ঈদ মাটি হবে অনেক এমপির by পার্থ প্রতীম ভট্টাচার্য্য
গত সংসদ নির্বাচনে বিজয়ের পর সোনার নৌকা উপহার নেওয়া, পরবর্তী সময়ে দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বিরোধ, উন্নয়নের নামে লুটপাটসহ তাঁর দুই ছেলের নানা অপকর্মের কারণে নির্বাচনী এলাকায় অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন রাজশাহী-৩ আসনের সংসদ সদস্য এমপি মেরাজ উদ্দিন মোল্লা।
এ অবস্থায় আসন্ন ঈদে এলাকায় এলে দলীয় নেতা-কর্মীদের তোপের মুখে পড়তে হতে পারে সরকারদলীয় এই এমপিকে- এমনটাই মনে করছেন বঞ্চিত ও হতাশাগ্রস্ত দলীয় নেতা-কর্মীরা।
রাজশাহী-৫ আসনের সংসদ সদস্য কাজী আব্দুল ওয়াদুদ দারার অবস্থা আরো নাজুক। তাঁর ভাই আবু হানিফ সুজা ও চাচাতো ভাই সালাহউদ্দিন রিপন এবং দুই চাচা আলিউজ্জামান মন্টু ও শরীফ কাজীর নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে অতিষ্ঠ এলাকার সাধারণ মানুষ। এ ছাড়া দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যেও রয়েছে চরম হতাশা ও ক্ষোভ। নানাভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতা-কর্মীরা। এ অবস্থায় এমপি দারা ঈদের মধ্যে ক্ষোভ ও তোপের মুখে পড়তে পারেন। ইতিমধ্যে তিনি তাঁর নির্বাচনী এলাকায় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুঠিয়া ও দুর্গাপুর থানার পুলিশের নিরাপত্তা নিয়ে চলাচল করছেন। তাঁর গাড়ির আগে অথবা পেছনেই থাকে পুলিশের পিকআপ।
আর রাজশাহী-৬ আসনের এমপি শাহরিয়ার আলম তোপের মুখে পড়তে পারেন বাঘা পৌরসভার বহিষ্কৃত মেয়র আক্কাস আলীর অনুসারী নেতা-কর্মীদের। মেয়র পদ থেকে আক্কাসকে সাময়িক বহিষ্কার এবং তাঁর বিরুদ্ধে ও তাঁর অনুসারী ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে সম্প্রতি একের পর এক মামলা দায়েরের পর অভিযোগ ওঠে, এমপির ইন্ধনেই এগুলো করা হয়েছে। আর এসব কারণে তাঁর ওপর বেজায় ক্ষুব্ধ হয়ে আছেন আক্কাসের অনুসারীরা। এ ছাড়া নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থতাসহ নানা অভিযোগে এবং গ্রুপিং-লবিংয়ে জর্জরিত চারঘাট-বাঘার তৃণমূল আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের মধ্যেও রয়েছে চরম হতাশা ও ক্ষোভ। তাঁদের দাবি, এমপি শাহরিয়ার আলমও এবার ঈদে দলীয় নেতা-কর্মীদের তোপের মুখে পড়তে পারেন।
আওয়ামী লীগের এই তিন এমপির পরিস্থিতির কথা জানিয়েছেন আমাদের রাজশাহী প্রতিনিধি। এই তিন সংসদ সদস্যের বিতর্কিত বিভিন্ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরে ইতিমধ্যে গোয়েন্দা প্রতিবেদনও দেওয়া হয়েছে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার কাছে।
ঈদ সবার জন্য খুশির বারতা নিয়ে এলেও এবারের ঈদ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য সুখকর নাও হতে পারে। অন্যান্যবারের চেয়ে এবার দেশে দ্রব্যমূল্য এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি সত্ত্বেও এলাকায় নিজ দলের মধ্যে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবেন ক্ষমতাসীন দলের অনেক মন্ত্রী, এমপি ও নেতা। দেশের বিভিন্ন স্থানে খোঁজ নিয়ে এ তথ্য জানা গেছে। তবে নির্বাচনের আগে এই ঈদকে জনগণের সঙ্গে দলের সম্পর্কোন্নয়নের সুযোগ হিসেবেও দেখছেন অনেকে। ঈদ সামনে রেখে তাঁরা এলাকায় জনসংযোগ এবং সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের ফিরিস্তি তুলে ধরার পরিকল্পনা করছেন। কিন্তু অন্যান্যবারের মতো এবার এমপিদের জন্য এ কাজ সহজ হবে না বলে জানা গেছে। সরকারের সাড়ে তিন বছরে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলোর অধিকাংশ বাস্তবায়িত না হওয়ায় সমর্থন চাইতে গেলে জনগণের জবাবদিহিতার মুখে পড়তে হবে তাঁদের। এ ছাড়া ক্ষমতাসীন হওয়ার ফলে সারা দেশে মন্ত্রী ও এমপির সঙ্গে দল, দলীয় উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌর চেয়ারম্যান, সাবেক এমপি ও স্থানীয় নেতা-কর্মীদের দূরত্ব নানা কারণে বেড়েছে। দলের পক্ষ থেকে এই দূরত্ব ঘোচানোর যথাযথ পদক্ষেপ না নেওয়ায় দলের ভেতরেই দু-তিনটি ধারা সৃষ্টি হয়েছে। উপরন্তু দেশের বিভিন্ন জায়গায় সংস্কারপন্থী আখ্যায়িত করে যাঁদেরকে দলে উপেক্ষিত রাখা হয়েছিল, এত দিনে তাঁরাও সক্রিয় হয়েছেন এবং বর্তমান এমপিদের বিভিন্ন নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের কারণে সেই উপেক্ষিত ব্যক্তিদের পালেও নতুন করে হাওয়া লেগেছে। তাঁরাও পরবর্তী নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে খোঁজ পাওয়া গেছে।
আবার ঈদ উপহার বিতরণ নিয়েও জটিলতার আশঙ্কা রয়েছে। কাবিখা ও টিআর কর্মসূচি নিয়ে প্রায় সব জায়গায় এমপিদের সঙ্গে স্থানীয় নেতাদের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে গত সাড়ে তিন বছরে। গত জুন মাসে আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের বর্ধিত সভায় সারা দেশ থেকে আসা তৃণমূল নেতারা এসব অভিযোগ করেছেন কেন্দ্রীয় নেতাদের সামনে। তৃণমূল নেতারা এমন অভিযোগও করেন যে, অতীতে বিএনপি-জামায়াতের দুঃশাসনের সময় যাঁরা নির্যাতিত হয়েছিলেন, দল ক্ষমতায় এলেও তাঁরা এখন নিজেদের মন্ত্রী-এমপিদের নির্যাতন-বঞ্চনারও শিকার হচ্ছেন।
আবার এমপিদের অনেকেই এলাকার সঙ্গে যোগাযোগ না রাখায় তাঁরা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। ঈদকে সামনে রেখে তাঁরাই সবচেয়ে বেশি ঝামেলার মুখোমুখি হবেন। এ ছাড়া নির্বাচনকে সামনে রেখে দলের ভেতরেও একাধিক প্রার্থী নেমেছেন মনোনয়ন পাওয়ার দৌড়ে। তাঁরা অতীতে বিভিন্ন সময় এমপিদের সঙ্গে থাকলেও এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। অধিকাংশ সংসদীয় এলাকায় তাঁরা এমপিদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছেন।
এর ওপর আবার আছে সারা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার বেহাল দশা। ঈদে বাড়ি যাওয়া-আসার সময় মানুষ এই ভোগান্তিতে পড়বে আর সমালোচনায় মুখর হবে ক্ষমতাসীন দলের নেতা, মন্ত্রী ও সাংসদদের। আবার পদ্মা সেতু নিয়ে এখনো কোনো সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে না পারায় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের ক্ষোভ আরো বেশি সরকারের ওপর।
গত ১১ জুন সংসদ নেতা শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠকে সতর্ক করে বলেন, এমপিদের মধ্যে ৬০ জনের অবস্থা খারাপ। পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে এই আসনগুলোতে তাঁর দল ভালো ফল নাও করতে পারে। স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি থাকলে তা মিটিয়ে ফেলে তাঁদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করার জন্য নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা। কিছু আসনে মনোনয়ন পরিবর্তন এবং পরবর্তী নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দেন তিনি।
