মানুষ হাঁড়ি-পাতিল-কলসি নিয়ে বিক্ষোভ করে। জনতা দুই ঘণ্টা সড়কও অবরোধ করে রাখে। উত্তর বাড্ডার শিক্ষার্থী মইদুল হক বলেন, 'গ্যাসের চুলা জ্বলে না ঠিকমতো, বিদ্যুৎ আসে-যায়। এর মধ্যে যদি পানি না থাকে, মেজাজ ঠিক থাকে না।'
পানির দাবিতে বাড্ডাবাসীর সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। গতকাল মঙ্গলবারও তিন এলাকায় বৈঠক হয়েছে। এসব বৈঠকে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ বিক্ষুব্ধ জনতার রোষানলে পড়ছে বলেও জানা গেছে। মডস জোন-৮ অফিসে যোগাযোগ করা হলে জানা যায়, কর্মকর্তারা বৈঠক করে বেড়াচ্ছেন। গতকাল বাড্ডার হারেজ গলি, কাজী বাড়ি ও কুড়িল এলাকায় বিক্ষুব্ধ জনতার সঙ্গে বৈঠক করে কর্তৃপক্ষ। সেখানে শিগগিরই পানি সংকট সমাধানের আশ্বাসও দেওয়া হয়। তবে এলাকাবাসী জানায়, ওয়াসার এ আশ্বাস কখনোই বাস্তবায়িত হয় না।
বাড্ডা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহবুবুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'পরিস্থিতি দিন দিন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। তবে আমরা ওয়াসা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা আশ্বাস দিয়েছে, পরিস্থিতির উন্নতি হবে। দেখা যাক, তারা কী করে।' তিনি বলেন, 'সংকট নিরসন করা আমাদের দায়িত্ব নয়। তার পরও জনতা বিক্ষুব্ধ হলে, ভাঙচুর করলে আমাদের ওপর চাপ আসে।' বাড্ডা থানার অপারেশন অফিসার আনিসুল ইসলাম বলেন, 'পানির দাবি তো মানুষের মৌলিক দাবি। না পেলে মানুষ বিক্ষোভ করবেই।'
বাড্ডা এলাকা ঘুরে দেখা যায়, মানুষ হাঁড়ি, বালতি, জগ, জারের মাধ্যমে রাস্তার লাইন থেকে পানি নিয়ে ব্যবহার করছে। অনেকে পানি আনার জন্য আলাদা লোকও রেখেছে। কালাচাঁদপুরের আয়েশা বেগম বলেন, 'আমার কাজই হলো এখান থেকে কলসি করে পানি বাসা-বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া। আমাকে দোকানে দোকানে পানি পৌঁছে দিতে হয়।' বাসা-বাড়িতে পানি সরবরাহকারী খাদিজা বেগম বলেন, 'বাড়িওয়ালার মেয়ে কয়েক দিন ধরে ডায়রিয়ায় ভুগছে। গিন্নির অবস্থাও খারাপ। এখান থেকে ওদের বাসায় পানি পৌঁছে দিই।'
বাড্ডার বিশ্বরোড-প্রগতি সরণি সড়কের হোসেন মার্কেটের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ তোফাজ্জল হোসেন জানান, এই গরমে পানি নেই। তাঁর ছোট মেয়ে গোসল করতে না পেরে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। উত্তর বাড্ডার শামছুল আলম সেলিম জানান, তিনি পানির অভাবে গত পাঁচ দিন গোসল করেননি। খাওয়া-দাওয়াও হচ্ছে না ঠিকমতো। এভাবে চলতে থাকলে ঢাকা শহর ছেড়ে দিতে হবে।
সংকট রাজধানীজুড়ে : রাজধানীর ই-২৮/২ মধ্য বাড্ডার বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম ক্ষোভ প্রকাশ করে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'কয়েক দিন ধরে পানি নেই। বাইরে থেকে জার কিনে কাজ সারছি।' ৩২৩ তেজকুনিপাড়ার গৃহবধূ নাজমা বেগম বলেন, 'প্রথমে একটি মোটর লাগিয়ে পাইপ থেকে পানি টানার ব্যবস্থা করেছিলেন বাড়িওয়ালা। কদিন হলো মোটর দিয়ে টেনেও পানি মিলছে না। তাই কয়েক দিন আগে এলাকাবাসী রাস্তায় নামে। তার পর থেকে সামান্য পানি আসছে।' ১৭/১ আজিমপুর ছাপড়া মসজিদ এলাকার একজন গৃহবধূ বলেন, 'পানি না পেয়ে পরে একজনকে দিয়ে তদবির করে ওয়াসা থেকে এক গাড়ি পানি এনেছিলাম। এক দিনেই সে পানি শেষ হয়ে গেছে।' ধানমণ্ডির ৯/এ নম্বর সড়কের ৭৮ নম্বর বাড়ির বাসিন্দা নুসরাত জাহান অভিযোগ করে বলেন, 'চার দিন পানি না পেয়ে গাড়িতে করে পানি দেওয়ার অনুরোধ করছি। সেটাও পাচ্ছি না।'
জানা গেছে, পানি সংকট নিরসনে গত বছর দুই শতাধিক পাম্পে বিদ্যুতের ডুয়েল কানেকশন (যৌথ সংযোগ) দেওয়া হয়েছে। একটি লাইনে বিদ্যুৎ চলে গেলে আরেকটি লাইনের বিদ্যুৎ দিয়ে পাম্প চালানোর জন্য এটা করা হয়েছিল। এখন মাঝেমধ্যে দুটি লাইনের কোনোটিতেই বিদ্যুৎ থাকছে না। এ ছাড়া অনেক সময় বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার দুই ঘণ্টা পরও বিদ্যুৎ আসে না। অথচ জেনারেটরগুলো একটানা এক ঘণ্টার বেশি চালানো যায় না। এর বেশি চালালেই বিগড়ে যায়। আর লো-ভোল্টেজে পাম্প চালালে মোটর জ্বলে যায়। তখন পুরো পাম্পই বন্ধ।
