জনপ্রতিনিধি-সাংসদদের ‘বিশেষ অধিকার’ সীমাহীন হতে পারে না by বদিউল আলম মজুমদার

বিগত কয়েক সপ্তাহে সংবাদপত্রের কয়েকটি শিরোনাম নাগরিক হিসেবে আমাদের চরমভাবে উদ্বিগ্ন করেছে। প্রথম শিরোনামটি হলো ‘রাজউক চেয়ারম্যানের কাছে ব্যাখ্যা চাইবে সংসদীয় কমিটি’ (আমাদের সময়, ৬ জুলাই ২০১০)।
পরদিন ‘নূরুল হুদাকে শোকজ করবে সংসদীয় কমিটি’ এই শিরোনামে আরেকটি সংবাদ প্রকাশিত হয় (কালের কণ্ঠ, ৭ জুলাই ২০১০)।


সংবাদের বিবরণ থেকে জানা যায়, ৬ জুলাই গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরীর সভাপতিত্বে কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সিদ্ধান্ত হয়, সাংসদদের নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করায় রাজউকের চেয়ারম্যান নূরুল হুদাকে কমিটির পক্ষ থেকে কারণ দর্শানোর নির্দেশ দেওয়া হবে। জনাব হুদার কাছ থেকে লিখিত ব্যাখ্যা চাওয়া হবে এবং জবাবে কমিটি সন্তুষ্ট না হলে তাঁকে অপসারণের দাবি জানানো হবে। একই সঙ্গে ড্যাপ সম্পর্কে কোনো সভা-সেমিনারে তাঁকে বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত থাকতে মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করেছে কমিটি।
সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বৈঠকের শুরুতেই কমিটির সদস্যরা অভিযোগ তোলেন, ‘সাংসদদের ব্যাপারে ধৃষ্টতাপূর্ণ মন্তব্য করার সাহস রাজউক চেয়ারম্যান কোত্থেকে পেলেন? এর জবাব তাঁর কাছ থেকে নিতে হবে। ড্যাপ নিয়ে রাজউকসহ একটি মহলের আগ্রহ দেখে মনে হচ্ছে, তাদের কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে, যার সঙ্গে রাজউক চেয়ারম্যানও জড়িত।’
অপর একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘সাংসদদের বিরুদ্ধে মামলা করতে অনুমতি লাগবে’ (প্রথম আলো, ১৪ জুলাই ২০১০)। প্রতিবেদনে বলা হয়, সাংসদ ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহর বিরুদ্ধে এক ট্রাফিক সার্জেন্টকে মারধর করার অভিযোগে মামলার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেন, ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ একজন সাংসদ। তাঁর বিরুদ্ধে মামলার আগে যেমন চিন্তা করা উচিত ছিল, তেমনি মামলা নেওয়ার সময় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বিষয়টি অবহিত করা উচিত ছিল। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সাংসদদের ছোটখাটো ভুলের বিষয়ে মামলা করার আগে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে অবশ্যই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে, অনুমতি নিতে হবে। উল্লেখ্য, এ ঘটনার জন্য পরবর্তীকালে পুলিশের পক্ষ থেকে ক্ষমা চাওয়া হয় এবং বিষয়টি তদন্তের জন্য আইজিকে নির্দেশ দেওয়া হয়। প্রসঙ্গত, তদন্তের পর যদি সার্জেন্ট কিংবা ওসির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তা হবে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর সমতুল্য।
এ তিনটি খবরই ‘পার্লামেন্টারি প্রিভিলেজ’ বা সংসদ ও সাংসদদের বিশেষ অধিকার ও দায়মুক্তি-সম্পর্কিত। অর্থাৎ অভিযোগ, নূরুল হুদা তাঁর বক্তব্যের মাধ্যমে সাংসদদের মর্যাদাহানি এবং সংসদের অবমাননা করেছেন।
আমাদের সংবিধানের ৭৮ অনুচ্ছেদ সংসদ ও সাংসদদের বিশেষ অধিকার ও দায়মুক্তি-সম্পর্কিত। এ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘(১) সংসদের কার্যধারার বৈধতা সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না। (২) সংসদের যে সদস্য বা কর্মচারীর উপর সংসদের কার্যপ্রণালী নিয়ন্ত্রণ, কার্যপরিচালনা বা শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষমতা ন্যস্ত থাকিবে, তিনি এই সকল ক্ষমতাপ্রয়োগ-সম্পর্কিত কোন ব্যাপারে কোনো আদালতের এখতিয়ারের অধীন হইবেন না। (৩) সংসদে বা সংসদের কোন কমিটিতে কিছু বলা বা ভোট দানের জন্য কোন সংসদ-সদস্যের বিরুদ্ধে কোন আদালতে কার্যধারা গ্রহণ করা যাইবে না। (৪) সংসদ কর্তৃক বা সংসদের কর্তৃত্বে কোন রিপোর্ট, কাগজপত্র, ভোট বা কার্যধারা প্রকাশের জন্য কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোন আদালতে কোন কার্যধারা গ্রহণ করা যাইবে না। (৫) এ অনুচ্ছেদ-সাপেক্ষে সংসদের আইন-দ্বারা সংসদের, সংসদের কমিটিসমূহের এবং সংসদ-সদস্যদের বিশেষ-অধিকার নির্ধারণ করা যাইতে পারিবে।’ এ ছাড়া সংবিধানের ৭৬ অনুচ্ছেদও সংসদীয় কমিটিগুলোর কার্যপরিচালনার ক্ষেত্রে বিশেষ অধিকারসম্পর্কিত। এ ক্ষেত্রেও আইনের দ্বারা এ ক্ষমতা কার্যকর করার কথা।
সংবিধানের এ দুটি ধারাকে কার্যকরতা দেওয়ার জন্য আমাদের দেশে অদ্যাবধি কোনো আইন প্রণীত হয়নি। সংসদ ও সাংসদদের অধিকার ক্ষুণ্নের অভিযোগে কাউকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে বলেও আমাদের জানা নেই। বস্তুত গত বছর ফজলে রাব্বি মিয়ার সভাপতিত্বে গঠিত সংসদীয় কমিটি সাবেক স্পিকার ও বর্তমান সাংসদ জমির উদ্দিন সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির সুস্পষ্ট প্রমাণ পেলেও এ-সম্পর্কিত আইন ও দৃষ্টান্তের অভাবে তাঁর বিরুদ্ধে সংসদের বিশেষ অধিকার ক্ষুণ্ন করার অভিযোগে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উল্লেখ্য, জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালি বিধিতে বিশেষ অধিকার প্রয়োগের পদ্ধতি বলা আছে, কিন্তু এতে বিশেষ অধিকার সংজ্ঞায়িত এবং এর পরিধিও নির্ধারণ করা হয়নি। আর এ জন্যই আইনের প্রয়োজন।
সংসদীয় বিশেষ অধিকার এবং দায়মুক্তির সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা দিয়েছেন এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ এরেসকাইন মে, ‘সংসদের বিশেষ অধিকার হলো কতগুলো স্বাতন্ত্র্য অধিকারের সমষ্টি, যা প্রত্যেক সাংসদ ব্যক্তিগতভাবে এবং সংসদের উভয় পক্ষই উপভোগ করে। এগুলো অন্যান্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ভোগ করা অধিকারের চেয়ে অতিরিক্ত অধিকার এবং এগুলো ছাড়া সংসদ ও সাংসদেরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করতে অক্ষম। তাই যদিও বিশেষ অধিকার রাষ্ট্রীয় আইনের অংশ, তবু এগুলোর মাধ্যমে অনেকটা সাধারণ আইনের আওতা থেকে তাঁদের রেহাই দেওয়া হয়।’ আমাদের দেশে অবশ্য উচ্চকক্ষ নেই। তাই উচ্চকক্ষের কথা আমাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্যও নয়।
সংসদীয় বিশেষ অধিকারগুলোকে দুভাবে বিভাজন করা যায়: কতগুলো এককভাবে সাংসদদের জন্য প্রযোজ্য এবং অন্যগুলো পুরো সংসদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ব্যক্তি সাংসদদের বেলায় প্রযোজ্য বিশেষ অধিকার ও দায়মুক্তির ক্ষেত্রগুলো হলো: ক. বাকস্বাধীনতা, খ. দেওয়ানি মামলায় গ্রেপ্তার থেকে অব্যাহতি, গ. জুরি হিসেবে দায়িত্ব পালন থেকে অব্যাহতি, এবং ঘ. সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত হওয়া থেকে অব্যাহতি। এগুলো মূলত দায়মুক্তি-সম্পর্কিত অধিকার এবং এগুলোর ফলে ব্যক্তি সাংসদদের স্বাধীনভাবে কাজ করার নিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালি বিধির ১৭২-১৭৬ ধারায় এসব বিষয়সম্পর্কিত বিধান রয়েছে।
পুরো সংসদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য অধিকার ও ক্ষমতাগুলো হলো: ক. শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার অধিকার। কোনো ব্যক্তিকে বিশেষ অধিকার ক্ষুণ্ন করার বা সংসদ অবমাননার জন্য শাস্তি প্রদান, যার মধ্যে দুর্নীতি, অপকর্ম ও অসদাচরণের জন্য সাংসদকে বহিষ্কার এ অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। সংসদের এ ধরনের অধিকারকে শাস্তিমূলক ক্ষমতা বলা হয়। খ. সংসদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ের ব্যবস্থাপনা বা কার্যপদ্ধতি নিয়ন্ত্রণসম্পর্কিত ক্ষমতা। গ. সাংসদদের উপস্থিতি ও কার্যকরতা নিশ্চিত করার ক্ষমতা। ঘ. তদন্ত করার, সাক্ষী ও রেকর্ডপত্র তলব করার ক্ষমতা। আমাদের জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালি বিধির ২০১-২০৩ ধারায় এ-সম্পর্কিত বিধান রয়েছে। ঙ. সাক্ষীদের শপথ প্রদানের ক্ষমতা। আমাদের কার্যপ্রণালি বিধির ২০৪-২০৫ ধারা এ বিষয়সম্পর্কিত। চ. মানহানিকর বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে এমন কাগজপত্র প্রকাশ করার ক্ষমতা।
বিষয়টি সম্পর্কে আরও সুস্পষ্ট ধারণা অর্জনের লক্ষ্যে বিশেষ অধিকার (privileges), ক্ষমতা (powers) ও দায়মুক্তির (immunities) মধ্যে বিভাজন করা আবশ্যক, যদিও তা অনেক সময় করা হয় না। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি সরকারের মতে, ‘নিজস্ব অভ্যন্তরীণ কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে সংসদের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাকে “বিশেষ অধিকার” হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। কোনো ব্যক্তিকে সংসদের অধিকার ক্ষুণ্ন বা অবমাননার দায়ে শাস্তি দেওয়ার অধিকারকে ক্ষমতা হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। সংসদে যেকোনো কিছু বলার জন্য কোনো সাংসদ দায়ী না হওয়ার অধিকারই “দায়মুক্তি”।’ [বিশেষ রেফারেন্স অনুচ্ছেদ ১৪৩, এআইআর (১৯৬৫, এসসি ৭৪৫)]
রাজউকের চেয়ারম্যানকে দুটি সংসদীয় কমিটির পক্ষ থেকে একই অভিযোগে কারণ দর্শানোর সিদ্ধান্ত একটি অভাবনীয় ঘটনা, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে ঘটেছে বলে আমাদের জানা নেই। এ ছাড়া বিশেষ অধিকারসম্পর্কিত সাংবিধানিক বিধানের কার্যকরতা প্রদানের জন্য কোনো আইনও নেই। তাই এ অধিকার প্রয়োগ করে তাঁকে শোকজ করার সিদ্ধান্ত সংসদীয় কমিটিদ্বয়ের এখতিয়ারবহির্ভূত বলেই আমাদের ধারণা। আইন ও দৃষ্টান্ত নেই বলে জমির উদ্দিন সরকারের বিরুদ্ধে যদি কোনো ব্যবস্থা নেওয়া না যায়, তাহলে জনাব হুদাকে কোন অধিকারে কারণ দর্শাতে বলা হবে? তাই অনেকের মতে, এ ধরনের সিদ্ধান্ত সংসদীয় বিশেষ অধিকারের অপব্যবহার বৈ কিছু নয়। এ ছাড়া আমাদের সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান...।’ আমরা আশা করি, স্পিকার এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় রুলিং দেবেন, যা তিনি করেছিলেন গত অক্টোবর মাসে তাঁর সহকর্মী ব্যারিস্টার সরকারের ক্ষেত্রে।
জনাব নূরুল হুদা কী বলেছিলেন, যার জন্য আমাদের অনেক সাংসদ তাঁর বিরুদ্ধে এককাট্টা এবং এত ক্ষিপ্ত? তিনি কি মিথ্যা কিছু বলেছিলেন? তাঁর বক্তব্যের মাধ্যমে কি তিনি কোনো আইন ভঙ্গ করেছেন?
সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ৩০ জুন জাতীয় প্রেসক্লাবে ব্লাস্টের আয়োজনে ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড: বাস্তবায়ন এবং করণীয়’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় রাজউকের চেয়ারম্যান বলেন, পরিকল্পিত পরিবেশ ও বাসোপযোগী ঢাকা চাইলে ড্যাপ বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। কিন্তু একটি স্বার্থান্বেষী মহল ব্যক্তিগত স্বার্থে এর বিরোধিতা করছে। দু-চারটা সংবাদপত্রও ড্যাপ ও রাজউকের সমালোচনা করছে। তারা ড্যাপ চায় না; রাজউককেও তুলে দিতে চাইছে। তাদের ইচ্ছা বাস্তবায়িত হলে কয়েক বছরের মধ্যে ঢাকাকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করতে হবে। এই শহর কংক্রিটের স্তূপে পরিণত হবে। তিনি আরও বলেন, যেসব সাংসদ আবাসনব্যবসার সঙ্গে জড়িত, তাঁরা সংসদে ড্যাপের বিরোধিতা করে বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি দুঃখ করে বলেন, ‘এ দেশে কে কী করবে? একজন সাংসদ গুলশান এলাকায় ছয়তলা ভবনের অনুমোদন নিয়ে ১৬ তলা করেছেন’ (প্রথম আলো, ১ জুলাই ২০১০)।
উপরিউক্ত প্রতিবেদন থেকে এটি সুস্পষ্ট যে, জনাব হুদা মিথ্যা কিছু বলেননি। এসব স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিরোধিতার মুখে ড্যাপ বাস্তবায়ন সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ়তার সঙ্গে সঙ্গে রাজউক চেয়ারম্যানের সত্যকথন অনেক নাগরিককেই আশ্বস্ত করেছে।
জনাব হুদা মিথ্যাচার করেননি কিংবা আইনও অমান্য করেননি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের আইনপ্রণেতাদের কেউ কেউ আইন ভঙ্গ করেছেন। যিনি ছয়তলার অনুমোদন নিয়ে ১৬ তলা ইমারত নির্মাণ করেছেন, তিনি অবশ্যই আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গলি প্রদর্শন করেছেন। একই সঙ্গে আইন ভঙ্গ করেছেন আমাদের সেসব সাংসদ, যাঁরা আবাসনব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়েও গৃহায়ণ ও গণপূর্তসম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সদস্য হয়েছেন। কার্যপ্রণালি বিধির ১৮৮(২) অনুযায়ী, ‘এমন কোন সদস্য (সংসদীয়) কমিটিতে নিযুক্ত হইবেন না, যাহার ব্যক্তিগত, আর্থিক ও পরোক্ষ স্বার্থ কমিটিতে বিবেচিত হইতে পারে এমন বিষয়ের সহিত সংশ্লিষ্ট আছে।’ উল্লেখ্য, কার্যপ্রণালি বিধি সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত এবং আইনের সমতুল্য। তাই সাংসদদের এককাট্টা হয়ে জনাব হুদার বিরুদ্ধে চড়াও হওয়া দুই বিঘা জমির ‘আমি আজ চোর বটে...’ বিখ্যাত লাইনটির কথাই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। প্রসঙ্গত, শুধু গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়সম্পর্কিত কমিটিতেই নয়, স্বার্থের দ্বন্দ্ব আছে এমন সাংসদেরা আরও অনেক সংসদীয় কমিটিতেও রয়েছেন, যার বিরুদ্ধে আমরা বহুদিন থেকেই সোচ্চার (সমকাল, ১ জুলাই ২০১০)। আমরা আনন্দিত যে প্রধানমন্ত্রী অন্তত ১৪ জন সাংসদের রদবদলের বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েছেন, যার জন্য তাঁকে আন্তরিক ধন্যবাদ (সমকাল, ১৭ জুলাই ২০১০)।
সাংসদ ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার বিষয়ে আসা যাক। সাংসদেরা যাতে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন, সে লক্ষ্যে তাঁদের বাকস্বাধীনতাসহ কিছু কিছু ক্ষেত্রে দায়মুক্ত করা হয়। কিন্তু কোনো দেশেই ফৌজদারি অপরাধ থেকে সাংসদদের দায়মুক্ত করার উদাহরণ আমাদের জানা নেই। এ ছাড়া আইনপ্রণেতারা কি আইনের ঊর্ধ্বে? তা হবে সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী এবং আইনের শাসনের সঙ্গে সম্পূর্ণ অসংগতিপূর্ণ। সাংসদদের বিরুদ্ধে মামলা করার ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতির বাধ্যবাধকতা সংসদীয় বিশেষ অধিকারের পরিধিকে সীমাহীন, বৈষম্যমূলক ও অযৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে গেছে, যা নৈতিকতা ও গণতান্ত্রিক চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এবং যার পরিণতিও অশুভ হতে বাধ্য।
এ ছাড়া আমাদের বর্তমান সংসদে কিছু সদস্য আছেন, যাঁরা তাঁদের উচ্ছৃঙ্খল আচরণের (যেমন, সরকারি কর্মকর্তাদের মারধর) মাধ্যমে মহান জাতীয় সংসদের মর্যাদাহানি করেছেন। ১৮ জন সাংসদ মিথ্যা হলফনামা দিয়ে রাজউকের প্লটের জন্য আবেদন করেছেন, যা নৈতিক স্খলনজনিত গুরুতর দণ্ডনীয় অপরাধ। এ পর্যন্ত এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরের কথা, এ ব্যাপারে কাউকে উচ্চবাচ্য করতেও আমরা শুনিনি।
পরিশেষে, আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে হলে, সংসদকে কার্যকর ও কলুষমুক্ত করতে হবে। আর এ জন্য প্রয়োজন সাংসদদের আইন ও বিধিবিধান মেনে চলা এবং নৈতিকতাবোধ দ্বারা পরিচালিত হওয়া। একই সঙ্গে প্রয়োজন যেসব সাংসদ জনস্বার্থের পরিবর্তে ব্যক্তিস্বার্থ দ্বারা পরিচালিত হচ্ছেন এবং অন্যায় কাজে বা অসদাচরণে লিপ্ত হয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া। এ ছাড়া প্রয়োজন সংসদ ও সাংসদদের বিশেষ অধিকার ও দায়মুক্তির বিষয়টি নির্ধারণ করার লক্ষ্যে দ্রুততার সঙ্গে একটি আইন প্রণয়ন। সাংসদেরা যাতে তাঁদের সংসদীয় পদ ব্যবহার করে ভবিষ্যতে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতে না পারেন, সে লক্ষ্যে জরুরি প্রয়োজন তাঁদের জন্য একটি আচরণবিধি প্রণয়ন এবং তাঁদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো জনসমক্ষে প্রকাশ করা। আরও প্রয়োজন সব ক্ষমতাধরের সম্পদের হিসাব প্রদান। স্মরণ করা যেতে পারে, আচরণবিধি প্রণয়ন এবং বার্ষিকভাবে সম্পদের হিসাব প্রদান ও প্রকাশ ‘দিনবদলের সনদে’র অঙ্গীকারের অন্তর্ভুক্ত। এসব বিষয়ের প্রতি আমরা প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।

No comments

Powered by Blogger.