প্রতিবেশী-কথায় কাজে ফাঁক বিস্তর by অমিত বসু

মমতা নাছোড়। চ্যালেঞ্জ ছড়াচ্ছেন অন্য রাজ্যে। পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনে চার রাজ্যে লড়াইয়ে তৃণমূল। হারজিত বড় কথা নয়। দলের পতাকাটা তো ভিন রাজ্যের লোক দেখছে। নিশানের রঙ তেরঙা, জাতীয় পতাকার মতোই। কংগ্রেসেরও তা-ই। বর্ণে বিবর্তন নেই। থাকবে কেন? তিনি তো এখনও কংগ্রেসেরই একজন।


কংগ্রেস নামটার আগে তৃণমূল শব্দটা শুধুু বাড়তি

মধু ফুরোচ্ছে, মোম জমছে। ধূসর মাছিরা খাবার খুঁজছে। মৌমাছিরা নিরুদ্দেশ। ব্যর্থ বসন্ত। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উদ্বিগ্ন, উত্তেজিত, উদ্ভ্রান্ত। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ঘূর্ণি। কৃষক, শ্রমিক, শিক্ষার্থী, চিকিৎসা প্রার্থীদের যন্ত্রণাবিদ্ধ মুখ নিয়ে তবু ভ্রান্তিবিলাস। ছায়া আরও দীর্ঘতর হলেও খেলা চলতে পারে। কিন্তু মুহ্যমান টিম নিয়ে কি স্কোরকার্ড উজ্জ্বল করা যাবে? পারফরম্যান্স খারাপ হলে দর্শক চিৎকার করবেই, তাই বলে প্লেয়ারের কণ্ঠ উচ্চকিত হবে কেন? জবাব ক্রীড়ানৈপুণ্যে।
ইমেজের সঙ্গে কাজ খাপ খাচ্ছে না। হাওয়াই চপ্পল, আটপৌরে শাড়ি, টালির চালের ঘরের বাসিন্দা অগি্নকন্যা, বাঁচার জন্য খড়কুটো খুঁজছেন। অসাধারণত্ব কোথায়? চকমকি পাথরের ঠোকাঠুকিতে ক্ষণিক আগুনের চমকও দেখা যাচ্ছে না। পাথরও বিট্রে করছে। মুখ্যমন্ত্রীর শ্রমদিবস নষ্ট মানে দশ কোটি বাঙালির ক্ষতি। লোকসানটা একার হলে কিছু বলার ছিল না। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর দিদির চালচিত্তিরটা মাথার পেছন থেকে খুলে ফেলার দরকার ছিল। কথা বলতে বলতে কাশছেন, নাক টানছেন। পা-ঢাকা জুতা-মোজা পরলে মহাভারত অশুদ্ধ হতো? নিজের জন্য শুধু নয়, পাবলিকের জন্য সুস্থ থাকাটা জরুরি।
কথায় কাজে ফাঁক থাকছে বিস্তর। বারবার বলছেন। সরকারি বাড়ি বা সুযোগ-সুবিধা নিই না। মুখ্যমন্ত্রী হয়েছি মানুষের স্বার্থে। এসব কথার কোনো মানে হয়? মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারটা তো নিয়েছেন। অফিস ঘরটাও নতুন করে সাজিয়েছেন। সেটাকে যদি দোকান মনে করা হয়, খদ্দের কোথায়? যারা বিনিয়োগ করে শিল্পায়ন ঘটাবে, অর্থনীতির মরা গাঙে বান ডাকাবে। তারা নিপাত্তা কেন? অফিসে-বাড়িতে শুধু ভাইয়েদের ভিড়। দিদির কাছে হাজার বায়নাক্কা। কেউ বলছে_ দিদি, ও আমায় মারছে। কারও নালিশ, আমাকে হটিয়ে সে নেতা হতে চাইছে। কারও দাবি_ দিদি, এক্ষুণি আন্দোলনে নামুন। রাজ্যে আগুন জ্বালিয়ে ছেড়ে দেব। হাঁড়িতে জল ফুটছে। চাল নেই। কেন্দ্র এমনি এমনি টাকা দেবে না। গরম দেখান, দেখবেন নরম হবে।
