কেমন আছেন উত্তরাবাসী-৭-মাঠ ঘাট খাল দখলের প্রতিযোগিতা by আপেল মাহমুদ
রাজউকের মহাপরিকল্পনায় গড়ে ওঠা উত্তরা মডেল টাউন একটি পরিকল্পিত শহর হলেও এখানে বিভিন্ন দখলের ঘটনা ঘটছে। দখল থেকে রোড-ঘাট-মাঠও বাদ যাচ্ছে না। কল্যাণ সমিতির নামে বরাদ্দ দেওয়া একটি খেলার মাঠ দখল করে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ফ্রেন্ডস ক্লাব নামে একটি সংগঠনের বিরুদ্ধে।
তা ছাড়া উত্তরা এলাকার পানি নিষ্কাশনের একমাত্র অবলম্বন আবদুল্লাহপুর খাল দখল করে বস্তি, কাঁচাবাজার এবং মসজিদ নির্মাণ করেছেন স্থানীয় কিছু লোক। এমনকি উত্তরার হাউস বিল্ডিং বাসস্ট্যান্ডের পাশে চলাফেরার একটি সার্ভিস রোড দখল করে স্যানিটারি মার্কেট গড়ে তুলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে জানান স্থানীয় লোকজন।
উত্তরা মডেল টাউনের ৩ নম্বর সেক্টরে একটি খেলার মাঠ রয়েছে। হাঁটাহাঁটি করার জন্য মাঠের ভেতরে রয়েছে ওয়ার্কওয়ে। এলাকাবাসীর ব্যবহারের জন্য রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এ মাঠটি বরাদ্দ দেয়। মাঠের তদারকি ও সংস্কারের দায়িত্ব দেওয়া হয় ৩ নম্বর সেক্টর কল্যাণ সমিতিকে। কিন্তু বর্তমানে মাঠটি দখল করে নিয়েছে ফ্রেন্ডস ক্লাব নামে একটি সংগঠন। তারা মাঠের প্রবেশ পথে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে। এর ভেতরে প্রবেশাধিকার ক্লাব কর্তৃপক্ষের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে। এমনকি মাঠের প্রবেশ পথে বড় একটি সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে তারা মালিকানাও প্রমাণের চেষ্টা করছে। এ সাইনবোর্ডের পাশেই আরেকটি সাইনবোর্ডে লেখা আছে, এ মাঠের মালিক উত্তরা ৩ নম্বর কল্যাণ সমিতি। রাজউক কর্তৃপক্ষ বলছে, এ মাঠ ফ্রেন্ডস ক্লাবকে কখনো বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। তারা জোরপূর্বক মাঠ দখল করে সেখানে বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে।
এ ব্যাপারে উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরের একাধিক বাসিন্দা কালের কণ্ঠের কাছে নাম প্রকাশ না করে বলেছেন, ১৯৮৬ সালের দিকে খেলার মাঠের পশ্চিম পাশের এক টুকরো জমি জোরপূর্বক দখল করে ঘর তুলে ফ্রেন্ডস ক্লাব নাম ঝুলিয়ে দেয় কিছু বহিরাগত ব্যক্তি। পরবর্তী সময়ে স্থানীয় কিছু যুবক ক্লাবের সঙ্গে জড়িত হয়। তাঁরা রাজউক থেকে অস্থায়ী ভিত্তিতে ক্লাবের জমি বরাদ্দ নিতে সক্ষম হন। এর পর তাঁরা ক্লাবের জমিতে বহুতল ভবন, কমিউনিটি সেন্টার এবং দোকানপাট নির্মাণ করেন। এ পর্যায়ে ক্লাবের কর্তৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এ নিয়ে ১৯৯৯ সালের ৩০ অক্টোবর শিমুল চৌধুরী নামে এক সম্ভাবনাময় যুবক প্রতিপক্ষের গুলিতে খুন হন। এরপর দীর্ঘদিন ক্লাবের কার্যক্রমে স্থবিরতা ছিল। এখন আগের মতো কার্যক্রম শুরু করেছে। খেলার মাঠে অর্থের বিনিময়ে তাঁরা বিভিন্ন মেলা ও অনুষ্ঠান আয়োজন করছে বলেও এলাকাবাসী অভিযোগ করেছেন।
