সহজিয়া কড়চা-আমার জানা ও দেখা শাসকদের ইতিকথা by সৈয়দ আবুল মকসুদ
শৈশবে অনেকটা সময় স্কুলের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক ছিল না। টেক্সট বই মুখস্থ করার বিড়ম্বনা থেকেও রেহাই পেয়েছিলাম। আমি ষষ্ঠ শ্রেণীতে স্কুলে ভর্তি হই। স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে জীবনে প্রথম আমি যে দুটি বই কষ্ট করে আগাগোড়া পড়ে শেষ করি, তার একটি উপন্যাস, অপরটি একটি ইতিহাসের বই।
সেগুলো হলো রবীন্দ্রনাথের নৌকাডুবি এবং রমেশচন্দ্র মজুমদারের ভারতবর্ষের ইতিহাস। নৌকাডুবির প্রধান চরিত্রের মধ্যে আছে রমেশ ও কমলা। আমাদের পাশের বাড়িতেও ছিল রমেশ ও কমলা। তাতে আমি খুব মজা পাই। রবীন্দ্রনাথের রমেশ ও কমলাকেও বেশ চেনা মানুষ মনে হয়।
রমেশ মজুমদারের ভারী ভারী ইতিহাসবিষয়ক বইগুলোর কথা সবাই জানেন। তিনি যে অর্থ উপার্জনের জন্য অথবা অনুরুদ্ধ হয়ে স্কুলপাঠ্য বই লিখেছিলেন, তা ঢাকা ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের বিখ্যাত অধ্যাপকেরাও জানেন না। আমি যে বইটির কথা বলছি, তা ছিল পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীদের জন্য লেখা। লিখেছিলেন ১৯২০-এর দশকে, তিনি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।
মজুমদারের শ দেড়েক পৃষ্ঠার ভারতবর্ষের ইতিহাস-এ যে মানুষগুলো সম্পর্কে লেখা, তাঁরা রবীন্দ্রনাথের রমেশ আর কমলার মতো নন। তাঁরা যে রক্ত-মাংস-অস্থিসর্বস্ব সাড়ে তিন হাত মানুষ নন, তাঁরা তিরিশ-পঁয়ত্রিশ হাত লম্বা মানুষ—উচ্চতায় তাঁরা বিধাতার কাছাকাছি। তাঁদের মাথায় মণি-মুক্তার মুকুট। তিনি লিখেছিলেন সৌর্য রাজবংশের চন্দ্রগুপ্তের কথা, সম্রাট অশোকের কথা, কুশাণ সাম্রাজ্যের রাখা কনিষ্কের কথা। আরও যাঁদের কথা লিখেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন গুপ্ত সাম্রাজ্যের সমুদ্রগুপ্ত, সুলতানি আমলের মুহম্মদ ঘুরী, শামসুদ্দিন ইলতুৎমিশ, আলাউদ্দিন খিলজি, মুহম্মদ বিন তুঘলক, মোগল সাম্রাজ্যের সম্রাট বাবর, শেরশাহ, হুমায়ুন, আকবর, আওরঙ্গজেবদের কথা। আলিবর্দি, সিরাজউদ্দৌলার সচিত্র কাহিনিও ছিল।
বিধাতার এ জগতে একদিকে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ, গ্রাম-বন্দর-জনপদে যাঁরা গিজ গিজ করে। এদের কেউ শৈশবে বই বগলে নিয়ে পাঠশালায় যায়, কেউ খেতে লাঙল চালাতে যায়, কেউ মাছ ধরে, কেউ কাপড় বোনে, হাট-বাজার ও অফিস-আদালত করে, যৌবনপ্রাপ্ত হলে বিয়ে করে, শালী এবং শালার বউয়ের সঙ্গে রসিকতা করে, কেউ যৌতুক না পেলে বউকে গলা টিপে মারে, তারপর জেলের ভাত খায়। এ জগতে আরেক প্রজাতি আছেন, যাঁদের কথা রমেশবাবু লিখেছেন। তাঁরা মানুষ নন—মানুষের ঊর্ধ্বে। তাঁরা শাসক।
