খোলা চোখে- আমেরিকায় নির্বাচন: ছি ছি, এত্তা জঞ্জাল (২)! by হাসান ফেরদৌস
ভাবতে পারেন, আমেরিকার প্রাথমিক নির্বাচনের ফলাফল উল্টে যাওয়ার মতো ঘটনার পেছনে বাংলাদেশের কোনো ভূমিকা থাকতে পারে? ২০০০ সালের ফেব্রুয়ারি। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বাছাই পর্বে রিপাবলিকান দলে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন টেক্সাসের গভর্নর জর্জ বুশ ও আরিজোনার সিনেটর জন ম্যাককেইন।
অভিজ্ঞতার দিক দিয়ে দুজনের কোনো তুলনাই হয় না, যোগ্যতার দিক দিয়ে তো নয়ই। রিপাবলিকান দলের রক্ষণশীল অংশ ও ইস্টাবলিশমেন্টপন্থীরা সবাই বুশের পক্ষে, অন্যদিকে কিঞ্চিৎ উদার ও মধ্যপন্থীরা ম্যাককেইনের শিবিরে। নিউ হ্যাম্পশায়ারের মতো উদারনৈতিক রাজ্যে ১৯ শতাংশ ভোটে জিতে ম্যাককেইন দক্ষিণ ক্যারোলাইনা রাজ্যে এলেন। এখানে বুশ এগিয়ে ছিলেন প্রায় ৫০ শতাংশ ভোটে, কিন্তু ম্যাককেইনের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব ক্রমশই কমে আসছিল। আমেরিকার ইভাঞ্জেলিকাল খ্রিষ্টানদের ঘাঁটি বলে পরিচিত দক্ষিণ ক্যারোলাইনার ভোটাররা অত্যন্ত রক্ষণশীল, সেখানে গর্ভপাত ও সমকামিতার বিরুদ্ধে প্রবল জনমত রয়েছে। তার পরও বুশের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় রিপাবলিকান ভোটারদের মধ্যে সন্দেহ জাগা শুরু হয়েছে। যেকোনো মূল্যে এই প্রাক-নির্বাচনে তাদের জিততেই হবে, সেই বিবেচনা থেকে বুশের নির্বাচনী কমিটি ম্যাককেইনের বিরুদ্ধে এক অভাবিত প্রচারণা শুরু করল। ঠিক হলো ম্যাককেইনের চরিত্র নিয়ে আক্রমণ করা হবে। কাজটি প্রথম শুরু করলেন অতি রক্ষণশীল বব জোনস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রিচার্ড হ্যান্ড। তিনি একটি ই-মেইল বার্তা পাঠালেন তাঁর পরিচিত বন্ধুবান্ধব, এমনকি ছাত্রদের মধ্যেও। তাতে বলা হলো, ম্যাককেইন একটি অবৈধ কৃষ্ণাঙ্গ কন্যাসন্তানের পিতা। তাঁর পরিবারের একটি ছবিও প্রচারিত হলো, তাতে ম্যাককেইনের স্ত্রী, শ্বেতাঙ্গ পুত্র ও কন্যার পাশে একটি কালো মেয়ে।
আগুনের মতো সে কথা রটে গেল। এক কথা গড়াল আরেক কথায়। প্রথমে ই-মেইল চালাচালি, বেনামি টেলিফোনে কথা ছড়ানো, তারপর গির্জায় গির্জায় লিফলেট। বলা হলো, ম্যাককেইন বিবাহিত হলে কী হবে, তিনি আসলে সমকামী। নির্বাচিত হলে হোয়াইট হাউসে সমকামীদের হাট বসবে। তাঁর স্ত্রীও বহুগামী, নিজে স্বীকার করেছেন তাঁর মাদকাসক্তি রয়েছে। (১৯৯৪ সালে শিরদাঁড়ায় পর পর দুটো অস্ত্রোপচারের পর ম্যাককেইনের স্ত্রী কড়া ডোজের পেইন কিলার ব্যবহার শুরু করেন ডাক্তারের পরামর্শে, তাকেই মাদকাসক্তি বলে প্রচার করা হলো।)
