যুক্তি তর্ক গল্প-পাকিস্তানি রাজনীতির বৃত্ত ভাঙতে হবে by আবুল মোমেন
পাকিস্তানি শাসন আমাদের শিখিয়েছিল, দেশপ্রেমের একটি ভিত্তি হলো ভারত-বিরোধিতা এবং এমন এক ইসলামপ্রীতি, যার মধ্যে অন্য ধর্ম, বিশেষত হিন্দুধর্ম ও ধর্মাবলম্বীদের প্রতি সন্দেহ ও অপছন্দের মনোভাব থাকবে। সেই থেকে এ অঞ্চলের রাজনীতিতে এ দুই উপাদান কারণে-অকারণে বহাল রয়েছে।
পাকিস্তানকে পরাজিত করে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও এই মনোভাব কাটেনি। ফলে স্বাধীন বাংলাদেশেও পাকিস্তানের মতো ভারত-বিরোধিতা এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুবিরোধী চেতনার রাজনীতি বেশ বহাল তবিয়তেই আছে।
এ বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন, নয়তো ভুল বোঝার সম্ভাবনা থাকবে। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে একটি দেশের নানা ইস্যুতে বিরোধ সৃষ্টি হওয়া কোনো অস্বাভাবিক বিষয় নয়। এমনকি সে বিরোধ চরম আকার ধারণ করে যুদ্ধ পর্যন্তও গড়াতে পারে। মেক্সিকো-যুক্তরাষ্ট্র, চীন-ভিয়েতনাম, ইরান-ইরাক ইত্যাদি দুই প্রতিবেশীর নানা মাত্রিক বিরোধের কথা আমরা জানি। কিন্তু সেটা যদি এমন একটি মনস্তাত্ত্বিক বিষয় হয়ে দাঁড়ায় যেন এ বিরোধের চেতনাটি দেশপ্রেম প্রমাণের একটি আবশ্যিক গুণ, তাহলেই সমস্যা। রাজনীতির সূচনাই যদি হয় নেতিবাচক মনোভাব নিয়ে, তাহলে দুই প্রতিবেশীর মধ্যে সম্পর্ক সহজ হওয়ার পরিবর্তে জটিলই হবে। এ দেশে যদি কোনো রাজনীতির চাহিদা হয় ভারত-বিরোধিতার চেতনা, সেই রাজনীতি তো চাইবেই সে সম্পর্কে জটিলতা অব্যাহত থাকুক। পাকিস্তান আমলে মুসলিম লীগ দল ও সরকার এভাবেই বরাবর তাদের রাজনীতি শক্তিশালী রাখার চেষ্টা করেছে। তাতে পাকিস্তানের রাজনীতিতে এই নেতিবাচক উপাদানটি বরাবর থেকেছে এবং তারাই ঘুরেফিরে ক্ষমতায় থেকেছে কিংবা যে দলই ক্ষমতায় গেছে, তাদের কোনো না কোনো মাত্রায় ভারত-বিরোধিতার উপাদানটি ব্যবহার করতে হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানে এ রাজনীতি টিকেছে ষড়যন্ত্র, স্বৈরশাসন, জঙ্গিবাদের বিস্তার ইত্যাদির বিনিময়ে। তাতে রাজনীতি টিকে থাকলেও রাষ্ট্রের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে।
বলা দরকার, তিস্তা ইস্যুতে নদীর প্রবাহ কিংবা ছিটমহল হস্তান্তর ইস্যুতে অবশ্যই আমরা শক্ত অবস্থান নেব। আমাদের জাতীয় স্বার্থ অবশ্যই আমাদের সব বিবেচনার কেন্দ্রে থাকবে, এমনকি পরিস্থিতি সে রকম হলে রীতিমতো যুদ্ধ করে হলেও অধিকার রক্ষা করব। অর্থাৎ, নীতি হবে যেকোনো মূল্যে জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করা, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। কিন্তু আমরা যদি ধরেই নিই যে ভারত যেকোনো মূল্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব খর্ব করতে ও আমাদের করদরাজ্য বানাতে চায় এবং তার বিরুদ্ধেই আমাদের রাজনীতি, তাহলে সেই রাজনীতি দেশকে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের পরিণতির দিকেই নেবে বলে আশঙ্কা হয়।
