শ্রদ্ধাঞ্জলি- বেলার কবি এই অবেলায় by ফারুক ওয়াসিফ
এটা কি কবির মহিমা না ট্র্যাজেডি যে নিজের সমাধিলিপি তাঁকেই লিখতে হয়? ‘আমাকে যেতেই হবে যদি, তবে আমি যীশুর মতন নগ্ন পদে চলে যেতে চাই।’ বাংলাদেশের কবিতার আধুনিকতা আর রাজনৈতিক স্বাধীনতার চেতনা হরিহর আত্মা হয়ে উঠেছিল শামসুর রাহমানের মধ্যে। তাঁর কবিতার ধারাবাহিক বিকাশ আর বাংলাদেশের রাজনৈতিক জীবনী যেন সমান্তরালভাবে বয়ে গেছে। তিনি বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের উত্থানবেলার কাব্যিক প্রতিনিধি।
বাংলাদেশের কাব্য ও বিদ্রোহের পরম্পরাকে ধারণ করে নিয়েছিলেন শামসুর রাহমান।
ষাটের দশকেই শুরু হয় তাঁর কবি-প্রতিষ্ঠার যাত্রা। প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে বলে তিনি শুরু করেছিলেন। এমন করে বলা আজ চল হিসেবে চালু। কিন্তু তাঁর সময়ের শুরুতে এটা নতুনই ছিল। তিনি বাংলা কবিতাকে ব্যক্তিমনের নিজস্ব অনুভবে রঞ্জিত করা শুরু করলেন। তরুণ শামসুর রাহমান ষাটের দশক থেকেই মধ্যবিত্ত জীবনের আনন্দ আর বিষাদের রূপকার হয়ে উঠতে থাকেন। আধুনিক নাগরিক আবহে পুষ্ট তাঁর কবিতা। ঢাকা নগরের অন্তরাত্মাও যেন তাঁর মধ্য দিয়ে কথা বলে ওঠে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী হয়েও এই কবিই কিনা, তাঁর সময়ের সব রাজনৈতিক আলোড়নে সাড়া দেন। কেবল বাংলাদেশের কবিতাতেই নয়, উভয় বাংলার কবিতায় তিনি একলাই এক স্তম্ভ। শামসুর রাহমান আর আল মাহমুদ মিলিয়ে বাংলাদেশের নতুন কবিতা এখনো কেশবতীর দুটি বেণির মতোই দুই ধারায় প্রবাহিত। একজন যেন অন্যজনের প্রতিস্বর।
শামসুর রাহমান নজরুলের মতোই রোমান্টিক, কিন্তু অতটা উচ্ছ্বসিত নন। তিনি জীবনানন্দ দাশের মতোই আলাদা, কিন্তু অতটা সামগ্রিকতাবাদী নন। তাঁর কবিতা ব্যক্তিমনের নির্জন প্রদেশে উঁকি দেয়, আবার জনসভায়ও সাবলীল। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান তার চেতনার মধ্যে নতুন উদ্দীপনা সঞ্চার করে। সেই অভ্যুত্থানের শহীদ আসাদকে নিয়ে লেখেন ‘আসাদের শার্ট’ কবিতা। ‘গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো, কিংবা সূর্যাস্তের/ জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট/ উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায়...আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা।’ ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় অবরুদ্ধ বাংলাদেশে বসে তিনি লেখেন তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ দুটি কবিতা, ‘স্বাধীনতা তুমি’ এবং ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’। সেই কবিতাগুলো আজ স্বাধীনতার ইতিহাসের অংশ। এ রকম করে দিনে দিনে লিখেছেন, ‘ফিরিয়ে দাও ঘাতক কাঁটা/ এবার আমি গোলাপ নেব’। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে নূর হোসেন শহীদ হওয়ার পরে লিখলেন, ‘বাংলাদেশ বনপোড়া হরিণীর মতো আর্তনাদ করে’। আমাদের একেকটি রাজনৈতিক যুগ ভাষার খোঁজে বারবার শামসুর রাহমানের আশ্রয় নিয়েছে। একজন কবির জন্য এ এক বিরাট প্রাপ্তি।
বাংলাদেশের জাতীয় জীবনের সব বাঁক ও মোড় ফেরায় শামসুর রাহমান সাড়া দিয়েছেন সপ্রাণতার সঙ্গে। তাঁকে ততটা রাজনৈতিকভাবে দায়বদ্ধ কবি ভাবা হয় না। অথচ কবিতার সঙ্গে রাজনীতির এ রকম অকপট যোগাযোগে তিনিই দিশারি। তাঁর কবিতার রোমান্টিক শরীরের মধ্যে সংগ্রামী মেজাজের এক উষ্ণ ধমনি সর্বদাই প্রবাহিত ছিল। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন ও গণ-আদালত গঠনের উদ্যোগে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।
তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ৬৬। গদ্য-পদ্য মিলিয়ে তাঁর মোট গ্রন্থের সংখ্যা এক শ ছুঁই ছুঁই। তাঁর প্রথম গ্রন্থ প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে। এরপর উল্লেখযোগ্য হচ্ছে রৌদ্রকরোটিতে, নিরালোকে দিব্যরথ, বিধ্বস্ত নীলিমা, বন্দি শিবির থেকে, ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা, ইকারুসের আকাশ, উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ প্রভৃতি গ্রন্থ। বেশ কিছু কিশোরপাঠ্য গ্রন্থেরও রচয়িতা তিনি।
কবি শামসুর রাহমানের জন্ম ১৯২৯ সালে, ঢাকার মাহুতটুলীতে। বাল্যকাল থেকে প্রবীণ বয়স পর্যন্ত থেকেছেন পুরান ঢাকার অশোক লেনের পৈতৃক গৃহে। পেশাগত জীবনের শুরু ১৯৫৭ সালে দ্য মর্নিং নিউজ-এ সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে। দীর্ঘ সময় একই পেশায় কাটিয়েছেন। সম্পাদনা করেছেন জাতীয় দৈনিক দৈনিক বাংলা। সাহিত্যে কৃতিত্বের স্বীকৃতিতে পেয়েছেন আদমজী পুরস্কার (১৯৬৩), বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬৯), একুশে পদক (১৯৭৭) এবং স্বাধীনতা দিবস পদক (১৯৯১)। ভারতের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি সম্মানসূচক ডি লিট উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। ইংরেজিসহ একাধিক বিদেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর কবিতা। আধুনিক বাংলা কবিতাকে পাঠকপ্রিয়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর রয়েছে বিশাল ভূমিকা।
আমৃত্যু তিনি ছিলেন কবি, আমৃত্যু তিনি ছিলেন দায়বদ্ধ এক নাগরিক। এই সরব ভূমিকার কারণে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী শক্তি একাধিকবার তাঁকে হত্যার চেষ্টা করেছে।
আজ কবি শামসুর রাহমানের ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি লিখেছিলেন, ‘কেউ কি এখন এই অবেলায় আমার দিকে বাড়িয়ে দেবে হাত’। আধুনিক বাংলাদেশের কবিতার ধারার একদিকে তিনি, অন্যদিকটা সামনের দিকে খুলে দিচ্ছে। হাত বাড়ানোই আছে; ধরবার জন্য তিনি আর জেগে নেই।
ফারুক ওয়াসিফ
farukwasif@yahoo.com
ষাটের দশকেই শুরু হয় তাঁর কবি-প্রতিষ্ঠার যাত্রা। প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে বলে তিনি শুরু করেছিলেন। এমন করে বলা আজ চল হিসেবে চালু। কিন্তু তাঁর সময়ের শুরুতে এটা নতুনই ছিল। তিনি বাংলা কবিতাকে ব্যক্তিমনের নিজস্ব অনুভবে রঞ্জিত করা শুরু করলেন। তরুণ শামসুর রাহমান ষাটের দশক থেকেই মধ্যবিত্ত জীবনের আনন্দ আর বিষাদের রূপকার হয়ে উঠতে থাকেন। আধুনিক নাগরিক আবহে পুষ্ট তাঁর কবিতা। ঢাকা নগরের অন্তরাত্মাও যেন তাঁর মধ্য দিয়ে কথা বলে ওঠে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী হয়েও এই কবিই কিনা, তাঁর সময়ের সব রাজনৈতিক আলোড়নে সাড়া দেন। কেবল বাংলাদেশের কবিতাতেই নয়, উভয় বাংলার কবিতায় তিনি একলাই এক স্তম্ভ। শামসুর রাহমান আর আল মাহমুদ মিলিয়ে বাংলাদেশের নতুন কবিতা এখনো কেশবতীর দুটি বেণির মতোই দুই ধারায় প্রবাহিত। একজন যেন অন্যজনের প্রতিস্বর।