এ ব্যাপারে ফ্রেন্ডস ক্লাবের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট মনোয়ারুল ইসলাম চৌধুরী রবিন বলেন, উত্তরায় বসতি গড়ে ওঠার আগেই মাঠটি তাঁদের ক্লাবের নিয়ন্ত্রণে ছিল। অন্যায়ভাবে কল্যাণ সমিতির লোকজন মাঠের কর্তৃত্ব নিতে চাইছে।
৩ নম্বর সেক্টর কল্যাণ সমিতি মাঠ ভাড়া দিচ্ছে বলে ফ্রেন্ডস ক্লাবের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে। ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সাইদ সিদ্দিকী কাকা বলেন, কিছু দিন আগে সমিতি স্থানীয় একটি স্কুলকে এক লাখ টাকার বিনিময়ে মাঠ ভাড়া দেয়। এ ধরনের কর্মকাণ্ড ঠেকানোর জন্যই মাঠে তালা লাগানো হয়েছে। তিনি আরো দাবি করেন, কল্যাণ সমিতি সৃষ্টির আগে ফ্রেন্ডস ক্লাবের জন্ম হয়েছে এবং এই ক্লাবই মাঠ গড়ে তোলে। তবে মাঠটি রাজউক থেকে তাঁদের বরাদ্দ দেওয়া হয়নি স্বীকার করে তিনি বলেন, মাঠটি শুধু কল্যাণ সমিতিকে ব্যবহার করার জন্য দেওয়া হয়নি। তা এলাকার সবাই ব্যবহার করার অধিকার রাখে। ফ্রেন্ডস ক্লাবের বিরুদ্ধে মাঠ ভাড়া দেওয়ার অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, অনেক আগে একবার মাঠে মেলার জন্য ভাড়া দেওয়া হয়েছিল।
রাজউকের উত্তরা অফিসে যোগাযোগ করা হলে উপপরিচালক মোহাম্মদ মুসা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'উত্তরা মডেল টাউনে ফ্রেন্ডস ক্লাবের অস্তিত্ব অফিসিয়ালি স্বীকার করা ঠিক নয়। কারণ, রাজউক শুধু সেক্টরের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সহযোগিতা করার জন্য কল্যাণ সমিতির অনুমোদন দিয়েছে। উলি্লখিত খেলার মাঠটি ৩ নম্বর কল্যাণ সমিতির নামেই বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া ফ্রেন্ডস ক্লাবের জন্ম হয়েছে ১৯৮৬ সালে। অন্য দিকে উত্তরা মডেল টাউন গড়ে তোলার জন্য জমি অধিগ্রহণ শুরু হয় ১৯৬৪-৬৫ সালের দিকে।'
কল্যাণ সমিতির সভাপতি আবু জাফর মো. হোসাইন খান কালের কণ্ঠকে বলেন, অনেকটা জোরপূর্বক মাঠের কর্তৃত্ব নিয়েছে ফ্রেন্ডস ক্লাবের লোকজন। ফলে সেক্টরের ছেলেমেয়েরা ঠিকমতো খেলাধুলা করতে পারছে না। বয়স্করা সকাল-বিকাল হাঁটাহাঁটি করতে সমস্যায় পড়ছেন। তিনি জানান, ক্লাবের বাধার কারণে মাঠের সংস্কারকাজ পর্যন্ত করতে পারছে না কল্যাণ সমিতি।