যে মেয়েটিকে ম্যাককেইনের অবৈধ কন্যা বলে পরিচয় দেওয়া হলো, তার নাম ব্রিজিট। ১৯৯১ সালে জন ম্যাককেইনের স্ত্রী সিন্ডি ম্যাককেইন বাংলাদেশে এসেছিলেন মাদার তেরেসার ত্রাণ সংস্থার অনুরোধে। সেবার একটি মেয়ে, জন্মগতভাবে তার কাটা ঠোঁট, ত্রাণ সংস্থার অনুরোধে সিন্ডি তাকে সঙ্গে নিয়ে যান চিকিৎসা করাবেন বলে। দুই দিনের আলাপ-পরিচয়ে মেয়েটিকে তিনি ভালোবেসে ফেললেন। ফিনিক্স এয়ারপোর্টে তাদের নিতে এসেছিলেন জন ম্যাককেইন। সেখানে সিন্ডি জানালেন, মেয়েটিকে কোথাও পাঠাতে তাঁর মন চাইছে না। দুজনে ঠিক করলেন মেয়েটিকে তাঁরা দত্তক নেবেন। সেই থেকে ব্রিজিট সিনেটর ম্যাককেইনের গৃহে তাঁর আরেকটি কন্যার মতোই বড় হয়েছে।
এমন অভাবিত মিথ্যা প্রচারণার সম্মুখীন তাঁকে হতে হবে, ম্যাককেইন বা তাঁর নির্বাচনী দল স্বপ্নেও ভাবেনি। কীভাবে এর মোকাবিলা করবেন, তা-ও তাঁদের জানা ছিল না। ২০০২ সালে প্রকাশিত তাঁর রাজনৈতিক স্মৃতিকথা ওয়ার্থ ফাইটিং ফর গ্রন্থে ম্যাককেইন দুঃখ করে লিখেছেন, এমন নোংরা আক্রমণের মুখে নিজের সম্মান বাঁচিয়ে চলা ছাড়া অন্য কিছুই তাঁর পক্ষে করা সম্ভব হয়নি। দক্ষিণ ক্যারোলাইনার সেই প্রাক-নির্বাচনে ১১ পয়েন্টের ব্যবধানে জিতেছিলেন জর্জ বুশ।
গণতান্ত্রিক ইতিহাসের গোড়া থেকেই আমেরিকায় এই কাণ্ড চলছে। বারবার ব্যবহারে মিথ্যা প্রচারণা এখন রীতিমতো একটা বিজ্ঞানে দাঁড়িয়ে গেছে। আমেরিকার তৃতীয় নির্বাচন হয় ১৮০০ সালে, তখন থেকেই সত্য-মিথ্যার যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে। ১৮২৮ সালের নির্বাচনে এন্ড্রু জ্যাকসনের প্রতিপক্ষ ছিলেন কুইনসি অ্যাডামস। জ্যাকসন শিবির থেকে এই বলে প্রচার চালানো হলো, অ্যাডামস যখন রাশিয়ায় আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ছিলেন, তখন তিনি রুশ জারের জন্য পতিতা সরবরাহ করতেন। এক কান থেকে আরেক কানে তাঁর নাম হয়ে গেল ‘পিম্প’ (পতিতার দালাল)। জ্যাকসন শিবির থেকে এ-ও বলা হলো, অ্যাডামসের স্ত্রী লুইসা আসলে অবৈধ সন্তান। তার চেয়েও মারাত্মক কথা, বিয়ের আগেই অ্যাডামস ও লুইসা যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেন, যা কিনা সেদিনের সামাজিক প্রেক্ষাপটে ছিল মারাত্মক অপরাধ। অ্যাডামস শিবিরও কম যায় না। তারা জ্যাকসনের স্ত্রী রেইচেলের তাঁর প্রথম স্বামীর সঙ্গে আইনসম্মতভাবে বিবাহবিচ্ছেদের আগেই জ্যাকসন রেইচেলকে বিয়ে করেছেন। এই অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন রেইচেল এবং জ্যাকসন নির্বাচিত হওয়ার দিন কয়েকের মধ্যেই মারা যান। (এ নিয়ে আরও বিস্তারিত যাঁরা জানতে চান, তাঁরা দেখুন ডেভিড মার্কের বই গোয়িং ডার্টি, রোম্যান অ্যান্ড লিটলফিল্ড পাবলিসার্স, ম্যারিল্যান্ড ২০০৯)।
২০০ বছরের সে ঐহিত্য এখনো রয়েছে। ২০১২ সালে এসে দেখছি, নির্বাচনের আগে আগে দেশের দুই প্রধান দলই অর্ধসত্য-পূর্ণ মিথ্যার গালগপ্প সাজিয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় নেমেছে। মূল লক্ষ্য ভোটারদের বিভ্রান্ত করা। আর কিছু না হোক, কিছু লোককে ভোট দেওয়া থেকে নিবৃত্ত রাখা। কেউ কোথাও মুখ ফসকে কী এক কথা বলেছে, অথবা যা বলেছে, তার ভগ্নাংশ ব্যবহার করে একের পর টেলিভিশন বিজ্ঞাপন ছাড়া হচ্ছে। এ দেশের লোক তাদের তাবৎ খবর সংগ্রহ করে টিভি থেকে, যাকে সবাই আদর করে নাম দিয়েছে ‘ইডিয়ট বক্স’। ৩০ সেকেন্ডের টিভি বিজ্ঞাপন, তাতে বেশি কথা বলার সুযোগ কম। দু-একটা সাউন্ড বাইট দিয়ে তৈরি সেই বিজ্ঞাপনে দিনকে রাত বানিয়ে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। উভয় দলই ভাবছে, ভোটারদের একটা বড় অংশ সে কথায় বিশ্বাস করে তাদের ভোটের সিদ্ধান্ত নেবে।
