স্থানীয় সরকার-বৃত্ত ও বৃত্তান্ত by তোফায়েল আহমেদ
স্থানীয় সরকার এ দেশে একটি বৃত্তাবদ্ধ অবস্থার শিকার। এ বৃত্তাবদ্ধতার বৃত্তান্তই এ দেশের স্থানীয় সরকারব্যবস্থার প্রকৃত ইতিহাস। এ বৃত্ত ভাঙার প্রচেষ্টা খুব একটা নেই। বৃত্তের আকার ও পরিধিকে বরং আরও ছোট করা হচ্ছে। একসময় এ বৃত্তের চারদিকে থাকত সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র।
তারা এটিকে পাহারা দিত এবং লালন-পালন করত। এখন কেন্দ্রীয় ও স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মানুষ এ বৃত্ত ও বৃত্তাবস্থায় একটি নতুন মাত্রা যুক্ত করে দিয়েছে। আমলাতন্ত্রও এ কাজে তাদের সঙ্গে আছে। লালন-পালন এখন আর তাদের কাজের অংশ নয়। পোষণ-তোষণ তো নয়ই। এখন বরং বাধাদান ও দমন-পীড়নই আগের বৃত্তাবস্থার সঙ্গে বোঝার ওপর শাকের আঁটি হয়ে দেখা দিয়েছে। স্থানীয় সরকারব্যবস্থার উন্নতি সামগ্রিক অর্থে অবরুদ্ধ এবং এটি একটি পরিচিত বৃত্তের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। এই বৃত্তাবদ্ধ অবস্থা থেকে বের হওয়ার কিছু কৌশল ও পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করতে চাই।
১. উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে দেখা যাচ্ছে মন্ত্রণালয়ের কমিটির ছাড়াছাড়ি। যেকোনো প্রকল্প করতে গেলেই তৃণমূল পর্যায়ে তার একটি কমিটি গঠনের নির্দেশ পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এক শিক্ষা বিভাগেরই প্রাথমিক-মাধ্যমিক মিলিয়ে প্রায় ছয়টি কমিটি। কিন্তু উপজেলা, ইউনিয়ন ও পৌরসভা পর্যায়ে যে শিক্ষাবিষয়ক স্থায়ী কমিটি রয়েছে তার কোনো খবর নেই। গুরুত্বহীন স্কুলভিত্তিক ব্যবস্থাপনা কমিটিগুলো। এভাবে ইউনিয়ন, পৌরসভা ও উপজেলায় স্থায়ী কমিটির বিধান থাকা সত্ত্বেও প্রতিদিন বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সার্কুলার জারি করে কমিটি গড়ে চলেছে। এভাবে ১৪টি স্থায়ী কমিটিকে অকার্যকর করে উপজেলায় ৩৫টি মন্ত্রণালয় নির্দেশিত কমিটি গড়া হয়েছে। অনুরূপভাবে ইউনিয়ন পর্যায়ে ১৩টি স্থায়ী কমিটি অকার্যকর রেখে নতুন নতুন মন্ত্রণালয় ও বিভাগীয় কমিটি করা বন্ধ হওয়া দরকার।
২. ইউনিয়ন, পৌরসভা ও উপজেলা—এ তিনটি প্রতিষ্ঠানের কাজের পরিধি, স্থানীয় সম্পদ সংগ্রহের ক্ষেত্রগুলো এবং স্থানীয় রাজস্বের অংশবিশেষ পাওয়ার মধ্যে ব্যাপক গোঁজামিল রয়েছে। (১) বাজারের রাজস্ব কোন প্রতিষ্ঠান কোন ফর্মুলায় কত পাবেন, তা পুনর্নির্ধারণ প্রয়োজন, এখন তা আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণে সম্পন্ন হয়। (২) একইভাবে ভূমি হস্তান্তর বা নিবন্ধন ফি-এর রাজস্ব ইউনিয়ন, পৌরসভা ও উপজেলার জন্য পৃথকভাবে নির্ধারণ করে দিতে হবে। (৩) ভূমি উন্নয়ন কর কী হারে কোন সংগঠন কীভাবে পেতে পারে তার স্পষ্ট বিধান থাকতে হবে। (৪) জেলা পরিষদগুলোকে ভূমি হস্তান্তর ও ভূমি উন্নয়ন রাজস্বের ১ শতাংশ দেওয়া হয়। যেহেতু জেলা পরিষদ এখন মূলত একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠান, এ প্রতিষ্ঠানে এ অর্থ দান সম্পূর্ণ নিরর্থক। এ অর্থ জেলা পরিষদ গঠিত না হওয়া পর্যন্ত পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা পরিষদের মধ্যে বণ্টন হতে পারে। (৫) একই রকমভাবে অনির্বাচিত ও অকার্যকর জেলা পরিষদের বিপরীতে প্রতিবছর সরকারের বাজেটে থোক বরাদ্দ দেওয়া থাকে, সে থোক বরাদ্দ বর্তমান বছরেও রাখা হয়েছে। এ অর্থ জেলা পরিষদের বদলে কার্যকর অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ব্যয় হতে পারে।
