অং সান সু চির বিজয়-প্রতিবেশীর নতুন যুগে আমরা সহযাত্রী
মিয়ানমারের পার্লামেন্টের উপনির্বাচনে নিজের ও দলের যে বিপুল বিজয়কে অং সান সু চি 'নতুন যুগের সূচনা' আখ্যা দিয়েছেন, তার তাৎপর্য বহুমাত্রিক। পাঁচ দশকের গুমোট সেনা শাসনের পর দেশটি যদিও নির্বাচনী অর্থে গণতান্ত্রিক যুগে গত বছরের নভেম্বরেই প্রবেশ করেছিল, জনপ্রিয়তম দল এনএলডির অংশগ্রহণ ছাড়া তা ম্লান ছিল।
রোববারের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সেখানে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা শুরু হলো। আমরা বিশ্বাস করি, প্রভাবশালী সেনাবাহিনী ও তাদের আশীর্বাদপুষ্ট সরকার এবং সু চির নেতৃত্বাধীন দলের মধ্যে সমঝোতা ও সহযোগিতার যে বাতাবরণ তৈরি হয়েছে, নবীন গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে তা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ হলেও শাসনতান্ত্রিক জটিলতার বেড়াজালে আটকে থেকে মিয়ানমার এতদিন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি লাভ করেনি। অভ্যন্তরীণ কোন্দল আন্তর্জাতিক মহলেও দেশটিকে একঘরে করে রেখেছিল। ভারসাম্য বজায় রাখতে গিয়ে হাতেগোনা দু'একটি প্রতিবেশীর সঙ্গে ভারসাম্যহীন সম্পর্ক আখেরে লাভ না ক্ষতির কারণ হয়েছে, সে হিসাব সম্ভবত সেনা শাসকরা ইতিমধ্যে কষেছেন। কমবেশি এক বছর ধরে সু চি ও তার দলের প্রতি সামরিক জান্তার মনোভাব অন্তত তা-ই নির্দেশ করে। মিয়ানমারের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে জাতিগত বিরোধেও অস্ত্রের বদলে সংলাপ বিনিময় শুরু হয়েছে। অং সান সু চিও বিরোধিতার প্রচলিত পথে না হেঁটে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। সাধারণ নির্বাচনে সুযোগ না পেয়েও উপনির্বাচনে অংশগ্রহণ তারই সর্বোচ্চ সংকেত। পার্লামেন্টে তার দলের সংখ্যালঘিষ্ঠতা সত্ত্বেও তিনি গণতান্ত্রিক সংস্কারের এই সন্ধিক্ষণে নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন। তিনিই হবেন নতুন যুগের পথনির্দেশক। আমরা আশা করি, অতীতের অন্ধকার কাটিয়ে মিয়ানমার আবার 'এশিয়ার সমৃদ্ধতম' দেশে পরিণত হবে। শ্বেতহস্তীর দেশের সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা বিশ্বের অন্যান্য দেশের জন্যও নিঃসন্দেহে শুভকর। প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য বিষয়টি আরও প্রত্যক্ষ। যে কারণে গণতান্ত্রিক উত্তরণ প্রক্রিয়ার সূচনা থেকেই বৈরী বলে পরিচিত দেশগুলো উৎসাহ প্রদর্শনে কার্পণ্য করেনি। আমরা দেখছি, মিয়ানমারের অন্যতম বৃহৎ প্রতিবেশী ভারত রাজনৈতিকভাবে সু চির সমর্থক হলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষায় বরাবরই উদ্যোগী ছিল। বাণিজ্যিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে রাজনীতির ছায়াপাত ঘটতে দেয়নি। উপনির্বাচনে অং সান সু চির বিজয়ের পরপরই ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমার সফরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। সামনের মাসগুলোতে প্রতিবেশী অন্যান্য দেশ থেকেও মিয়ানমারে রাষ্ট্রীয় সফর দেখা যাবে হয়তো। বাংলাদেশ আরও আগে থেকেই মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে জোর দিয়েছে। গত বছর ডিসেম্বরে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর রাষ্ট্রীয় সফর সে ক্ষেত্রে একই মাইলফলক হয়ে রয়েছে। দু'দেশের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল, তা সাম্প্রতিককালে আরও দৃঢ় হয়েছে। সড়ক ও রেল যোগাযোগেও খুলতে যাচ্ছে সম্ভাবনার দ্বার। দু'দেশের মধ্যকার সমুদ্রসীমা নিয়ে অস্বস্তিও ইতিমধ্যে কেটে গেছে। আমরা আশা করি, গণতান্ত্রিক মিয়ানমারের সঙ্গে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার জন্য রক্ত দেওয়া বাংলাদেশের সম্পর্ক নতুন মাত্রা পাবে। বাঙালি সংস্কৃতি ও রবীন্দ্রনাথের ভক্ত অং সান সু চির নেতৃত্বে যে নতুন যুগ সেখানে শুরু হতে যাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে সহযাত্রী হতে পারে।
No comments