ভ্রান্ত প্রচারণা যে কাজে লাগে, তার একটি তরতাজা প্রমাণ মিলেছে মিসৌরি অঙ্গরাজ্যে। রক্ষণশীল বলে পরিচিত এই রাজ্যের বর্তমান সিনেটর ডেমোক্রেটিক দলের ক্লেয়ার ম্যাকস্কিল অধিকাংশ জনমত জরিপে ১০ বা তার চেয়েও বেশি শতাংশে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী রিপাবলিকান প্রার্থীর তুলনায় পিছিয়ে আছেন। নভেম্বরে সাধারণ নির্বাচন, কিন্তু তার আগে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কে হবেন তাঁর রিপাবলিকান প্রতিদ্বন্দ্বী। আমাদের দেশে বড় দুই দলের প্রধান দুই নেত্রী ঠিক করে দেন প্রার্থী কে হবেন। এ দেশে সেই সিদ্ধান্ত নেন দলের রেজিস্ট্রিকৃত ভোটাররা ‘প্রাইমারি’ নির্বাচনের মাধ্যমে। রিপাবলিকান প্রার্থিতার জন্য প্রতিযোগিতায় ছিলেন দুজন, তাঁরা উভয়েই রক্ষণশীল। কিন্তু তাঁদের একজন টড একিন এতটাই রক্ষণশীল যে নিজস্ব সমর্থকদের বাইরে, বিশেষত স্বতন্ত্র ভোটারদের কাছে, তাঁর গ্রহণযোগ্যতা প্রায় শূন্য। অথচ রিপাবলিকান দলের অতি রক্ষণশীল সদস্য, যাঁরা প্রাথমিক নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় ভোট দিতে আসেন, তাঁদের কাছে টড একিন অধিক পছন্দের। ম্যাকস্কিল হিসাব করে দেখলেন, টড একিন যদি তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হন, নিরপেক্ষ ও স্বতন্ত্র ভোটারদের সমর্থনে নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে তাঁর জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
এই নীল নকশা অনুযায়ী ম্যাকস্কিল দিন-রাত টিভিতে বিজ্ঞাপন দেওয়া শুরু করলেন। নিজের কথা বলার বদলে তাঁর প্রতিটি বিজ্ঞাপনের একই বক্তব্য: টড একিন অত্যন্ত রক্ষণশীল। এমন রক্ষণশীল ব্যক্তি নির্বাচিত হলে তিনি মিসৌরির সব মানুষের প্রতিনিধিত্ব করতে সক্ষম হবেন না। রিপাবলিকান দলের ‘প্রাইমারি’ ভোটাররা তো সবচেয়ে রক্ষণশীল প্রার্থীর পক্ষে ভোট দেওয়ার জন্য মুখিয়েই আছেন। উদারপন্থী বলে পরিচিত ক্লেয়ার ম্যাকস্কিল যদি টড একিনকে সবচেয়ে রক্ষণশীল বলেন, তাহলে তো বাদবিচারের প্রশ্ন ওঠে না। ব্যস, হয়ে গেল প্রাথমিক নির্বাচন, আর তাতে অনায়াসে জিতে গেলেন টড একিন। এখন নভেম্বরে নিজেকে মধ্যপন্থী বলে হাজির করে তাতে টিকে থাকার জন্য লড়বেন ক্লেয়ার ম্যাকস্কিল।
একদিকে ‘নেতিবাচক প্রচারাভিযান’, অন্যদিকে টাকার খেলা—এই হলো ২০১২ সালের আমেরিকার নির্বাচনের মোদ্দা কথা। নেতিবাচক প্রচারণার জন্য দরকার কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। ফলে দুই প্রধান দলই চাঁদা সংগ্রহের লড়াইয়ে নেমেছে। টাইম সাময়িকী সাম্প্রতিক সংখ্যার প্রচ্ছদ কাহিনির শিরোনাম: হোয়াইট হাউস বিক্রি হতে যাচ্ছে। দাম ধরা হয়েছে আড়াই বিলিয়ন ডলার। ডেমোক্র্যাট বারাক ওবামা ও রিপাবলিকান মিট রমনি সিংহভাগ ব্যয় করবেন টিভি বিজ্ঞাপনে। আর টিভি বিজ্ঞাপন মানেই অর্ধসত্য বা পুরো মিথ্যা দিয়ে সাজানো গালগপ্প।
ওবামাকে নিয়ে রমনি শিবিরের একটি বিজ্ঞাপনের কথা ধরুন। কোনো এক সভায় ওবামা বলেছিলেন, বড় বড় ব্যবসায়ী নিজেরা একা তাদের ব্যবসা গড়ে তোলেনি। সে কাজে নানাজন তাদের সাহায্য করেছে। সরকার রাস্তাঘাট বানিয়েছে। সরকারি স্কুলে লেখাপড়া করেছে এমন লোকেরা সেই ব্যবসায়ে শ্রম দিয়েছে, বুদ্ধি দিয়েছে। বিজ্ঞানীরা ইন্টারনেট বানিয়েছে, যার সাহায্য নিয়ে সেই ব্যবসা পয়মন্ত হয়েছে। রমনি শিবির সব কথা বাদ দিয়ে ওবামার শুধু ‘ব্যবসায়ীরা একা তাদের ব্যবসা বানায়নি’ অংশটুক বক্তৃতা থেকে কেটে নিয়ে বারবার দেখানো শুরু করল। অভিযোগ করা হলো, ওবামা আমেরিকার অর্থনীতি কীভাবে কাজ করে তা বোঝেন না, এ দেশের মানুষের উদ্যমকে তিনি দাম দিতে জানেন না। পারবেন কী করে, তিনি জানেন শুধু সব কাজ সরকারের ঘাড়ে চাপাতে। এর কারণ তিনি আসলে কমিউনিস্ট বা ইউরোপীয় ধাঁচের সোশ্যালিস্ট। এমন লোক আমেরিকার জন্য ক্ষতিকর, তাঁকে ভোট দেবেন না, ইত্যাদি।
ওবামার নির্বাচনী দলও কম যায় না। তারা ব্যস্ত এ কথা প্রমাণ করতে যে রমনি অতি ধনী মানুষ, অন্য মানুষকে ঠকিয়ে, বাকি দশজন সাধারণ মানুষের মতো নিয়মিত কর না দিয়ে টাকার পাহাড় বানিয়েছেন। এমন লোক প্রেসিডেন্ট হলে বড়লোক আরও বড়লোক হবে, কপাল পুড়বে মধ্যবিত্তের। প্রমাণ হিসেবে তারা রমনির মালিকানাধীন একটি শিল্প সংস্থার এক সাবেক কর্মচারীর উদাহরণ এনেছে। বেশি লাভের আশায় রমনি সেই কোম্পানি বিক্রি করে বিদেশে তার পুঁজি সরিয়ে নেন। ফলে সেই লোকের চাকরি যায়। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর স্ত্রীর স্বাস্থ্যবিমাও শেষ হয়ে যায়। আর ঠিক সেই সময়েই ধরা পড়ে তাঁর স্ত্রী ক্যানসারে আক্রান্ত। বিমা না থাকায় চিকিৎসার অভাবে কিছুদিন পর তাঁর স্ত্রী মারা যান। বিজ্ঞাপনের মূল কথা: সেই লোকের স্ত্রীর মৃত্যুর জন্য দায়ী মিট রমনি। এমন লোককে ভোট দেওয়ার কথা মাথায়ও আনবেন না।
লক্ষ করুন, যে কোম্পানিকে ওই নারীর মৃত্যুর জন্য দায়ী করা হলো, রমনি সেই কোম্পানি ছেড়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন দায়িত্ব গ্রহণ করেন ১৯৯৯ সালে, তখন থেকে এই কোম্পানির সঙ্গে রমনির কার্যত কোনো যোগাযোগ নেই। যে ভদ্রলোকের কথা দিয়ে বিজ্ঞাপন বানানো হলো, তার চাকরি যায় ২০০১ সালে, আর তাঁর স্ত্রী ক্যানসারে মারা যান ২০০৬ সালে। সন-তারিখের হিসাব মেলাতে গেলে বিপদ আছে, ফলে সেসব কথা পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে বিজ্ঞাপনে। একসময় রমনির কোম্পানিতে তিনি কাজ করতেন সে কথা তো আর মিথ্যা নয়! রমনির কোম্পানি বিক্রি করে দেওয়া হয়, সে কথাও তো মিথ্যা নয়। তাহলে?
