গদ্যকার্টুন-মন্ত্রীরা কেন শুল্কমুক্ত গাড়ি পাবেন না? by আনিসুল হক
একটা খবর পড়লাম। মন্ত্রিসভার বৈঠক চলছে। প্রধানমন্ত্রী সভাপতিত্ব করছেন। একজন মন্ত্রী বললেন, সংসদ সদস্যরা একটা করে শুল্কমুক্ত গাড়ি পাবেন। কিন্তু মন্ত্রীরা শুধু মোটরপুল থেকে গাড়ি পান। মন্ত্রীরাও শুল্কমুক্ত গাড়ি পেতে পারেন কি না! অত্যন্ত সংগত প্রশ্ন।
জাতীয় সংসদ সদস্যরা শুল্কমুক্ত গাড়ি আনেন। এর আগের বার দেখা গেছে, তাঁরা এমন দামি গাড়ি আমদানি করছেন, যার শুল্ক আসে কোটি টাকারও বেশি। সেই শুল্কের পুরোটাই মাফ। এরপর তাঁদের কেউ কেউ গাড়িটা বিক্রি করে দেন কোনো বড়লোকের কাছে। তাতে তাঁর কোটিখানেক টাকা আয় হয়। ব্যবসা মন্দ না। একটা কাগজ বিক্রি করে ঘরে বসে কোটি টাকা উপার্জন। এবার অবশ্য কত বড় গাড়ি আমদানি করা যাবে, কত দামি গাড়ি, সে বিষয়ে একটা নিয়ম করা হয়েছে। ফলে আগেরবারের মতো লাভ এবার করা যাবে না। আর গাড়ি বিক্রিও করা যাবে না নির্ধারিত সময়ের আগে। তবু শুল্কমুক্ত গাড়ি বলে কথা। এই দেশে গাড়ির ওপর ট্যাক্স বড় বেশি। যে গাড়ির দাম শুল্ক ছাড়া পড়ে ১৫ লাখ, শুল্ক দিলে সেটার দাম পড়ে ৭০ লাখ। এই সুযোগ কে ছাড়তে চায়?
মন্ত্রীরা আমাদের সেবক। আমাদের প্রতিনিধি। তাঁরা সরকারি গাড়ি পান বটে, কিন্তু তা তো সরকারি গাড়ি। আর গাড়িটাও তেমন দামিটামি নয়। যদি না প্রকল্পের দামি ফোর হুইল ড্রাইভ গাড়ি দু-চারটা তাঁরা মর্জিমাফিক ব্যবহার করার সুযোগ নিয়ে থাকেন। তো আমাদের জনপ্রতিনিধি আর সেবকেরা যদি নিজেরা দামি গাড়ির মালিক না হতে পারেন, শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানি করে সেটা ব্যবহার ও মওকামতো বিক্রি করে দেওয়ার এখতিয়ার লাভ না করেন, তাহলে তাঁরা কিসের নেতা।
দুনিয়াতে মানুষ আছে দুই প্রকার। এক প্রকার হলো যাঁরা দেন, যাঁদের অন্তর সারাক্ষণ দিতে চায়, তাঁরা হলেন দেওতা, দেবতা। আরেক প্রকার হলেন যাঁরা নেন, যাঁদের অন্তর সর্বদা ডেকে চলে, নেও নেও, তাঁরা হলেন নেওতা, মানে নেতা। তো নেতা যদি নেতার মতো হন, তিনি অবশ্যই নেবেন। গাড়ি নেবেন, বাড়ি নেবেন, ঢেউটিন নেবেন, বনের হরিণ নেবেন। এটাই তো স্বাভাবিক। কাজেই মন্ত্রী স্বাভাবিক প্রশ্নটাই উত্থাপন করেছেন। সংসদ সদস্যরা যদি শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির এই সুযোগ, শুধু সুুযোগই বা বলি কেন, সম্মান, শুধু সম্মানই বা বলি কেন, অধিকার লাভ করে থাকেন, তাহলে মন্ত্রীরা কেন সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রীর এই গভীর অর্থপূর্ণ ও অর্থকরী প্রশ্নটির উত্তর দিয়েছেন নিতান্তই অনর্থকরী ভঙ্গিতে। বলেছেন, আপনার যদি মনে হয় সংসদ সদস্য হওয়াই অধিক লাভজনক, তাহলে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিয়ে সংসদ সদস্য পরিচয় নিয়েই সন্তুষ্ট থাকুন।
প্রধানমন্ত্রী আসলে মন্ত্রীর প্রশ্নটির গভীর তাৎপর্য উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছেন। একজন মন্ত্রীর একাধিক গাড়ি থাকা মানে মন্ত্রীর ক্ষমতায়ন, সম্মানবৃদ্ধি, গতিবৃদ্ধি, শ্রীবৃদ্ধি। আর মন্ত্রী হলেন জনগণের সেবক ও প্রতিনিধি। প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ। আর জনগণের এই মালিকানা তাদের প্রতিনিধিদের মাধ্যমেই অর্জিত ও চর্চিত হয়। মন্ত্রীর একাধিক গাড়ি থাকা মানে জনগণেরই একাধিক গাড়ি থাকা। তা থেকে একজন মন্ত্রীকে বঞ্চিত করা মানে জনগণকেই জনগণের সম্পদ থেকে বঞ্চিত রাখা।
এবার আর বাংলাদেশের গল্প নয়। ভারতের গল্প। ভারতের একজন মন্ত্রী মারুতি গাড়ির কারখানা পরিদর্শন করতে গেছেন। পরিদর্শন শেষে কারখানার পক্ষ থেকে মন্ত্রীকে একটা গাড়ি বিনা মূল্যে উপহার হিসেবে দেওয়া হলো। মন্ত্রী বললেন, এটা সম্ভব নয়। আমি কখনোই বিনা মূল্যে একটা গাড়ি নিতে পারি না। যদি নিই, তাহলে সেটা হবে দুর্নীতি। আমি দুর্নীতি করব না। আমার সরকার দুর্নীতি না করার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