দিদির পক্ষে ভাইয়েদের সব কথা মানা সম্ভব নয়। তবু যতটা পারেন করেন। নিজেও বুদ্ধি খাটিয়ে সিদ্ধান্ত নেন। আমরিকাণ্ডে চিকিৎসক মণি ছেত্রির মতো জীবন্ত কিংবদন্তিকে পুলিশ হাজতে পুরে বুঝিয়ে দেয়, তার সঙ্গে চালাকি চলবে না। আইন আইনের পথে চলবে। মুখ্যমন্ত্রীর কুরসি নিষ্কণ্টক রাখতে সিপিএমের সঙ্গে কংগ্রেসকেও নিশ্চিহ্ন করা দরকার। যেমন চিন্তা তেমন কাজ। সেখানে আইনের বালাই নেই। পুলিশ থেকেও নেই। শরিকরা প্রতিবাদ করলে কানে তুলো। কংগ্রেস মন্ত্রী মনোজ চক্রবর্তী পদত্যাগ করেছেন। অন্যরাও যদি যেতে চান যেতে পারেন। দরজা খোলা আছে। সবাই চলে গেলেও দিদি থাকবেন। কারণ তার ভাইয়েরা আছে। চারপাশে যে ভাইয়েরা আছে, তারা সবাই মদন মিত্রের মতো খাঁটি ভাই না হলেও ভাই তো বটে। একটু-আধটু ভুলচুক করলেও দিদির হৃদয়ে ক্ষমার প্লাবন।
কিন্তু যারা ভাই নয়, তাদের বেলায়? তারা কি বানের জলে ভেসে যাবে? দু'কোটি মানুষ মমতাবিরোধী। মমতাকে তারা ভোট দেয়নি। সাংবিধানিক নিয়মে মমতা তাদেরও মুখ্যমন্ত্রী। তাদের জন্য কী বিশেষ ব্যবস্থা? তিনি যাদের মানবেন না, তাদের দিদিকে মানতে হবে। ভক্তিতে না হোক, ভয়ে। ১৯৭২-এ ইন্দিরা গান্ধীর একই অবস্থা হয়েছিল। ভারতমাতা হয়ে কী কাণ্ডটাই না করেছিলেন। যারা তাকে মা হিসেবে মানেনি, তাদের অবস্থা নাকের জলে চোখের জলে। জরুরি অবস্থায় সঙ্গিন। খবরের কাগজের পাতা খালি। ইন্দিরা বন্দনা নয়তো শূন্য। মা-দিদির এটাই দস্তুর। আনুগত্যের বাইরে থাকলে রক্ষে নেই। গণতন্ত্রের আকাল। পাকাল মাছের মতো স্লিপ করে পালানোর রাস্তা বন্ধ। দিদি বা মা খপ করে ধরবেনই। দিদির হাত থেকে মণি ছেত্রি বাঁচেননি। বাকিরা কতদিন বেঁচে থাকবেন কে জানে।
সান্ত্বনা একটাই, মমতার নামটা প্রধানমন্ত্রীর শর্ট লিস্টে ওঠেনি। লিস্টে মায়াবতীর নাম আছে, মমতার নেই। তালিকা আলো করে আছেন নরেন্দ্র মোদী, রাহুল গান্ধী, সুষমা স্বরাজ থেকে মুলায়ম সিং যাদব। মমতাকে বাদ দেওয়া হলো কেন? তিনি কম কিসে? পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্য যার হাতের মুঠোয়, জাতীয় রাজনীতির মানচিত্রে তার জায়গা হবে না?