আমেরিকায় নির্বাচনের এখনো তিন মাস বাকি। এই খেলা যখন শেষ হবে, তখন দেখা যাবে চতুর্দিকে জঞ্জাল আর জঞ্জাল। এই জঞ্জালের রাজ্যকে আর যাই বলি, গণতন্ত্র বলা বোধ হয় সমীচীন নয়।
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
আগুনের মতো সে কথা রটে গেল। এক কথা গড়াল আরেক কথায়। প্রথমে ই-মেইল চালাচালি, বেনামি টেলিফোনে কথা ছড়ানো, তারপর গির্জায় গির্জায় লিফলেট। বলা হলো, ম্যাককেইন বিবাহিত হলে কী হবে, তিনি আসলে সমকামী। নির্বাচিত হলে হোয়াইট হাউসে সমকামীদের হাট বসবে। তাঁর স্ত্রীও বহুগামী, নিজে স্বীকার করেছেন তাঁর মাদকাসক্তি রয়েছে। (১৯৯৪ সালে শিরদাঁড়ায় পর পর দুটো অস্ত্রোপচারের পর ম্যাককেইনের স্ত্রী কড়া ডোজের পেইন কিলার ব্যবহার শুরু করেন ডাক্তারের পরামর্শে, তাকেই মাদকাসক্তি বলে প্রচার করা হলো।)
যে মেয়েটিকে ম্যাককেইনের অবৈধ কন্যা বলে পরিচয় দেওয়া হলো, তার নাম ব্রিজিট। ১৯৯১ সালে জন ম্যাককেইনের স্ত্রী সিন্ডি ম্যাককেইন বাংলাদেশে এসেছিলেন মাদার তেরেসার ত্রাণ সংস্থার অনুরোধে। সেবার একটি মেয়ে, জন্মগতভাবে তার কাটা ঠোঁট, ত্রাণ সংস্থার অনুরোধে সিন্ডি তাকে সঙ্গে নিয়ে যান চিকিৎসা করাবেন বলে। দুই দিনের আলাপ-পরিচয়ে মেয়েটিকে তিনি ভালোবেসে ফেললেন। ফিনিক্স এয়ারপোর্টে তাদের নিতে এসেছিলেন জন ম্যাককেইন। সেখানে সিন্ডি জানালেন, মেয়েটিকে কোথাও পাঠাতে তাঁর মন চাইছে না। দুজনে ঠিক করলেন মেয়েটিকে তাঁরা দত্তক নেবেন। সেই থেকে ব্রিজিট সিনেটর ম্যাককেইনের গৃহে তাঁর আরেকটি কন্যার মতোই বড় হয়েছে।
এমন অভাবিত মিথ্যা প্রচারণার সম্মুখীন তাঁকে হতে হবে, ম্যাককেইন বা তাঁর নির্বাচনী দল স্বপ্নেও ভাবেনি। কীভাবে এর মোকাবিলা করবেন, তা-ও তাঁদের জানা ছিল না। ২০০২ সালে প্রকাশিত তাঁর রাজনৈতিক স্মৃতিকথা ওয়ার্থ ফাইটিং ফর গ্রন্থে ম্যাককেইন দুঃখ করে লিখেছেন, এমন নোংরা আক্রমণের মুখে নিজের সম্মান বাঁচিয়ে চলা ছাড়া অন্য কিছুই তাঁর পক্ষে করা সম্ভব হয়নি। দক্ষিণ ক্যারোলাইনার সেই প্রাক-নির্বাচনে ১১ পয়েন্টের ব্যবধানে জিতেছিলেন জর্জ বুশ।
গণতান্ত্রিক ইতিহাসের গোড়া থেকেই আমেরিকায় এই কাণ্ড চলছে। বারবার ব্যবহারে মিথ্যা প্রচারণা এখন রীতিমতো একটা বিজ্ঞানে দাঁড়িয়ে গেছে। আমেরিকার তৃতীয় নির্বাচন হয় ১৮০০ সালে, তখন থেকেই সত্য-মিথ্যার যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে। ১৮২৮ সালের নির্বাচনে এন্ড্রু জ্যাকসনের প্রতিপক্ষ ছিলেন কুইনসি অ্যাডামস। জ্যাকসন শিবির থেকে এই বলে প্রচার চালানো হলো, অ্যাডামস যখন