কল্পকথার গল্প-চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দেয় না by আলী হাবিব

পূর্ণিমা চলে গেল তিন দিন আগে। পূর্ণিমা তো মাসে মাসেই আসে। আসে আর যায়। চাঁদের কলা পূর্ণ হয়। অমাবস্যার পর চাঁদ আস্তে আস্তে বড় হয়। বড় হতে হতে পূর্ণতা পায় চাঁদ। কিন্তু সেদিন দিবাবসানে যে চাঁদ উঁকি দিল পৃথিবীর আকাশে, সে চাঁদের সঙ্গে অন্য চাঁদের তুলনা চলে না। 'সে রাতে রাত ছিল পূর্ণিমার'।


ফাল্গুনী হাওয়া না থাকলেও বাসন্তী হাওয়া তো ছিল। আকাশে মেঘের সঙ্গে চাঁদের লুকোচুরি খেলা ছিল। ছিল অন্য রকম আলো। সাধারণভাবে পূর্ণিমা তিথিতে চাঁদ যে আলো দেয়, তার চেয়ে অনেক বেশি আলো ছড়িয়েছিল সেই পূর্ণিমার চাঁদ। কেন? কারণ সে রাতে চাঁদ চলে এসেছিল পৃথিবীর খুব কাছাকাছি। তাতে কী ঘটল? আমাদের জীবন কি ভরে গেল চাঁদের আলোয়? আমরা কি চাঁদের আলোর বন্যায় ভেসে ভেসে নতুন এক জীবন পেয়ে গেলাম? না, তা নয়। বিজ্ঞানে যাঁদের আগ্রহ, তাঁরা হয়তো দূরবীক্ষণে চোখ লাগিয়ে দেখলেন চাঁদের কলা। পৃথিবীর অনেক কাছাকাছি চলে আসা চাঁদকে হাতের মুঠোয় পাওয়া না গেলেও কাছে তো পাওয়া গেল। শহুরে জীবনে আজকাল তো আকাশ দেখাই হয়ে ওঠে না। আর চাঁদ? সে তো দূরের কোনো উপগ্রহ। কত দিন দেখা হয় না চাঁদ! হয় না চাঁদের আলোয় অবগাহন। আকাশে কখন চাঁদ ওঠে, কখন অস্ত যায়_সে হিসাব রাখার সময় কোথায় এই ব্যস্ত নাগরিক জীবনে?
দূরের আকাশে ওঠে যে চাঁদ, সবারই কমন মামা সেই চাঁদ তো আমাদের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সেই ছোট্টবেলা থেকেই। কাজেই চাঁদের গুরুত্ব একেবারে কম নয়। মায়ের কোলে শুয়ে-বসে দোল খেতে খেতে আমরা তো কতই শুনেছি সেই গান_'চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা'। কিন্তু কজনের কপালে আর টিপ দিয়ে যায় চাঁদ? চাঁদ-কপাল নিয়ে সবার কি আর জন্ম হয়? আর চরকা কাটা চাঁদের বুড়ির গল্প শুনতে শুনতে তো আমরা বড় হয়ে উঠেছি। সেই চাঁদের বুড়ির গল্পও একসময় পুরনো হয়ে যায়। মানুষ পা রাখে চাঁদের বুকে। দূরের চাঁদ যে আমাদের নিকট প্রতিবেশী, সেটা জানতেও আর বাকি থাকে না। শৈশবের গান ভুলে আমরা গেয়ে উঠি, 'নভোচারী গেল চাঁদে নিয়ে এল বার্তা/আগে যা শুনেছি তা সব কিছু মিথ্যা'। বিজ্ঞান আমাদের কল্পনাকে তাড়িয়ে দেয় দূরে। তার পরও সেই দূরের চাঁদকে অস্বীকার করতে পারি না আমরা। চাঁদ আমাদের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে।
আমাদের জীবনজুড়ে জড়িয়ে আছে চাঁদ। চাঁদকে অস্বীকার করার কোনো উপায় তো নেই। মায়ের কোলে 'আয় আয় চাঁদমামা' শুনতে শুনতে বড় হয়ে ওঠা চাঁদের জীবনে একদিন আরেক চাঁদের আবির্ভাব। তখন চাঁদের মুখে অন্য এক গান_'ও চাঁদ সামলে রেখো জোছনাকে'। কিন্তু চাঁদ তো আর জোছনাকে সামলে রাখতে পারে না। চাঁদের কপালে যে চাঁদের আবির্ভাব ঘটে, সেই চাঁদও একদিন হয়তো অস্ত যায়। কিংবা ওঠে অন্য কোনো আকাশে। এ আকাশে তখন অন্য এক চাঁদের আবির্ভাব। সে অর্থে সবাই চাঁদ-কপাল নিয়েই জন্মায়। কিন্তু চাঁদ ধরে রাখতে পারাটাই একসময় এসে সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা যায়। চাঁদ-কপাল নিয়ে জন্মগ্রহণের মজাই আলাদা। চাঁদমামার কাছে আর নতুন করে টিপ দেওয়ার অনুরোধ করতে হয় না। চাঁদ-কপাল নিয়ে জন্মানোর মজাই আলাদা। না, কোনো কিছুরই অভাব নেই। চাইলেই হাতের মুঠোয় সব। হাত বাড়ালেই সব কিছু মিলে যায়। চাঁদের মজা এখানেই।