দখল খাল ও সড়ক : উত্তরা মডেল টাউনের পানি নিষ্কাশনের মূল ধারা হচ্ছে আবদুল্লাহপুর খাল। ৫ দশমিক ৬৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এ খালটি বাউনিয়া দ্বিগুণ খালের সংযোগস্থল থেকে উৎপত্তি হয়ে উত্তরার পশ্চিম পাশ দিয়ে আবদুল্লাহপুরে এসে তুরাগ নদীতে মিশেছে। বর্তমানে এ খালের অস্তিত্ব হুমকির মুখে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, বিভিন্ন স্থানে খালের দুই পাশে অবৈধ বস্তিঘর তৈরি করে নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। আবদুল্লাহপুর-আশুলিয়া সড়কের ওপর স্লুইজ গেইটের পুরো জমি অবৈধ দখলদারদের হাতে চলে যাওয়ায় পানি নিষ্কাশনের পথ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। গেইটের ওপর সরকারি জমিতে গড়ে তোলা হয়েছে একটি দোতলা মসজিদ। মসজিদের পশ্চিম পাশে খালের কিছু অংশ ভরাট করে নির্মাণ করা হয়েছে একটি বড় কাঁচাবাজার। তুরাগ থানাধীন নয়ানগরের বাসিন্দা আল আমিন ওই বাজারে দুই শতাধিক দোকান নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছেন বলে বাজারের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। মাংস ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম জানান, তিনি আল আমিনের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা অগ্রিম এবং মাসে তিন হাজার টাকা ভাড়ায় দোকানটি বরাদ্দ নিয়েছেন।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আবদুল্লাহপুর খালের স্লুইজ গেইটের জমি এর আগে একাধিক রাজনৈতিক ব্যক্তি দখল করেছিলেন। আল আমিনের আগে মহি নামে এক ব্যক্তি ওই জমি দখল করে টোকাই আল আমিনের মাধ্যমে ভাড়া তুলতেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আল আমিন ওই জমিতে বাজার নির্মাণ করে দোকান বরাদ্দ দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দা হযরত আলী। আল আমিন হরিরামপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আবুল হাশেমের লোক বলে পরিচিত। উত্তরা ১১ নম্বরের বাসিন্দা রকিবুল রানা বলেন, এ খালটির স্রোতধারা বন্ধ হয়ে গেলে একটু বৃষ্টিতে পুরো উত্তরা মডেল টাউন তলিয়ে যাবে।
তবে আল আমিন কালের কণ্ঠকে বলেন, তিনি পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে ৯৯ বছরের জন্য খালের ওই জায়গা ইজারা নিয়েছেন। এ জায়গার মালিকানা নিয়ে বিরোধের জের ধরে তাঁর বাবা তৈয়ব আলী মেম্বার খুন হন বলেও তিনি জানান।
এদিকে উত্তরা হাউস বিল্ডিং বাসস্ট্যান্ডের উত্তর পাশে সার্ভিস রোড দখল করে ৪০টির মতো স্যানিটারি টাইলসের অবৈধ দোকান নির্মাণ করা হয়েছে। ওই দোকানগুলোর সাইনবোর্ডে কোথাও সোহাগী কোথাও সলিমুল্লাহ আবার কোথাও শাহীনারা কমপ্লেঙ্ লেখা রয়েছে। এ দখলের ফলে উত্তরা থেকে টঙ্গী ও আবদুল্লাহপুর যাতায়াতের একমাত্র রাস্তাটি বন্ধ হয়ে গেছে। একসময় এ রাস্তাটি দিয়ে রিকশা-ভ্যান চলাচল করত। কেউ কেউ হেঁটেও বিভিন্ন স্থানে যেতেন। কিন্তু কয়েক বছর আগে স্থানীয় খোকন ভাণ্ডারী, সাজ্জাদ, রমু, আমেলা বেগম প্রমুখ রাস্তা দখল করে মার্কেট নির্মাণ করেন। সরেজমিন দোকানদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁরা ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা অগ্রিম দিয়ে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা মাসিক ভাড়ায় ব্যবসা করছেন। তবে ওই জমি নিয়ে সড়ক ও জনপথ বিভাগের সঙ্গে দোকান মালিকদের মামলা-মোকদ্দমা চলছে। দোকান মালিকরা দাবি করেন, তাঁরা উত্তরা মডেল টাউন সৃষ্টির আগে ওই জমির মালিক ছিলেন।