৩. স্থানীয় সরকারকে পাশ কাটিয়ে প্রকল্প রচনা আমাদের সব উন্নয়নবিষয়ক মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা কমিশন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি অতি পুরোনো পদ্ধতি, যা বর্তমান সময়েও অব্যাহত গতিতে চলছে। লক্ষাধিক কোটি টাকার জাতীয় বাজেটে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও জেলা পরিষদের জন্য থোক বরাদ্দ রাখা আছে প্রায় ১২০০ কোটি টাকা। অপরদিকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রকল্প বরাদ্দ প্রায় আট হাজার কোটি টাকা। স্থানীয় সরকার বিভাগের অন্তর্গত স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর গঠনের যৌক্তিকতাই ছিল তারা বিভিন্ন স্তরের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকে কারিগরি সহায়তা দেবে। কালের ব্যাপ্ত পরিসরে তারাই স্থানীয় সরকারের নামে হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে, আর স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো নীরব দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ। এ ব্যবস্থা বহাল রেখে স্থানীয় শাসনসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানকে কোনো দিন সঠিক ভূমিকায় অবতীর্ণ করা সম্ভব নয়।
৪. স্থানীয় সরকারের অধিক্ষেত্র বা ভৌগোলিক এলাকার মধ্যে অত্যন্ত অস্বচ্ছভাবে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সরাসরি অর্থায়নে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কার্যক্রম বা প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়। কিন্তু স্থানীয়ভাবে পরিষদগুলো কোনোভাবেই এসব কাজের জবাবদিহিতা নিতে পারে না এবং দারিদ্র্য হ্রাসকরণে কোনো সমন্বিত পরিকল্পনার অধীনে এ সেইফটি নেট কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে পারে না। তা যদি হতো তা হলে বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু কর প্রদানের হার আরও বৃদ্ধি পেত।
৫. স্থানীয় পর্যায়ে পৌরসভা, সিটি করপোরেশন, ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ যেসব রাজস্ব আহরণ করে এবং সেবা প্রদান করে তা জাতীয় বাজেটে কোথাও কোনোভাবে প্রতিফলিত হয় না।
৬. দেশে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণীত হতে যাচ্ছে এবং প্রেক্ষিত পরিকল্পনার দলিলের খসড়া প্রস্তুত হয়েছে। কিন্তু স্থানীয় পরিকল্পনার কোনো গুরুত্ব জাতীয়ভাবে স্বীকার করা হচ্ছে না। স্থানীয়ভাবে প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, উপজেলা ও জেলা পরিষদের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণীত হওয়া প্রয়োজন। সে পরিকল্পনাগুলো মূলত জাতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্য ও কৌশলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে করা যেতে পারে না। জাতীয়, আঞ্চলিক ও স্থানীয় পরিকল্পনা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না। বরং একই লক্ষ্য ভিন্ন ভিন্নভাবে হাসিল করবে।
