চারদিক-দিনটা যখন বন্ধুর জন্য by শারমিন নাহার

‘বন্ধু’ শব্দটা হয়তো ছোট। কিন্তু এর গভীরতা বা ব্যাপ্তি কতটা, তা বুঝবেন, যদি আপনার তেমন একজন বন্ধু থাকে। আমরা নিশ্চিত, অন্তত একজন তেমন বন্ধু আপনার আছে। ‘বন্ধু’ বলতে অনেকে হয়তো ভাবে একজন ছেলে একজন মেয়ের মধ্যে কিংবা শুধু ক্লাসের বন্ধুদের মধ্যেই এ সম্পর্ক সীমাবদ্ধ। কিন্তু বিষয়টা তেমন নয়।


এই বন্ধু হতে পারে মা, বাবা, ভাই-বোন অথবা অন্য যে কেউ। যার সঙ্গে ভাগাভাগি করতে পারেন সবকিছু। যে বন্ধনে থাকবে না কোনো চাওয়া-পাওয়া, স্বার্থ। আর এই বন্ধুত্বের বন্ধনকে দৃঢ় করতেই যেন বন্ধু দিবস পালনের রীতি।
অনেকে বলে থাকেন এই বন্ধু দিবস কি শুধুই এক দিনের জন্য বন্ধুকে স্মরণ করা, কাছে পাওয়া? এখানেও উত্তর তৈরি। বন্ধু দিবস হচ্ছে বন্ধুকে বিশেষভাবে স্মরণ করার জন্য। ছোট কোনো উপহার কিনে দেওয়া। পশ্চিমা বিশ্বে বন্ধু দিবস পালিত হচ্ছে অনেক আগে থেকেই। কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশেও নিয়মিতভাবে তা পালিত হচ্ছে। বন্ধুর হাতটা বেঁধে দেওয়া হয় একটা ব্যান্ড দিয়ে—ফ্রেন্ডশিপ ব্যান্ড নামেই তা পরিচিত হয়ে উঠেছে। এই বন্ধন যেন বন্ধুত্বের বন্ধনকে আরও পোক্ত করে। পাতা উল্টে পেছনে গেলে বন্ধু দিবসের ইতিকথা বেরিয়ে আসে। দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময় সহিংসতা, সংঘর্ষের বিষ যখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে ঠিক সে সময় এই বিশেষ দিবসটা উঠে আসে।
১৯৩৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস আগস্টের প্রথম রোববারকে জাতীয় বন্ধু দিবস ঘোষণা করে। জনপ্রিয়তার কারণে দিবসটির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলে। এর পর থেকে দিনটি বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে আন্তর্জাতিক বন্ধু দিবস হিসেবে। কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশেও বন্ধু দিবস পালন করা হচ্ছে। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের আগ্রহের একটা জায়গা তৈরি হয়েছে দিবসটিকে ঘিরে।
তবে কি দিবসটি শুধু তরুণদের জন্য? উত্তর মেলে প্রফেসর জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর কাছ থেকে। ‘তা হবে কেন? বন্ধু সব বয়সেই থাকে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে ওঠা বন্ধুত্ব অনেক জোরালো হয়। চিরকাল ধরে নদী অববাহিকার মতো বহমান।’ সব প্রজন্মের মধ্যে বন্ধুত্ব থাকে, তার অন্য এক উদাহরণ ড. সৌমিত্র শেখর। কেমন ছিল ওই প্রজন্মের আড্ডা ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক? তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন সম্পর্ক বন্ধুত্ব।’ এককথায় সাহিত্যের এই শিক্ষকের কাছে বন্ধুত্ব হলো নিরাসক্ত ভালো লাগার সীমাহীন ও সংজ্ঞাহীন একটা সম্পর্ক।’ এই প্রজন্মের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শর্মির মতে, ‘বিশ্বাস, নির্ভরতা ও আস্থার জায়গা হলো বন্ধুত্ব। একটা অন্যটার পরিপূরক। আর বন্ধুত্বের আড্ডার যে স্বাদ তা ভাষায় ব্যক্ত করা যাবে না।’
হেনরি অ্যাডামস বলেন, ‘বন্ধু তৈরি হয় না, জন্ম নেয়।’ দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেন, ‘বন্ধুত্ব যেন দুই দেহে একই আত্মা।’ জর্জ হার্ভার্ট বলেন, ‘একজন বন্ধু হলো সর্বোৎকৃষ্ট আয়না।’ তার মানে এই আয়নাতে প্রতিমুহূর্তে সে নিজেকে দেখবে। শুধু বাহ্যিক অবয়বকে নয়, ভেতরটাকেও।
সাহিত্যে বন্ধু ও বন্ধুত্ব নিয়ে কি কম লেখা হয়েছে?
‘আমার এই ভবঘুরে জীবনের ‘অপরাহ্ন’ বেলায় ইহার একটা অধ্যায় বলিতে বসিয়া আর কত না কথা মনে পড়িতেছে”... নিশ্চয়ই আপনার মনে পড়ে গেছে কোন উপন্যাসের অংশ এটি। কেন পড়েননি, শ্রীকান্ত?
শরৎ-সাহিত্যে শ্রীকান্ত চরিত্র গঠনে বন্ধু ইন্দ্রনাথের ভূমিকা কি মনে পড়ছে আপনার? বন্ধুত্ব এমনই।
শিশুসাহিত্যের দিকে চোখ রাখি। শাহরিয়ার কবিরের নুলিয়াছড়ির সোনার পাহাড় উপন্যাসে বাবু-টুনি, আবির-ললির বন্ধুত্ব, মুহম্মদ জাফর ইকবালের দীপু নাম্বার টু উপন্যাসে দীপু ও তারেকের বন্ধুত্ব কি ভোলা যায়?
বন্ধুত্ব আসলে সম্পর্কের এক বিশেষ পর্যায়। স্বার্থহীনভাবে একে অন্যকে অনুভব করার নামই বন্ধুত্ব। এমন উদাহরণের কি অভাব আছে, যেখানে মুমূর্ষু বন্ধুর পাশে হাসপাতালে রাতের পর রাত কাটিয়েছে বিশ্বস্ত বন্ধু? অন্য যে কারও চেয়ে অনেক আগে পৌঁছে গেছে বন্ধুর কাছে? নিজের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে বন্ধুর জন্য তৈরি করে দিয়েছে সুমসৃণ পথ?
এই বিশেষ দিনে বন্ধুকে আবার নতুন করে বলি, ‘বন্ধু, তোমায় বড় ভালোবাসি।’

No comments

Powered by Blogger.