অবৈধ এসব দোকান উচ্ছেদের জন্য কয়েকবার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল বলে স্থানীয় লোকজন জানান। কিন্তু প্রতিবারই মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে সে উচ্ছেদ বন্ধ করা হয় বলে অভিযোগ করেন হাউস বিল্ডিং এলাকার ব্যবসায়ী শাহজাহান টুকু। ৮ নম্বর সেক্টরে অবস্থিত সাধারণ বীমা কোয়ার্টারে বসবাসরত সরকারি কর্মকর্তা সাজ্জাদ হোসেন কালের কণ্ঠকে জানান, ১৯৭৪ সালে জীবন বীমার কোয়ার্টার নির্মাণের সময় সার্ভিস রোডটি ছিল উন্মুক্ত। কিন্তু পরে কিছু লোক নিজেদের জমি দাবি করে রোডটি দখল করে সেখানে স্যানিটারি মার্কেট নির্মাণ করে। ফলে কোয়ার্টারে সববাসরত ১২০টি পরিবার অনেকটা অবরুদ্ধ জীবনযাপন করছে। তিনি অচিরেই সড়ক থেকে মার্কেটটি উচ্ছেদ করে সার্ভিস রোডটি অবমুক্ত করার দাবি জানান।
সার্ভিস রোডের ওপর দোকান নির্মাণ প্রসঙ্গে জমির মালিক দাবিদার খোকন ভাণ্ডারী বলেন, এ জায়গাটি রাজউকের অধিগ্রহণের বাইরে পড়েছে। তাঁদের পৈতৃক প্রায় ৫২ বিঘা জমি অধিগ্রহণ হওয়ার পর সামান্য জমি অবশিষ্ট রয়েছে। তিনি আরো বলেন, অধিগ্রহণে অনেক জমি হারানোর পরও তারাও ক্ষতিপূরণ হিসেবে রাজউক থেকে কোনো প্লট পাননি_উপরন্তু বর্তমানে দোকানের জমিটুকুও সড়ক ও জনপথের কোনো কোনো কর্মকর্তা আত্মসাৎ করার চেষ্টা করছে। খোকন ভাণ্ডারী বলেন, থাকার জায়গার অভাবে তিনি পরিবার-পরিজন নিয়ে খিলগাঁও তিলপাপাড়ায় বসবাস করছেন।
উত্তরা মডেল টাউনের ৩ নম্বর সেক্টরে একটি খেলার মাঠ রয়েছে। হাঁটাহাঁটি করার জন্য মাঠের ভেতরে রয়েছে ওয়ার্কওয়ে। এলাকাবাসীর ব্যবহারের জন্য রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এ মাঠটি বরাদ্দ দেয়। মাঠের তদারকি ও সংস্কারের দায়িত্ব দেওয়া হয় ৩ নম্বর সেক্টর কল্যাণ সমিতিকে। কিন্তু বর্তমানে মাঠটি দখল করে নিয়েছে ফ্রেন্ডস ক্লাব নামে একটি সংগঠন। তারা মাঠের প্রবেশ পথে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে। এর ভেতরে প্রবেশাধিকার ক্লাব কর্তৃপক্ষের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে। এমনকি মাঠের প্রবেশ পথে বড় একটি সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে তারা মালিকানাও প্রমাণের চেষ্টা করছে। এ সাইনবোর্ডের পাশেই আরেকটি সাইনবোর্ডে লেখা আছে, এ মাঠের মালিক উত্তরা ৩ নম্বর কল্যাণ সমিতি। রাজউক কর্তৃপক্ষ বলছে, এ মাঠ ফ্রেন্ডস ক্লাবকে কখনো বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। তারা জোরপূর্বক মাঠ দখল করে সেখানে বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে।
