ধর্ম- ‘জুমাতুল বিদা’ রমজানের বিদায়বার্তা by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

মাহে রমজানের বিদায়বার্তা প্রকাশক শুক্রবার তথা শেষ জুমার দিন মুসলিম বিশ্বে জুমাতুল বিদা নামে পরিচিত। এই জুমার দিনটি রমজান মাসের শেষ জুমা হিসেবে পালিত হওয়ায় এর গুরুত্ব, তাৎপর্য ও মাহাত্ম্য অপরিসীম। জুমার নামাজ মুসলমানদের বৃহত্তর জামাতে অনুষ্ঠিত হয়। দিন হিসেবে জুমাবার বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।


আর এই জুমাবার যদি হয় পবিত্র রমজান মাসে, তবে তা আরও বেশি ফজিলতময়। তাই জুমাতুল বিদাসহ মাহে রমজানের প্রত্যেক জুমাবারে ইবাদত-বন্দেগিতে অধিক সওয়াব লাভের সুযোগ থাকে। রমজান মাসের শেষ শুক্রবার হিসেবে সারা বিশ্বের মুসলমানরা জুমার নামাজ আদায় করেন। ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা একটি মাস ত্যাগ-তিতিক্ষার সঙ্গে সিয়াম সাধনা বা রোজা রাখার পর এই দিনটিতে জুমার নামাজ আদায় করে মাহে রমজানকে বিদায় জানান। মসজিদে মসজিদে ধর্মীয় নেতা বা ইমাম-খতিবগণ ‘আল-বিদা, ইয়া শাহরু রামাদান’ অর্থাৎ ‘শুভ বিদায়’ বলে বিশেষ খুতবা দেন।
জুমা ফরজে আইন বা অবশ্যকরণীয়। তাই জুমার নামাজের ওয়াক্ত হলে মসজিদের দিকে অবশ্যই ধাবিত হওয়া উচিত। মাহে রমজান সংযমের মাস। আর এই সংযমের একটি পরীক্ষা হয় জুমাতুল বিদার জামাতে। কেননা, এই দিন মসজিদে অধিকসংখ্যক ধর্মপ্রাণ মুসল্লির আগমন হয়। এ সময় নিজেকে সংযত, সংকুচিত করে অপর মুসলমান ভাইকে স্থান ছেড়ে দেওয়া হলো সংযমের পরিচয়। তাই রমজানের শেষ জুমার নামাজটি সহিষ্ণুতার ক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। যদিও সব ফরজ নামাজ জামাতের সঙ্গে সমানভাবে আদায় করা অত্যাবশ্যক, তথাপি পবিত্র কোরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন শুক্রবারের জুমার নামাজের গুরুত্ব সম্পর্কে বিশেষভাবে নির্দেশ দিয়েছেন এবং সব মুসলমানকে এদিন একত্র হয়ে জুমার নামাজ আদায়ের তাগিদ প্রদান করে ঘোষণা করেছেন, ‘হে বিশ্বাসীরা, জুমার দিনে যখন নামাজের জন্য আহ্বান করা হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণে ধাবিত হও এবং ক্রয়-বিক্রয় ত্যাগ করো। তোমরা যদি উপলব্ধি কর, তাহলে এটাই তোমাদের জন্য অতি উত্তম।’ (সূরা আল-জুমা, আয়াত-৯)
অন্যান্য নামাজ বিশেষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে একাকী আদায় করা যেতে পারে, কিন্তু জুমার নামাজ অপরিহার্যভাবে জামাতের সঙ্গে আদায় করা আবশ্যক বিধায় একাকী আদায় করার বিধান নেই। তাই জুমাতুল বিদা হচ্ছে অত্যাবশ্যকীয় নামাজ। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন দিন ও রাত সৃষ্টি করেছেন। এসব দিন-রাতের মধ্যে তিনি কয়েকটি পুণ্যময় দিন ও রাতকে মানুষের জন্য বিশেষভাবে মর্যাদাবান করেছেন। এই রমজান মাসের সর্বোত্তম রজনী হলো লাইলাতুল কদর। আর সর্বোত্তম দিবস হলো শেষ শুক্রবার তথা জুমাতুল বিদা। জুমাতুল বিদা মহিমান্বিত দিনগুলোর মধ্যে একটি, যা পবিত্র রমজান মাসের পরিসমাপ্তিসূচক শেষ শুক্রবার পালিত হয়। এদিন মুমিন মুসলমানদের ইমানি সম্মিলন হয়। এই দিনে এমন একটি সময় আছে, যে সময় মুমিন বান্দার মোনাজাত ও ইবাদত আল্লাহ তাআলা বিশেষভাবে কবুল করেন। এই সময়টি হলো দ্বিতীয় খুতবার আজানের সময় থেকে সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত। রমজান মাস হলো আল্লাহর কাছে গুনাহখাতা মাফের মাস।