এরই সঙ্গে যুক্ত হলো ধর্মের বিষয়টি। ভারত মানে হিন্দু, এবং যা কিছুর মধ্যে হিন্দুত্ব ও হিন্দুয়ানির ছোঁয়া আছে বলে সন্দেহ, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও—পাকিস্তানে এ নীতিটি ছিল সোচ্চারে ঘোষিত এবং দৃষ্টিগ্রাহ্যভাবে পালিত। বাংলাদেশে বিভিন্ন আমলে এই একই নীতি নীরবে নেপথ্যে অনুসৃত হয়েছে। এ নীতির জের ধরে স্বাধীনতার পরেও বাংলাদেশ থেকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগ বন্ধ হয়নি।
এ মানসিকতার ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে, এতে জাতির অগ্রগতির পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। কেবল অর্থনীতি বা সরকার গঠনের মাধ্যমে কোনো জাতি গঠিত হয় না। জাতি গঠিত হয় মূলত সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের ভিত্তিতে। ফলে জাতির ইতিহাস ও জীবনে দেশ ও জনগোষ্ঠীর ইতিহাস-ঐতিহ্যের গুরুত্ব এদিক থেকে সীমাহীন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, এর রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসে একটি ইসলাম-পূর্ব অত্যন্ত সমৃদ্ধ হিন্দু, বৌদ্ধ ও প্রকৃতিপূজারিদের ইতিহাস আছে; আবার ইসলাম-পরবর্তী সময়ে ইংরেজ ও পশ্চিমা সভ্যতার প্রভাবও ব্যাপক হয়েছে। নৃতাত্ত্বিকভাবে নিগ্রোবটু ও মঙ্গোলয়েড মহাজাতি ও তাদের শাখাজাতির প্রভাব রয়েছে। ভাষাগত দিক থেকে আর্য ভাষা সংস্কৃত ছাড়াও অস্ট্রিক-দ্রাবিড়-খমের ইত্যাদি ভাষার ও ভাষাজাতির প্রভাব পড়েছে। এভাবে দেখা যাবে ভাষা, সাহিত্য, সংগীত, নৃত্য, নাট্য, স্থাপত্য, ভাস্কর্য, চিত্রকলা প্রভৃতি মানুষের শ্রেষ্ঠ সব কীর্তির দিক থেকে আমাদের গভীর যোগাযোগ রয়েছে ভারতীয় সভ্যতার সঙ্গে। ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের অনেক উত্তরাধিকারই এক ও অবিভাজ্য। এ রকম ঘটনা পৃথিবীর বহু অঞ্চলেই ঘটেছে। পশ্চিম ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া একই সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত হয়েও নানা দেশে বিভক্ত এবং প্রয়োজনে পরস্পরের বিরুদ্ধে বহু ধ্বংসাত্মক যুদ্ধেও তারা লিপ্ত হয়েছে। রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত হয়ে কিংবা যুদ্ধের তিক্ত অভিজ্ঞতা ও স্মৃতির কারণে তারা কিন্তু সভ্যতার ঠিকানা বা উত্তরাধিকার নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিবাদ-বিতর্ক শুরু করেনি।
বাংলাদেশে সমস্যা দাঁড়িয়েছে, বিএনপি তার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের রাজনীতির বিরোধী রাজনীতি দাঁড় করাতে গিয়ে বাংলাদেশের বাস্তবতা বিবেচনা করার চেয়ে পাকিস্তানি ধারা ও মানসিকতাকে বহন করার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। বিএনপির রাজনীতির মূল বিষয় দাঁড়িয়েছে এই প্রমাণ করা যে আওয়ামী লীগ ভারতের বশংবদ দল হিসেবে দেশকে ভারতের কাছে বিক্রি করে দেবে এবং তারা ক্ষমতায় থাকলে দেশে ইসলাম বিপন্ন হয়।
আমার বিবেচনায়, আওয়ামী লীগ অবশ্য বরাবরই কট্টর বাঙালি জাতীয়তাবাদী দল। সে কারণে স্বাধীনতার পরে দেশে প্রত্যাবর্তনের আগেই লন্ডনে বসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করেছিলেন, দেশ থেকে বিজয়ী যৌথ বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত ভারতীয় সেনাদের যেন দ্রুত স্বদেশে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। বাস্তবে তা-ই ঘটেছিল। আমার ধারণা, তিস্তা ও অন্যান্য ইস্যুতে শেখ হাসিনাও তাঁর বাবার মতো দেশের স্বার্থ ও সম্মান রক্ষায় কোনোরকম দুর্বলতা দেখাবেন না, পিছপা হবেন না।