৭. দেশের পার্বত্য অঞ্চলের বিরাজিত স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে কার্যকর করার জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। এখন সেখানে বিরাজিত স্থানীয় সরকারব্যবস্থা এবং জাতীয় সরকারের বিভাগগুলো যথাযথভাবে কাজ করছে না। আঞ্চলিক পরিষদ, জেলা পরিষদ ও জেলা প্রশাসনে কোনো কার্যকর সম্পর্ক নেই। নেই উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের সঙ্গে জেলা পরিষদের কার্যকর আইনি সম্পর্ক। অপরদিকে আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদে যথাক্রমে ১০ ও ১৮ বছর ধরে কোনো নির্বাচন নেই। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মধ্যে কার্যকর কোনো যোগাযোগ নেই। পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে বিশেষ কোনো কমিশন করে পুরো আইনকাঠামো ও প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা পর্যালোচনা করা দরকার।
৮. দেশে স্থানীয় সরকারব্যবস্থার উন্নয়ন, কার্যকরকরণ ও শক্তিশালীকরণ প্রক্রিয়া থমকে দাঁড়িয়ে আছে। এখানে পুনরায় সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন। ১৪৪৩ জন নেতৃত্ব উপজেলায় নির্বাচিত হয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে আছেন। আবার ইউপি ও পৌরসভায় নির্বাচন বন্ধ হয়ে আছে। এখানে চলছে একটি সর্বগ্রাসী স্থবিরতা। অবিলম্বে নির্বাচন দিয়ে এ স্থবিরতা কাটাতে হবে। আইন সংশোধনের প্রয়োজন নেই। আইনের যথার্থ প্রয়োগ করেই নভেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব।
৯. যেসব স্তরে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে, সেসব স্তরের নেতাদের সঠিকভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে লাগাতে হবে। যেসব স্তরে নির্বাচন হবে বা হতে যাচ্ছে নির্বাচন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যাতে তারা প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ শুরু করতে পারে তার আগাম ব্যবস্থা রাখতে হবে।
১০. আজকাল ইউএসএআইডি, ডানিডা ও অন্যান্য বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন স্থানীয় সরকার সমিতিগুলো সংগঠিত হয়েছে। যেমন বাংলাদেশ পৌরসভা সমিতি এবং বাংলাদেশ ইউনিয়ন পরিষদ ফোরাম। আবার প্রকল্প কার্যক্রমের বাইরে ইউনিয়ন, পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদের নেতাদের আরও সংগঠন রয়েছে। কিন্তু তাদের মধ্যে সামগ্রিকভাবে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা শক্তিশালীকরণের সমন্বিত কোনো কার্যক্রম নেই। প্রায় সবাই নিজস্ব পরিষদীয় গণ্ডি এমনকি খুবই সংকীর্ণ ব্যক্তিকেন্দ্রিক দাবিদাওয়া নিয়ে কালক্ষেপণ করে।
১১. জাতীয়ভাবে সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে একদিন ‘স্থানীয় সরকার দিবস’ পালনের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এই একটি দিনে সারা দেশের প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ নিজ নিজ এলাকায় দিবসটি পালন করবে। বেসরকারিভাবে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরা প্রথমে পালন করতে শুরু করতে পারে। তারপর সরকার এবং অন্যান্য সংস্থাও এতে যোগ দিতে পারে। প্রথমে বিইউপিএফ, ম্যাব, উপজেলা সমিতি এবং ফোরাম, আপনারা একটি দিন নির্বাচন করুন। সারা দেশে নিজ নিজ উদ্যোগে আগামী বছর থেকে দিনটি পালন শুরু করুন। সাধারণভাবে সবাই নিজ নিজ এলাকায় দিনব্যাপী দিবসটি পালন করতে পারেন। দিনটি এমন একটি সময়ে নির্ধারণ করতে হবে যা বছরের শেষ, মধ্যখানে বা শেষে নয়। হতে পারে একটি অর্থবছর শেষ হওয়ার তিন মাস আগে অর্থাৎ প্রতিবছর মার্চ মাসে দিনটি পালিত হতে পারে। ধরা যাক প্রতিবছর ১ মার্চ। এ সময় বছরের গত সময়ের সব উন্নয়ন এবং সেবাকাজের পর্যালোচনা এবং আগামী কোয়ার্টারের মধ্যে চলতি বছরের সব পরিকল্পিত কাজ শেষ করার সংশোধিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে। এ দিবস পালনের মাধ্যমে সারা জাতি বছরের একটা দিন স্থানীয় সরকার নিয়ে চিন্তাভাবনার সুযোগ পাবেন।
ওপরে যে ১১টি বিষয় উল্লেখ করা হলো এগুলো করা গেলে বৃত্ত ভাঙার পথে আমরা এক ধাপ এগোতে পারি। নতুবা একই বৃত্তের মধ্যে একই বৃত্তান্তই ঘুরেফিরে আমাদের আরও বহুকাল কপচাতে হবে।
ড. তোফায়েল আহমেদ: স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ। বিলুপ্ত স্থানীয় সরকার কমিশনের সদস্য।
১. উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে দেখা যাচ্ছে মন্ত্রণালয়ের কমিটির ছাড়াছাড়ি। যেকোনো প্রকল্প করতে গেলেই তৃণমূল পর্যায়ে তার একটি কমিটি গঠনের নির্দেশ পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এক শিক্ষা বিভাগেরই প্রাথমিক-মাধ্যমিক মিলিয়ে প্রায় ছয়টি কমিটি। কিন্তু উপজেলা, ইউনিয়ন ও পৌরসভা পর্যায়ে যে শিক্ষাবিষয়ক স্থায়ী কমিটি রয়েছে তার কোনো খবর নেই। গুরুত্বহীন স্কুলভিত্তিক ব্যবস্থাপনা কমিটিগুলো। এভাবে ইউনিয়ন, পৌরসভা ও উপজেলায় স্থায়ী কমিটির বিধান থাকা সত্ত্বেও প্রতিদিন বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সার্কুলার জারি করে কমিটি গড়ে চলেছে। এভাবে ১৪টি স্থায়ী কমিটিকে অকার্যকর করে উপজেলায় ৩৫টি মন্ত্রণালয় নির্দেশিত কমিটি গড়া হয়েছে। অনুরূপভাবে ইউনিয়ন পর্যায়ে ১৩টি স্থায়ী কমিটি অকার্যকর রেখে নতুন নতুন মন্ত্রণালয় ও বিভাগীয় কমিটি করা বন্ধ হওয়া দরকার।
২. ইউনিয়ন, পৌরসভা ও উপজেলা—এ তিনটি প্রতিষ্ঠানের কাজের পরিধি, স্থানীয় সম্পদ সংগ্রহের ক্ষেত্রগুলো এবং স্থানীয় রাজস্বের অংশবিশেষ পাওয়ার মধ্যে ব্যাপক গোঁজামিল রয়েছে। (১) বাজারের রাজস্ব কোন প্রতিষ্ঠান কোন ফর্মুলায় কত পাবেন, তা পুনর্নির্ধারণ প্রয়োজন, এখন তা আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণে সম্পন্ন হয়। (২) একইভাবে ভূমি হস্তান্তর বা নিবন্ধন ফি-এর রাজস্ব ইউনিয়ন, পৌরসভা ও উপজেলার জন্য পৃথকভাবে নির্ধারণ করে দিতে হবে। (৩) ভূমি উন্নয়ন কর কী হারে কোন সংগঠন কীভাবে পেতে পারে তার স্পষ্ট বিধান থাকতে হবে। (৪) জেলা পরিষদগুলোকে ভূমি হস্তান্তর ও ভূমি উন্নয়ন রাজস্বের ১ শতাংশ দেওয়া হয়। যেহেতু জেলা পরিষদ এখন মূলত একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠান, এ প্রতিষ্ঠানে এ অর্থ দান সম্পূর্ণ নিরর্থক। এ অর্থ জেলা পরিষদ গঠিত না হওয়া পর্যন্ত পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা পরিষদের মধ্যে বণ্টন হতে পারে। (৫) একই রকমভাবে অনির্বাচিত ও অকার্যকর জেলা পরিষদের বিপরীতে প্রতিবছর সরকারের বাজেটে থোক বরাদ্দ দেওয়া থাকে, সে থোক বরাদ্দ বর্তমান বছরেও রাখা হয়েছে। এ অর্থ জেলা পরিষদের বদলে কার্যকর অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ব্যয় হতে পারে।
৩. স্থানীয় সরকারকে পাশ কাটিয়ে প্রকল্প রচনা আমাদের সব উন্নয়নবিষয়ক মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা কমিশন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি অতি পুরোনো পদ্ধতি, যা বর্তমান সময়েও অব্যাহত গতিতে চলছে। লক্ষাধিক কোটি টাকার জাতীয় বাজেটে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও জেলা পরিষদের জন্য থোক বরাদ্দ রাখা আছে প্রায় ১২০০ কোটি টাকা। অপরদিকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রকল্প