জুমাতুল বিদার দিন পূর্বাহ্নে আমাদের কিছু করণীয় রয়েছে। তা হলো, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও পূত-পবিত্র হয়ে মসজিদে জামাতে যোগদানের জন্য তৈরি হওয়া। এদিন গোসল করা সুন্নাত। জুমার দিন গোসল না করে মসজিদে যাওয়া নবী করিম (সা.) অপছন্দ করতেন। জুমার সুন্নাত কাজগুলো হলো মাথায় তেল দেওয়া, চোখে সুরমা দেওয়া এবং আতর বা সুগন্ধি ব্যবহার করা। ভালো জামা-কাপড় পরিধান করে জুমার আজানের আগেই মসজিদে সমবেত হয়ে আজানের জন্য অপেক্ষা করা এবং আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করা। জুমার দিনের শ্রেষ্ঠত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘সপ্তাহের সাত দিনের মধ্যে জুমাবার সর্বাধিক মর্যাদাবান ও নেতৃস্থানীয় দিন। এই পুণ্যদিনে আমাদের আদি পিতা হজরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করা হয়। এই দিনে তিনি জান্নাতে প্রবেশ করেন। এই দিনে তিনি পুনরায় পৃথিবীতে আগমন করেন। এই দিনে তাঁর ইন্তেকাল হয়। এই শুক্রবারেই কিয়ামত সংঘটিত হবে। এই পুণ্যদিনে এমন একটি সময় রয়েছে, যে সময় আল্লাহর দরবারে দোয়া কবুল হয়।’ (মিশকাত)
মুসলমানদের জন্য শুক্রবার সপ্তাহের সর্বশ্রেষ্ঠ ও পবিত্র দিন। আর জুমার দিনের ফজিলত ও মর্যাদা অন্যান্য দিনের চেয়ে অনেক বেশি। তদুপরি মাহে রমজানে জুমার নামাজ, বিশেষ করে শেষ জুমা বা জুমাতুল বিদার সওয়াব অনেক বেশি। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, ‘যারা জুমার নামাজ পড়ার জন্য পায়ে হেঁটে (মসজিদে) যায়, তাদের প্রতি কদমের জন্য এক বছর ধরে নফল রোজা রাখার সওয়াব দেওয়া হবে।’ (তিরমিযি) নবী করিম (সা.) শুক্রবার পবিত্র জুমার দিনের মাহাত্ম্য ও মর্যাদা সম্পর্কে বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি জুমার দিন মৃত্যুবরণ করবে, তার কবর-আজাব মাফ হয়ে যাবে এবং সে একজন শহীদের সওয়াব পাবে।’
মাহে রমজানের সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিনটি হলো জুমাতুল বিদা। যে তিনটি বিষয় জুমাতুল বিদাকে আল্লাহর করুণা, দয়া, ক্ষমা তথা মাগফিরাত ও নাজাত লাভের দিবস হিসেবে চিহ্নিত করেছে, তা হচ্ছে—মাহে রমজান, জুমাতুল বিদা এবং রমজান মাসের শেষ শুক্রবার। এতে জুমাতুল বিদা নামাজের জন্য ধর্মপ্রাণ রোজাদারদের কাছে এদিনের মর্যাদা বেশি গুরুত্বপূর্ণ নিঃসন্দেহে। তাই রমজান মাসের বিদায়ী শুক্রবার ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জন্য অতি মূল্যবান। এদিন মাহে রমজান শেষ হয়ে যাওয়ার সতর্কতামূলক দিবস। জুমাতুল বিদা রোজাদারদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, রমজানের সমাপনান্তে এ বছর এর চেয়ে ভালো দিবস আর পাওয়া যাবে না। সুতরাং এই পুণ্যময় দিনটির যথাযথ সদ্ব্যবহার করা অপরিহার্য কর্তব্য।
তাই রমজান মাসের সমাপনীসূচক জুমাতুল বিদার নামাজে মসজিদে মসজিদে বিশেষ মোনাজাতে রোজাদার মুসল্লিরা দেশ-জাতির উন্নয়ন ও অগ্রগতি এবং মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, সংহতি, শান্তি ও কল্যাণের জন্য আল্লাহর দরবারে পরম ভক্তি ও আন্তরিকতা সহকারে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। মসজিদে ইতিকাফ ছাড়াও এই দিনটি ইবাদত-বন্দেগি তথা পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত, নামাজ, দোয়া-ইস্তেগফার, তাসবিহ-তাহলিল, জিকির-আজকার ও দরুদ শরিফ পাঠ করার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করা উচিত।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.