গোলটেবিল বৈঠক- কেমন সিটি করপোরেশন চাই

৩১ জুলাই, ২০১২ প্রথম আলোর উদ্যোগে রংপুরে ‘কেমন সিটি করপোরেশন চাই’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। রংপুরের নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক দলের নেতা এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা আলোচনায় অংশ নেন। তাঁদের বক্তব্য এখানে সংক্ষিপ্ত আকারে ছাপা হলো।
যাঁরা অংশ নিলেন
মলয় কিশোর ভট্টাচার্য
অধ্যাপক, অর্থনীতিবিদ ও আহ্বায়ক সচেতন নাগরিক কমিটি
শরফুদ্দিন আহমেদ
সাবেক সাংসদ ও সিটি করপোরেশন বাস্তবায়ন সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক
মশিউর রহমান
উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য, জাতীয় পার্টি
মোজাফফর হোসেন
আহ্বায়ক, জেলা বিএনপি
মোস্তাফিজার রহমান
সদস্যসচিব, জেলা জাতীয় পার্টি ও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান
কাজী মো. জুননুন
সাবেক পৌর চেয়ারম্যান
সাফিউর রহমান
সভাপতি, মহানগর আওয়ামী লীগ
আজিজুল করীম
পরিচালক, আরডিআরএস বাংলাদেশ
মো. মোছাদ্দেক হোসেন
সভাপতি, চেম্বার অব কমার্স, রংপুর ও জেলা কমান্ডার, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ
হাসনা চৌধুরী
সাধারণ সম্পাদক, মহিলা পরিষদ, রংপুর
মফিজুল ইসলাম
চিকিৎসক ও সমাজকর্মী
এম এ বাশার
লেখক ও সংগঠক
তুহীন ওয়াদুদ
সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়
ইরা হক
মহিলা সমাজকর্মী ও নারীনেত্রী
শুভরঞ্জন
বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠক, রংপুর
রেজাউল ইসলাম
সাধারণ সম্পাদক, জেলা দোকান মালিক সমিতি
আরিফুল হক
নিজস্ব প্রতিবেদক, প্রথম আলো, রংপুর
সঞ্চালক
আব্দুল কাইয়ুম: যুগ্ম সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনা
আরিফুল হক
এই জনপদের মানুষের রংপুরকে বিভাগ করার দাবি ছিল দীর্ঘদিনের। সেই স্বপ্ন আজ পূরণ হয়েছে। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের আটটি জেলা নিয়ে রংপুর বিভাগ। এই বিভাগের প্রাণকেন্দ্র হবে রংপুর সিটি করপোরেশন। আমরা চাই রংপুর হবে দেশের অন্যতম পরিকল্পিত ও আধুনিক সিটি করপোরেশন। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, সমাজকর্মী, এনজিও, বিশেষ করে নির্বাচিত মেয়র—সবার আন্তরিক প্রচেষ্টায় একটি আধুনিক ও দৃষ্টিনন্দন সিটি করপোরেশন গড়ে উঠবে বলে আশা করি। প্রথম আলো আমাদের মতোই আশা করে, এখানে একটি সুন্দর পরিচ্ছন্ন সিটি করপোরেশন গড়ে উঠুক।

আব্দুল কাইয়ুম
রংপুর পৌরসভা সিটি করপোরেশনে উন্নীত হওয়ায় এ অঞ্চলের সব শ্রেণী-পেশার মানুষ আনন্দিত। মনুষের দীর্ঘদিনের আন্দোলন-সংগ্রামের ফসল এই সিটি করপোরেশন। আমারা আশা করি, রংপুর হবে বাংলাদেশের একটি আদর্শ সিটি করপোরেশন। এই প্রত্যাশা পূরণের জন্য অনেকগুলো বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে। আজকের আলোচনার মধ্য দিয়ে হয়তো এসব বিষয় সামনে আসবে। আমরাও চাই, সব বিষয় নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হোক, যাতে একটি আধুনিক ও আদর্শ সিটি করপোরেশন গড়ার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা না হয়। প্রথমে মলয় কিশোর ভট্টাচার্যকে অনুরোধ করছি এ বিষয়ে বলার জন্য।

মলয় কিশোর ভট্টাচার্য
আমাদের কথা কেউ ভাবেনি। আজকে অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে চাই, রংপুরে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে যা কিছু বলি না কেন—এর কোনোটাই এমনিতে হয়নি। দিনের পর দিন এ অঞ্চলের মানুষকে আন্দোলন-সংগ্রাম করে অর্জন করতে হয়েছে। এ রকম একটি আন্দোলনেরই ফসল রংপুর সিটি করপোরেশন। এই সিটি করপোরেশন কী রকম হবে, সে বিষয়ে গত কয়েক দিন প্রথম আলোয় ব্যাপক লেখালেখি হয়েছে। সেখানে বিস্তারিত বলা হয়েছে। তার পরও কয়েকটি বিষয় আলোচনা করতে চাই। আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্বদানের জন্য পোস্টারে যাঁদের ছবি দেখেছি, তাঁদের মধ্য থেকে কেউ যদি মেয়র নির্বাচিত হন, তা হলে নিশ্চয়ই সিটি করপোরেশনের উন্নয়ন হবে। আমার বিবেচনায় তাঁরা সৎ, দক্ষ ও যোগ্য। সৎ, যোগ্য ও নিষ্ঠাবান নেতৃত্ব ছাড়া কখনোই আধুনিক নগর তৈরি হতে পারে না। পর্যাপ্ত বিনোদন ও খেলাধুলার ব্যবস্থা থাকতে হবে। একটা সিটি করপোরেশনের শুধু বড় রাস্তাগুলো সুন্দর করলে হবে না। প্রধান সড়কে আসার জন্য যে গলি ও ছোট রাস্তা আছে, সেগুলো প্রশস্ত ও সুন্দর করতে হবে।
শহরের পয়ঃপ্রণালিব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে। একটা পরিচ্ছন্ন সিটি করপোরেশনের পয়ঃপ্রণালিব্যবস্থা অবশ্যই উন্নত হতে হবে। শ্যামা সুন্দরী খাল নিয়ে অনেক রকমের কথা শোনা যায়। কিন্তু এখন পর্যন্ত কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এই খালের শ্রোতধারা ফিরিয়ে এনে এর দুই ধারে রাস্তা, পার্ক ও আলোর ব্যবস্থা করলে এটা বিনোদনের জন্য একটা অসাধারণ জায়গা হবে। রংপুর শহরে একটা পূর্ণাঙ্গ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থাকা দরকার। শিশুদের জন্য বিনোদনকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। গণশৌচাগারের ব্যবস্থা ছাড়া আধুনিক নগর কল্পনা করা যায় না। মাদকের ভয়াবহতা থেকে যুবসমাজকে রক্ষা করতে হবে।

