আদিবাসী-আনন্দমোহন সিংহের আক্ষেপ ও বাংলাদেশ রাষ্ট্র by আবু সাঈদ খান

বাংলাদেশ একটি বহুত্ববাদী সমাজ। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, এখানে অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, মোঙ্গলীয়, আর্যসহ বিভিন্ন জনস্রোত আছড়ে পড়েছে; যার একটি মিলিত রূপ_ বাঙালি। কিন্তু এর বাইরে অর্ধশতাধিক জনগোষ্ঠী স্বতন্ত্র ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। তারাও দেশের সমমর্যাদার নাগরিক।


তাহলে কেন তাদের জাতিসত্তা, ভাষা, সংস্কৃতির স্বীকৃতির দাবি উপেক্ষিত? এই জাতিগুলোকে ব্রিটিশ আমলে 'ট্রাইব' বলা হতো। এখন বাংলায় 'উপজাতি' বলা হচ্ছে। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে গৃহীত অনুচ্ছেদ ২৩ক-তে উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য_ সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সম্মিলিতভাবে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে আসছে তারা

মার্চের উনিশ, মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জে মণিপুর ললিতকলা একাডেমীতে স্থানীয় আদিবাসী ও বাঙালিদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় মিলিত হয়েছিলাম। ওই সভায় অনেকের সঙ্গে বক্তব্য রেখেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা আনন্দমোহন সিংহ। জাতিতে তিনি মণিপুরি। অত্যন্ত আক্ষেপের সঙ্গে তিনি বললেন, হয়তো মৃত্যুর পর আমার দেহ জাতীয় পতাকা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হবে। সেটি মৃত আনন্দমোহন সিংহের জন্য এক বিরল সম্মান। কিন্তু জীবদ্দশায় আমার মর্যাদা নেই। আদিবাসী পরিচয় আজ সাংবিধানিকভাবে অস্বীকৃত।
একাত্তরে আনন্দমোহন ছিলেন টগবগে যুবক। শুধু তিনি নন, তার মতো পাহাড় ও সমতলের অনেক আদিবাসী একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। বাঙালির পাশাপাশি মণিপুরি, খাসিয়া, সাঁওতাল, গারো, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছেন। তাই স্বাধীনতা জাতি-ধর্ম, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব মানুষের মিলিত অর্জন।
একাত্তরে জনগণের আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রবিন্দু ছিল মুক্তি। আমরা পাকিস্তানি শাসন-শোষণের অবসান চেয়েছি, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লড়াই করেছি। একাত্তরে ভৌগোলিক স্বাধীনতা অর্জিত হলেও আমাদের লক্ষ্য ছিল আরও সুদূরপ্রসারী ও ব্যাপক। সেদিন আমরা অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক মুক্তির স্বপ্নও ধারণ করেছিলাম। জাতিগত-সম্প্রদায়গত শোষণ-নিপীড়নের অবসান কামনা করেছিলাম।
একাত্তরের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরোচিত হামলায় ছত্রভঙ্গ রাজনৈতিক কর্মীরা শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরেছিল। শহরগুলো যখন পাকিস্তানি হানাদারদের দখলে তখন গ্রামবাংলার কৃষকের গৃহেই মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় মিলেছিল। কৃষকের প্রতিটি গৃহ পরিণত হয় একেকটি দুর্গে। কৃষকের ঘরে কেবল আশ্রয় মেলেনি, কৃষক-মজুররা লাঙলের গুটি ছেড়ে রাইফেল হাতে যুদ্ধেও শামিল হয়। এভাবেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রূপ নেয় জনযুদ্ধে, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষ সব মানুষের যুদ্ধে।
সেদিন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও যোদ্ধাদের কাছ থেকে দেশবাসী কী শুনেছে? স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে কী বাণী ভেসে আসত? স্বাধীন বাংলাদেশে শোষণ-বঞ্চনা থাকবে না। হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-আদিবাসীর মধ্যে কোনো ভেদাভেদ থাকবে না। সবাই হবে একই দেশের সমমর্যাদার নাগরিক।
নারীরাও শুনেছে যে, স্বাধীন দেশে নারীরা গৃহকোণে বন্দি রবে না। নারী অধিকার নিশ্চিত হবে। সে স্বপ্নেই তারামন বিবিরা পুরুষের পাশে অস্ত্র হাতে লড়েছেন। সবার চোখে তখন এক সাম্যভিত্তিক, মানবিক সমাজ।
