জন্মদিন- বন্ধু মুর্তজা বশীর by কাইয়ুম চৌধুরী

মুর্তজা বশীর আজ ৮০ বছর পূর্ণ করলেন। আমার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু, আমাদের একই বছরে জন্ম। আমি পাঁচ মাস আগে ৮০ পূর্ণ করেছি। আমরা একই বছর প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছি। একই বছরে আর্ট স্কুলে ভর্তি হয়েছি। একই বছরে আর্ট স্কুল থেকে পাস করে বেরিয়েছি।


মজার ব্যাপার হলো, বশীরকে দেখলে এখনো সেই আর্ট স্কুলের তরুণ ছাত্রটির কথা মনে হয়। হাস্যোজ্জ্বল, টগবগে। ওর সান্নিধ্যে আমারও বয়স তখন কমে যায়। আগের মতোই গল্প, আগের বিষয়গুলো প্রাধান্য পায় সেই সব গল্পে। সময়গুলো পঞ্চাশের দশকে ফিরে যায়।
বশীর আমার চেয়ে সব ব্যাপারেই ওয়াকিবহাল ছিল। সাহিত্যের বিষয়ে, ছবির বিষয়ে, ফিল্মের বিষয়ে—সব ওর নখদর্পণে। আর্ট স্কুলে ভর্তি হওয়ার দিনের কথা মনে পড়ে। আমরা প্রায় সবাই ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছি। অধ্যক্ষ জয়নুল আবেদিন সবাইকে ডেকে বললেন, আগামীকাল থেকে ক্লাস শুরু হবে। প্রয়োজনমতো কাগজ, পেনসিল, তুলি, কালি নিয়ে আসবে। আমাকে গো-বেচারা দেখে ডেকে বললেন, কাগজ, পেনসিল, চাইনিজ ইঙ্ক, তুলি নিয়ে আসবে। আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, চায়নিজ ইঙ্কটা কী? আবেদিন স্যার অবাক চোখে আমাকে একবার দেখে নিয়ে বশীরকে ডাক দিয়ে বললেন, বশীর, ও তো দেখি কিছুই চেনে না। তুমি একটু সাহায্য করো। ওকে জিনিসগুলো কিনেটিনে দিয়ো। বশীরের সঙ্গে বেরিয়ে রয়েল স্টেশনারি সাপ্লাই হাউস থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো কিনে নিলাম।
সেই থেকে বশীরের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা। সাহিত্য, শিল্প, সংগীত এবং রাজনীতি নিয়ে আমরা কথাবার্তা বলতাম। কথাবার্তা বলতাম প্রেম, ভালোবাসা নিয়েও। এ ব্যাপারে আমাদের দুজনেরই অবস্থা কাঠফাটা রৌদ্রের মতন। শুকনো, খাঁ খাঁ। রাজনীতিটা আমার কাছে তখন নতুন বিষয়। বশীরের সেটা স্পষ্ট। কারণ, ও বাম রাজনীতির সঙ্গে তখন থেকেই সংশ্লিষ্ট। পরিবারে রাজনীতি চর্চাটা ছিল। মাঝেমধ্যে স্কুল থেকে হাওয়া হয়ে যেত। আমাদের এক ক্লাস উঁচুতে পড়তেন আমিনুল ইসলাম। আমিনুলের সঙ্গেও বশীরের ঘনিষ্ঠতা। আমিনুলও বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তখনকার সময়ে বম্বে থেকে ক্রসরোড বলে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা আমিনুলের কাছে আসত। আমিনুল আমাকে নিয়মিত কাগজটি সরবরাহ করতেন। বশীরও প্রগতিশীল লেখকদের রচনাপাঠে অভ্যস্ত ছিল। মনে আছে, আর্ট স্কুল থেকে বৃত্তি পেলাম ৩৫ টাকা। বশীরকে বললাম রংতুলি কিনব। বশীর আমাকে নিয়ে গেল আরমানিটোলায় ওয়ার্সী বুক সেন্টারে। ওরা তখন পুস্তক ব্যবসার পাশাপাশি ইংল্যান্ড থেকে রংতুলি এনে বিক্রি করত। বুক সেন্টারে গিয়ে বইয়ের সংগ্রহ দেখে আমার চক্ষু চড়কগাছ। স্থির করলাম অর্ধেক টাকা দিয়ে রংতুলি আর বাকি অর্ধেকে বই। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, তারাশংকর, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বই সারি সারি। বেছে বেছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বই হাতে নিই। প্রাগৈতিহাসিক, ছোট বকুলপুরের যাত্রী, পুতুল নাচের ইতিকথা, পদ্মানদীর মাঝি। যেটাই নেব বলে ভাবি, বশীর বাধা দেয়। না, না, ওটা না, ওগুলো আমার আছে। আমার কাছ থেকে নিয়ে পড়বি। পুরো মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বশীরের সংগ্রহে এবং সব বই পড়া। শেষ পর্যন্ত অন্য