আব্দুল কাইয়ুম
কাজী মো. জুননুন, আপনি পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন। সিটি করপোরেশন হওয়ায় কাজের ক্ষেত্র ও দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেল। কী করা উচিত? আপনার অভিজ্ঞতা থেকে বলুন।

কাজী মো. জুননুন
একটি সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর যেমন নতুন নতুন চাহিদা তৈরি হয়, তেমনি একটি নতুন সিটি করপোরেশনের জন্য একটা একটা করে অনেক কিছুর প্রয়োজন। এই প্রয়োজন পূরণের জন্য উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো একজন সৎ, যোগ্য ও সাহসী মেয়র নির্বাচিত করা; যিনি এই সিটি করপোরেশনের মেয়র হবেন। নিশ্চয়ই তিনি কোনো না কোনো দলের হবেন। কিন্তু তাঁকে দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করতে হবে। তিনি হবেন সব দলের, সব মানুষের। ইতিপূর্বে আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, কোনো বিশেষ দল থেকে যখন কোনো প্রার্থী নির্বাচিত হন, তখন তিনি সবকিছু দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখেন। এতে তাঁর দলের ও নিজের উন্নতি হলেও গণমানুষের কোনো কাজ তাঁর দ্বারা হয়নি। আমাদের জাতীয় রাজনীতি থেকে শুরু করে সব পর্যায়ে এই দৃষ্টিভঙ্গি আছে। সত্যিকার একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ সিটি করপোরেশন গড়ে তুলতে হলে যিনি দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করতে পারবেন, এমন একজন মানুষকে মেয়র নির্বাচিত করতে হবে।
গ্যাসের অভাবসহ বিভিন্ন কারণে রংপুরে কোনো শিল্প গড়ে ওঠেনি। এখানে শিল্প কলকারখানা গড়ে তোলার ব্যবস্থা করতে হবে। তা হলে বেকার সমস্যাসহ বিভিন্ন সমস্যার সমাধান হবে। আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল বেতারকেন্দ্রটিকে ১০০ কিলোহার্জে উন্নীত করা; আজও সেটা বাস্তবায়িত হয়নি। শিশুদের বিনোদনের একেবারেই কোনো ব্যবস্থা নেই। তাদের বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। নদী-খালের অভাবে রংপুরের ৮০ শতাংশ মানুষ সাঁতার জানে না। তাই কয়েকটি সুইমিংপুল তৈরি করতে হবে।

মো. মোছাদ্দেক হোসেন
২০৩ বর্গকিলোমিটার এলাকাব্যাপী রংপুর সিটি করপোরেশন আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করেছে। এখন একে একটি আধুনিক নগরে রূপ দিতে হবে। এ উদ্দেশ্য সামনে রেখে দল-মতনির্বিশেষে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এ অঞ্চলেন সর্বস্তরের প্রগতিশীল চিন্তার মানুষ, পরিকল্পনাবিদ, বিভিন্ন পেশাজীবী, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক নেতাদের সামনে সুযোগ এসেছে নতুন এই নগরের কাঠামোকে পরিবেশবান্ধব ও দৃষ্টিনন্দন হিসেবে গড়ে তোলার।
পরিকল্পিত সিটি করপোরেশনের জন্য শিল্প কলকারাখানা, অফিস-আদালত, হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ, বিপণিকেন্দ্র, পর্যটনকেন্দ্র, শিশুপার্ক, চিড়িয়াখানা—সবই পরিকল্পনামাফিক নির্দিষ্ট জায়গায় হতে হবে। সিটি করপোরেশন এলাকার সব রাস্তাঘাট হতে হবে নিরাপদ ও প্রশস্ত। পর্যাপ্ত ফুটপাত ও পার্কিংয়ের ব্যবস্থা থাকতে হবে। বিশ্বরোডকে চার লেনে উন্নীত করতে হবে। সুবিধামতো বাইপাস ও ফিডার রোডের ব্যবস্থা করতে হবে। করপোরেশনের বাজারগুলোকে সংস্কার, বর্ধিতকরণ ও আধুনিকীকরণ করতে হবে। স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ, পানি ও পয়োনিষ্কাশনের আধুনিক ব্যবস্থা থাকতে হবে।
রংপুরের ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলতে হবে। বিসিক শিল্পনগরকে আরও বড় করতে হবে। বন্ধ থাকা আরডিসিসিএস কারখানা পুনরায় চালু করতে হবে। বিদ্যমান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে উন্নত যোগাযোগব্যবস্থাসহ আধুনিক অবকাঠামো নির্মাণ ও সংস্কার সাধন করতে হবে। পর্যটনের সুযোগ-সুবিধা বড়ানোর জন্য তাজহাট জাদুঘর, গোঁসাইবাড়ী, কুকরুলবিল, চিড়িয়াখানা, চিকলীবিল, নাচনিয়ারবিল ইত্যাদি স্থানকে সংস্কার, বর্ধিতকরণ ও আধুনিকীকরণ করতে হবে। স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ, পানি ও পয়োনিষ্কাশনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা থাকতে হবে। এ ছাড়া একটি নান্দনিক সিটি করপোরেশনের জন্য সমাজকল্যাণ কার্যক্রম, মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি সংরক্ষণ, চিকিৎসাসেবার উন্নয়ন, সংস্কৃতি চর্চাকেন্দ্র, ক্রীড়া উন্নয়নসহ নানাবিধ কার্যক্রম হাতে নিতে হবে।

মফিজুল ইসলাম
এ অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে রংপুুরকে বিভাগ করায় বর্তমান মহাজোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জানাই আন্তরিক শভেচ্ছা ও কৃতজ্ঞতা। দেশের উত্তর-পশ্চিমের প্রাচীন জনপদ রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় নিয়ে উত্তরাঞ্চলের সদ্য ঘোষিত রংপুর বিভাগ। এই বিভাগকে বাংলাদেশের সবচেয়ে উন্নত ও আধুনিক জনপদ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য এখন থেকে পরিকল্পনা নিতে হবে। কেননা, রাজধানী ঢাকা এখন বিভিন্ন সমস্যায় ভারাক্রান্ত নগরে পরিণত হয়েছে। পরিকল্পনাহীন নগর কাঠামো, আবাসন, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা, শিল্প এলাকা, রাস্তাঘাট, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি প্রভৃতি ক্ষেত্রে নানা অব্যবস্থাপনার শিকার। ভবিষ্যতে রংপুর বিভাগকে যেন এমন পরিস্থিতির শিকার না হতে হয়, সেই দায়ভার এখন থেকে সব মহলকে নিতে হবে।
রংপুরে হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার—সব পাশাপাশি অবস্থান করছে। ফলে সব শ্রেণী-পেশার মানুষ সহজে স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারছে না। অনেককে দূর থেকে আসতে হয়। বর্জ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনা নেই। এতে প্রতিনিয়ত পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। রংপুর শহরে কোনো সদর হাসপাতাল নেই। অন্য শহরগুলোতে আছে কিন্তু রংপুরে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সাধারণ মানুষের চিকিৎসাসেবার জন্য সরকারি হাসপাতালের ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতাল গড়ে তুলতে চাই। রংপুরের স্বাস্থ্যসেবাকে সঠিক পরিকল্পনার আওতায় নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে।
আমাদের জন্য এই সময়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক কিছু নিয়ে স্বপ্ন দেখতে চাই এবং স্বপ্নের বাস্তবায়ন চাই। এ ক্ষেত্রে সঠিক পরিকল্পনা করতে হবে। বাজেট প্রণয়ন করতে হবে। রাজনৈতিক নেতাসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ এগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। আমরা চাই, রংপুর সিটি করপোরেশন হবে উত্তরাঞ্চলের একটি পরিকল্পিত সিটি করপোরেশন। তাই কাজগুলোকে গুরুত্বের ভিত্তিতে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় বর্ষ করে ভাগ করতে হবে। মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। এ জন্য আমাদের সিটি করপোরেশনকে স্বপ্নের মতো করে সাজাতে চাই।
রংপুরকে দেখতে চাই দ্বিতীয় রাজধানী হিসেবে। চিটাগং, বরিশাল, সিলেট ইত্যাদি বিভাগের ভূ-প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য আমাদের মতো নয়। নদী, পাহাড় আর অসমতল ভূমি নিয়ে এ অঞ্চলগুলো গড়ে উঠেছে। রংপুর জেলার ভূমি সমতল। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় খুব সহজেই যাওয়া যায়। তাই এ অঞ্চলকে স্বপ্নের মতো করে সাজাতে কোনো সমস্যা নেই। দরকার শুধু ইচ্ছা এবং ইচ্ছার সঠিক প্রতিফলন। সঠিক পরিকল্পনার অভাবে আজকে ঢাকা শহরের জনজীবন থমকে গেছে। অপরিকল্পিত আবাসনব্যবস্থা, যানজট, শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎসহ নানা সমস্যায় জনজীবন বিপর্যস্ত। আমরা কখনোই চাই না রংপুরের অবস্থা ঢাকাসহ অন্য অঞ্চলের মতো হোক। জীবনানন্দ দাশের ‘রূপসী বাংলা’র মতো করে গড়ে তুলতে চাই আমাদের স্বপ্নের সিটি করপোরেশন।

হাসনা চৌধুরী
আলোচনায় শিল্পায়নের কথা এসেছে। বিষয়টির সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত। কোনো নগরকে সমৃদ্ধ নগর হিসেবে গড়ে তুলতে হলে শিল্পায়ন অত্যন্ত জরুরি। কারণ, নগরের দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে না পারলে কখনো কোনো জনপদ সমৃদ্ধ নগর হিসেবে টিকে থাকতে পারে না। রংপুর শহরের বিভিন্ন জায়গায় ভাসমান মানুষ, যারা শহরের যেখানে-সেখানে অব্যবস্থাপনার মধ্যে বাস করছে—তাদের কর্মসংস্থান ও আবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের বলপ্রয়োগে উচ্ছেদ করে স্বপ্নের নগর নির্মাণ সম্ভব নয়।
শহরে মাদকের ব্যবহার ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। আজকে আমাদের শিশু, কিশোর ও যুবকেরা মাদকাসক্ত হয়ে তাদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করছে। যে পরিবারে একজন মাদকাসক্ত, তার পুরো পরিবার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। যে করেই হোক, আমাদের সন্তানদের মাদকের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করতে না পারলে নগরের সৈন্দর্য বিনষ্ট হবে। আমার জানামতে, রংপুর শহরের খাসজমিগুলো ধনী ও অবস্থাপন্ন মানুষের দখলে। এই জমিগুলো উদ্ধার করে এখানে শিল্পায়নের ব্যবস্থা করতে হবে। আবাদি জমি নষ্ট করা যাবে না। সর্বোপরি, দুর্নীতি ও চাঁদাবাজমুক্ত নগর গড়ে তুলতে হবে। এ ব্যাপারে সাধারণ নাগরিকদের সচেতন হতে হবে। তা না হলে আমাদের চোখের সামনে দিয়ে দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি চলতে থাকবে। চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর উপায় থাকবে না।
নারীর ক্ষমতায়ন সম্পর্কে বলতে চাই। ক্ষমতা হচ্ছে নারীর যোগ্যতা অনুসারে তাঁকে কাজ দেওয়া। ক্ষমতায়ন হচ্ছে যোগ্যতা অনুসারে কাজ, অর্থ ও স্বাধীনতা দেওয়া। এখানে যত প্রশাসনিক কাঠামো হবে, প্রতিটি প্রশাসনে যোগ্যাতা অনুসারে নারীদের কাজ দেওয়া দরকার। এবং সেই কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল ও স্বাধীনতা দেওয়া উচিত। কিন্তু অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, প্রশাসনিক কাঠামোতে নারীর অংশগ্রহণ থাকে কম এবং কাজ করার ক্ষমতাও থাকে কম। এভাবে চললে কখনো নারীর ক্ষমতায়ন হবে না। নারীর ক্ষমতায়ন চাইলে নারীকে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ও কাজ করার পরিবেশ দিতে হবে।

আজিজুল করীম
এখানে এনজিওগুলোর খুব বেশি ভূমিকা নেই। যদি পরিকল্পনামাফিক আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকা গড়ে ওঠে, তা হলে নগরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে। শহরের ভাসমান মানুষের জন্য বাসস্থান ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। তা হলে একসঙ্গে বেশি মানুষকে সেবা প্রদান সম্ভব হবে। সবার দিক থেকে পরিকল্পিত নগরের কথাই ভাবতে হবে। আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প প্রভৃতি এলাকা আলাদা হলে এবং পৃথক হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জোন থাকলে সবার জন্য সেবা প্রদান-গ্রহণের মধ্যে ভারসাম্য থাকবে।
৩৩টি ওয়ার্ড নিয়ে রংপুর সিটি করপোরেশন হবে। প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে খেলার মাঠের ব্যবস্থা থাকতে হবে। পথশিশুদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষার মান বাড়াতে হবে। সরকারি পর্যায়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের সংখ্যা বাড়ানো দরকার। উন্নত পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা থাকতে হবে। সবার আগে প্রয়োজন একজন যোগ্য মেয়র। প্রাথমিক অবস্থায় তাঁর ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে। একজন সৎ ও যোগ্য মেয়র উপহার দিতে পারবে একটি নান্দনিক সিটি করপোরেশন।

রেজাউল ইসলাম
স্বাধীনতার পর থেকে এ অঞ্চলে ভারী শিল্প কলকারখানা গড়ে ওঠেনি। তাই লেখাপড়া শেষ করার পর আমাদের কাজের সন্ধানে বাইরে যেতে হয়। অনেকেই ছোট-বড় ব্যবসাকে বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করেন। কিন্তু রংপুর শহরে পরিকল্পনামাফিক আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসহ কোনো বাণিজ্য জোন বা বিপণিকেন্দ্র গড়ে ওঠেনি। আমাদের প্রধান কাজ হবে একজন সৎ ও যোগ্য মেয়র নির্বাচন করা, যিনি আধুনিক সুযোগ-সুবিধার কথা চিন্তা করে পরিকল্পিত বাণিজ্য জোনের ব্যবস্থা করবেন।
ব্যবসার প্রয়োজনে ছোট ছোট শিল্প গড়ে তুলবেন। কিন্তু এখানে বিএসটিআইয়ের কোনো অফিস না থাকায় সেটাও সম্ভব হচ্ছে না। কয়েক দিন আগে আমার কাছে একজন বললেন যে তাঁর একটি সেমাইয়ের ছোট ট্রাক কাস্টমস ধরে নিয়ে গেছে। তিনি অনেক কষ্ট করে ঢাকা থেকে ২০১১-১২ সালের অনুমতি এনেছিলেন। ২০১২-১৩ সালের অনুমতি নেই। ভ্যাটসংক্রান্ত জটিলতার জন্য ট্রাকটি আটক করা হয়েছিল। ২৪ মণ সেমাইয়ের জন্য ১৫ হাজার টাকা দিতে হলো ভ্যাট কর্মকর্তাকে। বললাম, ২৪ মণ সেমাইয়ের জন্য ১৫ হাজার টাকা ভ্যাট দিলে ব্যবসা বন্ধ করে দিতে হবে। কর্মকর্তা বললেন, জরিমানা-ভ্যাট মিলিয়ে ১৫ হাজার টাকা। এভাবে আমরা ভ্যাট কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাচারিতার শিকার হচ্ছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, ভ্যাটের কোনো সঠিক নীতিমালা আজও পাইনি। ভ্যাটের জন্য একটা সুনির্দিষ্ট নীতিমালা দিতে হবে। ট্যাক্সের জন্য যেমন টেলিভিশনে ঘোষণা দেওয়া হয়, তেমনি ভ্যাটের জন্যও ঘোষণা থাকতে হবে। এবং সেখানে বিস্তারিত উল্লেখ থাকবে যে কোন পণ্য উৎপাদনের জন্য কী পরিমাণ ভ্যাট দিতে হবে। দোকান-ব্যবসায়ীদের জন্য একটা ভ্যাট নীতিমালা আছে। বিভাগীয় শহরের জন্য তিন হাজার ৬০০ টাকা, থানার জন্য দুই হাজার ৪০০ টাকা। কিন্তু ভ্যাট কর্মকর্তারা এই নীতিমালা মানেন না। তাঁরা দোকানে মাল বেশি দেখলে বেশি ভ্যাট দাবি করেন। ১০ থেকে ২০, এমনকি ৬০ হাজার টাকা তাঁরা ভ্যাট দাবি করেন। এঁরা ব্যবসায়ীদের ওপর জুলুম করে টাকা আদায় করেন। ভ্যাট কর্মকর্তাদের নিয়ে ব্যবসায়ীরা সব সময় শঙ্কার মধ্যে থাকেন। এভাবে কোনো ব্যবসা করা সম্ভব নয়। এঁদের কারণে ব্যবসা বন্ধ করতে হয়। এতে দেশে বেকার সমস্যার সৃষ্টি হয়।
রংপুরে একটি বিসিক নগর আছে। সেখানে নামে-বেনামে অনেকে জায়গা নিয়েছেন। বিসিক নগরকে বর্ধিত করে সঠিক নীতিমালার মাধ্যমে নতুন উদ্যোক্তাদের সুযোগ করে দিতে হবে। রংপুর শহর মাদকে ছেয়ে গেছে। যুবসমাজকে রক্ষা করতে না পারলে আমাদের অনেক অর্জন শেষ হয়ে যাবে। খুব সামান্য কারণেই বাসমালিকেরা গাড়ি বন্ধ করে দেন। রংপুরের মানুষ যেন অল্প খরচে রেলের মাধ্যমে খুব সহজে যোগাযোগ করতে পারে, সেদিকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। আমাদের দেশে সৎ ও দক্ষ মানুষের খুব অভাব। সব শেষে একজন সৎ ও দক্ষ মেয়র চাই।

শুভরঞ্জন
সবাই সৎ, যোগ্য, দক্ষ ও কর্মঠ মেয়রের কথা বলেছেন। এসবের সঙ্গে যোগ করতে চাই, তিনি যেন ক্রীড়ামোদি হন। আমি বিসিবির (বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড) সদস্য। বিসিবি নতুন একটা আইন পাস করতে যাচ্ছে, যেখানে আঞ্চলিক ক্রিকেট উন্নয়নের জন্য মেয়র হবেন প্রধান পৃষ্ঠপোষক। সাধারণত প্রশাসনের লোক দিয়ে কাজ করাতে হয়। এখন সুবিধা হলো, মেয়রই এসব কাজ করবেন। রংপুরে আন্তর্জাতিক মানের খেলার মাঠ তৈরি করার প্রক্রিয়া চলছে। যিনি মেয়র নির্বাচিত হবেন, তাঁকেই মূলত কাজটি শেষ করতে হবে। এ জন্য সবার মতো আমিও একজন ভালো মানুষ মেয়রের বিকল্প ভাবতে পারি না। আজকে মাদকসহ বিভিন্ন কারণে যুবসমাজ অবক্ষয়ের দিকে যাচ্ছে। তাদের রক্ষা করতে হলে ব্যাপকভাবে ক্রীড়াক্ষেত্রের উন্নয়ন করতে হবে। নির্বাচিত মেয়রকে এ বিষয়ে আন্তরিকতার সঙ্গে ভাবতে হবে। ক্রিকেট, ফুটবল ও হ্যান্ডবলের জন্য রংপুরের মাটি খুব ভালো। এখানে একটা ক্রীড়া কমপ্লেক্স অবশ্যই করতে হবে। আমরা চাই, রংপুর হবে বাংলাদেশের একটি আদর্শ ক্রীড়াক্ষেত্র।

এম এ বাশার
বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ভাওইয়া, পল্লিগীতি। রংপুর হলো ভাওইয়া-পল্লিগীতির সূতিকাগার। এখানে রয়েছে আব্বাসউদ্দীনের স্মৃতি। কাজী নজরুল ইসলাম এই মাটিতে এসেছেন। একজন বলেছেন, আন্দোলন-সংগ্রাম ছাড়া রংপুরে কিছুই অর্জিত হয়নি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আন্দোলন-সংগ্রাম করেও আমরা একটি সাংস্কৃতিক পল্লি গড়ে তুলতে পারিনি। প্রশাসন থেকে বারবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। কোনোবারই রক্ষা করা হয়নি। কোনো সমাজে সংস্কৃতির চর্চা না থাকলে সেই সমাজের মানসিক উন্নতি বাধাগ্রস্ত হয়। টাউন হল ও পাবলিক লাইব্রেরি এলাকায় অনেক ভাসমান সংগঠন আছে। কিছুদিন কাজ করার পর তাদের থেমে যেতে হয়। আমাদের দাবি ছিল, এদের জন্য একটি স্থায়ী সংস্কৃতি চর্চান্দ্রে করে দেওয়ার। রংপুরে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, নারী-শিশু নির্যাতন ও বেকার সমস্যাসহ নানা সমস্যা রয়েছে। এখানে একটি শ্রম ও পরিবেশ আদালত করতে হবে। রংপুরের জিরো পয়েন্ট থেকে রাস্তা পার হতে হলে পাঁচ থেকে দশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এখন আমদের তাকিয়ে থাকতে হবে নির্বাচিত মেয়রের দিকে; যিনি শুদ্ধ চিন্তা, সুন্দর মানসিকতা, নগরপ্রেম ও রুচিশীল ভাবনা দিয়ে রংপুর সিটি করপোরেশনকে গড়ে তুলবেন। যিনি রংপুরের রূপকার নির্বাচিত হবেন, তাঁকে আগামী ১০০ বছরের ভাবনা নিয়ে একটি সুন্দর পরিচ্ছন্ন নগর গড়ে তোলার পরিকল্পনা করতে হবে, যাতে আজকের ঢাকার মতো দুর্বিষহ অবস্থা ভবিষ্যতে রংপুরের না হয়।

ইরা হক
নগরের রূপকার বলেন আর মেয়র বলেন, তাঁকে কে নির্বাচিত করবে? আমরাই তো করব। তিনি আমাদের জন্যই নির্বাচিত হবেন। অতএব, তিনি আমাদের সঙ্গে পরামর্শ করে আমাদের কাজগুলো করবেন। আমাদের এখানে অনেক নারী উদ্যোক্তা রয়েছেন। তাঁদের জন্য একটা পৃথক মার্কেটের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে এখানে তাঁদের ইচ্ছেমতো পণ্যগুলো বিপণন করতে পরেন। নতুন সিটি করপোরেশনের জন্য অনেক বেশি কর্মক্ষেত্র বাড়বে। সেখানে যেন নারীদের যথেষ্ট কাজের সুযোগ থাকে। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, রংপুর শহরে আনেক পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও তাদের সন্তান-সন্ততি রয়েছে। এরা সব দিক থেকে বঞ্চিত, কোথাও এদের কাজের সুযোগ নেই। লেখাপড়ার সুযোগ নেই। এদের মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করা হয় না। খুব অমানবিক অবস্থায় এরা বেঁচে থাকে। তাই নির্বাচিত মেয়রের কাছে আমার অনুরোধ থাকবে, তিনি যেন তাদের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখেন। আমার শেষ কথা হলো, নারী-পুরুষ আলাদাভাবে না দেখে, সবাইকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করে, সবার সঙ্গে পরামর্শ করে তিনি আমাদের প্রিয় নগর গড়ে তুলবেন।

তুহীন ওয়াদুদ
শিক্ষার ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের অনেক দায়িত্ব রয়েছে। এ ক্ষেত্রে তাদের অনেক কিছু করার সুযোগ আছে। সিটি করপোরেশন এলাকার স্কুল-কলেজে শিক্ষার ব্যয় খুব বেশি। সিটি করপোরেশন ইচ্ছা করলে সেটি কমিয়ে আনতে পারে। সমমানের আরও স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলতে পারে। রংপুর শহরে বেকার সমস্যা প্রকট। কাজের অভাবে এখানে যুবসমাজ মাদকে জড়িয়ে যাচ্ছে। এই বিপর্যয় থেকে তরুণদের রক্ষার জন্য কর্মমুখী শিক্ষা খুবই জরুরি। এ ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। নির্বাচিত নগর অভিভাবককে বেশি করে কর্মমুখী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। রংপুর অঞ্চলে প্রায় ৫০ হাজার উচ্চশিক্ষিত যুবক রয়েছে, যাদের ঢাকায় গিয়ে পিএসসি (পাবলিক সার্ভিস কমিশন) পরীক্ষা দিতে হয়। নির্বাচিত মেয়র যেন পিএসসির একটি আঞ্চলিক কার্যালয় গড়ে তোলেন। কারমাইকেল কলেজে ৩০ হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। এই কলেজের বিশাল অব্যবহূত অর্থ রয়েছে। বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে ৩০ হাজার ছাত্রের আবাসিক ব্যবস্থা করা সম্ভব। সব শেষে অনুরোধ করব, নতুন মেয়র এমন একটি শহর গড়ে তুলবেন, যেখান দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মানুষ আগামী দিনের স্বপ্ন দেখতে পারে।

সাফিউর রহমান
একটি সুন্দর নগরের জন্য মহাপরিকল্পনা দরকার। আমরা সবাই একটি সুন্দর পরিকল্পিত নগরের স্বপ্ন দেখি। আজকে শহরে বের হলে যানজটে আটকে থাকতে হয়। নিশ্চয়ই আমি একটি যানজটমুক্ত শহর দেখতে চাই। একটু বৃষ্টি হলে নগরে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। আমরা এমন একটি নগর দেখতে চাই, যেখানে কোনো জলাবদ্ধতা থাকবে না। এর জন্য প্রয়োজন পরিকল্পিত আবাসন ও পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা। যাঁরা দায়িত্বে থাকেন, তাঁরা যদি দায়িত্বশীল আচরণ না করেন, তাহলে তাদের দ্বারাই আমাদের এই নগর ধ্বংস হবে। যাঁরা অফিস-আদালতে চাকরি করেন, তাঁদের সৎ হতে হবে। আজকে নগরের রস্তাগুলোতে বাতি নেই। নগরের রস্তাগুলোকে বড় করতে হবে এবং বাতির ব্যবস্থা করতে হবে। ৫৪ বর্গকিলোমিটার পৌরসভা পরিকল্পিত ছিল না। এখন ২০৩ বর্গকিলোমিটারের সিটি করপোরেশন কীভাবে পরিকল্পিত হবে, সেটা নিয়ে অনেক ভাবতে হবে। শ্যামা সুন্দরী খাল ভরাট করে আরও সংকুচিত করা হয়েছে। এই খালকে পুনরুদ্ধার করে পানি প্রবাহের ব্যবস্থা করতে হবে। ১৪৯ বর্গকিলোমিটার এলাকা নতুন এই সিটি করপোরেশন এলাকায় যুক্ত হয়েছে। সেখানে রস্তাঘাট, বাড়িঘরসহ কোনো কিছুই পরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠেনি। নতুন এই জায়গার জন্য মহাপরিকল্পনা নিতে হবে। রংপুর হবে আধুনিক, নান্দনিক ও মনোরম একটি সিটি করপোরেশন, যেখানে আমরা নগরবাসী নির্বিঘ্নে বসবাস করতে পারব।

মোজাফফর হোসেন
প্রথমে একটি কথা বলতে চাই। সততা, দেশপ্রেম, দূরদর্শিতা ও ঐক্য না থাকলে কারও পক্ষেই উন্নয়ন করা সম্ভব না। আমরা যারা রংপুরে রাজনীতি করি, তারা রংপুরের উন্নয়ন চাই। যাঁরা জাতীয় রাজনীতি করেন, তাঁরা দেশের উন্নয়ন চান।
আজকে যদি সত্যি কথা বলতে হয়, তাহলে বলতে হবে, আমরা উন্নয়ন চাই কিন্তু উন্নয়ন হয় না। আমরা যারা রাজনীতি করি, তারা ভালোভাবে দায়িত্ব পালন করছি না। একসময় মা-বাবাকে না বলে এ দেশের মানুষ ও মা-বোনদের সম্ভ্রম রক্ষা করার জন্য মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম। নিজের স্বার্থের কথা, জীবনের কথা চিন্তা করিনি। সে রকম মানসিকতা নিয়ে, সততা নিয়ে দেশের জন্য করতে পারলে অবশ্যই উন্নয়ন হতো। মেয়রের কাছ থেকে প্রশাসক দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি আজ উপস্থিত থাকলে ভালো হতো। তিনি হয়তো লজ্জা পেতেন। তার পরও আমাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব তৈরি হতো। আজকে বাংলাদেশে আমাদের মধ্যে সততার অভাব আছে। কেরামতিয়া হুজুর সাহেবের সামনের খালের যে সংস্কার করা হয়েছে, তার পানি এত খারাপ যে সেখানে কোনো অবস্থাতেই বসা যায় না। দুই কোটি টাকা খরচ করার পরও খালের যে অবস্থা, এ ব্যাপারে কেউ কোনো কথা বলেনি।
আমাদের মধ্যে কোনো ঐক্য নেই। আজকের এই গোলটেবিল আলোচনা থেকে যদি আমাদের মধ্যে ঐক্য আসে, তাহলে মেডিকেল ঠিক হবে, পৌরসভা ঠিক হবে, সিটি করপোরেশন ঠিক হবে। ঐক্য থাকলে সব অন্যায়ের প্রতিবাদ করা সম্ভব। একজন বললেন, এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে অন্যায়ভাবে ভ্যাট কর্মকর্তা টাকা নিয়েছেন। আজকে ঐক্য থাকলে তিনি এর প্রতিবাদ করতে পারতেন। আমাদের ডাক দিলে আমরা সবাই একসঙ্গে এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে পারতাম। ওই কর্মকর্তা তো দেশের বাইরেন নন। আজকে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি বলেই তো উনি ভ্যাট কর্মকর্তা। উনি কেন গরিবের ওপর জুলুম করবেন?
মেয়র কে হবেন, আমি জানি না। তবে যাঁর যোগ্যতা, সততা ও সাহস আছে; যিনি সব শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে মিশতে পারবেন, তাঁরই মেয়র হওয়া উচিত। কোনো কাজ করার সময় সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে পরামর্শ করবেন। আমাদের দেশে যিনি ক্ষমতায় যান, তিনি মনে করেন—আমিই সব, অন্যরা কিছুই না। এই মানসিকতার কারণে যেমন দেশের উন্নয়ন হয়নি, তেমনি রংপুর সিটি করপোরেশনের উন্নয়ন হবে না। সব শেষে একটি কথা বলতে চাই, রংপুরে আমলারা চরম অন্যায় করে যাচ্ছেন। আজকের গোলটেবিলের পর সাত দিনের মধ্যে আসুন আমরা দল-মতনির্বিশেষে এক হয়ে এর প্রতিবাদ করি।

মোস্তাফিজার রহমান
সবাই রংপুর সিটি করপোরেশনকে সুন্দর-পরিচ্ছন্ন নগর হিসেবে দেখতে চাই। মেয়র হিসেবে দেখতে চাই একজন সৎ, যোগ্য ও সাহসী মানুষকে। এখন সিটি করপোরেশন হলো, কিন্তু যখন পৌরসভা ছিল, তখনই ২১ শতাংশ মানুষের বাড়িতে বিদ্যুতের সংযোগ নেই। রাস্তাঘাট সরু এবং জরাজীর্ণ। অর্থাৎ পৌরসভার নাগরিক সুবিধা রংপুরের মানুষ পায়নি। এখন বিশাল এলাকা নিয়ে সিটি করপোরেশন হলো। আমরা এ অঞ্চলের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা, পারিবারিক অবস্থা অনেকটাই জানি। খুব স্বাভাবিকভাবে নীতিমালার আলোকে চলমান কিছু কাজ বন্ধ হয়ে যাবে। যেমন—অতিদরিদ্রের জন্য কাজের বিনিময় খাদ্য কর্মসূচি, ইত্যাদি। এতে এই নবগঠিত সিটি করপোরেশনের প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষ বেকার হয়ে পড়বে। এদের যদি কর্মসংস্থান করা না যায়, তা হলে রংপুর সিটি করপোরেশনের যে স্বপ্ন, সেটা বাধাগ্রস্ত হবে।
ইংরেজরা ২০০ বছর আগে যে পরিকল্পনা করেছিল, এখনো আমরা সেই পরিকল্পনার বাইরে যেতে পারিনি। প্রতিনিয়ত পৃথিবীতে পরিবর্তন আসছে; আমরা কিন্তু সেই গোড়াতেই রয়ে গেছি। প্রগতির সঙ্গে তাল মেলাতে হলে আমাদের পরিবর্তিত হতে হবে। নিশ্চয়ই আমাদের প্রত্যেকের ভাবনায় একটি সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন সিটি করপোরেশনের স্বপ্ন রয়েছে। সেটাকে বাস্তবায়ন করতে হলে একটি বাস্তবভিত্তিক সুন্দর পরিকল্পনা করতে হবে। একটি নান্দনিক সিটি করপোরেশন গড়ে তুলতে হলে আমাদের সবার মধ্যে ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। আমরা যদি দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করতে না পারি, তা হলে আমাদের স্বপ্নের সিটি করপোরেশন কখানোই হবে না। আমাদের মধ্যে ঐক্যের অভাবে রংপুরের স্বার্থে কোনো দাবিই আদায় করতে পারিনি। আমরা প্রত্যেকেই নিজের উন্নয়ন ও দল নিয়ে ভেবেছি। রংপুরের স্বার্থ ও উন্নয়ন নিয়ে ভাবিনি। আমারা কখনো চিন্তা করিনি, কেন রংপুরের মানুষ আমার পেছনে থাকবে। নিজেকে প্রশ্ন করিনি, আমি রংপুরের জন্য কী করেছি। এখন সময় এসেছে সবকিছু নতুন করে ভাবার।

মশিউর রহমান
আজকের এই আয়োজনে যাঁরা উপস্থিত, তাঁদের মধ্য থেকে কেউ না-কেউ মেয়র নির্বাচিত হবেন। তাঁরা সবাই এই আলোচনা শুনেছেন। আমাদের সবার একটাই উচ্চারণ, যিনিই মেয়র নির্বাচিত হোন না কেন; তিনি যেন দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে সবার সঙ্গে পরামর্শ করে রংপুর সিটি করপোরেশনের জন্য কাজ করেন। নির্বাচন করতে গিয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে কাদা ছোড়াছুড়ি করার কারণে সম্পর্কের মধ্যে তিক্ততা সৃষ্টি হয়। তখন নির্বাচিত ব্যক্তি ভালো-মন্দ যা-ই করুন না কেন, আমরা একযোগে তাঁর বিরোধিতা করতে থাকি।
আগামী এক হাজার বছরের পরিকল্পনা নিয়ে সিটি করপোরেশনের কাজ করতে হবে। এখনই বৃষ্টি হলে নগরে জলবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এখন সিটি করপোরেশনের সঙ্গে নতুন করে ১৮টি ওয়ার্ড যুক্ত হবে। এতে জলাবদ্ধতা আরও প্রকট আকার ধারণ করবে। তাই খুব পরিকল্পনামাফিক পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। মাটির নিচ দিয়ে রেললাইনের ব্যবস্থা করতে হবে। পৌরসভায় যে ১৫টি ওয়ার্ড ছিল, সেখানে এখন আর মাঠ, স্কুল-কলেজ, বিনোদনকেন্দ্র নতুন করে করা অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। কারণ, পরিকল্পনার অভাবে সরকারি জায়গা পর্যন্ত দখল করে যে যার মতো করে ব্যবহার করছে। রাস্তাঘাট প্রশস্তসহ যেকোনো কাজ করতে গেলে সমস্যার সৃষ্টি হয়। কিন্তু নতুন যে ১৮টি ওয়ার্ড যুক্ত হবে, সেখানে এখন খেলার মাঠ, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, বিনোদনকেন্দ্র—সবকিছু করা সম্ভব।
একটা বিষয় সবাইকে মনে রাখতে হবে, সিটি করপোরেশন হলে কর বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু সেভাবে যদি মানুষ সেবা না পায়, তাহলে একসময় এই মানুষ, যারা আন্দোলন-সংগ্রাম করে সিটি করপোরেশনের দাবি আদায় করেছে, তারাই এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাবে। তারা বলবে, এই সিটি করপোরেশন আমারা চাই না। উপজেলা সম্পর্কে আজকে সংসদে অনেক সাংসদই বলে থাকেন—এ রকম উপজেলা আমরা চাই না। রংপুর সিটি করপোরেশনে যেন এ রকম অবস্থা কখনোই না আসে।
রংপুরকে আমাদের সবার আবাসস্থল, জন্মভূমি মনে করতে হবে। যিনি মেয়র হবেন, তিনি যদি দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করেন, তাহলে রংপুরের সব পরিকল্পনা ভণ্ডুল হবে। আমরা চাই, নির্বাচিত মেয়র কোনো পরিকল্পনা নেওয়ার আগে সবাইকে নিয়ে বসবেন।

শরফুদ্দিন আহমেদ
এতক্ষণ অনেক আলোচনা হয়েছে। অনেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মতামত দিয়েছেন। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, দৃষ্টিনন্দন সিটি করপোরেশন করার সহযোগিতা আমরা কার কাছে চাই? সিটি করপোরেশনের কাছে, না সরকারের কাছে? সিটি করের কথা বলা হয়েছে। বর্তমান অবস্থায় বার্ষিক কর ৫০ লাখ টাকার বেশি হবে না। এ ক্ষেত্রে সরকারকেই আমাদের বলতে হবে সহযোগিতার কথা। আশা করা যায়, প্রধানমন্ত্রী আমাদের সহযোগিতা করবেন। কারণ, তিনি এই সিটি করপোরেশন ঘোষণা করেছেন। তাহলে রংপুর সিটি করপোরেশনের আগামী বাজেটের জন্য আমাদের জোর দাবি তুলতে হবে। সরকারি অর্থে প্রথম বছর লাইট, রাস্তা, পয়ঃপ্রণালি ইত্যাদি কাজ করতে পারলে তারপর ধীরে ধীরে সিটি করপোরেশনের অর্থ দিয়ে কাজ শুরু করা যাবে।
সিটি করপোরেশন এলাকায় ইতিপূর্বে খালের জন্য ৪৬ কোটি টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। কিন্তু সেটা খাল না হয়ে হয়েছে নালা। ৬৫ ফুট রাস্তা করার কথা ছিল, কোথাও ৬৫ ফুট রাস্তা হয়নি। টিনের লাইটপোস্ট দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বরাদ্দ করা অর্থ সবই তোলা হয়েছে। এভাবে সিটি করপোরেশন এলাকায় কাজ হলে কখনোই স্বপ্নের সিটি করপোরেশন করা সম্ভব হবে না।

মলয় কিশোর ভট্টাচার্য
সবকিছু নির্ভর করবে একজন সৎ ও যোগ্য মেয়রের ওপর। তাঁকে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে এসে কাজ করতে হবে। কোনো কাজ করার আগে অন্য সবার সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কাজের পরিকল্পনা নিয়ে সবার সঙ্গে আলোচনা করলে কাজের ভুলগুলো বেরিয়ে আসবে। সে ক্ষেত্রে কাজটি সঠিক ও নির্ভুল হবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রবণতাকে সামনে রেখে প্রত্যেকটি পরিকল্পনা করতে হবে। অর্থাৎ আগামী ৫০০ বছর পর কী প্রভাব পড়তে, পারে সেটা মাথায় রেখে কাজ করতে হবে। আবারও বলি নির্বাচিত মেয়র যদি সৎ, যোগ্য, সাহসী ও ভালো মানুষ হন; তা হলে আমাদের স্বর্ণের সিটি করপোরেশন গড়া অসম্ভব হবে না।আব্দুল কাইয়ুম
অনেক ব্যস্ততার মধ্যেও আপনারা সময় দিয়েছেন। আজকের আলোচনায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ ও মতামত উঠে এসেছে। বিশেষ করে সবাই একজন সৎ ও যোগ্য মেয়রের কথা বলেছেন। এ অঞ্চলের মানুষ যদি এমন একজন মেয়র নির্বাচিত করতে পারেন, তাহলে নিশ্চয়ই রংপুর একটি দৃষ্টিনন্দন সিটি করপোরেশন হবে। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.