মন্ত্রীর সামনেই ফেরি-গাড়ি লুকোচুরি by তৌফিক মারুফ

তিন নম্বর ফেরিঘাট দিয়ে বিআইডাব্লিউটিএর বিশেষ লঞ্চ 'তিস্তা'য় উঠলেন নৌপরিবহনমন্ত্রী মো. শাজাহান খান। তাঁর সঙ্গে ছিলেন নৌসচিব, বিআইডাব্লিউটিএ ও বিআইডাব্লিউটিসির চেয়ারম্যানদ্বয়সহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। ঘাট তখন অদ্ভুত রকমের ছিমছাম। ফেরি নেই, গাড়িও নেই।


এমনকি সামনের সড়কে নেই বাস-ট্রাকের ঠাসাঠাসি ভিড়ের নিত্যদিনের চিত্র। এ দৃশ্য গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টার। এপারে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ঘাট, ওপারে রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া। মাঝনদীতে দেখা মেলে কয়েকটি ফেরি। কোনোটি যায়, কোনোটি আসে। যাত্রীবোঝাই ছোট লঞ্চও চোখে পড়ে। একসময় মন্ত্রীর নৌবহর দৌলতদিয়া ঘাটে পৌঁছায়। এ প্রান্তও খালি। গাড়ি নেই। ফেরি নেই। তবে অন্য প্রান্তে ততক্ষণে একটি ফেরি পৌঁছে থেমে আছে। ঘাটকর্মী নাসির বলেন, 'গাড়ি কম থাকলে ফেরি বসে থাকে। গাড়ি এলেই ছাড়ে।' মন্ত্রী সফরসঙ্গীদের নিয়ে ঘাটে নেমে চলে যান কাছেই এক ডাকবাংলোতে। ঘণ্টাখানেক পর ফিরে এসে আবার বসেন তিস্তার ভিআইপি রুমে।
উপস্থিত সাংবাদিকরা মন্ত্রীর কাছে জানতে চান- 'কী দেখলেন?' মন্ত্রী বলেন, 'আপনারাও তো দেখছেন কী সুন্দর পরিবেশ। অথচ সব সময় এখানে একটি চক্র কৃত্রিম যানজট সৃষ্টি করে ফায়দা লুটতে চায়। এবার আর আমরা সেই সুযোগ দিইনি। এখন ঘাটে কোনো সময় নষ্ট হচ্ছে না। গাড়ি আসছে আর সিরিয়ালমতো টিকিট কেটে ফেরিতে উঠছে। ফেরি ছেড়ে যাচ্ছে। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য নেই।' এরপর মন্ত্রী যোগ করেন, 'আগের দিন এখানে আট হাজার গাড়ি পারাপার হয়েছে, আশি লাখ টাকা আয় হয়েছে। কোনো বিশৃঙ্খলা নেই। মানুষের ভোগান্তি নেই।'
কালের কণ্ঠের প্রশ্নের মুখে মন্ত্রী বলেন, 'এবার আমরা ফেরি ও লঞ্চে সেবা নিশ্চিত-নির্বিঘ্ন করতে শতভাগ শক্তি নিয়োগ করেছি। এ কৃতিত্ব কেবল নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের একার নয়; বিআইডাব্লিউটিএ, বিআইডাব্লিউটিসি, স্থানীয় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সবার চেষ্টায় আমরা সফল হয়েছি।' মন্ত্রী বলেন, 'আমাদের কোনো ফেরি বসে নেই। সব ফেরি চলছে। সামনে এ পরিস্থিতির আরো উন্নতি হবে। ঢাকা লঞ্চঘাটের (সদরঘাট) বিভিন্ন লঞ্চে অব্যবস্থাপনা, অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই, মালামাল বোঝাই এবং কোনো কোনো লঞ্চের বেপরোয়া আচরণ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে মন্ত্রী বলেন, সরকারি নৌ যাত্রী পরিবহনের সংখ্যা বাড়ানো গেলে বেসরকারি লঞ্চ মালিকদের দৌরাত্ম্য অনেকটা কমে যাবে। যাত্রী হয়রানি ঠেকাতে সরকারের সর্বোচ্চ চেষ্টা রয়েছে।
গত বুধবার সদরঘাটে সংসদ সদস্য গোলাম কিবরিয়া টিপুর মালিকানাধীন লঞ্চ এমভি টিপু-৩-এর বেপরোয়া ধাক্কায় একজন যাত্রীর মৃত্যুর বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে- এমন প্রশ্নের মুখে মন্ত্রী কিছুটা অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বলেন, 'কোনো লঞ্চ কোনো অনিয়ম করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে দেখা যাবে যাত্রীদের ভোগান্তি বেড়ে গেছে। এ জন্য অবশ্য যাত্রীদের সচেতনতা বাড়াতে হবে। তবে আমরা অনেক নৌযান মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি- অতীতে যা হয়নি।'
মন্ত্রীকে বহনকারী 'তিস্তা'র এবার ফেরত যাত্রা। পাটুয়ারিয়া ঘাটের কাছে আসতেই তীরে চোখে পড়ে যত দূর চোখ যায় দুই পাশে যাত্রীবাহী বাস ও মালবাহী ট্রাকের দীর্ঘ সারি। মন্ত্রী তাঁর বহর নিয়ে ঘাটে নামেন। পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা ওই বাস-ট্রাকের সারির মাঝখান দিয়ে পথ করে দেন মন্ত্রীর গাড়িবহর ঢাকার দিকে এগিয়ে যেতে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মন্ত্রীর পরিদর্শনের কারণেই ফেরিতে যানবাহন পরিবহন সাময়িক নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে।
এ সময় ঘাটে ফেরির জন্য অপেক্ষমাণ বাসের সারির মধ্যে হানিফ পরিবহনের যাত্রী এমদাদুল কড়া রোদে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলেন, 'সকাল সাড়ে ৯টায় গাবতলী থেকে বাস ছেড়েছে। পথে পথে যানজট ঠেলেঠুলে কোনো মতে বাস ঘাটে এলো। কিন্তু এখানে এসে আটকা পড়ে আছি দেড় ঘণ্টা ধরে। দেখেন, আমাদের পেছনে আরো কত গাড়ি, কত মানুষ।' দেখা গেলও তা-ই। যাত্রীরা বাস থেকে নেমে কেউ দুই বাসের মাঝে, কেউ পাশের গাছের ছায়ায় বসে বা দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় আছে ফেরি জন্য। খুলনাগামী যাত্রী রেহানা আক্তার বলেন, 'গাড়ির মধ্যে গরমে বসা যায় না। তাই বাচ্চা নিয়ে গাছের নিচে বসেছি।'
হাতপাখা বিক্রেতা কালাম বলেন, 'সকালের দিকে পাখা বেচাকেনা হয় নাই, এহন এই গাড়িগুলা আটকা পড়ার সুযোগে মানুষ গরমে, অতিষ্ঠ হইয়া পাখা কিনছে। আমার ভালোই হইছে।'
সব ফেরি সচল থাকার পরও ঘাটে পরিবহনের এত দীর্ঘ সারি কেন, জানতে চাইলে নৌমন্ত্রীর বহরে থাকা বিআইডাব্লিউটিএর উপপরিচালক আরিফ উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'প্রতিদিন এর চেয়ে অনেক বেশি যানজট থাকে, আজ বরং অনেকটাই কম।'
এর আগে মন্ত্রী পাটুয়ারিয়া লঞ্চঘাটে নেমে যাত্রী পরিবহন ব্যবস্থা পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি স্থানীয় সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন।
পাল্টে গেছে মাওয়া ঘাট : লৌহজং (মুন্সীগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, কর্তৃপক্ষ এবার সচেতন থাকায় মাওয়া ঘাটের চিত্র একেবারেই পাল্টে গেছে। ঘাটে নেই কোনো যানজট। ফেরিগুলো পরিবহনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। যাত্রীরা পার হচ্ছে নির্বিঘ্নে। সি-বোট ঘাটে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ ছাড়া ঘাটে টোল আদায় করা হচ্ছে নির্ধারিত রেটেই। ফেরিগুলো নিয়মিতভাবে ছেড়ে যাওয়ায় দূরপাল্লার কোনো পরিবহনকে ঘাটে যানজটে আটকা পড়তে দেখা যায়নি। মূলত ফেরিঘাট থেকে লঞ্চঘাট সরিয়ে নেওয়ায়ই মাওয়া ঘাটে দক্ষিণবঙ্গের যাত্রীদের এবার তেমন কোনো বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে না। বিশাল পার্কিং ইয়ার্ড, সেই সঙ্গে নিয়মতান্ত্রিকভাবে পার্ক করায় ঘাটে নেই কোনো ধরনের যানজট। এ ছাড়া মাওয়া চৌরাস্তায় সুব্যবস্থার কারণেই গাড়িগুলো সরাসরি পার্কিং ইয়ার্ডে চলে যাচ্ছে। ফলে ফেরিঘাটে যেতে দূরপাল্লার গাড়িগুলোকেও কোনো ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয়নি। ঈদ স্পেশালসহ ১৫টি ফেরি দিয়ে বিআডাব্লিউটিসি এবার ফেরি পারাপার করছে নির্বিঘ্নে।
জানা গেছে, পণ্যবাহী ট্রাকগুলোকে আটকিয়ে রেখে ঈদে ঘরমুখো যাত্রীবাহী পরিবহনগুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পার করছে বিআইডাব্লিউটিসি। আজ শুক্রবার থেকে যাত্রীদের সেবায় রোভার স্কাউট ঘাটে নামছে।
লৌহজং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলাম জানান, মাওয়া দিয়ে দক্ষিণবঙ্গের যাত্রীদের নির্বিঘ্নে ঘরে ফেরাতে ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। কোনো ধরনের হয়রানি ছাড়াই এবার যাত্রীরা বাড়ি ফিরছে। নিয়মিত টোলের বাইরে কোনো টাকা আদায় করতে দেওয়া হচ্ছে না। বিআইডাব্লিটিসির মাওয়া অফিসের এজিএম আশিকুজ্জামান জানান, পর্যাপ্ত ফেরির ব্যবস্থা থাকায় দূরপাল্লার গাড়িগুলো ঘাটে আসার সঙ্গে সঙ্গেই ফেরিতে উঠছে। ফলে ফেরির অপেক্ষায় এখন আর গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে থাকছে না। হাইওয়ে পুলিশের সার্জেন্ট শাহাদাৎ হোসেন জানান, পণ্যবাহী ট্রাকগুলো ১০ কিলোমিটার দূরে শ্রীনগর উপজেলার ছনবাড়ী নামক স্থানে আটকিয়ে দেওয়া হয়েছে। মাওয়া চৌরাস্তায় নেওয়া হয়েছে বিশেষ ট্রাফিক ব্যবস্থা। কোনো গাড়িকে চৌরাস্তায় দাঁড়াতে দেওয়া হচ্ছে না।

No comments

Powered by Blogger.