মিয়ানমার-‘সু চির বিজয় ভয় হতে অভয় পথে’ by হান্নাহ বিচ
পার্টির সদর দপ্তরে তখন চলছিল সব পার্টির শেষ পার্টি। অনেক দিন, ইয়াঙ্গুনে মিয়ানমারের বিরোধী দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনলডি) সদর দপ্তরের সামনের এবড়োখেবড়ো পানের পিকের দাগধরা চত্বরটি হয়ে ছিল এক ‘গমন-নিষিদ্ধ’ এলাকা। বার্মিজরা এর সামনে দিয়ে দ্রুত পায়ে চলে যায়,
পারতপক্ষে চোখ ফিরিয়ে রাখে কারাকুঠুরির মতো অফিস-ঘরটার দিক থেকে। এখান থেকেই নোবেল বিজয়ী অং সান সু চির নিবেদিতপ্রাণ সমর্থকেরা বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়ক রাষ্ট্রে গণতন্ত্র আনার জন্য তাদের অন্য রকম সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। রাস্তার ওপারেই একটা খোলা চায়ের দোকান। সেখানে সরকারের কুখ্যাত স্পেশাল ব্রাঞ্চের লোকেরা টেলিফোটো লেন্সের ক্যামেরা দিয়ে নজর রাখে, কে কে সাহস করে পার্টির দপ্তরে ঢুকছে। এই গোয়েন্দারা মোটামুটি মার্কা মারা, চিনতে বেশি বেগ পেতে হয় না। তাদের পরনে থাকে সাদা অক্সফোর্ড শার্ট, কালো সারং আর চোখে কালো সানগ্লাস।
কিন্তু পয়লা এপ্রিলে, মিয়ানমারের গত ৫০ বছরের মধ্যে তৃতীয় নির্বাচনের ফল প্রকাশের দিন সেই বিরান চত্বরটি তো বটেই, সামনের ব্যস্ত রাস্তাতেও জনস্রোত নেমে এল। বিরোধী দল এনএলডি এই উপনির্বাচনের বিজয়কে নিরঙ্কুশ বলে অভিহিত করেছে। ৬৬৪টি সংসদীয় আসনের মাত্র ৪৫টিতে এই উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৯০-এর পর এটাই প্রথম নির্বাচন, যেখানে সু চির এনএলডি অংশ নিয়েছে। ১৯৯০ সালের সাধারণ নির্বাচনে সু চির দল এ রকমই এক কূল-উপচানো বিজয় পেয়েছিল। কিন্তু সামরিক জান্তা সেই বিজয়কে বাতিল করে সু চিকে দফায় দফায় মোট ১৫ বছর গৃহবন্দী করে রাখে। অবশ্য ২০১০ সালেও একটা নির্বাচন হয়েছিল; যার মাধ্যমে ছদ্ম-বেসামরিক সরকার জেনারেলদের ঘুঁটি হিসেবে ক্ষমতায় আসীন হয়।
এবার এনএলডির দপ্তরের ছাদে বিরাট এক পর্দায় নির্বাচনের বেসরকারি ফল প্রকাশ করা হচ্ছিল। প্রতিটি বিজয়ের খবরে উপস্থিত জনতা সোল্লাসে গর্জন করে ওঠে। রাত ১০টার মধ্যেই ৪৫টি আসনের মধ্যে সু চির আসনসহ ৪৪টি আসনে বিজয় নিশ্চিত হয়। এই বিজয় এনএলডিকে আইনসভায় সামরিক বাহিনীর খাড়া করা দল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (ইউএসডিপি) বিপরীতে তেমন কোনো শক্তি না জোগালেও একে আধুনিক মিয়ানমারের ইতিহাসের মোড় ফেরানো ঘটনা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
