জাতীয় প্রতিবন্ধী দিবস-বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধকতা by মাহবুবুর রহমান ভুঁইয়া
"সাহেব যখন চিঠির শেষে আমাকে লেখেন �Yours truly� সত্যি তোমারই, তখন তাহার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তার 'সত্যিই' পদটুকুকে তর্জমা করে আমি এই বুঝি_তিনি সত্যিই আমার নহেন।" প্রায়ই সভা কিংবা সেমিনারে বক্তারা বলেন, 'আমাদের সমাজে প্রতিবন্ধীরা আজও অবহেলিত।' সত্যিই ওদের জন্য কিছু করা দরকার।
কেন জানি এতটা বছর পরও রবি ঠাকুরের সেই উক্তিটির সঙ্গে আমাদের নীতিনির্ধারকদের 'সত্যিই' কথাটির খুব বেশি মিল খুঁজে পাই। তাই তো বলি, কিছু করার চেয়ে প্রথম এ নেতিবাচক শব্দটা দূর করার জন্য কিছু করুন। আজ ৪ এপ্রিল ২০১২, জাতীয় প্রতিবন্ধী দিবস। প্রতিবছর এপ্রিল মাসের প্রথম বুধবার জাতীয় প্রতিবন্ধী দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এ দিবসে সভা, সেমিনার, পত্রিকা, টেলিভিশন, সরকারি অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ এমনকি পারিবারিক বন্ধনে কম করে হলেও লক্ষবার উচ্চারিত হবে এ 'প্রতিবন্ধী' শব্দটি। আর লক্ষবারই আহত হবে তাদের মন। আমরা কি কখনো বুঝতে চেষ্টা করি, এ নেতিবাচক শব্দটা তাদের ভেতরটা কতটুকু নেতিবাচক করে তোলে? Disability শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ অসামর্থ্য আর Disable শব্দের অর্থ অক্ষম করা, অযোগ্য করা বা অনুপযুক্ত। এই অনুপযুক্ত মানুষগুলো যতটা শারীরিক দিক থেকে অনুপযুক্ত, তার চেয়েও ঢের অনুপযুক্ত আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে। আমার কেন জানি মনে হয়, এ 'প্রতিবন্ধী' শব্দটিই তাদের জন্য সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা। যেহেতু কোনো না কোনোভাবে তারা তাদের জীবন নির্বাহ করতে সক্ষম, তাহলে আমরা কেন তাদের ক্ষেত্রে এই অক্ষম, অনুপযুক্ত শব্দটা ব্যবহার করব? তাই চলুন, Disable শব্দটার পরিবর্তে আমরা বলিDifferently able, 'প্রতিবন্ধী' শব্দটার পরিবর্তে বলি 'অন্যভাবে সক্ষম'। কেউ কেউ হয়তো বলতে পারেন, শুধু শব্দের পরিবর্তন হলেই কী চলবে? আমি বলি চলবে, কমপক্ষে এ শব্দটার ভেতর জাদুকরী কিছু না পেলেও কিছুটা অনুরাগের ছোঁয়া পাবে। তথ্য মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে ২৮ শতাংশ শারীরিক 'অন্যভাবে সক্ষম মানুষ', ৩২ শতাংশ দৃষ্টি 'অন্যভাবে সক্ষম মানুষ', ২২ শতাংশ শ্রবণ ও বাক 'অন্যভাবে সক্ষম মানুষ', ৭ শতাংশ বুদ্ধি 'অন্যভাবে সক্ষম মানুষ', ১১ শতাংশ একাধিক বা বহুমাত্রিক 'অন্যভাবে সক্ষম মানুষ' আছে। যার অধিকাংশ অবজ্ঞা, অবহেলা আর নিরন্তর যন্ত্রণা বুকে চেপে পাথরের মতো নিষপ্রাণ হয়ে বেঁচে আছে। অথচ সুযোগ পেলে তারাও হতে পারে অনুকরণীয় কিংবা অনুসরণীয় মানুষ। আশার কথা, সরকার এবং কিছু বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা অন্যভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের কাজের সুযোগ করে দিচ্ছে এবং তাদের মানসিক পীড়ন ও মনোবল ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখছে। তবে চাকরির ক্ষেত্রে পুরুষদের চেয়ে নারী অন্যভাবে সক্ষমদের ঠকতে ও ঠেকতে হয় অনেক বেশি। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সব নিয়োগে কমপক্ষে ৫ শতাংশ কোটা বরাদ্দ, যেমন_যথাযথ অনুসরণ করা হচ্ছে না, তেমনি সরকার ঘোষিত ১০ শতাংশ সরকারি চাকরি কোটাও অনেকাংশে পূরণ করা হচ্ছে না। সব মৌলিক স্বাধীনতা ও মানবিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার ২০০৭ সালে 'অন্যভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের অধিকারসংক্রান্ত জাতিসংঘ সনদে' (UNCRPD) স্বাক্ষরও করে। কিন্তু সনদের আলোকে 'অন্যভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের অধিকার নিশ্চিতকল্পে প্রয়োজন উপযোগী একটি আইন প্রণয়নের দাবি অনেক দিনের; যা এখনো পূরণ হয়নি। তা ছাড়া স্কুল, সাইক্লোন শেল্টার, বন্যার আশ্রয়কেন্দ্র, পাবলিক টয়লেট এবং গোসলখানা, স্বাস্থ্যকেন্দ্রসহ নানাবিধ ভবন এখনো তাদের জন্য সহজে প্রবেশগম্য নয়। এ বিষয়গুলোও তাদের প্রতিবন্ধকতার মাত্রাকে আরো বেশি বাড়িয়ে তুলছে। সত্যিই 'আমরা বেড়ে উঠেছি বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধকতা ও প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে, টিকে আছি নিরন্তর বৈষম্যের অসম প্রতিযোগিতায়।'
মাহবুবুর রহমান ভুঁইয়া
মাহবুবুর রহমান ভুঁইয়া
No comments