এভাবে সারা দেশের ৩০০ আসনের মধ্যে শতাধিক আসনে ভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে নয়, নিজ দলের নেতারা পরস্পরের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছেন আওয়ামী লীগে। আর ঈদের সফরকে কেন্দ্র করে এই দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নেবে- এমন আশঙ্কা দলের ভেতর থেকেই করা হচ্ছে।
আমাদের নরসিংদী প্রতিনিধি জানান, এই জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হয়েও ১০ মাস ধরে নরসিংদীতে আসতে পারছেন না ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু। মন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকা রায়পুরার সাধারণ মানুষ তথা জেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের ধারণা ছিল, এবারের ঈদে হয়তো মন্ত্রী রাজু তাঁর দীর্ঘ নির্বাসন কাটিয়ে নিজ জেলায় ফিরবেন। কিন্তু সেই আশা পূরণ হচ্ছে না। নরসিংদীর জনপ্রিয় পৌর মেয়র ও শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লোকমান হোসেন হত্যাকাণ্ডের বিতর্কে জড়িয়ে দলীয় প্রতিপক্ষের রোষানলে পড়ার শঙ্কায় কেন্দ্রের সবুজ সংকেত না মেলায় এবারের ঈদে মন্ত্রী রাজু নিজ জেলায় আসতে পারছেন না। তবে মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠরা জানিয়েছেন, সব বাধা কাটিয়ে ঈদের পর নরসিংদীতে আসবেন মন্ত্রী। সেই অনুযায়ী মন্ত্রীকে বরণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তাঁর সমর্থক নেতা-কর্মীরা।
আমাদের খুলনা প্রতিনিধি জানিয়েছেন, জেলায় আওয়ামী লীগের অধিকাংশ আসনেই দলের অবস্থা নাজুক। এর মধ্যে খুলনা-৬ আসনের সংসদ সদস্য সোহরাব আলী সানার অবস্থান খুবই খারাপ। ঈদকে সামনে রেখে তিনি আরো বেকায়দায় আছেন বলে জানা গেছে। কয়রা এলাকার মানুষে তাঁর ওপর বেজায় ক্ষুব্ধ। তাঁদের অভিযোগ, তিনি কয়রা এলাকার লোকজনের সঙ্গে ঠিকমতো কথা বলেন না, নির্বাচনের পর সেখানে একটি রাতও অবস্থান করেননি। সাম্প্রতিক সময়ে আওয়ামী লীগের কয়রা উপজেলা সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান মহসিন রেজার বিরুদ্ধে এমপি নিজেই ইউপি সদস্যদের উসকানি দিয়ে অনাস্থা প্রস্তাব পাস করিয়েছেন। সংসদ সদস্য কর্তৃক পাইপ দিয়ে নোনা পানি তুলে চিংড়ি চাষ করা, সব কাজে ছেলে ও জামাইয়ের পরামর্শ মেনে নিয়ে কাজ করা এবং দলীয় কর্মী-অনুসারীদের এড়িয়ে নব্য আওয়ামী লীগারদের দিয়ে একটি আজ্ঞাবহ গোষ্ঠী গড়ে তুলে নিজের স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করার প্রতিবাদ হিসেবে কয়রা উপজেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তাঁকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ কারণে ক্ষুব্ধ এমপি উপজেলা চেয়ারম্যানকে পদ্ধতিগত জালে ফেলে সাজা দিলেন। এখন স্থানীয় আওয়ামী লীগারদের তোপের মুখে পড়েছেন এমপি।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা হারুন-অর-রশীদ বলেন, 'সংসদ সদস্য আমাদের নেতা নন। তিনি গোষ্ঠীর নেতা। কিছু মানুষকে সুবিধা পাইয়ে দিয়ে তিনি তাঁর কর্তৃত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করছেন। তবে এটি আর হবে না। তাঁকে এবার আমরা বয়কট করব।'
সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, দলীয় নেতা-কর্মীদের বাদ দিয়ে ১০ জন পিএস, এপিএসের মাধ্যমে উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করায় এবং নেতা-কর্মীদের মূল্যায়ন না করায় সুনামগঞ্জ-১ আসনের এমপি মোয়াজ্জেম হোসেন রতন এখন প্রায়ই নেতা-কর্মীদের তোপের মুখে পড়ছেন। গত ৯ আগস্ট তাঁর নির্বাচনী এলাকা ধরমপাশা উপজেলা যুবলীগ ও আওয়ামী লীগ তাঁকে চ্যালেঞ্জ করে তাঁর অনুপস্থিতিতে ১৫ আগস্ট শোক দিবস পালনের প্রস্তুতি সভা ও দলীয় বর্ধিত সভা করেছে। ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসও এমপিকে বাদ দিয়ে করেছে তারা। এর আগে গত সপ্তাহে জামালগঞ্জে নেতা-কর্মীদের তোপের মুখে পড়ে সভা না করেই ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন তিনি। তবে তাঁর নির্বাচনী অন্য উপজেলা তাহিরপুরে নির্বিঘ্নে দলীয় কার্যক্রম পালন করছেন তিনি।
ধরমপাশা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আবদুল হাই তালুকদার বলেন, 'এমপি সাহেব দলীয় নেতা-কর্মীদের কোনো মূল্যায়ন করেন না। তার ১০ জন পিএস, এপিএস যা বলেন তা-ই করেন। সাংগঠনিক কাজে তিনি সময় ব্যয় না করায় নেতা-কর্মীরা হতাশ। অনেকে তাঁর এমন কাণ্ডে চরম ক্ষুব্ধ।'
সুনামগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও এই আসনের নেতা অ্যাডভোকেট আক্তারুজ্জামান সেলিম বলেন, নির্বাচনী এলাকার কারো সঙ্গে এমপির সম্পর্ক নেই। তিনি ভাগবাটোয়ারার খবর নিলেও নেতা-কর্মীদের সুখ-দুঃখের খবর নেন না। তাঁর প্রতি নেতা-কর্মীরা ক্ষুব্ধ।
এসব আসন ছাড়াও চট্টগ্রাম-৯, নারায়ণগঞ্জ-২ ও ৪, কুমিল্লা-৬, খুলনা-৬, বরিশাল-২ ও ৩, নেত্রকোনা-১ ও ৩, যশোর-১, ২, ৩ ও ৬, কক্সবাজার-৪, বরগুনা-১, পিরোজপুর-২, রংপুর-৪ ও ৫, সিলেট-৫, গাইবান্ধা-২ ও ৫, চুয়াডাঙ্গা-১, রাজশাহী-৬, পাবনা-১, সাতক্ষীরা-১ ও ৩, পটুয়াখালী-৩, ভোলা-৪, ময়মনসিংহ-১০, ঢাকা-৪, শরীয়তপুর-১ আসনেও আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী মাঠে নেমেছেন সামনের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে।
তবে বিভিন্ন জায়গায় দলের এসব সমস্যা সময়মতো মিটিয়ে ফেলা হবে বলে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন কালের কণ্ঠকে বলেন, আওয়ামী লীগের মতো বড় দলে সমস্যা থাকবেই। সংসদ সদস্যদের প্রতিদ্বন্দ্বী থাকতেই পারে। তবে সময় হলে দলীয় সভাপতি এগুলো মিটিয়ে ফেলবেন।
রাজশাহী-৫ আসনের সংসদ সদস্য কাজী আব্দুল ওয়াদুদ দারার অবস্থা আরো নাজুক। তাঁর ভাই আবু হানিফ সুজা ও চাচাতো ভাই সালাহউদ্দিন রিপন এবং দুই চাচা আলিউজ্জামান মন্টু ও শরীফ কাজীর নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে অতিষ্ঠ এলাকার সাধারণ মানুষ। এ ছাড়া দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যেও রয়েছে চরম হতাশা ও ক্ষোভ। নানাভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতা-কর্মীরা। এ অবস্থায় এমপি দারা ঈদের মধ্যে ক্ষোভ ও তোপের মুখে পড়তে পারেন। ইতিমধ্যে তিনি তাঁর নির্বাচনী এলাকায় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুঠিয়া ও দুর্গাপুর থানার পুলিশের নিরাপত্তা নিয়ে চলাচল করছেন। তাঁর গাড়ির আগে অথবা পেছনেই থাকে পুলিশের পিকআপ।
আর রাজশাহী-৬ আসনের এমপি শাহরিয়ার আলম তোপের মুখে পড়তে পারেন বাঘা পৌরসভার বহিষ্কৃত মেয়র আক্কাস আলীর অনুসারী নেতা-কর্মীদের। মেয়র পদ থেকে আক্কাসকে সাময়িক বহিষ্কার এবং তাঁর বিরুদ্ধে ও তাঁর অনুসারী ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে সম্প্রতি একের পর এক মামলা দায়েরের পর অভিযোগ ওঠে, এমপির ইন্ধনেই এগুলো করা হয়েছে। আর এসব কারণে তাঁর ওপর বেজায় ক্ষুব্ধ হয়ে আছেন আক্কাসের অনুসারীরা। এ ছাড়া নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থতাসহ নানা অভিযোগে এবং গ্রুপিং-লবিংয়ে জর্জরিত চারঘাট-বাঘার তৃণমূল আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের মধ্যেও রয়েছে চরম হতাশা ও ক্ষোভ। তাঁদের দাবি, এমপি শাহরিয়ার আলমও এবার ঈদে দলীয় নেতা-কর্মীদের তোপের মুখে পড়তে পারেন।