জীবনে প্রথম আমি আমাদের শাসকদের চাক্ষুষ দেখার সুযোগ পাইনি—ছবিতে তাঁদের দেখেছি। মজুমদার যাঁদের কথা লিখেছেন, তাঁদেরই পাকিস্তানি সংস্করণের সঙ্গে পরিচিত হই শৈশবে একটি ফটোর মাধ্যমে। আমাদের বাড়িতে নানা রকম ছবি বাঁধাই করে টাঙানো ছিল। রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের ছবির পাশেই একটি আলোকচিত্র ছিল। খাজা নাজিমউদ্দিন যেদিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন, সেই দিনের শপথ অনুষ্ঠানের ছবি। মাঝখানে মধ্যমণি হিসেবে নতুন গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ লাঠিতে ভর দিয়ে বসা, পাশে স্যার নাজিমউদ্দিন ও মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্য। গ্রুপ পোর্ট্রেটটি ঢাকার একটি দৈনিকের ফটোগ্রাফারের কাছ থেকে সংগ্রহ করে আব্বা বাঁধাই করে রাখেন। বোধহয় তিনি মনে করেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী পূর্ববাংলার হওয়ায় এবার প্রদেশের প্রচণ্ড উন্নয়ন হবে।
ওই গ্রুপ পোর্ট্রেটের মানুষগুলোর কীর্তির কথা এখন ইতিহাসে লেখা হয়ে গেছে। ঢাকার মানুষ খাজা সাহেব প্রথম ধাক্কায়ই বাংলা ভাষাটাকে নাকচ করে দিলেন। গোলাম মোহাম্মদ রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে পাকিস্তানের রাজনীতিতে কী কীর্তি রেখে গেছেন, তা বলতে গেলে বমি আসে। তাঁর সম্পর্কে কিছু কথা জানা যায় কুদরতুল্লাহ শাহারের স্মৃতিকথা থেকে। এক ইরানি বংশোদ্ভূত সুন্দরী ছিলেন তাঁর সেক্রেটারি (মহিলা সিআইএর পক্ষে গোপনে কাজ করতেন)। ভীমরতিতে ধরা গভর্নর জেনারেল যুবতী সেক্রেটারিকে বলেছিলেন, ‘দ্যাখো হে, আমার বিরুদ্ধে কেউ গুজ গুজ করলে তা আমি ঠিকই কানে শুনি। তা ছাড়া অন্য সব কথা আমি ঠিকমতো শুনতে পাই না। তুমি আমার কানের কাছে মুখ এনে কথা বলবে। তীব্র সেন্ট লাগিয়ে সুন্দরী গোলাম মোহাম্মদের কানের কাছে মুখ নিলে, তিনি গজ গজ করতেন, মুখটা ঠোঁটের কাছে আনতে পারো না? তোমাকে আমি স্যাক করব।’
১৯৫৪ সাল থেকে আমাদের শাসকদের চাক্ষুষ দেখার সৌভাগ্য হচ্ছে। শেরেবাংলা ফজলুল হক ’৫৪ সালে পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন। গোলাম মোহাম্মদের মতো তিনি ষড়যন্ত্র করে ক্ষমতা দখল করেননি, মানুষের ভোটে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় যান। মুখ্যমন্ত্রী হয়ে তিনি এবং খাদ্যমন্ত্রী আবদুল লতিফ বিশ্বাস কোথাও যাচ্ছিলেন স্টিমারে। শিবালয় ঘাটে (এখন আরিচা) তাঁর স্টিমার থামে। তিনি জাহাজ থেকে হাত নাড়েন, ভাঙায় হাজারখানেক মানুষের সঙ্গে আমিও ছিলাম। প্রথম কোনো শাসককে চাক্ষুষ দেখলাম। কিন্তু তাঁকে বেশি সময় দেখা সম্ভব হলো না। গভর্নর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জার ধাক্কায় তিনি