মমতা নাছোড়। চ্যালেঞ্জ ছড়াচ্ছেন অন্য রাজ্যে। পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনে চার রাজ্যে লড়াইয়ে তৃণমূল। হারজিত বড় কথা নয়। দলের পতাকাটা তো ভিন রাজ্যের লোক দেখছে। নিশানের রঙ তেরঙা, জাতীয় পতাকার মতোই। কংগ্রেসেরও তা-ই। বর্ণে বিবর্তন নেই। থাকবে কেন? তিনি তো এখনও কংগ্রেসেরই একজন। কংগ্রেস নামটার আগে তৃণমূল শব্দটা শুধুু বাড়তি। কংগ্রেসের হাত প্রতীকের জায়গায় ঘাসফুল। কংগ্রেস রাজ্য সভাপতি পদে নির্বাচনে যে সোমেন মিত্রের কাছে হেরে রাগ করে তৃণমূলের পতাকা তুলেছিলেন মমতা, সেই সোমেন আজ তার সহসৈনিক। যে সুব্রত মুখার্জি রাজীব গান্ধীর কাছে মমতার নাম সুপারিশ করে ওপরে ওঠার মই ধরেছিলেন, তিনিও এখন মমতার সঙ্গে মন্ত্রিসভায় প্রথমটায় কোণঠাসা হয়ে পড়ে একটু ওপরে। অন্য রাজ্যের নির্বাচনে মমতার ভরসা দলত্যাগী বা নির্বাসিত কংগ্রেসীরা। কংগ্রেস সাংসদ অধীর চৌধুরীর ভাষায়, কংগ্রেসের উচ্ছিষ্ট নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস। কথাটা একটু বাড়িয়ে বললে বলতে হয়, কংগ্রেসের অ্যাকশন স্কোয়াড হচ্ছে তৃণমূল। সেই ব্রিগেডকে শুধু কংগ্রেস নয়, বিজেপিও বামফ্রন্ট বধে কাজে লাগিয়েছে। মমতা ভেবেছিলেন, কৃতজ্ঞতাস্বরূপ কংগ্রেস অন্তত নির্বিঘ্নে মমতাকে মুখ্যমন্ত্রিত্ব এনজয় করার সুযোগ দেবে। দিচ্ছে কই, মুখ্যমন্ত্রী হওয়াটা যে কত কষ্টের, কংগ্রেস জানে। কত খারাপ-ভালো, সত্যি-মিথ্যা, আলো-অন্ধকার মিশিয়ে মানুষকে জয় করতে হয়। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরও হারানোর ভয় কম নয়। মিডিয়ার একটা বড় অংশকে মমতা সেটা বোঝাতে পেরেছেন। বোঝানো যায়নি কংগ্রেসকে।
দিদি ইমেজটাই মমতার ভরসা। ব্যর্থতার নদী পেরোনোর নৌকো ভাইয়েদের কাছে দিদির সাত খুন মাফ। মা হয়েও ইন্দিরার শেষ রক্ষা হয়নি। ডুবেছিলেন। দিদি হয়েও নির্বিবাদে থাকতে পারছেন কই মমতা। ফুটবলের খাতিরে বাঙালির মনের দেশ ব্রাজিল। সেখানেও একই সমস্যা হয়েছিল। ২০১০-এর অক্টোবরে প্রথম মহিলা রাষ্ট্রপতি ডিলমা রুসেফের শপথ গ্রহণের পর। রুসেফ যখন প্রতিদ্বন্দ্বী হোসে সেরাকে ১০ শতাংশ ভোটে হারিয়ে উল্লাসে টগবগ করে ফুটছেন, তার মেন্টর পূর্বতন প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দ্য সিলভার কপালে ভাঁজ। কন্যাসম রুসেফের ইমেজ কী হবে তাই নিয়ে চিন্তা। সিদ্ধান্ত নিলেন মেয়েকে মা সাজাবেন। মাদার ফিগার হলে গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। ফ্যাশন ডিজাইনারদের সঙ্গে কথাও বললেন। হেয়ার কাট, চশমার ফ্রেম থেকে পোশাক, পায়ের জুতো পাল্টে ফেলার ব্যবস্থা হলো। কবি, লেখকরা রে-রে করে উঠলেন। প্রতিবাদের ঝড় উঠল। তারা বললেন, আমরা দিদি বা মা চাই না। একজন সাচ্চা প্রেসিডেন্ট চাই। যার প্রধান কাজ হবে লুলার তৈরি করা অর্থনীতির ভিতকে আরও শক্ত করা, অসাম্যের বাঁধন ছিঁড়ে ফেলা। লুলা তাই করলেন। রুসেফকে বললেন, তোমার কাজই তোমার ইমেজ। সাজলেই সাজা।

অমিত বসু :ভারতীয় সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.