কিন্তু স্বাধীনতার পরে মওলানা ভাসানী থেকে শুরু করে বিএনপি পর্যন্ত ভারত ও ধর্ম ইস্যুতেই আওয়ামী লীগকে মোকাবিলা করতে চাওয়ায় শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনীতির বৃহত্তম দলটি তার সর্বতো সেক্যুলার সংস্কৃতি ত্যাগ করে ধর্মীয় সংস্কৃতি গ্রহণ করেছে। আজকের বাংলাদেশে বাম দলগুলো হয় দুর্বল হয়েছে, নয়তো আওয়ামী লীগে ভিড়ে যাওয়ায় দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন আর সত্যিকারের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক শক্তি নেই। এখন সাংস্কৃতিক-সামাজিক অঙ্গনে যে সেক্যুলার শক্তি কার্যকর রয়েছে, তারা—হয়তো কিছুটা আত্মরক্ষার এবং অনেকটাই দেশপ্রেমের তাগিদে—আওয়ামী লীগকে সেক্যুলার রাজনীতিতে বা আওয়ামী লীগের সেক্যুলার সত্তাটি টিকিয়ে রাখতে চাইছে।
কিন্তু ক্ষমতার রাজনীতিতে বিপদ, অর্থাৎ পরাজয়ের আশঙ্কায় পড়লে টিকে থাকার লড়াইয়ে আওয়ামী লীগও অন্তত নির্বাচনী রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার বাড়াবে এবং ভারত-বিরোধিতার প্রথাগত কার্ডটিও ব্যবহার করতে চাইবে। তাতে ক্ষতি হবে দেশের। আওয়ামী লীগের এই পশ্চাদপসরণ ও আপসের কারণে দেশে ইসলামি জঙ্গিবাদ এবং মৌলবাদের উত্থানের সুযোগ বৃদ্ধি পাবে। পাকিস্তানের মতো সামাজিক অগ্রগতি যেমন ব্যাহত হবে, তেমনি রাষ্ট্রও দুর্বল হতে থাকবে।
বিএনপিকে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাগুলো মাথায় নিয়েই রাজনীতিকে ঢেলে সাজাতে হবে। নতুবা কেবল আওয়ামী লীগ বিরোধিতার যে রাজনীতি তারা দাঁড় করিয়েছে, তা দেশকে তালেবানি পাকিস্তানের পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারে, যেটা হয়তো তাদের অধিকাংশ নেতা-কর্মীর কাম্য নয়।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
এ বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন, নয়তো ভুল বোঝার সম্ভাবনা থাকবে। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে একটি দেশের নানা ইস্যুতে বিরোধ সৃষ্টি হওয়া কোনো অস্বাভাবিক বিষয় নয়। এমনকি সে বিরোধ চরম আকার ধারণ করে যুদ্ধ পর্যন্তও গড়াতে পারে। মেক্সিকো-যুক্তরাষ্ট্র, চীন-ভিয়েতনাম, ইরান-ইরাক ইত্যাদি দুই প্রতিবেশীর নানা মাত্রিক বিরোধের কথা আমরা জানি। কিন্তু সেটা যদি এমন একটি মনস্তাত্ত্বিক বিষয় হয়ে দাঁড়ায় যেন এ বিরোধের চেতনাটি দেশপ্রেম প্রমাণের একটি আবশ্যিক গুণ, তাহলেই সমস্যা। রাজনীতির সূচনাই যদি হয় নেতিবাচক মনোভাব নিয়ে, তাহলে দুই প্রতিবেশীর মধ্যে সম্পর্ক সহজ হওয়ার পরিবর্তে জটিলই হবে। এ দেশে যদি কোনো রাজনীতির চাহিদা হয় ভারত-বিরোধিতার চেতনা, সেই রাজনীতি তো চাইবেই সে সম্পর্কে জটিলতা অব্যাহত থাকুক। পাকিস্তান আমলে মুসলিম লীগ দল ও সরকার এভাবেই বরাবর তাদের রাজনীতি শক্তিশালী রাখার চেষ্টা করেছে। তাতে পাকিস্তানের রাজনীতিতে এই নেতিবাচক উপাদানটি বরাবর থেকেছে এবং তারাই ঘুরেফিরে ক্ষমতায় থেকেছে কিংবা যে দলই ক্ষমতায় গেছে, তাদের কোনো না কোনো মাত্রায় ভারত-বিরোধিতার উপাদানটি ব্যবহার করতে হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানে এ রাজনীতি টিকেছে ষড়যন্ত্র, স্বৈরশাসন, জঙ্গিবাদের বিস্তার ইত্যাদির বিনিময়ে। তাতে রাজনীতি টিকে থাকলেও রাষ্ট্রের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে।