পড়ে গেলেন। বাংলার মাটি ফসল উৎপাদন ও ষড়যন্ত্রের জন্য অতি উর্বর। সেই ষড়যন্ত্রের শিকার কে কখন কীভাবে হয়, তা বিধাতা ছাড়া আর কেউ বলতে পারবে না। হক সাহেবের পর কিছুদিন অগণতান্ত্রিক গভর্নরের শাসন, তারপর পর্যায়ক্রমে আতাউর রহমান খান আর আবু হোসেন সরকার মুখ্যমন্ত্রী হলেন। শান্তিমতো কাজ করতে পারলেন না। করাচির কলকাঠি এমনভাবে নড়তে লাগল যে তাঁদের পাগল হওয়ার উপক্রম। পাগল তাঁরা হলেন না বটে, তবে ক্ষমতাচ্যুত হলেন।
শাসক কাকে বলে, তা টের পেলাম ’৫৮-এর অক্টোবরে। তাঁর নাম জেনারেল আইয়ুব খান। অশোক, চন্দ্রগুপ্ত, ইলতুৎমিশ ও আকবর তাঁর কাছে ছাড়। তাঁর ক্ষমতা গ্রহণের দুই হপ্তার মধ্যে আমাদের এলাকার পুকুর, খাল-বিল ও ছোট নদীতে যত কচুরিপানা ছিল, তা পরিষ্কার হয়ে গেল। পানা পরিষ্কারের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীতে আমিও ছিলাম। ফরমান জারি হয়েছিল: কারও বাড়ির আশপাশে ঝোপঝাড় এবং কারও পুকুরে পানা থাকলে ১০ বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও বেত্রাঘাত। আমাদের বাড়ির সংলগ্ন এক শতবর্ষী জঙ্গল ছিল। সেখানে সাপ, শেয়াল, খাটাশ প্রভৃতি যুগ যুগ ধরে শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান করত। সাত দিনে সেই জঙ্গল সাফ। মার্শাল ল শুধু মানুষের নয়, শেয়াল-খাটাশের জীবন পর্যন্ত দুর্বিষহ করে। সেই সামরিক শাসনে দেখেছিলাম, কেবল থোড় এসেছে এমন আমন ধানের খেতের মধ্যে একটি মড়া মুরগি শেয়াল ও কুকুরে ভাগাভাগি করে খাচ্ছে।
কচুরিপানা ও জঙ্গল সাফ করলে কোনো কথা ছিল না। মাস দুয়ের মধ্যে হাট-বাজার, ইউনিয়ন বোর্ডের অফিস, এলাকার বড় বড় গাছের গুঁড়ি, আমাদের বাংলাঘরের বেড়া ছেয়ে গেল পোস্টারে। তাতে কত শাসনকর্তার ছবি! বাঙালির মতো চোখ-মুখবসা হ্যাগার্ড তাঁরা নন। শাসকের মতোই বীরের চেহারা। কী সব সাংঘাতিক নাম: জেনারেল মোহাম্মদ মুসা, জেনারেল ওমরাও খান, জেনারেল আজম খান। কয়েক মাস না যেতেই দেখা গেল, ‘গণতন্ত্র’ শব্দটিতে তাঁদের পোষায় না, তাঁরা আমাদের উপহার দিলেন ‘মৌলিক গণতন্ত্র’। একপর্যায়ে তাঁরা দেখলেন, ‘মৌলিক’ শব্দটিতে হয় বাঙালিত্ব, না হয় হিন্দুয়ানি ভাব; সুতরাং তাঁরা প্রবর্তন করলেন ‘বুনিয়াদি গণতন্ত্র’। এক হেমন্তে তাঁরা ক্ষমতায় এসেছিলেন, অবিলম্বে দেখা দিল পাকিস্তানে গণতন্ত্রের শীতকাল। ১১ বছরের মধ্যে সেই শীত আর গেল না। আইয়ুব বললেন, পাকিস্তানের মঙ্গল তিনিই করবেন, আর কেউ নয়। আর কারও প্রয়োজন নেই, তবে একজন সহযোগী তিনি একপর্যায়ে খুঁজে পান, তাঁর নাম মোনায়েম খান।