বই নিলাম, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের শিলালিপি, তারাশংকরের পঞ্চগ্রাম, এরিখ মারিয়া রেমার্কের অনুবাদ থ্রি কমরেডস। আমি শ্রদ্ধার চোখে বশীরের দিকে তাকাই তার পড়াশোনার ব্যাপ্তি দেখে। পরে বশীর লেখালেখিতে মগ্ন হয়। অনেকগুলো অসাধারণ ছোটগল্প লিখেছিল। সেই গল্পগুলো নিয়ে একটি বই ছাপা হয়েছিল কাঁচের পাখীর গান নামে। সন্ধানী প্রকাশনী থেকে বইটি বেরিয়েছিল। প্রচ্ছদ করেছিলাম আমি। প্রচ্ছদ দেখে বশীর আমাকে বলেছিল, তুই এ ধরনের ছবি আঁকিস না কেন? আমার তখন ছবি আঁকায় খরা যাচ্ছে। বশীরের কথা আমাকে খুব অনুপ্রাণিত করেছিল। কবিতাও লিখেছে বশীর। ভাষা আন্দোলনের ওপর লেখা ওর কবিতা কলকাতার পরিচয় কাগজে ছাপা হয়েছিল।
ভীষণ কল্পনাপ্রবণ বশীর। ছবি আঁকার আগে পুরো ছবিটা সে মনশ্চক্ষে দেখতে পেত। কোথায় কী রং, কোথায় ড্রইং কীভাবে ভাঙবে, কোথায় টেক্সচার কীভাবে প্রয়োগ করবে—সব বলে যাচ্ছে কল্পনাতে। আমাদের বলত, কাল রাতে এ ছবিটা সে এঁকেছে। আসলে সত্যি নয়, ছবি আঁকেইনি এখনো। সবাই খুব প্রশংসা করাতে সে সেদিনই ছবিটা এঁকে ফেলল। এবং সত্যিই সুন্দর একটা ছবি সে আঁকল।
চিত্রবিদ্যার উচ্চশিক্ষা গ্রহণে ইতালি গেল বশীর। আমিনুলের ইতালি যাওয়াটা বশীরকে খুব অনুপ্রাণিত করেছিল। ইতালিতে অবস্থানের সময় বিশ্ব চিত্রকলার সঙ্গে তাঁর চাক্ষুষ খুবই ফলপ্রসূ হয়েছিল। তাঁর সে সময়কার ছবি স্বচ্ছচক্ষু দিয়ে দেখা বিষয়বস্তু। রঙে, রেখায়, কম্পোজিশনে অসাধারণ সৃষ্টি। বশীর বলতেন, তাঁর ছবিতে ড্রইংয়ে ‘এট্রুসকান’ চিত্ররীতির প্রভাব রয়েছে। সে ড্রইং আরও সরল রেখায় উপস্থাপিত করে একটা নতুন শৈলীর উদ্ভব ঘটায়। গ্রাম, নিসর্গ, রমণীমুখের সরলীকরণের মধ্যে রঙের প্রয়োগে নতুনত্ব ছিল। তারপরেই পুরোপুরি নির্বস্তুক। দেয়াল সিরিজে বশীর নতুন রূপে দেখা দিলেন। টেক্সচার ফর্ম, স্পেসের খেলা তিনি দেখালেন ক্যানভাসে নতুন রূপে। তাঁর এপিটাফ সিরিজও আরেকটি নতুন বাঁক। দেয়ালপঞ্জির জন্য একটি ফরমায়েসি কাজ করতে গিয়ে একটি অনন্যসাধারণ শৈলীর জন্ম দিলেন বশীর। বাংলা সাহিত্যে নায়িকার প্রতিলিপি অঙ্কন তাঁকে একটি নতুন আঙ্গিকের মুখোমুখি করে। সেই আঙ্গিকে কন্যা ও জায়ার ছবি আর একটি নতুন শৈলীর জন্ম দেয়।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী বশীর। নানা ধরনের শখ তাঁকে নতুন নতুন কর্মে উৎসাহী করেছে। প্রাচীন মুদ্রা সংগ্রহ। ডাকটিকিট সংগ্রহ তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছে গবেষণাকার্যে। সুলতানি আমলের মুদ্রার ওপরে গবেষণা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সেই সব রচনা আন্তর্জাতিক গবেষণাপত্রে। এবং এসব কর্মকাণ্ডে তাঁকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিতি দিয়েছে।
আনন্দিত হই, যখন দেখি বশীর এখনো সৃষ্টিশীল। এখনো ছবি আঁকেন। লেখালেখি করেন। সময়কে তিনি পুরোপুরি উপভোগ করেন। আগের মতো বশীরের সঙ্গে আমারও দেখা হয় না। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হঠাৎ দেখা। উষ্ণ আলিঙ্গনে পরস্পরের কুশল বিনিময় হয়। গল্প করি, স্মৃতি রোমন্থন করি। বিদায়ের মুহূর্তে আবার দেখা হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদায় হই। ক্ষণিক দেখার আনন্দে অনেকক্ষণ আত্মহারা থাকি। বশীর শতায়ু হবেন, সৃষ্টিশীল থাকবেন, ক্বচিৎ কোথাও দেখা হবে। স্মৃতি রোমন্থন করব পানাহারের সঙ্গে। বশীর, আমরা অনেক দিন আরও বেঁচে থাকব। মনে করব আমিনুলকে, কিবরিয়াকে, দেবদাসকে, বিজনকে, আমাদের যৌবনকে।

No comments

Powered by Blogger.