এমনই এক স্বপ্ন বুকে নিয়ে গ্রাম-শহরের মানুষ সব কষ্ট সয়েছে, সীমান্তের ওপারে এক কোটি শরণার্থী সব ক্ষুধা-যন্ত্রণা ভুলেছে। হাজার হাজার যুবক অতি সামান্য অস্ত্র হাতে পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে পাঞ্জা লড়েছে, মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে। এই কষ্ট, রক্ত, অশ্রু, ত্যাগের ফসল স্বাধীনতা।
তাই সঙ্গত কারণেই স্বাধীনতা-উত্তর দেশ পরিচালনায় মানুষের অধিকারের বিষয়টি প্রাধান্য পায়; যার প্রতিফলন রয়েছে '৭২-এ গৃহীত সংবিধানে। এতে রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা স্বীকৃত হয়। তবে একটি বড় ভুল রয়ে গিয়েছিল সে সংবিধানে। বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে আসা নেতৃত্ব, যারা একদা পাকিস্তানি আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, জাতিগত, ভাষাগত সাম্যের দাবি সমুন্নত করেছেন_ তাদের হাতে রচিত সংবিধানে সংখ্যালঘু জাতিসত্তার স্বীকৃতির দাবিটি উপেক্ষিত হয়। সবাইকে বাঙালি বানানোর এক স্বেচ্ছাচারী মনোভাবের কাছে পরিত্যক্ত হয় জাতিগত সাম্যের বাণী। তাই স্বাধীনতার একচলি্লশ বছর পরও মুক্তিযোদ্ধা আনন্দমোহন সিংহকে এ অনুভব বিদীর্ণ করে যে, স্বাধীন স্বদেশে তার পরিচয়ের স্বীকৃতিটুকু মিলল না। যে স্বপ্ন নিয়ে আনন্দমোহনের মতো আদিবাসী যুবকরা অস্ত্র ধারণ করেছিলেন তা পূরণ হয়নি এখনও।
এ কথা অস্বীকার করার জো নেই যে, বাঙালির জাতিগত অহমিকার কারণে পাহাড় ও সমতলে অনেক অঘটন ঘটেছে_ রক্ত ও অশ্রু ঝরেছে। পার্বত্য শান্তিচুক্তি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের অবসান ঘটালেও এখনও যথাযথ সাংবিধানিক স্বীকৃতি পায়নি সংখ্যালঘু জাতিসত্তার মানুষ। উপরন্তু পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে নতুন করে জাতি হিসেবে এ দেশের মানুষকে বাঙালি বলে অভিহিত করা হয়েছে। এর মানে আনন্দমোহন সিংহ তথা সব জাতিসত্তার মানুষকে বাঙালি বানানোর যে ভ্রান্ত নীতি '৭২-এ উচ্চারিত হয়েছিল, তা পুনঃপ্রতিষ্ঠারই প্রয়াস চলছে।
বাংলাদেশ একটি বহুত্ববাদী সমাজ। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, এখানে অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, মোঙ্গলীয়, আর্যসহ বিভিন্ন জনস্রোত আছড়ে পড়েছে; যার একটি মিলিত রূপ_ বাঙালি। কিন্তু এর বাইরে অর্ধশতাধিক জনগোষ্ঠী স্বতন্ত্র ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। তারাও দেশের সমমর্যাদার নাগরিক। তাহলে কেন তাদের জাতিসত্তা, ভাষা, সংস্কৃতির স্বীকৃতির দাবি উপেক্ষিত?
এই জাতিগুলোকে ব্রিটিশ আমলে 'ট্রাইব' বলা হতো। এখন বাংলায় 'উপজাতি' বলা হচ্ছে। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে গৃহীত অনুচ্ছেদ ২৩ক-তে উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য_ সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সম্মিলিতভাবে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে আসছে তারা। ইতিপূর্বে সরকারি ভাষ্যে বহুবার 'আদিবাসী' শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে 'আদিবাসী'র উল্লেখ রয়েছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেত্রী আদিবাসী দিবসে একাধিকবার বাণী দিয়েছেন। তবে সাংবিধানিক স্বীকৃতিতে বাধা কোথায়?