রাশিয়ায় আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ছিলেন, তখন তিনি রুশ জারের জন্য পতিতা সরবরাহ করতেন। এক কান থেকে আরেক কানে তাঁর নাম হয়ে গেল ‘পিম্প’ (পতিতার দালাল)। জ্যাকসন শিবির থেকে এ-ও বলা হলো, অ্যাডামসের স্ত্রী লুইসা আসলে অবৈধ সন্তান। তার চেয়েও মারাত্মক কথা, বিয়ের আগেই অ্যাডামস ও লুইসা যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেন, যা কিনা সেদিনের সামাজিক প্রেক্ষাপটে ছিল মারাত্মক অপরাধ। অ্যাডামস শিবিরও কম যায় না। তারা জ্যাকসনের স্ত্রী রেইচেলের তাঁর প্রথম স্বামীর সঙ্গে আইনসম্মতভাবে বিবাহবিচ্ছেদের আগেই জ্যাকসন রেইচেলকে বিয়ে করেছেন। এই অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন রেইচেল এবং জ্যাকসন নির্বাচিত হওয়ার দিন কয়েকের মধ্যেই মারা যান। (এ নিয়ে আরও বিস্তারিত যাঁরা জানতে চান, তাঁরা দেখুন ডেভিড মার্কের বই গোয়িং ডার্টি, রোম্যান অ্যান্ড লিটলফিল্ড পাবলিসার্স, ম্যারিল্যান্ড ২০০৯)।
২০০ বছরের সে ঐহিত্য এখনো রয়েছে। ২০১২ সালে এসে দেখছি, নির্বাচনের আগে আগে দেশের দুই প্রধান দলই অর্ধসত্য-পূর্ণ মিথ্যার গালগপ্প সাজিয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় নেমেছে। মূল লক্ষ্য ভোটারদের বিভ্রান্ত করা। আর কিছু না হোক, কিছু লোককে ভোট দেওয়া থেকে নিবৃত্ত রাখা। কেউ কোথাও মুখ ফসকে কী এক কথা বলেছে, অথবা যা বলেছে, তার ভগ্নাংশ ব্যবহার করে একের পর টেলিভিশন বিজ্ঞাপন ছাড়া হচ্ছে। এ দেশের লোক তাদের তাবৎ খবর সংগ্রহ করে টিভি থেকে, যাকে সবাই আদর করে নাম দিয়েছে ‘ইডিয়ট বক্স’। ৩০ সেকেন্ডের টিভি বিজ্ঞাপন, তাতে বেশি কথা বলার সুযোগ কম। দু-একটা সাউন্ড বাইট দিয়ে তৈরি সেই বিজ্ঞাপনে দিনকে রাত বানিয়ে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। উভয় দলই ভাবছে, ভোটারদের একটা বড় অংশ সে কথায় বিশ্বাস করে তাদের ভোটের সিদ্ধান্ত নেবে।
ভ্রান্ত প্রচারণা যে কাজে লাগে, তার একটি তরতাজা প্রমাণ মিলেছে মিসৌরি অঙ্গরাজ্যে। রক্ষণশীল বলে পরিচিত এই রাজ্যের বর্তমান সিনেটর ডেমোক্রেটিক দলের ক্লেয়ার ম্যাকস্কিল অধিকাংশ জনমত জরিপে ১০ বা তার চেয়েও বেশি শতাংশে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী রিপাবলিকান প্রার্থীর তুলনায় পিছিয়ে আছেন। নভেম্বরে সাধারণ নির্বাচন, কিন্তু তার আগে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কে হবেন তাঁর রিপাবলিকান প্রতিদ্বন্দ্বী। আমাদের দেশে বড় দুই দলের প্রধান দুই নেত্রী ঠিক করে দেন প্রার্থী কে হবেন। এ দেশে সেই সিদ্ধান্ত