এ ব্যাপারে উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরের একাধিক বাসিন্দা কালের কণ্ঠের কাছে নাম প্রকাশ না করে বলেছেন, ১৯৮৬ সালের দিকে খেলার মাঠের পশ্চিম পাশের এক টুকরো জমি জোরপূর্বক দখল করে ঘর তুলে ফ্রেন্ডস ক্লাব নাম ঝুলিয়ে দেয় কিছু বহিরাগত ব্যক্তি। পরবর্তী সময়ে স্থানীয় কিছু যুবক ক্লাবের সঙ্গে জড়িত হয়। তাঁরা রাজউক থেকে অস্থায়ী ভিত্তিতে ক্লাবের জমি বরাদ্দ নিতে সক্ষম হন। এর পর তাঁরা ক্লাবের জমিতে বহুতল ভবন, কমিউনিটি সেন্টার এবং দোকানপাট নির্মাণ করেন। এ পর্যায়ে ক্লাবের কর্তৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এ নিয়ে ১৯৯৯ সালের ৩০ অক্টোবর শিমুল চৌধুরী নামে এক সম্ভাবনাময় যুবক প্রতিপক্ষের গুলিতে খুন হন। এরপর দীর্ঘদিন ক্লাবের কার্যক্রমে স্থবিরতা ছিল। এখন আগের মতো কার্যক্রম শুরু করেছে। খেলার মাঠে অর্থের বিনিময়ে তাঁরা বিভিন্ন মেলা ও অনুষ্ঠান আয়োজন করছে বলেও এলাকাবাসী অভিযোগ করেছেন।
এ ব্যাপারে ফ্রেন্ডস ক্লাবের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট মনোয়ারুল ইসলাম চৌধুরী রবিন বলেন, উত্তরায় বসতি গড়ে ওঠার আগেই মাঠটি তাঁদের ক্লাবের নিয়ন্ত্রণে ছিল। অন্যায়ভাবে কল্যাণ সমিতির লোকজন মাঠের কর্তৃত্ব নিতে চাইছে।
৩ নম্বর সেক্টর কল্যাণ সমিতি মাঠ ভাড়া দিচ্ছে বলে ফ্রেন্ডস ক্লাবের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে। ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সাইদ সিদ্দিকী কাকা বলেন, কিছু দিন আগে সমিতি স্থানীয় একটি স্কুলকে এক লাখ টাকার বিনিময়ে মাঠ ভাড়া দেয়। এ ধরনের কর্মকাণ্ড ঠেকানোর জন্যই মাঠে তালা লাগানো হয়েছে। তিনি আরো দাবি করেন, কল্যাণ সমিতি সৃষ্টির আগে ফ্রেন্ডস ক্লাবের জন্ম হয়েছে এবং এই ক্লাবই মাঠ গড়ে তোলে। তবে মাঠটি রাজউক থেকে তাঁদের বরাদ্দ দেওয়া হয়নি স্বীকার করে তিনি বলেন, মাঠটি শুধু কল্যাণ সমিতিকে ব্যবহার করার জন্য দেওয়া হয়নি। তা এলাকার সবাই ব্যবহার করার অধিকার রাখে। ফ্রেন্ডস ক্লাবের বিরুদ্ধে মাঠ ভাড়া দেওয়ার অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, অনেক আগে একবার মাঠে মেলার জন্য ভাড়া দেওয়া হয়েছিল।
রাজউকের উত্তরা অফিসে যোগাযোগ করা হলে উপপরিচালক মোহাম্মদ মুসা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'উত্তরা মডেল টাউনে ফ্রেন্ডস ক্লাবের অস্তিত্ব অফিসিয়ালি স্বীকার করা ঠিক নয়। কারণ, রাজউক শুধু সেক্টরের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সহযোগিতা করার জন্য কল্যাণ সমিতির অনুমোদন দিয়েছে। উলি্লখিত খেলার মাঠটি ৩ নম্বর কল্যাণ সমিতির নামেই বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া ফ্রেন্ডস ক্লাবের জন্ম হয়েছে ১৯৮৬ সালে। অন্য দিকে উত্তরা মডেল টাউন গড়ে তোলার জন্য জমি অধিগ্রহণ শুরু হয় ১৯৬৪-৬৫ সালের দিকে।'
