দেরিতে চলছে ট্রেন-বাস by পার্থ সারথি দাস
প্লাটফর্ম থেকে ছুটে এসে যাত্রীরা জিজ্ঞেস করছে- কোনো খবর আছে? যাত্রীদের এ উদ্বিগ্নতার মধ্যে রেলস্টেশনের ব্যবস্থাপকের কক্ষে রেলওয়ের একজন প্রকৌশলী চিৎকার করেই চলেছেন। কাছে যাওয়ার আগেই শোনা গেল টেলিফোনে তিনি বলছেন, 'রিলিফ ট্রেইন সব সময় ঠিক রাখবা।
পাওয়ার ফেইল করছে ক্যান? এইখানে প্যাসেঞ্জার গেদারিং করতাছে। তাড়াতাড়ি করো।' স্টেশন ব্যবস্থাপক খায়রুল বশির পাশেই ছিলেন। তাঁর কাছে থেকে জানা গেল, সিল্কসিটি ট্রেনটি উল্লাপাড়ায় আটকে আছে ইঞ্জিন বিকল হয়ে। ঘড়িতে তখন দুপুর দেড়টা। অথচ ওই সময় সিল্কসিটির কমলাপুর রেলস্টেশনে অবস্থানের কথা। সন্ধ্যা সোয়া ৬টায়ও সিল্কসিটি কমলাপুরে এসে পৌঁছাতে পারেনি। তখন এটি ছিল জয়দেবপুর স্টেশনের আশপাশে।
সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে মালপত্র নিয়ে সকাল ৮টা থেকে অপেক্ষা করছেন নায়না বেগম। সঙ্গে দুই ছেলে সিয়াম ও সায়েম। যাবেন চট্টগ্রাম। বাস এলে টিকিট দেওয়া হবে বলে বিভিন্ন কাউন্টার থেকে বলছে; কিন্তু টিকিট পাচ্ছেন না। দুপুরে নায়না জানতে পারেন, ওই মহাসড়কে যানজট লেগে আছে।
রাজধানী থেকে ঘরে ফেরা মানুষের ভিড় বাড়ছে কমলাপুর ও বিমানবন্দর রেলস্টেশন, সায়েদাবাদ ও অন্য দুটি বড় বাস টার্মিনালে। ট্রেনের সময়সূচি ঠিক থাকছে না, মহাসড়কে যানজট লেগেই আছে, তাই যাত্রার শুরুতেই দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে যাত্রীদের।
গতকাল ঢাকা ও এর আশপাশের বিভিন্ন রেলস্টেশনে হাজার হাজার যাত্রী চরম দুর্ভোগে পড়ে। কোনো কোনো রুটের যাত্রীকে সাড়ে চার ঘণ্টাও অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে স্টেশনে। আবার টিকিট থাকার পরও কোচ সংকট ও ভিড়ের কারণে অনেকে নির্দিষ্ট ট্রেনে উঠতে পারেনি। কমলাপুর রেলস্টেশনে দুপুর ১টার দিকে প্রায় উদ্ভ্রান্তের মতো অবস্থা ছিল আহসান হাবিবের। মহাখালীর বাসিন্দা আহসান রাজশাহী যাওয়ার জন্য সিল্কসিটির শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত চেয়ার কোচের দুটি টিকিট কিনেছিলেন ৭ আগস্ট। এ জন্য তাঁকে লাইনে দাঁড়াতে হয়েছিল ১৩ ঘণ্টা। ট্রেনটিতে ওঠার জন্য স্টেশনে এসে তিনি জানতে পারেন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত চেয়ার সিটের টিকিট বাতিল করতে হবে। কোচ সংকটের কারণে দুটি কোচের শতাধিক যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব হবে না। আহসান টিকিট বদলে শোভন চেয়ারের দুটি টিকিট নিতে কাউন্টারে যান। কিন্তু তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে টিকিট ছাড়াই। স্টেশন ব্যবস্থাপকের কক্ষে এসে আহসান কর্মকর্তাদের কাছে ধরনা দিচ্ছেন; কিন্তু কেউ উপায় বলে দিচ্ছেন না। আহসান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এখন কিভাবে যাব?' এ সময় রেলওয়ের অপারেশন বিভাগের যুগ্ম পরিচালক মিয়াজান পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এ বিষয়ে জানান, দুর্ঘটনার কারণে বগি নষ্ট হয়েছে।
গতকাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কমলাপুর রেলস্টেশনে যাত্রীদের বিড়ম্বনা ছিল অবর্ণনীয়। সকাল ১০টায় স্টেশনে গিয়ে জানা গেল, ধূমকেতু ট্রেনের যাত্রীরা অপেক্ষায় আছে। অথচ ট্রেনটি ছাড়ছে না। এ সময় অপেক্ষারত যাত্রী নায়না হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সময়মতো ট্রেন ধরতে ভোরেই স্টেশনে এসেছি। তিন ছেলে আর মালপত্র নিয়ে স্টেশনের এখান থেকে ওখানে যাচ্ছি। কেউ কিছু বলতে পারছে না।' রাজশাহীর উদ্দেশে সকাল ৬টায় কমলাপুর ছেড়ে যাওয়ার নির্ধারিত সময় ছিল ধূমকেতু এক্সপ্রেসের। এটি ছেড়ে যায় সকাল ১০টা ২৫ মিনিটে। রেলওয়ের বিভাগীয় নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, পাঁচ ঘণ্টা পাঁচ মিনিট বিলম্বে ট্রেনটি কমলাপুর রেলস্টেশনে আসে। এরপর ইঞ্জিন লাগানোসহ আনুষঙ্গিক কাজের জন্য ছাড়তে এত দেরি হয়।
ট্রেনের সময়সূচি নেই : নিয়ন্ত্রণ কক্ষের দেওয়া তথ্য থেকে জানা গেছে, সকাল ৬টা ১০ মিনিটে খুলনার উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়ার নির্ধারিত সময় ছিল সুন্দরবন এক্সপ্রেসের। এটি ছাড়ে তিন ঘণ্টা ২৫ মিনিট দেরিতে। এ ট্রেনটিও কমলাপুরে তিন ঘণ্টা পাঁচ মিনিট দেরিতে ঢুকেছিল। ধূমকেতু ও সুন্দরবন ছাড়াও মহানগর প্রভাতী আধঘণ্টা, এগারসিন্ধুর ১৫ মিনিট, নীলসাগর দুই ঘণ্টা, রংপুর এক্সপ্রেস সাড়ে তিন ঘণ্টা, অগ্নিবীণা দেড় ঘণ্টা, একতা এক ঘণ্টা ৫৫ মিনিট দেরিতে ছেড়ে যায়। গতকাল বেলা ৩টার দিকে সিলেটের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়ার জন্য প্লাটফর্মে দাঁড়িয়েছিল কালনী এক্সপ্রেস। কিন্তু এটি ছেড়ে যায় ৪০ মিনিট দেরিতে। চট্টগ্রামের উদ্দেশে মহানগর গোধূলির যাওয়ার নির্ধারিত সময় ছিল ৪টা ৪০ মিনিট। এটি ছয় মিনিট দেরিতে ছেড়ে যায়। চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে ৩টা ২০ মিনিটে ছাড়ার কথা ছিল সুবর্ণ এক্সপ্রেসের, এটি যায় পাঁচ মিনিট দেরিতে।
সিল্কসিটি কখন আসবে- জানতে চাইলে জবাবে রেলওয়ের পাকশী বিভাগের সহকারী পরিবহন কর্মকর্তা এ এইচ এম আকরামুল হক কালের কণ্ঠকে জানান, সন্ধ্যা ৭টার পর ট্রেনটি কমলাপুর পৌঁছাবে বলে তিনি আশা করছেন। এর অর্থ এটি পাঁচ ঘণ্টা দেরিতে কমলাপুর পৌঁছাবে। ইঞ্জিনের ত্রুটির কারণে উল্লাপাড়ায় ট্রেনটি থেমে ছিল সোয়া দুই ঘণ্টা। এরপর জোড়াতালি দিয়ে ট্রেনটি ছাড়া হয়। ৯০ কিলোমিটার গতিবেগের বদলে ৩০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেনটি চালাতে হচ্ছে বলে তিনি জানান।
নিয়ন্ত্রণ কক্ষে কর্মকর্তাদের একজন বিল্লাল মিয়া কালের কণ্ঠকে জানান, দেরিতে ট্রেন ঢুকলে যেতেও দেরি হয়। তবে রাজশাহীর দুর্ঘটনার কারণে ঢাকা-রাজশাহী-লালমনিরহাট, ঢাকা-খুলনা ও ঢাকা-দিনাজপুর-নীলফামারী রুটের ট্রেনগুলো কমলাপুর থেকে ছাড়তে বিলম্ব হচ্ছে। তিনি আরো জানান, রেলপথ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তো নিজেই বলেছেন ট্রেনের সময়সূচি ঠিক থাকবে না। তবে যাত্রীরা যাতে বেশি ভোগান্তিতে না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখা হবে। দীর্ঘদিন ধরে রেলওয়েতে কর্মরত বিল্লাল মিয়া জানান, প্রতিবছর ঈদ মৌসুমে দিনাজপুর রুটের দ্রুতযান ও লালমনি এক্সপ্রেস ট্রেন দেরিতে আসা-যাওয়া করছে। ঈদের আগে বাড়ি ফিরতে অনেক যাত্রীর রাত ২-৩টা পর্যন্তও অপেক্ষা করে।