আওয়ামী লীগের এই তিন এমপির পরিস্থিতির কথা জানিয়েছেন আমাদের রাজশাহী প্রতিনিধি। এই তিন সংসদ সদস্যের বিতর্কিত বিভিন্ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরে ইতিমধ্যে গোয়েন্দা প্রতিবেদনও দেওয়া হয়েছে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার কাছে।
ঈদ সবার জন্য খুশির বারতা নিয়ে এলেও এবারের ঈদ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য সুখকর নাও হতে পারে। অন্যান্যবারের চেয়ে এবার দেশে দ্রব্যমূল্য এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি সত্ত্বেও এলাকায় নিজ দলের মধ্যে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবেন ক্ষমতাসীন দলের অনেক মন্ত্রী, এমপি ও নেতা। দেশের বিভিন্ন স্থানে খোঁজ নিয়ে এ তথ্য জানা গেছে। তবে নির্বাচনের আগে এই ঈদকে জনগণের সঙ্গে দলের সম্পর্কোন্নয়নের সুযোগ হিসেবেও দেখছেন অনেকে। ঈদ সামনে রেখে তাঁরা এলাকায় জনসংযোগ এবং সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের ফিরিস্তি তুলে ধরার পরিকল্পনা করছেন। কিন্তু অন্যান্যবারের মতো এবার এমপিদের জন্য এ কাজ সহজ হবে না বলে জানা গেছে। সরকারের সাড়ে তিন বছরে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলোর অধিকাংশ বাস্তবায়িত না হওয়ায় সমর্থন চাইতে গেলে জনগণের জবাবদিহিতার মুখে পড়তে হবে তাঁদের। এ ছাড়া ক্ষমতাসীন হওয়ার ফলে সারা দেশে মন্ত্রী ও এমপির সঙ্গে দল, দলীয় উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌর চেয়ারম্যান, সাবেক এমপি ও স্থানীয় নেতা-কর্মীদের দূরত্ব নানা কারণে বেড়েছে। দলের পক্ষ থেকে এই দূরত্ব ঘোচানোর যথাযথ পদক্ষেপ না নেওয়ায় দলের ভেতরেই দু-তিনটি ধারা সৃষ্টি হয়েছে। উপরন্তু দেশের বিভিন্ন জায়গায় সংস্কারপন্থী আখ্যায়িত করে যাঁদেরকে দলে উপেক্ষিত রাখা হয়েছিল, এত দিনে তাঁরাও সক্রিয় হয়েছেন এবং বর্তমান এমপিদের বিভিন্ন নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের কারণে সেই উপেক্ষিত ব্যক্তিদের পালেও নতুন করে হাওয়া লেগেছে। তাঁরাও পরবর্তী নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে খোঁজ পাওয়া গেছে।
আবার ঈদ উপহার বিতরণ নিয়েও জটিলতার আশঙ্কা রয়েছে। কাবিখা ও টিআর কর্মসূচি নিয়ে প্রায় সব জায়গায় এমপিদের সঙ্গে স্থানীয় নেতাদের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে গত সাড়ে তিন বছরে। গত জুন মাসে আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের বর্ধিত সভায় সারা দেশ থেকে আসা তৃণমূল নেতারা এসব অভিযোগ করেছেন কেন্দ্রীয় নেতাদের সামনে। তৃণমূল নেতারা এমন অভিযোগও করেন যে, অতীতে বিএনপি-জামায়াতের দুঃশাসনের সময় যাঁরা নির্যাতিত হয়েছিলেন, দল ক্ষমতায় এলেও তাঁরা এখন নিজেদের মন্ত্রী-এমপিদের নির্যাতন-বঞ্চনারও শিকার হচ্ছেন।
আবার এমপিদের অনেকেই এলাকার সঙ্গে যোগাযোগ না রাখায় তাঁরা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। ঈদকে সামনে রেখে তাঁরাই সবচেয়ে বেশি ঝামেলার মুখোমুখি হবেন। এ ছাড়া নির্বাচনকে সামনে রেখে দলের ভেতরেও একাধিক প্রার্থী নেমেছেন মনোনয়ন পাওয়ার দৌড়ে। তাঁরা অতীতে বিভিন্ন সময় এমপিদের সঙ্গে থাকলেও এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। অধিকাংশ সংসদীয় এলাকায় তাঁরা এমপিদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছেন।
এর ওপর আবার আছে সারা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার বেহাল দশা। ঈদে বাড়ি যাওয়া-আসার সময় মানুষ এই ভোগান্তিতে পড়বে আর সমালোচনায় মুখর হবে ক্ষমতাসীন দলের নেতা, মন্ত্রী ও সাংসদদের। আবার পদ্মা সেতু নিয়ে এখনো কোনো সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে না পারায় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের ক্ষোভ আরো বেশি সরকারের ওপর।
গত ১১ জুন সংসদ নেতা শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠকে সতর্ক করে বলেন, এমপিদের মধ্যে ৬০ জনের অবস্থা খারাপ। পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে এই আসনগুলোতে তাঁর দল ভালো ফল নাও করতে পারে। স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি থাকলে তা মিটিয়ে ফেলে তাঁদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করার জন্য নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা। কিছু আসনে মনোনয়ন পরিবর্তন এবং পরবর্তী নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দেন তিনি।
এভাবে সারা দেশের ৩০০ আসনের মধ্যে শতাধিক আসনে ভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে নয়, নিজ দলের নেতারা পরস্পরের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছেন আওয়ামী লীগে। আর ঈদের সফরকে কেন্দ্র করে এই দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নেবে- এমন আশঙ্কা দলের ভেতর থেকেই করা হচ্ছে।
আমাদের নরসিংদী প্রতিনিধি জানান, এই জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হয়েও ১০ মাস ধরে নরসিংদীতে আসতে পারছেন না ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু। মন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকা রায়পুরার সাধারণ মানুষ তথা জেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের ধারণা ছিল, এবারের ঈদে হয়তো মন্ত্রী রাজু তাঁর দীর্ঘ নির্বাসন কাটিয়ে নিজ জেলায় ফিরবেন। কিন্তু সেই আশা পূরণ হচ্ছে না। নরসিংদীর জনপ্রিয় পৌর মেয়র ও শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লোকমান হোসেন হত্যাকাণ্ডের বিতর্কে জড়িয়ে দলীয় প্রতিপক্ষের রোষানলে পড়ার শঙ্কায় কেন্দ্রের সবুজ সংকেত না মেলায় এবারের ঈদে মন্ত্রী রাজু নিজ জেলায় আসতে পারছেন না। তবে মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠরা জানিয়েছেন, সব বাধা কাটিয়ে ঈদের পর নরসিংদীতে আসবেন মন্ত্রী। সেই অনুযায়ী মন্ত্রীকে বরণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তাঁর সমর্থক নেতা-কর্মীরা।
আমাদের খুলনা প্রতিনিধি জানিয়েছেন, জেলায় আওয়ামী লীগের অধিকাংশ আসনেই দলের অবস্থা নাজুক। এর মধ্যে খুলনা-৬ আসনের সংসদ সদস্য সোহরাব আলী সানার অবস্থান খুবই খারাপ। ঈদকে সামনে রেখে তিনি আরো বেকায়দায় আছেন বলে জানা গেছে। কয়রা এলাকার মানুষে তাঁর ওপর বেজায় ক্ষুব্ধ। তাঁদের অভিযোগ, তিনি কয়রা এলাকার লোকজনের সঙ্গে ঠিকমতো কথা বলেন না, নির্বাচনের পর সেখানে একটি রাতও অবস্থান করেননি। সাম্প্রতিক সময়ে আওয়ামী লীগের কয়রা উপজেলা সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান মহসিন রেজার বিরুদ্ধে এমপি নিজেই ইউপি সদস্যদের উসকানি দিয়ে অনাস্থা