আইয়ুবের প্রশস্তিমূলক উপসম্পাদকীয় লেখা হতে লাগল কাগজে, ঠিক যেমন হয়েছিল জিয়াউর রহমান ও তিনোদ্দীনের সরকারের সময়। চট্টগ্রাম থেকে পেশোয়ার পর্যন্ত আইয়ুবের মেহমান হিসেবে ট্রেনে সফর করলেন আমাদের সাংবাদিকেরা। সেই ভ্রমণকাহিনি যাঁরা লিখেছিলেন, এখনো তাঁরা কেউ বেঁচে আছেন। আমাদের প্রগতিশীল লেখকেরাও বসে রইলেন না। বুনিয়াদি গণতন্ত্র সম্পর্কে রচনা ও পুস্তিকা লিখলেন নূরুল মোমেন, হাসান জামানসহ অনেকে। অতি শ্রদ্ধেয় কেউ বেনামে। বাংলা ও উর্দু মিশিয়ে একটি ‘পাকিস্তানি ভাষা’ গড়ে উঠবে একদিন—সে প্রস্তাব করেও লিখলেন তাঁরা। নাটকের ওপর গবেষণা করতে গিয়ে অনেকে বুনিয়াদি গণতন্ত্র নিয়েও লিখলেন এবং রেডিওতে বললেন। ওই গণতন্ত্র যে ভারতের প্রথাগত গণতন্ত্রের চেয়ে উত্তম, তাও আমরা জানলাম। ভাসানী-মুজিবসহ সব নেতা জেলে। প্রগতিশীলরা দুর্বার গতিতে করে চললেন আইয়ুবের স্বর্ণযুগের প্রশংসা। তারপর একদিন আইয়ুব-ওমরাও খানরা বিদায় নিতে বাধ্য হলেন। বাংলার মাটি বিশ্বাসঘাতকদের তার বুকে ঠাঁই দেয় না। মোনায়েম খানের কবরের মাটিটুকুও জুটল না।
এলেন আরেক শাসনকর্তা—ইয়াহিয়া খান। শরিফ আদমি। ক্ষমতার লোভ বিন্দুমাত্র নেই। নিজে নির্বাচন করবেন না। নির্বাচন করিয়ে অন্যকে সরকারপ্রধান বানিয়ে নিজে আজীবন রাষ্ট্রপতি থাকতে চান। আমাদের নির্বাচনমুখী দলগুলো বগল বাজাতে লাগল। এমন শাসকই চাই! নিজে যেহেতু নির্বাচন করবেন না, সুতরাং তাঁকে গণতন্ত্রের মানসপুত্র বলা যায় না, তিনি হলেন গণতন্ত্রের মানসচাচা। চাচার আসল রূপ দেখলাম, পঁচিশে মার্চ থেকে ষোলোই ডিসেম্বর বেলা চারটা পর্যন্ত। তিনি হলেন আমার দেখা শেষ পাকিস্তানি শাসক।
বাহাত্তরে পেলাম একটি নতুন রাষ্ট্র এবং তার একটি নতুন সরকার। ওই সময়ের শাকদের শুধু দূর থেকে দেখলাম না, তাঁদের সঙ্গে চলাফেরার সুযোগ পেলাম। সুতরাং শুধু দেখলাম না, জানলামও। বাহাত্তরের ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়, আমার বিচারে সেটিই বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বৈধ ও শ্রেষ্ঠ সরকার। কারণ ওই সরকারের নেতারাই একটি রাষ্ট্র উপহার দেন। তাঁদের ভুলভ্রান্তি, দুর্বলতা ও দোষগুলো বড় করে দেখা উচিত নয়।
তেহাত্তরের মার্চে গঠিত সরকার প্রথম সাংবিধানিক সরকার। সুতরাং সেই সরকারের মর্যাদাও ঐতিহাসিক। কিন্তু সেই সরকার পঁচাত্তরের জানুয়ারিতে যে সরকারে রূপান্তরিত হলো, তা ছিল একটি গায়ের জোরের সরকার—যার ভেতরে জনগণের ইচ্ছার কোনো প্রতিফলন ছিল না। বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের শাসকেরা পথ হারালেন।
বাহাত্তরের সরকার যেমন ছিল সবচেয়ে বৈধ সরকার, তেমনি পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট-পরবর্তী মেজর-সমর্থিত মোস্তাকি সরকারটি ছিল বাঙালির ইতিহাসে সবচেয়ে অবৈধ সরকার। শেখ মুজিব একটি রাষ্ট্র উপহার দিয়েছিলেন, মোস্তাক একটি টুপি উপহার দিলেন। সে সরকারকেও খুব ভালো করে দেখলাম। দেখলাম তাঁদের সমর্থক রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীদেরও।