বলা হচ্ছে যে, এই নৃগোষ্ঠীগুলোকে আদিবাসী স্বীকৃতি দিলে বাঙালির অধিকার ও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিপন্ন হতে পারে। এই যুক্তি হাস্যকর। জনগোষ্ঠীর ৯৮% যেখানে বাঙালি, সেখানে সংখ্যালঘু জাতিসত্তার স্বীকৃতি দিলে অধিকার ক্ষুণ্ন হবে, তা মেনে নেওয়া যায় না। এখানে স্পষ্ট হওয়া দরকার, কে আগে বা পরে এসেছে_ এই বিতর্ক অবান্তর। আদিবাসী মানে দেশের আদি বাসিন্দা নয়। জাতিসংঘের আইএলও কনভেনশনের ১০৭ অনুচ্ছেদ (বাংলাদেশ কর্তৃক অনুসমর্থিত) ও ১৬৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, আদিবাসীর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে_ ক. ঐহিত্যবাহী জীবনপদ্ধতি; খ. সংস্কৃতি ও জীবনপদ্ধতিতে অন্য জাতিগুলো থেকে ভিন্নতা তথা ভাষা ও আচারে বিশিষ্টতা; গ. নিজস্ব সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান; ঘ. অন্য কেউ প্রবেশ বা অনুপ্রবেশ করার আগেই একটি স্থানে ঐতিহাসিকভাবে দীর্ঘকাল বসবাসের নজির। এ বিবেচনায় বাংলাদেশের উলি্লখিত জনগোষ্ঠীগুলোকে আদিবাসী অভিধায় স্বীকৃতি দিতে কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। বরং তাতে জাতীয় সংহতির বাতাবরণ সুসংহত হবে।
প্রসঙ্গক্রমে বলা দরকার, পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতার পাশাপাশি রাষ্ট্রধর্ম বিধান পুনরায় সংবিধানে সনি্নবেশিত হয়েছে। এটি মুক্তিযুদ্ধের মর্মবাণী তথা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সঙ্গে কতটুকু সঙ্গতিপূর্ণ? গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের মধ্যে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ থাকবে, কিন্তু রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকবে না, কোনো জাতির প্রতি পক্ষপাত থাকবে না, নারী হবে না বৈষম্যের শিকার।
এখানে উল্লেখ্য, বাংলাদেশের জনগণের সিংহভাগ হচ্ছে বাঙালি, অন্যদিকে ধর্মীয় পরিচয়ের ক্ষেত্রে সিংহভাগ মুসলিম। তাই সঙ্গতভাবে উগ্র বাঙালিত্ব ও উগ্র মুসলমানিত্বই হচ্ছে গণতান্ত্রিক ও মানবিক সমাজের জন্য বড় বাধা। এ দুই উগ্রতার যোগফল হচ্ছে বাঙালি মুসলমানদের কর্তৃত্বপরায়ণতা। এর প্রকাশ আমরা পঞ্চদশ সংশোধনী গ্রহণকালে দেখেছি। যে মনোভাব থেকে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম বিধান পুনঃস্থাপিত হয়েছে, সেই একই মনোভাব থেকেই খর্বিত হয়েছে আদিবাসীদের অধিকার।
স্বাধীনতা-উত্তরকালের এ প্রবণতা উঁকি দিয়েছিল, তবে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে বাঙালি মুসলমানের কর্তৃত্বপরায়ণ মানসিকতা আরও উন্মোচিত হয়েছে। জিয়ার ফরমানে সংবিধানে 'বিসমিল্লাহ' এবং 'সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস' মূল রাষ্ট্রীয় নীতিতে সংযোজন এবং এরশাদের নির্দেশে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করার পেছনে বাঙালি মুসলমানের কর্তৃত্ববাদ যে কাজ করেছে_ তা অস্বীকার করার জো নেই। বিএনপি-জাতীয় পার্টি সেই রাজনীতিরই ধারক। পঞ্চদশ সংশোধনীর পর প্রমাণ হলো যে, এক সময়ের অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারক আওয়ামী লীগও এই রাজনীতির বাইরে নয়।
মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ চিহ্নিত, সরাসরি এ রাজনীতিকে মোকাবেলা করা সম্ভব; কিন্তু জাতীয়তাবাদী বা ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির অভ্যন্তরে এই ভ্রান্তি বাসা বাঁধলে তা দূর করা সহজ নয়!
এ প্রসঙ্গে বলা হচ্ছে, এটি নাকি কৌশল। রাজনীতিতে কৌশল আছে; কিন্তু কৌশলের কথা বলে নীতি পরিহার করার অবকাশ নেই। বাস্তবে যা অনুসৃত হচ্ছে, সেটি কৌশল নয়, বরং সুবিধাবাদের নামান্তর। আর এই সুবিধাবাদ গণতন্ত্র ও সংখ্যালঘু অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেই কেবল নয়, জাতীয় সংহতি রচনার ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধক।
আমরা সেই রাষ্ট্র চাই, যেখানে মুক্তিযোদ্ধা আনন্দমোহন সিংহকে এমন আক্ষেপ করতে হবে না, সন্তু লারমাকে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের জন্য আর ফরিয়াদ জানাতে হবে না। রাষ্ট্র হবে একাত্তরের আকাঙ্ক্ষায় জাতি-ধর্ম-লিঙ্গ নির্বিশেষ সব মানুষের। একাত্তরে আমরা শোষণহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছি, মানুষের ভেদাভেদ ঘোচাতে চেয়েছি, সেই কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র ছাড়া স্বাধীনতা অর্থহীন।

আবু সাঈদ খান :সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com

No comments

Powered by Blogger.