শামসুর রাহমান নজরুলের মতোই রোমান্টিক, কিন্তু অতটা উচ্ছ্বসিত নন। তিনি জীবনানন্দ দাশের মতোই আলাদা, কিন্তু অতটা সামগ্রিকতাবাদী নন। তাঁর কবিতা ব্যক্তিমনের নির্জন প্রদেশে উঁকি দেয়, আবার জনসভায়ও সাবলীল। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান তার চেতনার মধ্যে নতুন উদ্দীপনা সঞ্চার করে। সেই অভ্যুত্থানের শহীদ আসাদকে নিয়ে লেখেন ‘আসাদের শার্ট’ কবিতা। ‘গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো, কিংবা সূর্যাস্তের/ জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট/ উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায়...আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা।’ ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় অবরুদ্ধ বাংলাদেশে বসে তিনি লেখেন তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ দুটি কবিতা, ‘স্বাধীনতা তুমি’ এবং ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’। সেই কবিতাগুলো আজ স্বাধীনতার ইতিহাসের অংশ। এ রকম করে দিনে দিনে লিখেছেন, ‘ফিরিয়ে দাও ঘাতক কাঁটা/ এবার আমি গোলাপ নেব’। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে নূর হোসেন শহীদ হওয়ার পরে লিখলেন, ‘বাংলাদেশ বনপোড়া হরিণীর মতো আর্তনাদ করে’। আমাদের একেকটি রাজনৈতিক যুগ ভাষার খোঁজে বারবার শামসুর রাহমানের আশ্রয় নিয়েছে। একজন কবির জন্য এ এক বিরাট প্রাপ্তি।
বাংলাদেশের জাতীয় জীবনের সব বাঁক ও মোড় ফেরায় শামসুর রাহমান সাড়া দিয়েছেন সপ্রাণতার সঙ্গে। তাঁকে ততটা রাজনৈতিকভাবে দায়বদ্ধ কবি ভাবা হয় না। অথচ কবিতার সঙ্গে রাজনীতির এ রকম অকপট যোগাযোগে তিনিই দিশারি। তাঁর কবিতার রোমান্টিক শরীরের মধ্যে সংগ্রামী মেজাজের এক উষ্ণ ধমনি সর্বদাই প্রবাহিত ছিল। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন ও গণ-আদালত গঠনের উদ্যোগে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।
তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ৬৬। গদ্য-পদ্য মিলিয়ে তাঁর মোট গ্রন্থের সংখ্যা এক শ ছুঁই ছুঁই। তাঁর প্রথম গ্রন্থ প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে। এরপর উল্লেখযোগ্য হচ্ছে রৌদ্রকরোটিতে, নিরালোকে দিব্যরথ, বিধ্বস্ত নীলিমা, বন্দি শিবির থেকে, ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা, ইকারুসের আকাশ, উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ প্রভৃতি গ্রন্থ। বেশ কিছু কিশোরপাঠ্য গ্রন্থেরও রচয়িতা তিনি।
কবি শামসুর রাহমানের জন্ম ১৯২৯ সালে, ঢাকার মাহুতটুলীতে। বাল্যকাল থেকে প্রবীণ বয়স পর্যন্ত থেকেছেন পুরান ঢাকার অশোক লেনের পৈতৃক গৃহে। পেশাগত জীবনের শুরু ১৯৫৭ সালে দ্য মর্নিং নিউজ-এ সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে। দীর্ঘ সময় একই পেশায় কাটিয়েছেন। সম্পাদনা করেছেন জাতীয় দৈনিক দৈনিক বাংলা। সাহিত্যে কৃতিত্বের স্বীকৃতিতে পেয়েছেন আদমজী পুরস্কার (১৯৬৩), বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬৯), একুশে পদক (১৯৭৭) এবং স্বাধীনতা দিবস পদক (১৯৯১)। ভারতের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি সম্মানসূচক ডি লিট উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। ইংরেজিসহ একাধিক বিদেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর কবিতা। আধুনিক বাংলা কবিতাকে পাঠকপ্রিয়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর রয়েছে বিশাল ভূমিকা।
আমৃত্যু তিনি ছিলেন কবি, আমৃত্যু তিনি ছিলেন দায়বদ্ধ এক নাগরিক। এই সরব ভূমিকার কারণে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী শক্তি একাধিকবার তাঁকে হত্যার চেষ্টা করেছে।
আজ কবি শামসুর রাহমানের ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি লিখেছিলেন, ‘কেউ কি এখন এই অবেলায় আমার দিকে বাড়িয়ে দেবে হাত’। আধুনিক বাংলাদেশের কবিতার ধারার একদিকে তিনি, অন্যদিকটা সামনের দিকে খুলে দিচ্ছে। হাত বাড়ানোই আছে; ধরবার জন্য তিনি আর জেগে নেই।
ফারুক ওয়াসিফ
farukwasif@yahoo.com
No comments