ঢাকা ওয়াসার পানি সরবরাহসংক্রান্ত প্রতিবেদন থেকে দেখা গেছে, গত ২৭ মার্চ উৎপাদন হয়েছে ২১০ কোটি লিটার। ২৬ মার্চ উৎপাদন হয়েছে ২০৬ কোটি লিটার। ২৭ মার্চ লোডশেডিংয়ের কারণে ৬০২টি পাম্প সাকল্যে ৫০৯ ঘণ্টা ও ২৬ মার্চ ৭৩০ ঘণ্টা বন্ধ ছিল। দিন দিন এই মাত্রা আরো বাড়ছে। তার ওপর পাম্প অপারেটরদের বিরুদ্ধে রয়েছে পাম্প না চালিয়ে জ্বালানি চুরির অভিযোগ। গত সোমবারও তিনজনকে দায়িত্বে অবহেলার কারণে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেছে কর্তৃপক্ষ। তার পরও পানি সংকটের নিরসন হচ্ছে না।
নর্দ্দার পাম্প অপারেটর মহিউদ্দিন জানান, তেল না থাকলে তো জেনারেটর বন্ধ থাকবেই। জ্বালানি তেল কোথায় যায় এ প্রশ্ন করলে তিনি উত্তেজিত হয়ে বলেন, 'সেটা কি আপনাকে বলতে হবে?' জ্বালানি তেল চুরির অভিযোগ অস্বীকার করেননি ঢাকা ওয়াসার মডস জোন-৮-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. কামরুল হাসান। তিনি বলেন, 'আমরাও অভিযোগ পাচ্ছি। কোথাও কোথাও পাম্প অপারেটর এ কাজ করেন বলেও শুনেছি।'
পানি সরবরাহে ঘাটতির কথা স্বীকার করে ওয়াসার একজন উপব্যবস্থাপনা পরিচালক কালের কণ্ঠকে বলেন, ইতিমধ্যে দুটি এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। তেজকুনিপাড়ার মিছিলের পেছনে কিছুটা রাজনৈতিক ইন্ধন ছিল। আর বাড্ডায় কিছুটা সমস্যা আছে। তবে জায়গা না পাওয়ায় এসব স্থানে পাম্প বসানো সম্ভব হয়নি। ওইসব স্থানে পানির সংকট হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ঢাকা ওয়াসার মডস জোন-৮ এলাকায় পাম্প আছে ৪০টি। এর মধ্যে ৩০টি পাম্পের সঙ্গে জেনারেট রয়েছে। কিন্তু বিদ্যুৎ চলে গেলে পাম্পগুলোও বন্ধ হয়ে যায়। জেনারেটর কোনো কাজেই আসে না।
ওয়াসার প্রকৌশলী কামরুল হাসান আরো বলেন, 'জেনারেটর চালানোর জন্য আমরা পর্যাপ্ত জ্বালানি পাই না। ফলে বিদ্যুৎ না থাকলে পাম্পও বন্ধ থাকে কোনো কোনো সময়।' তিনি জানান, বাড্ডা এলাকায় পানি সংকটের তিনটি কারণ রয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। ফলে আগের মতো পানি উত্তোলিত হয় না। দ্বিতীয়ত, বিদুৎ সংকট। তৃতীয়ত, লোকসংখ্যা বাড়ছে, পানির চাহিদাও বাড়ছে। কিন্তু বাড়ছে না পানির পাম্প।
পানি সংকট চলার কথা স্বীকার করেন মিরপুর এলাকার দায়িত্বরত কর্মকর্তা ওয়াসার নির্বাহী প্রকৌশলী মোবারক হোসেন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এই সময় চাহিদামতো পানি গাড়িতে করে সরবরাহ করা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। তার পরও আমাদের কর্মীরা রাত-দিন পানি সরবরাহ করে যাচ্ছেন।'
ওয়াসার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, বর্তমানে গাড়ির পানির চাহিদা বেড়ে তিন গুণ হয়েছে। চাহিদাপত্র দেওয়ার দুই দিন পরও পানি সরবরাহ সম্ভব হচ্ছে না। অনেক জায়গায় মসজিদ থেকে মাইকে নামাজের আগে মুসলি্লদের ওজু করে মসজিদে যাওয়ার আহ্বান জানানো হচ্ছে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা : সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানায়, রাজধানীর পানি সংকট দূর করতে চারটি পানি শোধনাগার চলমান থাকাসহ সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ চলছে। এটা শেষ হলে প্রতিদিন সাড়ে ২২ কোটি লিটার পানি পাওয়া যাবে। এ ছাড়া সায়েদাবাদ তৃতীয় পর্যায়ের ৪৫ কোটি লিটার উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন শোধনাগার স্থাপনের সমীক্ষা শেষ হয়েছে। অন্যদিকে প্রতিদিন ৪৫ কোটি লিটার পানি পাওয়ার লক্ষ্যে পদ্মা থেকে পানি আনার একটি প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শেষ হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য পাঁচ বছর সময় লাগবে। এ ছাড়া এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সহায়তায় মেঘনা নদী থেকে পানি এনে খিলক্ষেতে শোধনাগার স্থাপন করে দৈনিক আরো ৫০ কোটি লিটার পানি সরবরাহের আরেকটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে ওয়াসা। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য দাতা সংস্থার সঙ্গে আলোচনা চলছে। এগুলো বাস্তবায়িত হলে রাজধানীতে পানি সংকট থাকবে না।

No comments

Powered by Blogger.