সুবক্তা সু চি ১৯৯০ সালে তাঁর এক ঐতিহাসিক বক্তৃতায় বলেছিলেন, সবচেয়ে বড় মুক্তি হলো ভয় থেকে মুক্তি। এবারের পয়লা এপ্রিলের রাতে, মিয়ানমারে তীব্র গরমের মধ্যে বার্মিজরা অবশেষে সেই মুক্তি অর্জন করল। এই নির্বাচন শাসকদের ভীতির রাজত্বে চিড় ধরিয়েছে।
বছর খানেক আগেও যেখানে কেবল এনএলডির দলীয় প্রতীক দেখালেও জেল হয়ে যেত, সেখানে এনএলডির সামনের বিজয়ের দৃশ্যগুলো যেন কোনো পরাবাস্তব চলচ্চিত্রের চলমান ছবি। লাল রং করা চুলের কিশোর-কিশোরীরা ৬৬ বছর বয়সী সু চির বন্দনাগীতির সঙ্গে নাচছে। বাবা-মায়েরা তাদের শিশুদের নিয়ে এসেছে, তাদের সবার হাতে এনএলডির লাল পতাকা: লালের মধ্যে সাদা তারকা ও সোনালি ময়ূরশোভিত। পুরো নির্বাচনী প্রচারেই এ রকম উচ্ছ্বসিত জনতাকে এনএলডির স্লোগান দিতে দেখা গেছে। কিন্তু জনগণের ইচ্ছাশক্তির এই খোলামেলা প্রকাশ, একদা নিষিদ্ধ একটি দলের পক্ষে দাঁড়ানোর এই সাহসিকতা যেন মিয়ানমারের রক্তাক্ত রাজনৈতিক ইতিহাসের আরেকটা সন্ধিক্ষণ।
সরকারিভাবে যে দেশটাকে মিয়ানমার বলা হয়, সে দেশের ভবিষ্যতে কী ঘটতে যাচ্ছে? রাজাসনে বসে থাকা অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলরা কি এনএলডির এই কূল-উপচানো বিজয়ে ধাক্কা খেয়েছে? নির্বাচনের দিনেও ভোট দেওয়া নিয়ে বেশ কিছু অনিয়মের অভিযোগ শোনা গেছে; সম্ভবত এনএলডির বিজয়কে ধূলিসাৎ করার জন্য অন্ধকারে নানান কলকাঠি নাড়ানো হলেও সেসব বিফল হয়েছে। এনএলডির দপ্তরের সামনের দৃশ্যের সাক্ষী এক কূটনীতিক বলেছেন, সরকারের কর্তাব্যক্তিরা নাকি ফোন ধরা বন্ধ রেখেছে। সরকারে আসীন ইউএসডিপি তাদের নির্বাচনী প্রচারে আধুনিক কলাকৌশল প্রয়োগ করে প্রাণপণ চেষ্টা করেছিল সম্মান রাখতে। এই বিজয় তাদের জন্যও অপমানকর। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং সামরিক বাহিনীর জন্য সংরক্ষিত এক-চতুর্থাংশ আসনের মদদ তাদের হয়তো নিশ্চিন্ত রাখবে, কিন্তু সরকারের ভাবমূর্তির ক্ষতিটা অপূরণীয়।
এখন প্রশ্ন হলো, সরকারের ভেতরকার যে কঠিনপন্থীরা প্রেসিডেন্ট থেইন সেইনের অবাক করা সংস্কার নিয়ে অস্বস্তিতে ভুগছিল—রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দেওয়া হচ্ছে, গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ শিথিল হচ্ছে, সু চি ও তাঁর দলকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া হচ্ছে ইত্যাদি; নির্বাচনের ফল দেখে তারা কি সংস্কারের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে? এটাও খেয়াল রাখতে হবে যে নির্বাচনের বেসরকারি ফল প্রকাশিত হলেও সরকারিভাবে চূড়ান্ত ফল ঘোষণা হতে সপ্তাহ লেগে যাবে। আজ যা প্রকাশিত হয়েছে আর পরে সরকারিভাবে যা প্রকাশিত হবে, তার মধ্যে যদি বিস্তর ব্যবধান তৈরি করা হয়? সব রকম জনবন্দনা সত্ত্বেও বিশ্বের সবচেয়ে প্রিয় বিরোধী