নেন দলের রেজিস্ট্রিকৃত ভোটাররা ‘প্রাইমারি’ নির্বাচনের মাধ্যমে। রিপাবলিকান প্রার্থিতার জন্য প্রতিযোগিতায় ছিলেন দুজন, তাঁরা উভয়েই রক্ষণশীল। কিন্তু তাঁদের একজন টড একিন এতটাই রক্ষণশীল যে নিজস্ব সমর্থকদের বাইরে, বিশেষত স্বতন্ত্র ভোটারদের কাছে, তাঁর গ্রহণযোগ্যতা প্রায় শূন্য। অথচ রিপাবলিকান দলের অতি রক্ষণশীল সদস্য, যাঁরা প্রাথমিক নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় ভোট দিতে আসেন, তাঁদের কাছে টড একিন অধিক পছন্দের। ম্যাকস্কিল হিসাব করে দেখলেন, টড একিন যদি তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হন, নিরপেক্ষ ও স্বতন্ত্র ভোটারদের সমর্থনে নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে তাঁর জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
এই নীল নকশা অনুযায়ী ম্যাকস্কিল দিন-রাত টিভিতে বিজ্ঞাপন দেওয়া শুরু করলেন। নিজের কথা বলার বদলে তাঁর প্রতিটি বিজ্ঞাপনের একই বক্তব্য: টড একিন অত্যন্ত রক্ষণশীল। এমন রক্ষণশীল ব্যক্তি নির্বাচিত হলে তিনি মিসৌরির সব মানুষের প্রতিনিধিত্ব করতে সক্ষম হবেন না। রিপাবলিকান দলের ‘প্রাইমারি’ ভোটাররা তো সবচেয়ে রক্ষণশীল প্রার্থীর পক্ষে ভোট দেওয়ার জন্য মুখিয়েই আছেন। উদারপন্থী বলে পরিচিত ক্লেয়ার ম্যাকস্কিল যদি টড একিনকে সবচেয়ে রক্ষণশীল বলেন, তাহলে তো বাদবিচারের প্রশ্ন ওঠে না। ব্যস, হয়ে গেল প্রাথমিক নির্বাচন, আর তাতে অনায়াসে জিতে গেলেন টড একিন। এখন নভেম্বরে নিজেকে মধ্যপন্থী বলে হাজির করে তাতে টিকে থাকার জন্য লড়বেন ক্লেয়ার ম্যাকস্কিল।
একদিকে ‘নেতিবাচক প্রচারাভিযান’, অন্যদিকে টাকার খেলা—এই হলো ২০১২ সালের আমেরিকার নির্বাচনের মোদ্দা কথা। নেতিবাচক প্রচারণার জন্য দরকার কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। ফলে দুই প্রধান দলই চাঁদা সংগ্রহের লড়াইয়ে নেমেছে। টাইম সাময়িকী সাম্প্রতিক সংখ্যার প্রচ্ছদ কাহিনির শিরোনাম: হোয়াইট হাউস বিক্রি হতে যাচ্ছে। দাম ধরা হয়েছে আড়াই বিলিয়ন ডলার। ডেমোক্র্যাট বারাক ওবামা ও রিপাবলিকান মিট রমনি সিংহভাগ ব্যয় করবেন টিভি বিজ্ঞাপনে। আর টিভি বিজ্ঞাপন মানেই অর্ধসত্য বা পুরো মিথ্যা দিয়ে সাজানো গালগপ্প।