রাজশাহী থেকে ঢাকাগামী পদ্মা এক্সপ্রেস বুধবার বিকেল সোয়া ৫টার দিকে চারঘাট উপজেলার সারদা স্টেশনের কাছে দুর্ঘটনায় পড়ে। এ কারণে খুলনা ও চিলাহাটি থেকে রাজশাহীমুখী এবং রাজশাহী থেকে চলাচলকারী সব রুটের ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ২০ ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর রাজশাহীর সঙ্গে ঢাকা ও খুলনার রেল চলাচল শুরু হয় গতকাল।
সময়সূচি ঠিক নেই এর পরও ট্রেনের টিকিটের জন্য তদবির-চেষ্টা চলছে। গত বুধবার অলকা নন্দিতা নামের এক যাত্রী তূর্ণা নিশীথা ট্রেনের একটি টিকিট কিনতে কমলাপুর রেলস্টেশনে যান। কাউন্টারে টিকিট না পেলেও অন্য এক স্থান থেকে ৩৫০ টাকার টিকিট এক হাজার টাকায় পেয়েছেন। গতকাল স্টেশনের সার্ভার রুমে ভিআইপিদের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন প্রতিনিধিরা টিকিট পেতে ভিড় করেন। মিনার মনসুর নামে একজন গত বুধবার চট্টগ্রাম যাওয়ার জন্য তূর্ণা নিশীথার টিকিট কিনতে এক কালোবাজারিকে অতিরিক্ত ৫০০ টাকা দেন। তিনি জানান, ওই কালোবাজারি টিকিটও দিচ্ছে না। ফোনও ধরছে না।
গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন টার্মিনালের মতো সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালেও ছিল যাত্রীর ভিড়। যাত্রাবাড়ী অংশ পার হতেই অনেক চালককে খুব বেগ পেতে হয়। এরপর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে গিয়ে পড়লেই যানজট। এ রুটের বাসচালক মনিরুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'রাস্তার অবস্থা আরো খারাপ হইতাছে। গাড়ি খালি দুলে আর দুলে। কাঁচপুর যাইতেই অনেকক্ষণ লাগে।' মহাসড়কের গৌরীপুরে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকামুখী একটি বাস আটকে পড়েছিল দুপুরে। বিষয়টি উল্লেখ করে মনিরুজ্জামান জানান, ফিরতি বাসেই যাত্রী নিয়ে যাবেন তিনি। এ কারণে বাসের টিকিটও বিক্রি করা হচ্ছে না। কারণ এ বাস কখন যাবে, কেউ বলতে পারছে না। স্থানে স্থানে অবৈধ স্থাপনা, চাঁদাবাজির জন্য হঠাৎ গাড়ি থামানো, গাড়ির অতিরিক্ত গতি, যেখানে সেখানে পার্কিংসহ বিভিন্ন কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে, যানজট সৃষ্টি হচ্ছে।
কল্যাণপুরে জে আর পরিবহনের কাউন্টারে গেলে কুষ্টিয়া, ভেড়ামারা ও মেহেরপুর রুটের যাত্রীদের অপেক্ষায় থাকতে দেখা গেছে। গতকাল সকালে এখানে গেলে টিকিট হাতে বাসের জন্য অন্য যাত্রীদের মতো অপেক্ষায় ছিলেন মোশতাক আহমদ। পাশেই ছিলেন অন্য যাত্রী মনোয়ার হোসেন। তারা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বাসের জন্য দেড় ঘণ্টা ধরে অপেক্ষায় আছি। কাউন্টারের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা মীর মোহাম্মদ সজীবুল হক বলেন, সময় যত যাচ্ছে যাত্রীর চাপও বাড়ছে। আমরা বাস আসামাত্রই যাত্রীদের উঠিয়ে দিচ্ছি।'
No comments