প্রস্তাব পাস করিয়েছেন। সংসদ সদস্য কর্তৃক পাইপ দিয়ে নোনা পানি তুলে চিংড়ি চাষ করা, সব কাজে ছেলে ও জামাইয়ের পরামর্শ মেনে নিয়ে কাজ করা এবং দলীয় কর্মী-অনুসারীদের এড়িয়ে নব্য আওয়ামী লীগারদের দিয়ে একটি আজ্ঞাবহ গোষ্ঠী গড়ে তুলে নিজের স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করার প্রতিবাদ হিসেবে কয়রা উপজেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তাঁকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ কারণে ক্ষুব্ধ এমপি উপজেলা চেয়ারম্যানকে পদ্ধতিগত জালে ফেলে সাজা দিলেন। এখন স্থানীয় আওয়ামী লীগারদের তোপের মুখে পড়েছেন এমপি।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা হারুন-অর-রশীদ বলেন, 'সংসদ সদস্য আমাদের নেতা নন। তিনি গোষ্ঠীর নেতা। কিছু মানুষকে সুবিধা পাইয়ে দিয়ে তিনি তাঁর কর্তৃত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করছেন। তবে এটি আর হবে না। তাঁকে এবার আমরা বয়কট করব।'
সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, দলীয় নেতা-কর্মীদের বাদ দিয়ে ১০ জন পিএস, এপিএসের মাধ্যমে উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করায় এবং নেতা-কর্মীদের মূল্যায়ন না করায় সুনামগঞ্জ-১ আসনের এমপি মোয়াজ্জেম হোসেন রতন এখন প্রায়ই নেতা-কর্মীদের তোপের মুখে পড়ছেন। গত ৯ আগস্ট তাঁর নির্বাচনী এলাকা ধরমপাশা উপজেলা যুবলীগ ও আওয়ামী লীগ তাঁকে চ্যালেঞ্জ করে তাঁর অনুপস্থিতিতে ১৫ আগস্ট শোক দিবস পালনের প্রস্তুতি সভা ও দলীয় বর্ধিত সভা করেছে। ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসও এমপিকে বাদ দিয়ে করেছে তারা। এর আগে গত সপ্তাহে জামালগঞ্জে নেতা-কর্মীদের তোপের মুখে পড়ে সভা না করেই ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন তিনি। তবে তাঁর নির্বাচনী অন্য উপজেলা তাহিরপুরে নির্বিঘ্নে দলীয় কার্যক্রম পালন করছেন তিনি।
ধরমপাশা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আবদুল হাই তালুকদার বলেন, 'এমপি সাহেব দলীয় নেতা-কর্মীদের কোনো মূল্যায়ন করেন না। তার ১০ জন পিএস, এপিএস যা বলেন তা-ই করেন। সাংগঠনিক কাজে তিনি সময় ব্যয় না করায় নেতা-কর্মীরা হতাশ। অনেকে তাঁর এমন কাণ্ডে চরম ক্ষুব্ধ।'
সুনামগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও এই আসনের নেতা অ্যাডভোকেট আক্তারুজ্জামান সেলিম বলেন, নির্বাচনী এলাকার কারো সঙ্গে এমপির সম্পর্ক নেই। তিনি ভাগবাটোয়ারার খবর নিলেও নেতা-কর্মীদের সুখ-দুঃখের খবর নেন না। তাঁর প্রতি নেতা-কর্মীরা ক্ষুব্ধ।
এসব আসন ছাড়াও চট্টগ্রাম-৯, নারায়ণগঞ্জ-২ ও ৪, কুমিল্লা-৬, খুলনা-৬, বরিশাল-২ ও ৩, নেত্রকোনা-১ ও ৩, যশোর-১, ২, ৩ ও ৬, কক্সবাজার-৪, বরগুনা-১, পিরোজপুর-২, রংপুর-৪ ও ৫, সিলেট-৫, গাইবান্ধা-২ ও ৫, চুয়াডাঙ্গা-১, রাজশাহী-৬, পাবনা-১, সাতক্ষীরা-১ ও ৩, পটুয়াখালী-৩, ভোলা-৪, ময়মনসিংহ-১০, ঢাকা-৪, শরীয়তপুর-১ আসনেও আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী মাঠে নেমেছেন সামনের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে।
তবে বিভিন্ন জায়গায় দলের এসব সমস্যা সময়মতো মিটিয়ে ফেলা হবে বলে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন কালের কণ্ঠকে বলেন, আওয়ামী লীগের মতো বড় দলে সমস্যা থাকবেই। সংসদ সদস্যদের প্রতিদ্বন্দ্বী থাকতেই পারে। তবে সময় হলে দলীয় সভাপতি এগুলো মিটিয়ে ফেলবেন।
No comments