ওবামাকে নিয়ে রমনি শিবিরের একটি বিজ্ঞাপনের কথা ধরুন। কোনো এক সভায় ওবামা বলেছিলেন, বড় বড় ব্যবসায়ী নিজেরা একা তাদের ব্যবসা গড়ে তোলেনি। সে কাজে নানাজন তাদের সাহায্য করেছে। সরকার রাস্তাঘাট বানিয়েছে। সরকারি স্কুলে লেখাপড়া করেছে এমন লোকেরা সেই ব্যবসায়ে শ্রম দিয়েছে, বুদ্ধি দিয়েছে। বিজ্ঞানীরা ইন্টারনেট বানিয়েছে, যার সাহায্য নিয়ে সেই ব্যবসা পয়মন্ত হয়েছে। রমনি শিবির সব কথা বাদ দিয়ে ওবামার শুধু ‘ব্যবসায়ীরা একা তাদের ব্যবসা বানায়নি’ অংশটুক বক্তৃতা থেকে কেটে নিয়ে বারবার দেখানো শুরু করল। অভিযোগ করা হলো, ওবামা আমেরিকার অর্থনীতি কীভাবে কাজ করে তা বোঝেন না, এ দেশের মানুষের উদ্যমকে তিনি দাম দিতে জানেন না। পারবেন কী করে, তিনি জানেন শুধু সব কাজ সরকারের ঘাড়ে চাপাতে। এর কারণ তিনি আসলে কমিউনিস্ট বা ইউরোপীয় ধাঁচের সোশ্যালিস্ট। এমন লোক আমেরিকার জন্য ক্ষতিকর, তাঁকে ভোট দেবেন না, ইত্যাদি।
ওবামার নির্বাচনী দলও কম যায় না। তারা ব্যস্ত এ কথা প্রমাণ করতে যে রমনি অতি ধনী মানুষ, অন্য মানুষকে ঠকিয়ে, বাকি দশজন সাধারণ মানুষের মতো নিয়মিত কর না দিয়ে টাকার পাহাড় বানিয়েছেন। এমন লোক প্রেসিডেন্ট হলে বড়লোক আরও বড়লোক হবে, কপাল পুড়বে মধ্যবিত্তের। প্রমাণ হিসেবে তারা রমনির মালিকানাধীন একটি শিল্প সংস্থার এক সাবেক কর্মচারীর উদাহরণ এনেছে। বেশি লাভের আশায় রমনি সেই কোম্পানি বিক্রি করে বিদেশে তার পুঁজি সরিয়ে নেন। ফলে সেই লোকের চাকরি যায়। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর স্ত্রীর স্বাস্থ্যবিমাও শেষ হয়ে যায়। আর ঠিক সেই সময়েই ধরা পড়ে তাঁর স্ত্রী ক্যানসারে আক্রান্ত। বিমা না থাকায় চিকিৎসার অভাবে কিছুদিন পর তাঁর স্ত্রী মারা যান। বিজ্ঞাপনের মূল কথা: সেই লোকের স্ত্রীর মৃত্যুর জন্য দায়ী মিট রমনি। এমন লোককে ভোট দেওয়ার কথা মাথায়ও আনবেন না।
লক্ষ করুন, যে কোম্পানিকে ওই নারীর মৃত্যুর জন্য দায়ী করা হলো, রমনি সেই কোম্পানি ছেড়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন দায়িত্ব গ্রহণ করেন ১৯৯৯ সালে, তখন থেকে এই কোম্পানির সঙ্গে রমনির কার্যত কোনো যোগাযোগ নেই। যে ভদ্রলোকের কথা দিয়ে বিজ্ঞাপন বানানো হলো, তার চাকরি যায় ২০০১ সালে, আর তাঁর স্ত্রী ক্যানসারে মারা যান ২০০৬ সালে। সন-তারিখের হিসাব মেলাতে গেলে বিপদ আছে, ফলে সেসব কথা পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে বিজ্ঞাপনে। একসময় রমনির কোম্পানিতে তিনি কাজ করতেন সে কথা তো আর মিথ্যা নয়! রমনির কোম্পানি বিক্রি করে দেওয়া হয়, সে কথাও তো মিথ্যা নয়। তাহলে?
আমেরিকায় নির্বাচনের এখনো তিন মাস বাকি। এই খেলা যখন শেষ হবে, তখন দেখা যাবে চতুর্দিকে জঞ্জাল আর জঞ্জাল। এই জঞ্জালের রাজ্যকে আর যাই বলি, গণতন্ত্র বলা বোধ হয় সমীচীন নয়।
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments