প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ, তবে সংশয় দূর হয়নি by হায়দার আকবর খান রনো

আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে বিশ্বব্যাংককে এমন ভাষায় চিত্রিত করা এবং এত কড়া ভাষা প্রয়োগ করতে পারেননি এ যাবৎকালের কোনো সরকারপ্রধান। শেখ হাসিনার নিশ্চয়ই অজানা নয় যে বিশ্বব্যাংক যুক্তরাষ্ট্র তথা সাম্রাজ্যবাদেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার।


বিষয়টা বুঝতে না পারার কোনো কারণ নেই, যখন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টের পদটি মার্কিন সরকারের জন্য নির্ধারিত। মার্কিন প্রশাসন ঠিক করে দেবে কে হবেন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট। এসব জেনেশুনেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাংকের কড়া সমালোচনা করতে ছাড়েননি। এতে যে মার্কিন প্রশাসনের বিরাগভাজন হতে হবে, সেটা জেনেও তিনি সত্য কথাটি বলেছেন সাহসের সঙ্গে, বলিষ্ঠতার সঙ্গে। সঙ্গে কিছু ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্যও ছিল, যা তাদের গায়ে বেশি করে জ্বালা সৃষ্টি করবে।
এর আগে কালের কণ্ঠের পাতায় এক লেখায় আমি বলেছিলাম, এতকাল কমিউনিস্ট ও বামপন্থীরা যে কথা বলে এসেছেন, এখন সেই কথাই শুনছি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর মুখে। বিশ্বব্যাংকের সমালোচনা করলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা এবং তথাকথিত বুদ্ধিজীবী বা সুশীল সমাজের দাবিদার ব্যক্তিরা তাচ্ছিল্যভরে বলতেন, ওসব বামপন্থী-কমিউনিস্টদের বুলি। ওসব শুনলে কি দেশ চলবে? আমরা গরিব দেশ, বিশ্বব্যাংকের ঋণ নাকি আমাদের লাগবেই। সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে কত ধরনের ওকালতি। বুদ্ধিজীবীদের একাংশের আবার নির্লজ্জ ওকালতির কারণ কিছুটা ইনিয়ে-বিনিয়ে খানিকটা বিজ্ঞের ঢঙে। আজ যখন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বিশ্বব্যাংকের সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছেন এবং সাহসের সঙ্গে ঘোষণা করছেন, আমরাই পারি নিজের অর্থে পদ্মা সেতু করতে, তখন গর্বিত জাতির অংশ হিসেবে আমার বুকটা ফুলে ওঠে। জানি না, তখন ওইসব বুদ্ধিজীবীর দল কোথায় মুখ লুকাচ্ছেন। বিশেষ করে যাঁরা আওয়ামী ঘরানার বুদ্ধিজীবী বলে পরিচিত এবং যাঁরা দুদিন আগেও বলতেন, বামপন্থীদের চালে পা দিলে সর্বনাশ। কারণ বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের সাহায্য (?) ছাড়া নাকি চলবে না। এই তো বিগত বাজেট সেশনের ঠিক আগে আগে এই শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার আইএমএফের সঙ্গে সর্বনাশা চুক্তি করেছিল। সেই শেখ হাসিনা যখন ভিন্ন সুরে কথা বলেন, তখন বিস্মিত হলেও আনন্দিত হয়েছি।
আসুন, আমরা একটু ইতিহাসের দিকে ফিরে দেখি। আমাদের দেশের বুর্জোয়া নেতারা সাধারণভাবে মার্কিন প্রশাসনের দালালি করতে অভ্যস্ত হলেও কখনো কখনো দু-একজন নেতা সাময়িক সময়ের জন্য হলেও কিছুটা স্বাধীন ভূমিকা দেখাতে চেয়েছেন। আওয়ামী লীগের এককালীন নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীও ১৯৫৭ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়ে পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি, মার্কিন সামরিক জোটের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন এই যুক্তিতে যে আমেরিকা ছাড়া নাকি আমাদের চলবে না। এখনো ঠিক একইভাবে এ-দেশীয় কিছু বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজের অংশ বলছেন, বিশ্বব্যাংক ছাড়া নাকি আমাদের চলবে না। সেই একই পুরনো যুক্তি। তাজউদ্দীন আহমদ মার্কিন সাহায্য লাগবে না বলে ঘোষণা করেছিলেন। এ পর্যন্ত একমাত্র তাজউদ্দীন আহমদ ছাড়া অন্য কোনো প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্ট বিদেশি সাহায্য ছাড়া স্বনির্ভর অর্থনীতির নীতির কথা বলেননি। অন্যদিকে খন্দকার মোশতাক প্রতিনিধিত্ব করতেন মার্কিন লবির। তাজউদ্দীন আহমদকে অপমানিত হয়ে সরে যেতে হয়েছিল তাঁর রাজনৈতিক ভূমিকার জন্য। সেদিন মোশতাক গ্রুপই জিতে গিয়েছিল। যে মোশতাক মাত্র অল্প সময়ের ব্যবধানে হত্যা করল বঙ্গবন্ধুকে।
দীর্ঘ চার দশক পর আবার সেই স্বনির্ভরের বাণী শোনালেন শেখ হাসিনা। তাঁর ব্যঙ্গাত্মক ভাষা ও ভাষার তীক্ষ্নতা আমাদের মনে সাহস জোগায়, জাতি হিসেবে মর্যাদাবোধ জাগ্রত করে। গত ২৬ জুলাই New Age পত্রিকায় রাজনৈতিক ভাষ্যকার ফারুক চৌধুরী লিখেছেন, Never before in the history of Bangladesh legislative assembly the global leader was discussed, dissected and criticized for so long a time with such words. Her (SK Hasina) pronouncements ponetimes made one imagine hearing voice from Latin America. She spoke of national honour and dignity, of the glorious war of liberation and was critical of the world Bank method and its practice. উল্লেখ্য, লেখক ফারুক চৌধুরী এবং New Age উভয়ের কেউই কিন্তু আওয়ামীপন্থী নন।
এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে দাঁড়িয়ে বিশ্বব্যাংকের অপকীর্তির কিছু বিবরণ তুলে ধরেছিলেন। বিশ্বব্যাংকের নির্দেশেই আমাদের গর্ব পৃথিবীর সর্ববৃহৎ পাটকল আদমজী বন্ধ করা হলো। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় যে পাটের দেশ বাংলাদেশে জুট মিল বন্ধ করতে হলো, যখন একই সময়ে নতুন করে পাটকল তৈরি হলো পশ্চিমবঙ্গে। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ কেবল মার্কিন ও পশ্চিমা বহুজাতিক করপোরেশনের স্বার্থই দেখে এবং সে জন্য তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের যে কী সর্বনাশ হয়েছে, তার বহু দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে।
অনেকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর মুখ দিয়ে স্থূল কথা নাকি আশা করা যায় না। কিন্তু আমরা তো দেখেছি, এর চেয়েও স্থূলভাবে অনেক অসভ্য কথা উচ্চারণ করেছেন মার্কিন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের মুখপাত্ররা। ইতিহাসের ছাত্ররা জানেন, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী চার্চিল মহাত্মা গান্ধীকে বলেছিলেন, 'অর্ধ উলঙ্গ ফকির'। সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ উত্তর কোরিয়ার সরকার ও জনগণ নিয়ে এ ধরনের অশালীন ভাষা ব্যবহার করছিলেন তা ওই দেশের শাসক শ্রেণীর সাংস্কৃতিক নিম্নমানের পরিচয় বহন করে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেক ভদ্রতা বজায় রেখেই নিষ্ঠুর সত্য কথাটি বলেছেন।
এ কথা সত্য, বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তারা ঘুষ খায়, কমিশন খায়। হ্যাঁ, বাংলাদেশের প্রশাসনও দুর্নীতিগ্রস্ত। কিন্তু তারাও পাল্লা দিয়ে কম যায় না। কানাডিয়ান কম্পানিকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনসহ অনেকের নাম যেমন শোনা যাচ্ছে, তেমনি বিশ্বব্যাংকও অনৈতিকভাবে বিশেষ করে চীনা কম্পানির জন্য সক্রিয় ছিল এবং সে ক্ষেত্রে অগ্রিম কমিশন খাওয়ার বিষয়টি একেবারে অমূলক নাও হতে পারে। শেখ হাসিনা যেভাবে অকপটে সত্যটি বলেছেন, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে।
একদিকে তিনি স্বদেশি অর্থায়নের ভিত্তিতে পদ্মা সেতুর কাজ হাতে নেওয়ার কথা বলছেন এবং সেভাবে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে সক্রিয় করেছেন। অন্যদিকে সংবাদপত্রের রিপোর্ট এই যে বাংলাদেশ আবার মালয়েশিয়ার সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করেছে। মালয়েশিয়ার অর্থে সেতু নির্মাণ ও তার সঙ্গে যেসব শর্তের কথা শোনা গেছে, তার অর্থনৈতিক ক্ষতির দিকটি বিরাট। কোনোভাবেই আমরা এ ধরনের কড়া সুদে ও কড়া শর্তে ব্যক্তিগত বিদেশি ঋণের মাধ্যমে প্রকল্পের কথা ভাবতে পারি না। তা ছাড়া দেখছি, অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেব আবারও বিশ্বব্যাংকের দরবারে ছোটাছুটি করছেন। মুহিত সাহেবের অবশ্য বিশ্বব্যাংকের প্রতি দুর্বলতা আগেও ছিল। এরশাদ সামরিক সরকারেরও অর্থমন্ত্রী তিনি ছিলেন। তখন তিনিই বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের কুপরামর্শে Structural Adjustment Programme করেছিলেন। ফলে তখন থেকে রেশনপ্রথা উঠে গেল, বাণিজ্যে উদারীকরণ নীতি এলো, কৃষিতে ভর্তুকি হ্রাস পেতে শুরু করল ইত্যাদি। তথাকথিত নয়া উদারনৈতিক অর্থনৈতিক নীতি এবং মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রবক্তা তো ছিলেন সেই অর্থমন্ত্রীই। একদিকে শেখ হাসিনা যখন নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে সেতু নির্মাণের ঘোষণা দিচ্ছেন, অন্যদিকে তখনই অর্থমন্ত্রী সেই আগের সুরে কথা বলছেন। এ প্রশ্নে কি অর্থমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে বিরোধ আছে? নাকি প্রধানমন্ত্রীরই একটা ঢাল মাত্র, যিনি দুই নৌকায় পা রাখতে চান।
আরো কিছু বিপজ্জনক সংকেত পাচ্ছি। আমেরিকান সপ্তম নৌবহর আমাদের দেশে ঘাঁটি করতে চায়। সে জন্যও চাপ আছে। ইতিমধ্যে মার্কিন সৈন্য যে বাংলাদেশে অবস্থান করছে, সে খবরও পাওয়া গেছে (সে সম্পর্কে বিস্তারিত লিখেছি)।
স্বনির্ভর হয়ে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজের পরিকল্পনাকে আমরা সাধুবাদ জানাই। কিন্তু এ প্রসঙ্গেও দু-একটি কথা বলতে চাই। প্রথমত, ইতিমধ্যে করভারে পিষ্ট গরিব মধ্যবিত্তের ওপর যেন আর চাপ না পড়ে। দ্বিতীয়ত, যে কালো টাকা দেশের মধ্যে ঘোরাঘুরি করছে (অর্থমন্ত্রীর ভাষ্য অনুযায়ী জিডিপির ৪০ থেকে ৮০ শতাংশ), তার একটা বড় অংশ উদ্ধার করলে তো একাধিক পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব। সেদিকে উদ্যোগী হতে হবে। তৃতীয়ত, অর্থনীতির অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ যে কথা বলেছেন, মাগুরছড়া ও টেংরাটিলার গ্যাস পুড়িয়ে যে ক্ষতিসাধন করেছে দুটি বিদেশি কম্পানি, তাদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করে যে টাকা পাওয়া যাবে, তা দিয়ে দুটি পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব। সে ক্ষেত্রে আমরা বৈদেশিক মুদ্রার সমস্যারও সমাধান করতে পারব। তা ছাড়া বিদেশে বসবাসরত বাংলাদেশি নাগরিক ও শ্রমিকদের রেমিট্যান্স কিভাবে সেতু নির্মাণের জন্য কাজে লাগানো যায়, সে সম্পর্কে অনেক ভালো প্রস্তাব ও উপদেশ ইতিমধ্যেই এসেছে। আমাদের নজর সেদিকে দিতে হবে।
আবারও বলছি, দুই নৌকায় পা দিলে কিন্তু সর্বনাশ। দেশেরও সর্বনাশ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্যও সর্বনাশ হতে পারে। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন ইস্যুতে যেমন- নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে কেন্দ্র করে মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্কে কিছুটা চিড় ধরেছে। মহাপুঁজিবাদী রাষ্ট্র, যাকে আমরা সাম্রাজ্যবাদ বলি, তারাই আবার আমাদের দেশের গার্মেন্ট শ্রমিকের দুরবস্থা নিয়ে ভেক কান্নাকাটি করছে অথবা হঠাৎ করে যুক্তরাষ্ট্রের একটি মানবাধিকার সংস্থা যে র‌্যাবকে নিষিদ্ধ করার জন্য সরকারের প্রতি প্রস্তাব রাখার মতো ঔদ্ধত্য দেখাচ্ছে- এসব কিসের ইঙ্গিত। যুক্তরাষ্ট্রে গার্মেন্টের বাজার বন্ধ হতে পারে এমন হুমকিও আসছে। র‌্যাব কর্তৃক বেআইনি গুম-খুনের জন্য র‌্যাব নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব আমরাও করেছি। গার্মেন্ট শ্রমিকদের ওপর অমানবিক নির্যাতন বন্ধের ও মজুরি বৃদ্ধির জন্য আমরাও দাবি করি। কিন্তু মার্কিন প্রশাসন অথবা সেই দেশের বহুজাতিক করপোরেশনের অর্থপুষ্ট কোনো সংস্থা যখন একই কথা বলে, তখন একটু অবাক হতে হয় বৈকি। সন্দেহ জাগে, অন্য কোনো মতলব আছে কী?
এ রকম সন্দেহ ক্রমেই প্রবল হয়ে উঠছে। শেষ পরিণতি কোথায় জানি না। শেখ হাসিনা কি জাতীয় মর্যাদা অক্ষুণ্ন্ন রেখে দেশপ্রেমিক ভূমিকা পালন করবেন, নাকি তাঁর দলের শ্রেণী-চরিত্র অনুযায়ী মাঝপথে সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে আপস-সমঝোতা করবেন, নাকি কোনো ষড়যন্ত্রের পরিণতিতে দেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎই নস্যাৎ হতে চলেছে, তা আরো কিছুদিন পর্যবেক্ষণ করার বিষয়।
লেখক : রাজনীতিবিদ ও কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.