কল্যাণ সমিতির সভাপতি আবু জাফর মো. হোসাইন খান কালের কণ্ঠকে বলেন, অনেকটা জোরপূর্বক মাঠের কর্তৃত্ব নিয়েছে ফ্রেন্ডস ক্লাবের লোকজন। ফলে সেক্টরের ছেলেমেয়েরা ঠিকমতো খেলাধুলা করতে পারছে না। বয়স্করা সকাল-বিকাল হাঁটাহাঁটি করতে সমস্যায় পড়ছেন। তিনি জানান, ক্লাবের বাধার কারণে মাঠের সংস্কারকাজ পর্যন্ত করতে পারছে না কল্যাণ সমিতি।
দখল খাল ও সড়ক : উত্তরা মডেল টাউনের পানি নিষ্কাশনের মূল ধারা হচ্ছে আবদুল্লাহপুর খাল। ৫ দশমিক ৬৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এ খালটি বাউনিয়া দ্বিগুণ খালের সংযোগস্থল থেকে উৎপত্তি হয়ে উত্তরার পশ্চিম পাশ দিয়ে আবদুল্লাহপুরে এসে তুরাগ নদীতে মিশেছে। বর্তমানে এ খালের অস্তিত্ব হুমকির মুখে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, বিভিন্ন স্থানে খালের দুই পাশে অবৈধ বস্তিঘর তৈরি করে নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। আবদুল্লাহপুর-আশুলিয়া সড়কের ওপর স্লুইজ গেইটের পুরো জমি অবৈধ দখলদারদের হাতে চলে যাওয়ায় পানি নিষ্কাশনের পথ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। গেইটের ওপর সরকারি জমিতে গড়ে তোলা হয়েছে একটি দোতলা মসজিদ। মসজিদের পশ্চিম পাশে খালের কিছু অংশ ভরাট করে নির্মাণ করা হয়েছে একটি বড় কাঁচাবাজার। তুরাগ থানাধীন নয়ানগরের বাসিন্দা আল আমিন ওই বাজারে দুই শতাধিক দোকান নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছেন বলে বাজারের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। মাংস ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম জানান, তিনি আল আমিনের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা অগ্রিম এবং মাসে তিন হাজার টাকা ভাড়ায় দোকানটি বরাদ্দ নিয়েছেন।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আবদুল্লাহপুর খালের স্লুইজ গেইটের জমি এর আগে একাধিক রাজনৈতিক ব্যক্তি দখল করেছিলেন। আল আমিনের আগে মহি নামে এক ব্যক্তি ওই জমি দখল করে টোকাই আল আমিনের মাধ্যমে ভাড়া তুলতেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আল আমিন ওই জমিতে বাজার নির্মাণ করে দোকান বরাদ্দ দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দা হযরত আলী। আল আমিন হরিরামপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আবুল হাশেমের লোক বলে পরিচিত। উত্তরা ১১ নম্বরের বাসিন্দা রকিবুল রানা বলেন, এ খালটির স্রোতধারা বন্ধ হয়ে গেলে একটু বৃষ্টিতে পুরো উত্তরা মডেল টাউন তলিয়ে যাবে।
তবে আল আমিন কালের কণ্ঠকে বলেন, তিনি পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে ৯৯ বছরের জন্য খালের ওই জায়গা ইজারা নিয়েছেন। এ জায়গার মালিকানা নিয়ে বিরোধের জের ধরে তাঁর বাবা তৈয়ব আলী মেম্বার খুন হন বলেও তিনি জানান।
এদিকে উত্তরা হাউস বিল্ডিং বাসস্ট্যান্ডের উত্তর পাশে সার্ভিস রোড দখল করে ৪০টির মতো স্যানিটারি টাইলসের অবৈধ দোকান নির্মাণ করা হয়েছে। ওই দোকানগুলোর সাইনবোর্ডে কোথাও সোহাগী কোথাও সলিমুল্লাহ আবার কোথাও শাহীনারা কমপ্লেঙ্ লেখা রয়েছে। এ দখলের ফলে উত্তরা থেকে টঙ্গী ও আবদুল্লাহপুর যাতায়াতের একমাত্র রাস্তাটি বন্ধ হয়ে গেছে। একসময় এ রাস্তাটি দিয়ে রিকশা-ভ্যান চলাচল করত। কেউ কেউ হেঁটেও বিভিন্ন স্থানে যেতেন। কিন্তু কয়েক বছর আগে স্থানীয় খোকন ভাণ্ডারী, সাজ্জাদ, রমু, আমেলা বেগম প্রমুখ রাস্তা দখল করে মার্কেট নির্মাণ করেন। সরেজমিন দোকানদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁরা ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা অগ্রিম দিয়ে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা মাসিক ভাড়ায় ব্যবসা করছেন। তবে ওই জমি নিয়ে সড়ক ও জনপথ বিভাগের সঙ্গে দোকান মালিকদের মামলা-মোকদ্দমা চলছে। দোকান মালিকরা দাবি করেন, তাঁরা উত্তরা মডেল টাউন সৃষ্টির আগে ওই জমির মালিক ছিলেন।
অবৈধ এসব দোকান উচ্ছেদের জন্য কয়েকবার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল বলে স্থানীয় লোকজন জানান। কিন্তু প্রতিবারই মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে সে উচ্ছেদ বন্ধ করা হয় বলে অভিযোগ করেন হাউস বিল্ডিং এলাকার ব্যবসায়ী শাহজাহান টুকু। ৮ নম্বর সেক্টরে অবস্থিত সাধারণ বীমা কোয়ার্টারে বসবাসরত সরকারি কর্মকর্তা সাজ্জাদ হোসেন কালের কণ্ঠকে জানান, ১৯৭৪ সালে জীবন বীমার কোয়ার্টার নির্মাণের সময় সার্ভিস রোডটি ছিল উন্মুক্ত। কিন্তু পরে কিছু লোক নিজেদের জমি দাবি করে রোডটি দখল করে সেখানে স্যানিটারি মার্কেট নির্মাণ করে। ফলে কোয়ার্টারে সববাসরত ১২০টি পরিবার অনেকটা অবরুদ্ধ জীবনযাপন করছে। তিনি অচিরেই সড়ক থেকে মার্কেটটি উচ্ছেদ করে সার্ভিস রোডটি অবমুক্ত করার দাবি জানান।
সার্ভিস রোডের ওপর দোকান নির্মাণ প্রসঙ্গে জমির মালিক দাবিদার খোকন ভাণ্ডারী বলেন, এ জায়গাটি রাজউকের অধিগ্রহণের বাইরে পড়েছে। তাঁদের পৈতৃক প্রায় ৫২ বিঘা জমি অধিগ্রহণ হওয়ার পর সামান্য জমি অবশিষ্ট রয়েছে। তিনি আরো বলেন, অধিগ্রহণে অনেক জমি হারানোর পরও তারাও ক্ষতিপূরণ হিসেবে রাজউক থেকে কোনো প্লট পাননি_উপরন্তু বর্তমানে দোকানের জমিটুকুও সড়ক ও জনপথের কোনো কোনো কর্মকর্তা আত্মসাৎ করার চেষ্টা করছে। খোকন ভাণ্ডারী বলেন, থাকার জায়গার অভাবে তিনি পরিবার-পরিজন নিয়ে খিলগাঁও তিলপাপাড়ায় বসবাস করছেন।
No comments