বিশ্ব বাঘ দিবস-বাঘের জন্য by খসরু চৌধুরী

আজ আন্তর্জাতিক বাঘ দিবস। পৃথিবীর ১৩টি বাঘ অধ্যুষিত দেশসহ অন্যান্য দেশে দিনটি পালিত হচ্ছে বাঘ সম্প্রদায়ের শুভ কামনায়। ১৯৭৩ সালে ভারতে বাঘ রক্ষার প্রকল্প চালু হওয়ার পর থেকে বিশ্ব বন্য প্রাণী তহবিল, স্মিথসোনিয়ান প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্ট নানা প্রতিষ্ঠানের বন্য প্রাণীবিষয়ক প্রচারণার প্রধান প্রতীক হয়ে দাঁড়ায় বাঘ।


শুধু বাঘ অধ্যুষিত দেশেই নয়, পাশ্চাত্যের ধনী দেশগুলো—যেগুলোতে কখনোই বাঘ ছিল না, তারাও বাঘ রক্ষার প্রচারণায় শামিল হয়।
বাঘের মোট আটটি উপপ্রজাতির মধ্যে ওই সময়ের মধ্যেই দুটো উপপ্রজাতি বিলুপ্ত, একটি বিলুপ্তপ্রায় (বর্তমানে বিলুপ্ত) এবং একটি প্রজাতির বাঘের অস্তিত্ব প্রশ্নে সম্মুখীন। বিশেষজ্ঞরা দেখতে পাচ্ছিলেন, উপমহাদেশের বাংলা বাঘ, ইন্দোচীন বাঘ, সুমাত্রা বাঘ ও রাশিয়ান দূরপ্রাচ্যের বাঘের মধ্যে জেনেটিক্যাল ভবিষ্যৎ আছে। অন্য বাঘ প্রজাতি, দক্ষিণ চীনা আমুর বাঘ বনে কটি আছে বা আদৌ আছে কি না সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা সন্দিহান ছিলেন।
উপমহাদেশে যেহেতু বাংলা বাঘের সংখ্যা অন্যান্য বাঘ দলের চেয়ে অনেক বেশি, সে কারণে বিশ্ব বন্য প্রাণী তহবিল ভারতীয় সংরক্ষিত বাঘের জঙ্গলগুলোয় বাঘ সংরক্ষণের জন্য ভারত সরকারকে উৎসাহিত করে সহায়তা দেয়। ভারতের তখনকার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এ বিষয়ে নিজেও অত্যন্ত উৎসাহী ছিলেন। পশ্চিমা দেশগুলোর অনেকেই প্রকল্প চালু রাখতে আর্থিক সহায়তা দেন।
বিশ্ব বন্য প্রাণী তহবিলের ট্রাস্টি গাই মাউন্টকোর্ট সে সময় সুন্দরবনের বাঘ সংরক্ষণের জন্য বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করলে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে বাঘ সংরক্ষণের পক্ষে মত দেন। সে সময়ই বাংলাদেশ বন্য প্রাণী আইন প্রণয়ন হয়। কিন্তু বন বিভাগের অনীহা, বিশেষজ্ঞের অভাবে বাংলাদেশে বাঘ প্রকল্প আর চালু হয়নি।
গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত বাঘ অধ্যুষিত দেশ চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ছাড়া অধিকাংশ দেশই বাঘ সংরক্ষণে এগিয়ে আসে। ষাটের (১৯৬০) দশকে যেখানে বাঘ বিশেষজ্ঞরা ভাবছিলেন, বাঘ সম্প্রদায় একবিংশ শতাব্দী দেখবে না, সেখানে নব্বইয়ের দশকের সাফল্যে সবাই উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠেন। ফলে আগেভাগেই বাঘ সংরক্ষণের সাফল্য উদ্যাপিত হয়। কিন্তু বাঘ বিজ্ঞানীরা দেখতে পান, আশির দশকের (১৯৮০) মধ্যেই পৃথিবীর আট উপপ্রজাতির বাঘের তিনটি শেষ হয়ে গেছে। ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়ায় আমেরিকান কার্পেট বম্বিং, জঙ্গল জ্বালিয়ে দেওয়ায়, জঙ্গলের খালগুলোয় বিষ প্রয়োগ করায় মানুষ, অন্যান্য বন্য প্রাণীসহ বাঘও প্রচুর পরিমাণে মারা পড়ে। ফলে ইন্দোচীনা বাঘ বিলুপ্তির মুখোমুখি দাঁড়ায়। এদিকে জাপানি কাঠের চাহিদা মেটাতে মালয় উপদ্বীপের ও ইন্দোনেশীয় জঙ্গল শেষ হওয়ার মুখে। গোদের ওপর মারাত্মক বিষফোঁড়ার মতো দেখা দিয়েছে ঐতিহ্যবাহী চীনা টোটকা ওষুধ। এই ওষুধে বাঘের দেহের কোনো না কোনো অংশ ব্যবহূত হয়। চীনই একমাত্র দেশ, যে দেশে বাঘের তিনটি উপপ্রজাতি (ইন্দোচীনা বাঘ, দক্ষিণ চীনা বাঘ বা আমুর বাঘ ও সাইবেরীয় বাঘ) বাস করে। তবে আমুর বাঘের অবস্থা খুবই খারাপ। জঙ্গলে মাত্র ৩০টি বাঘ আছে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।
বাঘ প্রজাতির উৎপত্তিস্থল হিসেবে বিজ্ঞানীরা সাইবেরিয়াকে চিহ্নিত করেন। সাইবেরীয় বাঘের জঙ্গল অনেক বড়। এখানে বাঘও প্রচুর ছিল। কিন্তু গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পটপরিবর্তনের ডামাডোলের সুযোগে সংঘবদ্ধ শিকারিরা প্রচুর বাঘ মেরে ফেলে। সেই সঙ্গে বাঘের জঙ্গলও কেটে ফেলে। এখন মার্কিন ও রুশ বিজ্ঞানীরা মিলিতভাবে সাইবেরীয় বাঘ উদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছেন। সুমাত্রা বাঘের সংকট হচ্ছে তাদের বাসস্থান ছোট হয়ে আসছে। বিশেষ করে জঙ্গল কেটে পামঅয়েল ও আখের ক্ষেত তৈরি করায় সুমাত্রা বাঘের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিজ্ঞানীরা চিন্তিত।
সারা বিশ্বে বাঘের অস্তিত্ব নেই হওয়ার আশঙ্কায়, সেই সময় বিশ্বব্যাংক এগিয়ে এসেছে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করার (২০২০ সালের মধ্যে) অভিপ্রায় নিয়ে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাঘের জঙ্গলগুলোর আশপাশের অধিবাসীরা অত্যন্ত গরিব। জঙ্গলের উপজাতই তাদের আয়ের প্রধান উৎস্য। এসব জঙ্গলের বর্তমান অবস্থা, ধারণক্ষমতা নিরূপণ না করেই বিশ্বব্যাংকের এই উচ্চাভিলাসী অভিপ্রায়ের বাস্তবায়ন নিয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে।
বাংলাদেশে যারাই মাঠপর্যায়ে বাঘ চর্চা করেন, তাদের একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। প্রশ্নটি হচ্ছে, বাঘের মতো একটি মারাত্মক প্রাণীকে বাঁচিয়ে রাখার দরকার কী? বাঘের ওপর মানুষের ক্ষোভটা এ জন্য যে বাঘ মানুষ মারে বলে? তাহলে বলতে হয়, বছরে সুন্দরবনে বাঘের হাতে মারা পড়ে ৪০ থেকে ৫০ জন (কোনো কোনো বছর অবশ্যই বেশি), অথচ সাপের হাতে মারা পড়ে প্রায় আড়াই হাজার মানুষ। হাতির হাতে গড়ে আটজন। অথচ সাপ, হাতির বিরুদ্ধে মানুষ এতটা খেপা নয়। খোঁজ নিয়ে জেনেছি অন্যান্য প্রাণীর হাতে মানুষ মারা পড়লে সেটাকে দুর্ভাগ্য মনে করা হয়। বাঘ শুধু মানুষ মারেই না, সুযোগ পেলে মারা মানুষ খেয়েও ফেলে। এ ব্যাপারটি মানুষের মনস্তত্ব কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। বাঘ বাঁচাতে হলে এই সমস্যার সমাধান করা দরকার।
যেকোনো বাঘের জঙ্গলের স্বাস্থ্যরক্ষার সবচেয়ে বড় শক্তি বাঘ। বাঘ শুধু খাদ্য শৃঙ্খলচক্রের সর্বোচ্চ অবস্থানেই থাকে না, সে প্রাকৃতিক পাহারাদারও। বাঘ আমাদের জাতীয় পরিচয়ের ধারক-বাহক। পৃথিবীর অনেকগুলো দেশের সাধারণ মানুষ বাংলাদেশ চেনে না। কিন্তু বেঙ্গল টাইগারের উপস্থিতি ছাড়া পৃথিবীর কোনো চিড়িয়াখানাই পরিপূর্ণ হয় না। পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীর ওপর যত বই লেখা হয়েছে, তাদের মধ্যে বাঘের ওপর লেখা বই সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে বাংলা বাঘের ওপর বই সিংহভাগ দখল করে আছে।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য হচ্ছে বাংলাদেশ সুন্দরবনের ৬০১৭ বর্গকিলোমিটারের খুব সামান্য এলাকাই বন বিভাগ তথা বাংলাদেশ সরকার নিয়ন্ত্রণ করে। সুন্দরবনের প্রধান নিয়ন্ত্রক হচ্ছে কয়েকটি ডাকাত দল। সুন্দরবনের ৮০টির মতো টহল ফাঁড়ির অধিকাংশেরই অস্ত্রপাতি বন বিভাগ সরিয়ে এনেছে ডাকাতদের ভয়ে। বনের পেশাদাররা সরকারকে যত বনকর দেয়, ডাকাতদের দিতে হয় তার চেয়ে অনেক বেশি। গাছচোর, মাছচোর, হরিণচোরের আশ্রয় ডাকাত দল। বেশ কয়েকটি টহল ফাঁড়ি ডাকাত দলের রাত্রিবাসের জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যারা বন-কর দিয়ে গোল, গরান, আগামরা সুন্দরী কাটে, ডাকাতদের উদ্বৃত্ত টাকা দিতে হয় বলে ঘের ক্রেতারা বরাদ্দকৃত জঙ্গলের চেয়ে বেশি এলাকার বন কাটে।
এই ডাকাত কণ্টকিত বনেই আমাদের বাঘের আবাস। বাঘ বাঁচাবে কারা? বন বিভাগ না ডাকাত দল?
খসরু চৌধুরী: লেখক ও বাঘ বিশেষজ্ঞ।

No comments

Powered by Blogger.