বলা দরকার, তিস্তা ইস্যুতে নদীর প্রবাহ কিংবা ছিটমহল হস্তান্তর ইস্যুতে অবশ্যই আমরা শক্ত অবস্থান নেব। আমাদের জাতীয় স্বার্থ অবশ্যই আমাদের সব বিবেচনার কেন্দ্রে থাকবে, এমনকি পরিস্থিতি সে রকম হলে রীতিমতো যুদ্ধ করে হলেও অধিকার রক্ষা করব। অর্থাৎ, নীতি হবে যেকোনো মূল্যে জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করা, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। কিন্তু আমরা যদি ধরেই নিই যে ভারত যেকোনো মূল্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব খর্ব করতে ও আমাদের করদরাজ্য বানাতে চায় এবং তার বিরুদ্ধেই আমাদের রাজনীতি, তাহলে সেই রাজনীতি দেশকে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের পরিণতির দিকেই নেবে বলে আশঙ্কা হয়।
এরই সঙ্গে যুক্ত হলো ধর্মের বিষয়টি। ভারত মানে হিন্দু, এবং যা কিছুর মধ্যে হিন্দুত্ব ও হিন্দুয়ানির ছোঁয়া আছে বলে সন্দেহ, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও—পাকিস্তানে এ নীতিটি ছিল সোচ্চারে ঘোষিত এবং দৃষ্টিগ্রাহ্যভাবে পালিত। বাংলাদেশে বিভিন্ন আমলে এই একই নীতি নীরবে নেপথ্যে অনুসৃত হয়েছে। এ নীতির জের ধরে স্বাধীনতার পরেও বাংলাদেশ থেকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগ বন্ধ হয়নি।
এ মানসিকতার ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে, এতে জাতির অগ্রগতির পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। কেবল অর্থনীতি বা সরকার গঠনের মাধ্যমে কোনো জাতি গঠিত হয় না। জাতি গঠিত হয় মূলত সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের ভিত্তিতে। ফলে জাতির ইতিহাস ও জীবনে দেশ ও জনগোষ্ঠীর ইতিহাস-ঐতিহ্যের গুরুত্ব এদিক থেকে সীমাহীন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, এর রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসে একটি ইসলাম-পূর্ব অত্যন্ত সমৃদ্ধ হিন্দু, বৌদ্ধ ও প্রকৃতিপূজারিদের ইতিহাস আছে; আবার ইসলাম-পরবর্তী সময়ে ইংরেজ ও পশ্চিমা সভ্যতার প্রভাবও ব্যাপক হয়েছে। নৃতাত্ত্বিকভাবে নিগ্রোবটু ও মঙ্গোলয়েড মহাজাতি ও তাদের শাখাজাতির প্রভাব রয়েছে। ভাষাগত দিক থেকে আর্য ভাষা সংস্কৃত ছাড়াও অস্ট্রিক-দ্রাবিড়-খমের ইত্যাদি ভাষার ও ভাষাজাতির প্রভাব পড়েছে। এভাবে দেখা যাবে ভাষা, সাহিত্য, সংগীত, নৃত্য, নাট্য, স্থাপত্য, ভাস্কর্য, চিত্রকলা প্রভৃতি মানুষের শ্রেষ্ঠ সব কীর্তির দিক থেকে আমাদের গভীর যোগাযোগ রয়েছে ভারতীয় সভ্যতার সঙ্গে। ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের অনেক উত্তরাধিকারই এক ও অবিভাজ্য। এ রকম ঘটনা পৃথিবীর বহু অঞ্চলেই ঘটেছে। পশ্চিম ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া একই সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত হয়েও নানা দেশে বিভক্ত এবং প্রয়োজনে পরস্পরের বিরুদ্ধে বহু ধ্বংসাত্মক যুদ্ধেও তারা লিপ্ত হয়েছে। রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত হয়ে কিংবা যুদ্ধের তিক্ত অভিজ্ঞতা ও স্মৃতির কারণে তারা কিন্তু সভ্যতার ঠিকানা বা উত্তরাধিকার নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিবাদ-বিতর্ক শুরু করেনি।
বাংলাদেশে সমস্যা দাঁড়িয়েছে, বিএনপি তার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের রাজনীতির বিরোধী রাজনীতি দাঁড় করাতে গিয়ে বাংলাদেশের বাস্তবতা বিবেচনা করার চেয়ে পাকিস্তানি ধারা ও মানসিকতাকে বহন করার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। বিএনপির রাজনীতির মূল বিষয় দাঁড়িয়েছে এই প্রমাণ করা যে আওয়ামী লীগ ভারতের বশংবদ দল হিসেবে দেশকে ভারতের কাছে বিক্রি করে দেবে এবং তারা ক্ষমতায় থাকলে দেশে ইসলাম বিপন্ন হয়।
আমার বিবেচনায়, আওয়ামী লীগ অবশ্য বরাবরই কট্টর বাঙালি জাতীয়তাবাদী দল। সে কারণে স্বাধীনতার পরে দেশে প্রত্যাবর্তনের আগেই লন্ডনে বসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করেছিলেন, দেশ থেকে বিজয়ী যৌথ বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত ভারতীয় সেনাদের যেন দ্রুত স্বদেশে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। বাস্তবে তা-ই ঘটেছিল। আমার ধারণা, তিস্তা ও অন্যান্য ইস্যুতে শেখ হাসিনাও তাঁর বাবার মতো দেশের স্বার্থ ও সম্মান রক্ষায় কোনোরকম দুর্বলতা দেখাবেন না, পিছপা হবেন না।
কিন্তু স্বাধীনতার পরে মওলানা ভাসানী থেকে শুরু করে বিএনপি পর্যন্ত ভারত ও ধর্ম ইস্যুতেই আওয়ামী লীগকে মোকাবিলা করতে চাওয়ায় শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনীতির বৃহত্তম দলটি তার সর্বতো সেক্যুলার সংস্কৃতি ত্যাগ করে ধর্মীয় সংস্কৃতি গ্রহণ করেছে। আজকের বাংলাদেশে বাম দলগুলো হয় দুর্বল হয়েছে, নয়তো আওয়ামী লীগে ভিড়ে যাওয়ায় দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন আর সত্যিকারের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক শক্তি নেই। এখন সাংস্কৃতিক-সামাজিক অঙ্গনে যে সেক্যুলার শক্তি কার্যকর রয়েছে, তারা—হয়তো কিছুটা আত্মরক্ষার এবং অনেকটাই দেশপ্রেমের তাগিদে—আওয়ামী লীগকে সেক্যুলার রাজনীতিতে বা আওয়ামী লীগের সেক্যুলার সত্তাটি টিকিয়ে রাখতে চাইছে।
কিন্তু ক্ষমতার রাজনীতিতে বিপদ, অর্থাৎ পরাজয়ের আশঙ্কায় পড়লে টিকে থাকার লড়াইয়ে আওয়ামী লীগও অন্তত নির্বাচনী রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার বাড়াবে এবং ভারত-বিরোধিতার প্রথাগত কার্ডটিও ব্যবহার করতে চাইবে। তাতে ক্ষতি হবে দেশের। আওয়ামী লীগের এই পশ্চাদপসরণ ও আপসের কারণে দেশে ইসলামি জঙ্গিবাদ এবং মৌলবাদের উত্থানের সুযোগ বৃদ্ধি পাবে। পাকিস্তানের মতো সামাজিক অগ্রগতি যেমন ব্যাহত হবে, তেমনি রাষ্ট্রও দুর্বল হতে থাকবে।
বিএনপিকে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাগুলো মাথায় নিয়েই রাজনীতিকে ঢেলে সাজাতে হবে। নতুবা কেবল আওয়ামী লীগ বিরোধিতার যে রাজনীতি তারা দাঁড় করিয়েছে, তা দেশকে তালেবানি পাকিস্তানের পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারে, যেটা হয়তো তাদের অধিকাংশ নেতা-কর্মীর কাম্য নয়।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
No comments