এ সরকারের প্রথম বছরেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে খুন হয়েছে ১০ মেধাবী ছাত্র by হারুন - আর - রশিদ
রক্তমাখা ভাষার মাসে ফেব্রুয়ারি ২০১০-এ তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন মেধাবী ছাত্রকে হারালাম। আবু বকর সিদ্দিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। দ্বিতীয় জনের নাম ফারুখ হোসেন, তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মেধাবী ছাত্র।
এই দুজন ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসের ভেতরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সামনেই নিহত হন। তৃতীয় যে ছাত্র, তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি বিভাগে পড়তেন। নাম এনএম মহিউদ্দিন মাসুম। মাসুম নিহত হন চট্টগ্রাম শহরে টিউশনি করে ফেরার পথে—পাহাড়তলী রেলস্টেশনের পাশে সন্ত্রাসীরা তাকে কুপিয়ে জখম করে হত্যা করেছে। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপারটি হলো—এই নিহত তিনজন ছাত্র গরিব পরিবারের সন্তান। তিনজনই ছিল মেধাবী। বিভিন্ন পত্রিকায় যে রিপোর্ট বেরিয়েছে, তাতে দেখা গেছে ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে আবু বকরের কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না। বাকি দুজন ছাত্রের মধ্যে ফারুক হোসেন ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মহিউদ্দিন মাসুমের রাজনীতির পরিচয় নিয়ে ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবির উভয় সংগঠনই দাবি করছে নিহত মহিউদ্দিন তাদের সমর্থক। বর্তমান সরকারের প্রথম বছরেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০ জন মেধাবী ছাত্র খুন হন। যে ছেলেটি রাজনীতি করতেন না (আবু বকর সিদ্দিক) তাকে প্রাণ দিতে হলো রাতের অন্ধকারে (২ ফেব্রুয়ারি ২০১০) ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে—যেটা এ এফ রহমান হলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের ভেতরকার দ্বন্দ্বের কারণে ঘটেছে। এক সময়ে ছাত্রলীগের আত্মঘাতী সংঘর্ষ রূপ নেয় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে। হলের ভেতর ঢুকে পুলিশ নির্বিচারে সাধারণ শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা করে এবং সংঘর্ষ থামাতে টিয়ার শেল ছোড়ে। প্রত্যক্ষদর্শী অনেকেই বলেছেন, পুলিশ শুধু টিয়ার শেলই ছোড়েনি, তারা গুলিও করেছে। তার আঘাতেই প্রাণ দিতে হয়েছে আবু বকরকে। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নেয়া হয় আবু বকরকে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে শত চেষ্টা করেও ডাক্তাররা বাঁচাতে পারলেন না আবু বকরকে। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপারটি হলো—বকরের সহপাঠীরা মাতম করছিল এই কথা বলে যে, বকরের জানাজার নামাজ আমরা ক্যাম্পাসে আদায় করতে পারলাম না। পত্রিকার বিবরণীতে জানা যায় হত্যাকাণ্ডের দায় এড়াতে পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ঘটনাটিকে ভিন্নরূপে আখ্যায়িত করেন। পুলিশ কমিশনার বলছেন, বকর কারও ইটের আঘাতে মারা গেছে। এখন কর্তব্যরত ডাক্তাররা সুর মিলিয়ে বলছেন, বকরের আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে কোনো ধাতব পদার্থ পাওয়া যায়নি। অরাজনৈতিক ছাত্র বলেই পুরো বিষয়টিকে সত্যিকার রূপ না দিয়ে নকলরূপে ঘটনাটিকে ধামাচাপা দেয়া হয়েছে। সত্য বেশি দিন চাপা দিয়ে রাখা যায় না। সে বিষয়টিও পরিষ্কার হয়ে গেল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পরের দিন (৪/২/১০) আইন মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত তিন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় বৈঠকের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন—এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা, এটা কোনো ব্যাপার নয়। এমনটি ঘটতেই পারে। তবে আমরা কী পদক্ষেপ নিচ্ছি সেটাই দেখার বিষয়। কিন্তু এত দিন পার হয়ে গেল জনগণ বকরের মর্মান্তিক মৃত্যুর ক্ষেত্রে উপহাসমূলক বক্তব্য ছাড়া ঊর্ধ্বতন প্রশাসন থেকে নিহত বকরের গরিব মা-বাবা কোনো আর্থিক অনুদান পাননি। পাননি কোনো সান্ত্বনাসূচক বাণী। টাঙ্গাইলের মধুপুর ঢাকা থেকে বেশি দূরেও নয়। এটুকুন পথ যাওয়া সরকারের মন্ত্রিপরিষদের একজন ব্যক্তির জন্য কোনো ব্যাপার ছিল না। কারণ একটি, তা হলো আবু বকরের পিঠে কোনো রাজনৈতিক সিল ছিল না। বকরের জন্য কোনো রাজনৈতিক দলই তেমনভাবে কোনো অনুশোচনা প্রকাশ করেনি। মহাজোট, জামায়াত, বিএনপি বলতে গেলে অনেকটা নীরব ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু লেখক, সাংবাদিক, সচেতন জনগোষ্ঠী, বিদগ্ধ পাঠকসমাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও সহপাঠীরা এবং শিক্ষকসমাজ ও মিডিয়ার কাছ থেকে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া এসেছে। তাদের মর্মযাতনা প্রকাশ করেছেন রিপোর্টিং ও লেখনীর মাধ্যমে, যা গোটা দেশে ‘শব্দ বুলেট’ হিসাবে গোটা রাষ্ট্রকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। ফারুক হোসেন পেয়েছে শুধু এক লাখ টাকার অনুদানই নয়—গ্রামের বাড়িতে গিয়ে মন্ত্রীরা পর্যন্ত বাবা-মাকে সান্ত্বনার বাণী দিয়ে এসেছেন। তার পরিবারের ভরণপোষণের সব ব্যয়ভার বহন করার কথাও বলেছেন। ফারুকের হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে শুরু করেছে গোটা দেশব্যাপী বিশেষ একটি দলের বিরুদ্ধে চিরুনির জাল বিস্তার। ওই চিরুনি জালে এই নিবন্ধ লেখার দিন পর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছে ৯০০’র অধিক মানুষ।
আমরা স্বীকার অবশ্যই করি, তিনটি হত্যাকাণ্ডই মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক। পাশাপাশি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের এই তিন সন্তানের মৃত্যু যন্ত্রণা যে কী ভয়ানকভাবে হৃদয়ে আঘাত করে, সেটা এখন বুঝতে পারছেন বকর, ফারুক ও মহিউদ্দিনের মা-বাবা ও ভাইবোনেরা। নিহত সন্তানরা আর ফিরে আসবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে তারা লাশ হয়ে গৃহে ফিরল কফিনে করে। ’৬৯ সালে একজন আসাদ মারা গেল—গোটা পাকিস্তানের ভিত কেঁপে উঠল। ’৬৯-এর ওই মৃত্যুর সূত্র ধরে গণঅভ্যুত্থানে ছিটকে পড়ল জেনারেল আইয়ুবের তখত-তাউস। পাকিস্তান ভেঙে গেল দুই বছর যেতে না যেতেই। এখন প্রতিদিন ’৬৯-এর মতো কোনো না কোনো শিক্ষাঙ্গনে বহু ছাত্র নিহত হচ্ছে স্বদেশি পুলিশ ভাইদের গুলিতে অথবা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা পেশাদার ক্যাডার বাহিনীর হাতে। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে দেখলাম—গত ৩৯ বছরে শুধু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিহত ছাত্রের সংখ্যা প্রায় ২০০ জন। এর মধ্যে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঝরে পড়েছে ৭৭টি মেধাবী ছাত্রের তরতাজা জীবন। এই ২০০ ছাত্রের মায়ের বুক যারা খালি করেছে তারা পাকিস্তান বা ভারতের শাসকরা নয়। এ দেশেরই শাসক সম্প্রদায়ের পোষ্য বাহিনীর দ্বারা রক্তাক্ত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলো। একটি ছাত্রের জন্য পাকিস্তান ভেঙে খান খান হয়ে গেল। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সূত্র ধরে ’৭১-এর স্বাধীনতাযুদ্ধে দেশ স্বাধীন হলো, এখন সীমান্তে নিহত হচ্ছে প্রতিদিনই দুই থেকে চারজন কৃষক, দিনমজুর বা নিরীহ কোনো গ্রামবাসী। আর এদিকে ছাত্র রাজনীতির নামে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে গরিব-মেধাবী ছাত্ররা নিহত হচ্ছেন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে। কিন্তু সরকারি ও বিরোধীদলের টনক একটু নড়ছে বলে মনে হয় না। সুশাসনের ছবকের কথা বলেন বটে; কিন্তু সেটা বাস্তবে প্রয়োগ নেই। ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্রশিবির—এরা সবাই এদেশেরই সন্তান। এদের রাজনীতির পথে কারা এনেছেন, আমরা সবাই তা জানি; কিন্তু তারা যে ক্ষমতাবান ব্যক্তি—যেমনি নাচায় তেমনি নাচি পুতুলের কী দোষ। নিরীহ ছাত্রদের দোষ দিয়ে লাভ কী? ওরা দাবার ঘুঁটির মতো ব্যবহার হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গুলি নির্দেশে। নিজেদের স্বার্থ আদায় করার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার—হলো শিক্ষাঙ্গনে পড়তে আসা নিরীহ শিক্ষার্থীরা। ভর্তি হওয়ার শুরুতেই উপর মহলের নির্দেশে তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শের ছবক দেয়া হয়। এই দলে আসলে এই উপকার, পদ, অর্থ, গাড়ি-বাড়ি, নেতা হওয়া সবকিছুই পাবে। হলে সিট পাওয়া, টেন্ডারবাজি, সরকারি অর্থ আত্মসাতের সুযোগ, ভর্তি বাণিজ্যের সুযোগ, অর্থ উপার্জনের নানা অবৈধ পথের সন্ধানটা বাতলিয়ে দেন রাজনৈতিক দলের নেতারাই। না হলে ছাত্ররা এই পথে আসবে কেন? বিনা লাভে কেউ পুঁজি খাটায় না। ছাত্রদের নষ্ট করেছে এক শ্রেণীর রাজনৈতিক নেতারা। এই সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদরা সব দলেই আছেন। নিজেদের ক্ষমতাকে সুদূরপ্রসারিত করার জন্য দেশের বড় দলগুলো শিক্ষার্থীদের সেই স্বাধীনের পর থেকে ‘ক্ষমতার ঢাল’ হিসেবে ব্যবহার করে চলছেন। শুধু এই একটি কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বন্ধুসুলভ সম্পর্কের পরিবর্তে গড়ে উঠছে প্রতিহিংসামূলক সম্পর্ক। ’৭০-এর দশকের আগে ছাত্র রাজনীতির মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ মনোভাব এখন আর নেই। সেই দিনের হিসাব আর বর্তমানের হিসাব ভিন্ন ছকে ধাবিত। তাই অংক মেলানো সম্ভব নয়। অংক মেলানো সম্ভব—যদি সব বড় রাজনৈতিক দলগুলো একত্রে বসে-ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করার ব্যবস্থা গ্রহণ অথবা ছাত্রদের রাজনীতি শুধু জাতীয় স্বার্থ ছাড়া লেজুড়বৃত্তি কোনো রাজনীতির সদস্য হওয়া যাবে না।
উল্লেখ্য, একটি জাতীয় দৈনিকে ১৬/২/১০ টেলিফোনে নাগরিক মন্তব্যে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের পক্ষে মত প্রকাশ করেছে শতকরা ৯০ শতাংশ মানুষ। এ ধরনের একটি কাঠামোগত ফ্রেমের মধ্যে যদি নীতিমালা তৈরি করা যায়—তাহলেই শিক্ষাঙ্গনে অস্ত্রের মহড়া কমে যাবে, ফিরে আসবে পড়াশোনার সুস্থ পরিবেশ। আজকের মতো পিতা-মাতাকেও সন্তানদের জন্য এতটা ভাবনায় ফেলবে না। সন্তানহারা পিতা-মাতার মতো মাতম করতে হবে না।
এই কাজটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি সত্সাহস নিয়ে বাস্তবায়ন করেন, তাহলে শুধু এই মহত্ কাজটির জন্য তিনি মৃত্যুর পরও অমর হয়ে থাকবেন। কথাটি বললাম এ জন্য যে, বঙ্গবন্ধু বহু কষ্ট পেয়েছেন ছাত্রলীগের অন্তর্কলহের কারণে। বঙ্গবন্ধুর ইমেজেরও ধস নেমেছিল ছাত্র রাজনীতির কারণে। স্বাধীনতার ঊষালগ্ন থেকেই ছাত্র রাজনীতি বহু মায়ের কোল খালি করে দিয়েছে। যে সন্তানটি ভবিষ্যতে সংসারের হাল ধরার কথা, সে যদি পড়তে এসে গুলিবিদ্ধ হয়ে লাশ হয়ে ঘরে ফেরে, সেই দৃশ্য কোনো পিতা-মাতাই স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারে না। ছেলের লাশ বাবার কাঁধে—এ যে কত হৃদয়বিদারক দৃশ্য, কত কষ্টদায়ক তা ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রী এই কথাটা না বোঝারও কথা নয়। পিতা-মাতা ভাই-বোন তিনি হারিয়েছেন। প্রিয়জন হারানোর বেদনা কোনোদিনই ভোলা যায় না। আপনি প্রিয়জন হারিয়েছেন—এর মর্মযাতনা আপনার চেয়ে বেশি কেউ বুঝবে না। সুতরাং আপনি পারেন ছাত্র রাজনীতিকে কলুষমুক্ত করে বা একেবারে নিষিদ্ধ করে সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাস গড়ার পাশাপাশি সুস্থ ধারার পড়াশোনার একটি পরিবেশ তৈরি করে দিতে।
লেখক : কলামিস্ট, গবেষক ও গ্রন্থকার
আমরা স্বীকার অবশ্যই করি, তিনটি হত্যাকাণ্ডই মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক। পাশাপাশি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের এই তিন সন্তানের মৃত্যু যন্ত্রণা যে কী ভয়ানকভাবে হৃদয়ে আঘাত করে, সেটা এখন বুঝতে পারছেন বকর, ফারুক ও মহিউদ্দিনের মা-বাবা ও ভাইবোনেরা। নিহত সন্তানরা আর ফিরে আসবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে তারা লাশ হয়ে গৃহে ফিরল কফিনে করে। ’৬৯ সালে একজন আসাদ মারা গেল—গোটা পাকিস্তানের ভিত কেঁপে উঠল। ’৬৯-এর ওই মৃত্যুর সূত্র ধরে গণঅভ্যুত্থানে ছিটকে পড়ল জেনারেল আইয়ুবের তখত-তাউস। পাকিস্তান ভেঙে গেল দুই বছর যেতে না যেতেই। এখন প্রতিদিন ’৬৯-এর মতো কোনো না কোনো শিক্ষাঙ্গনে বহু ছাত্র নিহত হচ্ছে স্বদেশি পুলিশ ভাইদের গুলিতে অথবা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা পেশাদার ক্যাডার বাহিনীর হাতে। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে দেখলাম—গত ৩৯ বছরে শুধু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিহত ছাত্রের সংখ্যা প্রায় ২০০ জন। এর মধ্যে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঝরে পড়েছে ৭৭টি মেধাবী ছাত্রের তরতাজা জীবন। এই ২০০ ছাত্রের মায়ের বুক যারা খালি করেছে তারা পাকিস্তান বা ভারতের শাসকরা নয়। এ দেশেরই শাসক সম্প্রদায়ের পোষ্য বাহিনীর দ্বারা রক্তাক্ত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলো। একটি ছাত্রের জন্য পাকিস্তান ভেঙে খান খান হয়ে গেল। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সূত্র ধরে ’৭১-এর স্বাধীনতাযুদ্ধে দেশ স্বাধীন হলো, এখন সীমান্তে নিহত হচ্ছে প্রতিদিনই দুই থেকে চারজন কৃষক, দিনমজুর বা নিরীহ কোনো গ্রামবাসী। আর এদিকে ছাত্র রাজনীতির নামে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে গরিব-মেধাবী ছাত্ররা নিহত হচ্ছেন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে। কিন্তু সরকারি ও বিরোধীদলের টনক একটু নড়ছে বলে মনে হয় না। সুশাসনের ছবকের কথা বলেন বটে; কিন্তু সেটা বাস্তবে প্রয়োগ নেই। ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্রশিবির—এরা সবাই এদেশেরই সন্তান। এদের রাজনীতির পথে কারা এনেছেন, আমরা সবাই তা জানি; কিন্তু তারা যে ক্ষমতাবান ব্যক্তি—যেমনি নাচায় তেমনি নাচি পুতুলের কী দোষ। নিরীহ ছাত্রদের দোষ দিয়ে লাভ কী? ওরা দাবার ঘুঁটির মতো ব্যবহার হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গুলি নির্দেশে। নিজেদের স্বার্থ আদায় করার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার—হলো শিক্ষাঙ্গনে পড়তে আসা নিরীহ শিক্ষার্থীরা। ভর্তি হওয়ার শুরুতেই উপর মহলের নির্দেশে তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শের ছবক দেয়া হয়। এই দলে আসলে এই উপকার, পদ, অর্থ, গাড়ি-বাড়ি, নেতা হওয়া সবকিছুই পাবে। হলে সিট পাওয়া, টেন্ডারবাজি, সরকারি অর্থ আত্মসাতের সুযোগ, ভর্তি বাণিজ্যের সুযোগ, অর্থ উপার্জনের নানা অবৈধ পথের সন্ধানটা বাতলিয়ে দেন রাজনৈতিক দলের নেতারাই। না হলে ছাত্ররা এই পথে আসবে কেন? বিনা লাভে কেউ পুঁজি খাটায় না। ছাত্রদের নষ্ট করেছে এক শ্রেণীর রাজনৈতিক নেতারা। এই সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদরা সব দলেই আছেন। নিজেদের ক্ষমতাকে সুদূরপ্রসারিত করার জন্য দেশের বড় দলগুলো শিক্ষার্থীদের সেই স্বাধীনের পর থেকে ‘ক্ষমতার ঢাল’ হিসেবে ব্যবহার করে চলছেন। শুধু এই একটি কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বন্ধুসুলভ সম্পর্কের পরিবর্তে গড়ে উঠছে প্রতিহিংসামূলক সম্পর্ক। ’৭০-এর দশকের আগে ছাত্র রাজনীতির মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ মনোভাব এখন আর নেই। সেই দিনের হিসাব আর বর্তমানের হিসাব ভিন্ন ছকে ধাবিত। তাই অংক মেলানো সম্ভব নয়। অংক মেলানো সম্ভব—যদি সব বড় রাজনৈতিক দলগুলো একত্রে বসে-ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করার ব্যবস্থা গ্রহণ অথবা ছাত্রদের রাজনীতি শুধু জাতীয় স্বার্থ ছাড়া লেজুড়বৃত্তি কোনো রাজনীতির সদস্য হওয়া যাবে না।
উল্লেখ্য, একটি জাতীয় দৈনিকে ১৬/২/১০ টেলিফোনে নাগরিক মন্তব্যে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের পক্ষে মত প্রকাশ করেছে শতকরা ৯০ শতাংশ মানুষ। এ ধরনের একটি কাঠামোগত ফ্রেমের মধ্যে যদি নীতিমালা তৈরি করা যায়—তাহলেই শিক্ষাঙ্গনে অস্ত্রের মহড়া কমে যাবে, ফিরে আসবে পড়াশোনার সুস্থ পরিবেশ। আজকের মতো পিতা-মাতাকেও সন্তানদের জন্য এতটা ভাবনায় ফেলবে না। সন্তানহারা পিতা-মাতার মতো মাতম করতে হবে না।
এই কাজটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি সত্সাহস নিয়ে বাস্তবায়ন করেন, তাহলে শুধু এই মহত্ কাজটির জন্য তিনি মৃত্যুর পরও অমর হয়ে থাকবেন। কথাটি বললাম এ জন্য যে, বঙ্গবন্ধু বহু কষ্ট পেয়েছেন ছাত্রলীগের অন্তর্কলহের কারণে। বঙ্গবন্ধুর ইমেজেরও ধস নেমেছিল ছাত্র রাজনীতির কারণে। স্বাধীনতার ঊষালগ্ন থেকেই ছাত্র রাজনীতি বহু মায়ের কোল খালি করে দিয়েছে। যে সন্তানটি ভবিষ্যতে সংসারের হাল ধরার কথা, সে যদি পড়তে এসে গুলিবিদ্ধ হয়ে লাশ হয়ে ঘরে ফেরে, সেই দৃশ্য কোনো পিতা-মাতাই স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারে না। ছেলের লাশ বাবার কাঁধে—এ যে কত হৃদয়বিদারক দৃশ্য, কত কষ্টদায়ক তা ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রী এই কথাটা না বোঝারও কথা নয়। পিতা-মাতা ভাই-বোন তিনি হারিয়েছেন। প্রিয়জন হারানোর বেদনা কোনোদিনই ভোলা যায় না। আপনি প্রিয়জন হারিয়েছেন—এর মর্মযাতনা আপনার চেয়ে বেশি কেউ বুঝবে না। সুতরাং আপনি পারেন ছাত্র রাজনীতিকে কলুষমুক্ত করে বা একেবারে নিষিদ্ধ করে সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাস গড়ার পাশাপাশি সুস্থ ধারার পড়াশোনার একটি পরিবেশ তৈরি করে দিতে।
লেখক : কলামিস্ট, গবেষক ও গ্রন্থকার
No comments