নেত্রী ক্ষমতাহীন সংসদ সদস্যে পর্যবসিত হলে সেটা কেমন হবে? এ রকম অজস্র আশঙ্কার কথাই মনে আসতে পারে। কিন্তু আজ রাতে, যখন নির্বাচনের বিজয়বার্তা সমগ্র মিয়ানমারে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে—ইয়াঙ্গুন থেকে মান্দালয়, এমনকি সামরিক জান্তার তৈরি বাংকারময় নতুন রাজধানী নেপিডো পর্যন্ত। এখন আন্দাজ-অনুমানের সময় নয়, এখন সময় উদ্যাপনের।
টাইম অনলাইন থেকে অনূদিত
হান্নাহ বিচ: সাংবাদিক, দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ।
কিন্তু পয়লা এপ্রিলে, মিয়ানমারের গত ৫০ বছরের মধ্যে তৃতীয় নির্বাচনের ফল প্রকাশের দিন সেই বিরান চত্বরটি তো বটেই, সামনের ব্যস্ত রাস্তাতেও জনস্রোত নেমে এল। বিরোধী দল এনএলডি এই উপনির্বাচনের বিজয়কে নিরঙ্কুশ বলে অভিহিত করেছে। ৬৬৪টি সংসদীয় আসনের মাত্র ৪৫টিতে এই উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৯০-এর পর এটাই প্রথম নির্বাচন, যেখানে সু চির এনএলডি অংশ নিয়েছে। ১৯৯০ সালের সাধারণ নির্বাচনে সু চির দল এ রকমই এক কূল-উপচানো বিজয় পেয়েছিল। কিন্তু সামরিক জান্তা সেই বিজয়কে বাতিল করে সু চিকে দফায় দফায় মোট ১৫ বছর গৃহবন্দী করে রাখে। অবশ্য ২০১০ সালেও একটা নির্বাচন হয়েছিল; যার মাধ্যমে ছদ্ম-বেসামরিক সরকার জেনারেলদের ঘুঁটি হিসেবে ক্ষমতায় আসীন হয়।
এবার এনএলডির দপ্তরের ছাদে বিরাট এক পর্দায় নির্বাচনের বেসরকারি ফল প্রকাশ করা হচ্ছিল। প্রতিটি বিজয়ের খবরে উপস্থিত জনতা সোল্লাসে গর্জন করে ওঠে। রাত ১০টার মধ্যেই ৪৫টি আসনের মধ্যে সু চির আসনসহ ৪৪টি আসনে বিজয় নিশ্চিত হয়। এই বিজয় এনএলডিকে আইনসভায় সামরিক বাহিনীর খাড়া করা দল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (ইউএসডিপি) বিপরীতে তেমন কোনো শক্তি না জোগালেও একে আধুনিক মিয়ানমারের ইতিহাসের মোড় ফেরানো ঘটনা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
সুবক্তা সু চি ১৯৯০ সালে তাঁর এক ঐতিহাসিক বক্তৃতায় বলেছিলেন, সবচেয়ে বড় মুক্তি হলো ভয় থেকে মুক্তি। এবারের পয়লা এপ্রিলের রাতে, মিয়ানমারে তীব্র গরমের মধ্যে বার্মিজরা অবশেষে সেই মুক্তি অর্জন করল। এই নির্বাচন শাসকদের ভীতির রাজত্বে চিড় ধরিয়েছে।
বছর খানেক আগেও যেখানে কেবল এনএলডির দলীয় প্রতীক দেখালেও জেল হয়ে যেত, সেখানে এনএলডির সামনের বিজয়ের দৃশ্যগুলো যেন কোনো পরাবাস্তব চলচ্চিত্রের চলমান ছবি। লাল রং করা চুলের কিশোর-কিশোরীরা ৬৬ বছর বয়সী সু চির বন্দনাগীতির সঙ্গে নাচছে। বাবা-মায়েরা তাদের শিশুদের নিয়ে এসেছে, তাদের সবার হাতে এনএলডির লাল পতাকা: লালের মধ্যে সাদা তারকা ও সোনালি ময়ূরশোভিত। পুরো নির্বাচনী প্রচারেই এ রকম উচ্ছ্বসিত জনতাকে এনএলডির স্লোগান দিতে দেখা গেছে। কিন্তু জনগণের ইচ্ছাশক্তির এই খোলামেলা প্রকাশ, একদা নিষিদ্ধ একটি দলের পক্ষে দাঁড়ানোর এই সাহসিকতা যেন মিয়ানমারের রক্তাক্ত রাজনৈতিক ইতিহাসের আরেকটা সন্ধিক্ষণ।