কারখানার কর্তৃপক্ষ তখন বলল, আপনি এক কাজ করুন। বিনা মূল্যে আপনাকে আমরা গাড়ি দেব না। আপনি ৫০০ রুপি দিন। ৫০০ টাকায় আপনার কাছে আমরা গাড়িটা বিক্রি করব। হ্রাসকৃত মূল্যে গাড়ি ক্রয় করাটা দুর্নীতির পর্যায়ে পড়ে না।
মন্ত্রী তখন তাঁর মানিব্যাগ থেকে দুটো ৫০০ টাকার নোট বের করে দিয়ে বললেন, সে ক্ষেত্রে আমাকে দুটো গাড়ি দিন।
এটা একটা কৌতুক। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সরকারি গাড়ি কোনটা? না, কোনো বিএমডব্লিউ বা মার্সিডিজ নয়। ভারতে তৈরি অ্যামবাসাডর। আর কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী এখনো অ্যামাবাসাডর গাড়িতেই চড়েন। এটা কৌতুক নয়।
বাংলাদেশে এখনো একাধিক মন্ত্রী আছেন, যাঁরা সাদাসিধে জীবনযাপন করেন এবং মন্ত্রী হিসেবে তাঁদের দায়িত্ব পালন করতে খুবই সচেষ্ট। এসব মন্ত্রণালয়ের সাফল্যও আমাদের চোখে পড়ে বৈকি।
কিন্তু সব মন্ত্রীই কি একই রকম? সব নেতাই কি একই রকম? সবাই দেওতা নয়, বেশির ভাগই নেওতা। সবাই দেওয়ার তালে নেই, কেউ কেউ নেওয়ার তালেও আছেন।
প্রধানমন্ত্রী তাঁদের মনোবেদনাটা বুঝতে পারবেন না? তাঁদের আরও কিছু দেবেন না? প্লট, ফ্ল্যাট, গাড়ি, টিভি চ্যানেল?
অবশ্য সবাই যে প্রধানমন্ত্রীর (অনুমতি) দানের অপেক্ষায় বসে থাকবেন, তা তো নয়। নিজের ভাগ্যের চাকা তো নিজেকেই ঘোরাতে হবে। তাঁরা হয়তো ঘোরাচ্ছেন।
বিগত সরকারের আমলে এক মন্ত্রী গাড়ি উপহার নিয়েছিলেন নাইকো নামক একটা তেল-গ্যাস কোম্পানির কাছ থেকে। সেই গাড়ির ছবি কাগজে ছাপা হওয়ার পরে মন্ত্রীর চাকরি চলে গিয়েছিল। ভারতের কৌতুকটা যদি মন্ত্রীর জানা থাকত, তাহলে তিনি নিশ্চয়ই পকেট থেকে ৫০০ টাকা বের করে দিয়ে গাড়িটা কিনে নিতেন। ওই সরকারের আরেক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দাতা দেশের কূটনীতিকেরা সংবাদ সম্মেলন করে ঘুষ দাবির অভিযোগ করে দাতব্য প্রকল্পের সব টাকা ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন।
দুর্নীতি সত্যি বিএনপি-জামায়াত সরকারের ভরাডুবির একটা বড় কারণ। এই সরকারের মন্ত্রী-এমপি-নেতা-কর্মীরা কি সেটা মনে রেখেছেন?
মন্ত্রীদের সম্পদের হিসাব চাই। এমপিরাও হিসাব দিন সম্পদের। আমরা যদি দেখি, আমাদের মন্ত্রী-এমপিরা উত্তরাধিকারসূত্রেই অনেক বড়লোক, তাতে আমাদের বুকই গর্বে ভরে উঠবে। হাজার হলেও, মন্ত্রী বড়লোক মানে তো জনগণই বড়লোক। তাঁরা তো আমাদেরই নেতা, আমাদেরই কণ্ঠস্বর, আমাদেরই প্রতিনিধি।
শুধু ইংরেজ ঐতিহাসিক লর্ড অ্যাকটন ১৮৮৭ সালে আরেকজন বিদ্বান ব্যক্তিকে লেখা চিঠিতে যা বলেছিলেন, তার উল্লেখ করতে চাই, ‘আমি তোমার কথা মেনে নিতে পারি না, তুমি ধরেই নিচ্ছ যে পোপ কিংবা সম্রাট কোনো অন্যায় করবেন না। যদি আগে থেকেই কোনো কিছু ধরে নিতে হয়, তাহলে তোমাকে অনুমান করতে হবে সম্পূর্ণ উল্টোটা, ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধে যাবে তোমার অনুমান, যতই ক্ষমতা বাড়বে, ততই এই বিরুদ্ধতা বাড়বে।... পাওয়ার ট্রেন্ডস টু করাপ্ট অ্যান্ড অ্যাবসোলুট পাওয়ার করাপ্টস অ্যাবসোলুটলি—ক্ষমতার প্রবণতা হলো দুর্নীতিগ্রস্ত করা এবং নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দুর্নীতিগ্রস্ত করে নিরঙ্কুশভাবে। বড় মানুষ প্রায়ই খারাপ মানুষ, এমনকি যখন তারা কর্তৃত্ব খাটায় না, কেবল প্রভাব খাটায়, তখনো। যখন তুমি তাকে আরও কর্তৃত্ব দাও, তখন তুমি তার দুর্নীতির প্রবণতা বা নিশ্চয়তা আরও অনেক বাড়িয়ে দাও।’
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments