বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৪৮৭ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। সাইদুল হক, বীর প্রতীক বীর যোদ্ধা সাহসী যোদ্ধা ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তসংলগ্ন কসবা রেলস্টেশন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অন্তর্গত। সীমান্ত এলাকা হওয়ায় কসবায় ১৯৭১ সালে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্যাপক তৎপরতা।


মুক্তিযুদ্ধকালে এখানে অসংখ্য যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২৩ অক্টোবর সাইদুল হকসহ একদল মুক্তিযোদ্ধা সেখানে আক্রমণ করেন।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখার জন্য একপর্যায়ে কসবা রেলস্টেশনে দুর্ভেদ্য ঘাঁটি তৈরি করে। স্টেশন এলাকার চারদিকে ছিল মাইনফিল্ড। এ ছাড়া ছিল পর্যবেক্ষণ পোস্ট। রাতে সাইদুল হক ও তাঁর সহযোদ্ধারা সীমান্ত অতিক্রম করে নিঃশব্দে সেখানে অবস্থান নেন। তারপর নির্দিষ্ট সময়ে ক্ষিপ্রগতিতে এগিয়ে যান। মাইনফিল্ডের কারণে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। এতে তাঁরা দমে যাননি বা মনোবল হারাননি।
সব বাধা উপেক্ষা করে সাহসিকতার সঙ্গে সাইদুল হকেরা প্রচণ্ড আক্রমণ করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীও প্রতিরোধ শুরু করে। গোলাগুলিতে রাতের আকাশ লাল হয়ে ওঠে। তুমুল যুদ্ধ চলতে থাকে। শত্রুসেনাদের ওপর তাঁরা বিপুল বিক্রমে চড়াও হন। তাঁদের বিক্রমে পাকিস্তানি সেনারা কোণঠাসা হয়ে পড়ে এবং একপর্যায়ে তারা কসবার পুরান বাজারের দিকে পালিয়ে যায়। সেখানে একটি মাঠে (বর্তমানে টি আলী কলেজ) তারা অবস্থান নেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে কসবা রেলস্টেশন।
২৫ অক্টোবর পাকিস্তানি সেনারা নতুন শক্তি সঞ্চয় করে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর পাল্টা আক্রমণ চালায়। সাইদুল হক ও তাঁর সহযোদ্ধারা এমন আক্রমণের জন্য প্রস্তুতই ছিলেন। সাহসিকতার সঙ্গে তাঁরা পাল্টা আক্রমণ মোকাবিলা করতে থাকেন। দুই পক্ষে তুমুল যুদ্ধের একপর্যায়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ছোড়া একটি শেল বিস্ফোরিত হয় সাইদুল হকের পাশে। বিস্ফোরিত শেলের কয়েকটি ছোট-বড় স্প্লিন্টার আঘাত করে তাঁর শরীরে। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি।
স্প্লিন্টারের আঘাতে সাইদুল হকের বাঁ পায়ের বিরাট অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। একটু পর সহযোদ্ধারা রক্তাক্ত অবস্থায় তাঁকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। তখনো তাঁর জ্ঞান ছিল। এরপর জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। সহযোদ্ধারা তাঁকে ফিল্ড চিকিৎসাকেন্দ্রে পাঠান। প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তাঁকে পাঠানো হয় আগরতলায়। সেখানে চিকিৎসা চলা অবস্থায় তাঁর অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে হেলিকপ্টারে পাঠানো হয় ভারতের উত্তর প্রদেশে। এখানে চিকিৎসা চলাকালে দেশ স্বাধীন হয়ে যায়।
সাইদুল হক চাকরি করতেন ইপিআরে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন সিলেট ইপিআর সেক্টরের অধীনে। তাঁর পদবি ছিল নায়েক। তিনি তখন তাঁর উইংয়ে (বর্তমানে ব্যাটালিয়ন) কর্মরত একজন পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তার দেহরক্ষী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে যান। পরে তিনি নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধীনে যুদ্ধ করেন। তাঁকে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি কোম্পানিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কসবাসহ আরও কয়েক স্থানে তিনি সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে বিশেষত কসবার যুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য সাইদুল হককে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী, তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ২১৩।
সাইদুল হক স্বাধীনতার কয়েক মাস পর সুস্থ হয়ে ভারত থেকে দেশে ফিরে আগের কর্মস্থল বিডিআরে (১৯৭১ সালে ইপিআর, বর্তমানে বিজিবি) যোগ দেন। সিলেট সেক্টর থেকে নায়েক হিসেবেই ১৯৯০ সালে অবসর নেন। তাঁকে পদোন্নতি দেওয়া হয়নি। বর্তমানে অবসর জীবনযাপন করছেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সদর উপজেলার ঘাটিয়ারা গ্রামের পশ্চিম পাড়ায়। বাবার নাম মমিনুল হক ভূঁইয়া। মা হাজেরা বেগম। স্ত্রী রওশন আরা বেগম। তাঁদের চার মেয়ে ও দুই ছেলে।
সূত্র: প্রথম আলোর আখাউড়া (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি দুলাল ঘোষ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ২।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.