বরাদ্দ প্রায় আট হাজার কোটি টাকা। স্থানীয় সরকার বিভাগের অন্তর্গত স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর গঠনের যৌক্তিকতাই ছিল তারা বিভিন্ন স্তরের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকে কারিগরি সহায়তা দেবে। কালের ব্যাপ্ত পরিসরে তারাই স্থানীয় সরকারের নামে হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে, আর স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো নীরব দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ। এ ব্যবস্থা বহাল রেখে স্থানীয় শাসনসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানকে কোনো দিন সঠিক ভূমিকায় অবতীর্ণ করা সম্ভব নয়।
৪. স্থানীয় সরকারের অধিক্ষেত্র বা ভৌগোলিক এলাকার মধ্যে অত্যন্ত অস্বচ্ছভাবে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সরাসরি অর্থায়নে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কার্যক্রম বা প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়। কিন্তু স্থানীয়ভাবে পরিষদগুলো কোনোভাবেই এসব কাজের জবাবদিহিতা নিতে পারে না এবং দারিদ্র্য হ্রাসকরণে কোনো সমন্বিত পরিকল্পনার অধীনে এ সেইফটি নেট কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে পারে না। তা যদি হতো তা হলে বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু কর প্রদানের হার আরও বৃদ্ধি পেত।
৫. স্থানীয় পর্যায়ে পৌরসভা, সিটি করপোরেশন, ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ যেসব রাজস্ব আহরণ করে এবং সেবা প্রদান করে তা জাতীয় বাজেটে কোথাও কোনোভাবে প্রতিফলিত হয় না।
৬. দেশে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণীত হতে যাচ্ছে এবং প্রেক্ষিত পরিকল্পনার দলিলের খসড়া প্রস্তুত হয়েছে। কিন্তু স্থানীয় পরিকল্পনার কোনো গুরুত্ব জাতীয়ভাবে স্বীকার করা হচ্ছে না। স্থানীয়ভাবে প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, উপজেলা ও জেলা পরিষদের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণীত হওয়া প্রয়োজন। সে পরিকল্পনাগুলো মূলত জাতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্য ও কৌশলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে করা যেতে পারে না। জাতীয়, আঞ্চলিক ও স্থানীয় পরিকল্পনা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না। বরং একই লক্ষ্য ভিন্ন ভিন্নভাবে হাসিল করবে।
৭. দেশের পার্বত্য অঞ্চলের বিরাজিত স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে কার্যকর করার জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। এখন সেখানে বিরাজিত স্থানীয় সরকারব্যবস্থা এবং জাতীয় সরকারের বিভাগগুলো যথাযথভাবে কাজ করছে না। আঞ্চলিক পরিষদ, জেলা পরিষদ ও জেলা প্রশাসনে কোনো কার্যকর সম্পর্ক নেই। নেই উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের সঙ্গে জেলা পরিষদের কার্যকর আইনি সম্পর্ক। অপরদিকে আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদে যথাক্রমে ১০ ও ১৮ বছর ধরে কোনো নির্বাচন নেই। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মধ্যে কার্যকর কোনো যোগাযোগ নেই। পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে বিশেষ কোনো কমিশন করে পুরো আইনকাঠামো ও প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা পর্যালোচনা করা দরকার।
৮. দেশে স্থানীয় সরকারব্যবস্থার উন্নয়ন, কার্যকরকরণ ও শক্তিশালীকরণ প্রক্রিয়া থমকে দাঁড়িয়ে আছে। এখানে পুনরায় সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন। ১৪৪৩ জন নেতৃত্ব উপজেলায় নির্বাচিত হয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে আছেন। আবার ইউপি ও পৌরসভায় নির্বাচন বন্ধ হয়ে আছে। এখানে চলছে একটি সর্বগ্রাসী স্থবিরতা। অবিলম্বে নির্বাচন দিয়ে এ স্থবিরতা কাটাতে হবে। আইন সংশোধনের প্রয়োজন নেই। আইনের যথার্থ প্রয়োগ করেই নভেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব।
৯. যেসব স্তরে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে, সেসব স্তরের নেতাদের সঠিকভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে লাগাতে হবে। যেসব স্তরে নির্বাচন হবে বা হতে যাচ্ছে নির্বাচন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যাতে তারা প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ শুরু করতে পারে তার আগাম ব্যবস্থা রাখতে হবে।
১০. আজকাল ইউএসএআইডি, ডানিডা ও অন্যান্য বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন স্থানীয় সরকার সমিতিগুলো সংগঠিত হয়েছে। যেমন বাংলাদেশ পৌরসভা সমিতি এবং বাংলাদেশ ইউনিয়ন পরিষদ ফোরাম। আবার প্রকল্প কার্যক্রমের বাইরে ইউনিয়ন, পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদের নেতাদের আরও সংগঠন রয়েছে। কিন্তু তাদের মধ্যে সামগ্রিকভাবে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা শক্তিশালীকরণের সমন্বিত কোনো কার্যক্রম নেই। প্রায় সবাই নিজস্ব পরিষদীয় গণ্ডি এমনকি খুবই সংকীর্ণ ব্যক্তিকেন্দ্রিক দাবিদাওয়া নিয়ে কালক্ষেপণ করে।
১১. জাতীয়ভাবে সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে একদিন ‘স্থানীয় সরকার দিবস’ পালনের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এই একটি দিনে সারা দেশের প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ নিজ নিজ এলাকায় দিবসটি পালন করবে। বেসরকারিভাবে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরা প্রথমে পালন করতে শুরু করতে পারে। তারপর সরকার এবং অন্যান্য সংস্থাও এতে যোগ দিতে পারে। প্রথমে বিইউপিএফ, ম্যাব, উপজেলা সমিতি এবং ফোরাম, আপনারা একটি দিন নির্বাচন করুন। সারা দেশে নিজ নিজ উদ্যোগে আগামী বছর থেকে দিনটি পালন শুরু করুন। সাধারণভাবে সবাই নিজ নিজ এলাকায় দিনব্যাপী দিবসটি পালন করতে পারেন। দিনটি এমন একটি সময়ে নির্ধারণ করতে হবে যা বছরের শেষ, মধ্যখানে বা শেষে নয়। হতে পারে একটি অর্থবছর শেষ হওয়ার তিন মাস আগে অর্থাৎ প্রতিবছর মার্চ মাসে দিনটি পালিত হতে পারে। ধরা যাক প্রতিবছর ১ মার্চ। এ সময় বছরের গত সময়ের সব উন্নয়ন এবং সেবাকাজের পর্যালোচনা এবং আগামী কোয়ার্টারের মধ্যে চলতি বছরের সব পরিকল্পিত কাজ শেষ করার সংশোধিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে। এ দিবস পালনের মাধ্যমে সারা জাতি বছরের একটা দিন স্থানীয় সরকার নিয়ে চিন্তাভাবনার সুযোগ পাবেন।
ওপরে যে ১১টি বিষয় উল্লেখ করা হলো এগুলো করা গেলে বৃত্ত ভাঙার পথে আমরা এক ধাপ এগোতে পারি। নতুবা একই বৃত্তের মধ্যে একই বৃত্তান্তই ঘুরেফিরে আমাদের আরও বহুকাল কপচাতে হবে।
ড. তোফায়েল আহমেদ: স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ। বিলুপ্ত স্থানীয় সরকার কমিশনের সদস্য।
No comments