জীবনের সঙ্গে চাঁদের বড় অদ্ভুত মিল। চাঁদের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নদীর জোয়ার-ভাটা। চাঁদের টানে নদীতে আসে জোয়ার-ভাটা। আমাদের জীবনেও তো জোয়ার-ভাটা আছে। বন্ধুর পথে আবার মিলে যায় কোনো নিকট বন্ধু। চাঁদের আলোর মতোই পথ দেখিয়ে দিতে অকৃপণ অনেক বন্ধুও জুটে যায়। চাঁদের মতোই পূর্ণ হয় আমাদের অনেকের জীবন। চাঁদের কলা যেমন একটু একটু করে পূর্ণ হয়_যেমন 'মাঝ রাত্তির/চাঁদের কাস্তে/ধারালো হচ্ছে/ আস্তে আস্তে', সে রকমই জীবনের পূর্ণতা আসে। একসময় এসে দেখা দেয় জীবনের পূর্ণতা। আবার কখনো অমাবস্যার অন্ধকারে ঢেকে যায় জীবন। চাঁদের আলোর চাঁদ-কপাল নিয়ে জন্মালে এই অমাবস্যার অন্ধকার নেমে আসার কোনো সুযোগ থাকে না। সেখানে কেবলই আলো। সে জীবনে আর 'ভাবনা কাহারে বলে', এমন ভাবনা ভাবতে হয় না। হুট করে চলে যাওয়া যায় 'সব পেয়েছি'র দেশে। সেখানে অভাব নেই, আছে প্রাচুর্যের আলো। সেখানে পূর্ণর্িমার চাঁদ 'অহেতুক' কাব্য করার অবসরই বা কোথায়। ঝলসানো রুটি যে দেখেনি, সে কেমন করে বুঝবে ঘরের চালের ফুটো দিয়ে ঢুকে পড়া একফালি চাঁদের আলোর কী মহিমা!
না, চাঁদকে অস্বীকার করার তো উপায় নেই। চাঁদকে অস্বীকার করলে আমাদের কল্পনার জগৎটা আর থাকে না। চাঁদকে অস্বীকার করলে আমাদের কল্পনার জগৎটাকেই তো অস্বীকার করা হয়। কল্পনা যদি না থাকে, আমরা বাঁচব কী নিয়ে? আমাদের তো বাঁচিয়ে রেখেছে কল্পনা। আমরা কল্পনা করতে পারি। কল্পনা করতে পারি বলেই তো বেঁচে আছি। কল্পনা আমাদের মনে স্বপ্ন বুনে যায়। আমরা স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন দেখতে দেখতে ঘুমাতে যাই। স্বপ্ন দেখে আমরা ঘুম থেকে উঠি। আমরা বাজারে গিয়ে প্রতারিত হই। আমাদের ক্রেতা অধিকার নেই। বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ে, আমরা স্বপ্ন দেখি সুন্দর আগামীর। স্বপ্ন দেখি এমন দিন আসবে, যেদিন ফুলে ও ফসলে ভরে উঠবে আমাদের প্রাঙ্গণ। স্বপ্ন দেখি সচ্ছলতার। আমাদের স্বপ্ন দেখা আর ফুরায় না। এই একটি ব্যাপারে আমাদের জুড়ি নেই। আমরা স্বপ্ন দেখেই চলেছি। একটার পর একটা স্বপ্ন ভঙ্গ হয়। আমরা নতুন স্বপ্ন দেখি। আমাদের স্বপ্নের মধ্যেও সেই চাঁদের কলা। একটু একটু করে আমরা আমাদের স্বপ্ন পূরণের দিকে এগিয়ে যাই। সে পথে কখনো আবার অমাবস্যার অন্ধকার নেমে আসে।
পূর্ণিমা তো কতই আসে। কিন্তু চাঁদ অমন কাছাকাছি চলে আসা পূর্ণিমা তো আর বারবার আসে না। কত বছর পর এভাবে চাঁদ চলে এল আমাদের একেবারে কাছে। অন্যবারের চেয়ে অনেক বেশি আলো দিল আমাদের। এমন যদি হতো সব সময়! তেমনটি হলে তো আমরা সমস্বরে গাইতে পারি, 'অমন চাঁদের আলো মরি যদি সেও ভালো'।
আমাদের মায়েরা যতই চাঁদকে ডাকুন না কেন, সব চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যায় না। আমাদের সবার কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে গেলে জীবনে 'অর্ধচন্দ্র' জোটার আশঙ্কা বোধ হয় থাকত না।
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.