সরকারিভাবে যে দেশটাকে মিয়ানমার বলা হয়, সে দেশের ভবিষ্যতে কী ঘটতে যাচ্ছে? রাজাসনে বসে থাকা অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলরা কি এনএলডির এই কূল-উপচানো বিজয়ে ধাক্কা খেয়েছে? নির্বাচনের দিনেও ভোট দেওয়া নিয়ে বেশ কিছু অনিয়মের অভিযোগ শোনা গেছে; সম্ভবত এনএলডির বিজয়কে ধূলিসাৎ করার জন্য অন্ধকারে নানান কলকাঠি নাড়ানো হলেও সেসব বিফল হয়েছে। এনএলডির দপ্তরের সামনের দৃশ্যের সাক্ষী এক কূটনীতিক বলেছেন, সরকারের কর্তাব্যক্তিরা নাকি ফোন ধরা বন্ধ রেখেছে। সরকারে আসীন ইউএসডিপি তাদের নির্বাচনী প্রচারে আধুনিক কলাকৌশল প্রয়োগ করে প্রাণপণ চেষ্টা করেছিল সম্মান রাখতে। এই বিজয় তাদের জন্যও অপমানকর। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং সামরিক বাহিনীর জন্য সংরক্ষিত এক-চতুর্থাংশ আসনের মদদ তাদের হয়তো নিশ্চিন্ত রাখবে, কিন্তু সরকারের ভাবমূর্তির ক্ষতিটা অপূরণীয়।
এখন প্রশ্ন হলো, সরকারের ভেতরকার যে কঠিনপন্থীরা প্রেসিডেন্ট থেইন সেইনের অবাক করা সংস্কার নিয়ে অস্বস্তিতে ভুগছিল—রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দেওয়া হচ্ছে, গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ শিথিল হচ্ছে, সু চি ও তাঁর দলকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া হচ্ছে ইত্যাদি; নির্বাচনের ফল দেখে তারা কি সংস্কারের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে? এটাও খেয়াল রাখতে হবে যে নির্বাচনের বেসরকারি ফল প্রকাশিত হলেও সরকারিভাবে চূড়ান্ত ফল ঘোষণা হতে সপ্তাহ লেগে যাবে। আজ যা প্রকাশিত হয়েছে আর পরে সরকারিভাবে যা প্রকাশিত হবে, তার মধ্যে যদি বিস্তর ব্যবধান তৈরি করা হয়? সব রকম জনবন্দনা সত্ত্বেও বিশ্বের সবচেয়ে প্রিয় বিরোধী নেত্রী ক্ষমতাহীন সংসদ সদস্যে পর্যবসিত হলে সেটা কেমন হবে? এ রকম অজস্র আশঙ্কার কথাই মনে আসতে পারে। কিন্তু আজ রাতে, যখন নির্বাচনের বিজয়বার্তা সমগ্র মিয়ানমারে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে—ইয়াঙ্গুন থেকে মান্দালয়, এমনকি সামরিক জান্তার তৈরি বাংকারময় নতুন রাজধানী নেপিডো পর্যন্ত। এখন আন্দাজ-অনুমানের সময় নয়, এখন সময় উদ্যাপনের।
টাইম অনলাইন থেকে অনূদিত
হান্নাহ বিচ: সাংবাদিক, দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ।
No comments