নভেম্বরের শুরুতেই শাসক বদলের হিড়িক পড়ে গেল। শাসকদেরও প্রমোশন হলো। আগস্টে ছিল মেজরদের সরকার, নভেম্বরে কয়েক ঘণ্টার জন্য পেলাম এক ব্রিগেডিয়ারকে। আর্মিতে জনসমর্থন না থাকায় ব্রিগেডিয়ার আওয়ামী লীগের মনোবলহীন নেতাদের বললেন: আমার পরিচয় হোক, আমি তোমাদেরই লোক, মেজররা পালানোর পথ খুঁজছিলেন, ব্রিগেডিয়ার তা করে দিলেন। তিনি অনেকগুলো কাজ করেন। মেজরদের বাঁচিয়ে দেন, জিয়াউর রহমানের উত্থানের পথ পরিষ্কার করেন, আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় যাওয়ার দরজা দুই দশকের জন্য বন্ধ করে দেন এবং নিজের মৃত্যু নিজে ডেকে আনেন। খালেদ ঘোঁটা না দিলে ৭ নভেম্বর সিপাহী জনতার ওই অভ্যুত্থান হতো না।
জিয়া যে চীনপন্থী কমিউনিস্ট, সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের পূর্ণ সমর্থন পেলেন তা-ই নয়, তাঁর খাল খাটার জন্য কাস্তে ও হাতুড়ি ফেলে মস্কোপন্থী কমিউনিস্টরাও কোদাল নিয়ে এগিয়ে গেলেন। সবাই মিলে সামরিক একনায়ককে অসামান্য জনপ্রিয় জননেতায় পরিণত করলেন।
সাত্তার নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তাঁকে ঠেলা দিয়ে ফেলে যিনি এলেন, কলকাতার দেশ পত্রিকার ভাষায়: তাঁর বন্দুকের নলের ডগায় বসা প্রজাপতি। তিনি ব্রিটিশ রাজকবি টেড হিউজেশসহ দেশি-বিদেশি কবিদের ঢাকায় জড়ো করলেন, নামজাদা কবিদের দিয়ে কবিতা লেখালেন, বন্যা-উপদ্রুত বস্তিতে গামবুট পায়ে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নিজের ‘লেখা’ গান গাইলেন। কবিতা ও গান লেখা নিয়ে থাকলেই হতো, তিনি সংবিধানও নতুন করে লিখলেন। যে সংবিধান সংশোধন নিয়ে আজ বাংলার আকাশ-বাতাস মুখরিত।
স্বৈরশাসন-পরবর্তী ১৫ বছরের ১০টি বছরই ছিল বিএনপি-জামায়াতের শাসনকাল। ওই দেশে যেমন ক্ষমতার উৎস হোয়াইট হাউস, আমরা পেয়েছিলাম ‘উইন্ড হাউস’—বাতাসের বাড়ি বা বায়ুঘর। ভবন তো নয়, যেন কোনো নগরী। সেখানে ছিলেন বঙ্গীয় আয়াতুল্লাহ। কেউ বলে তাঁকে ভাইয়া। তিনি নবযুগের শাসনকর্তা। এ কালের ইলতুৎমিশ বা আলাউদ্দিন খিলজি। বায়ুঘর পর্যন্তও ভালো ছিল, কিন্তু ওদিকে এক অপার্থিব রূহানি শাসনের হেডকোয়ার্টার মগবাজারে। ওখানে নির্দেশ আসে আরশ অথবা মধ্যপ্রাচ্য থেকে। সে নির্দেশ চাপিয়ে দেওয়া হয় বাংলার মানুষের ওপর ও মেয়েদের ওপর। খালেদা-নিজামী ও ভাইয়ার শাসনামলের শেষ দিকে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। একদিন তাঁরা গেলেন বটে, কিন্তু যাঁরা এলেন, তাঁরা মোহাম্মদ বিন তুঘলককে হার মানালেন।
ইলতুৎমিশ-তুঘলক থেকে তিনোদ্দীন পর্যন্ত সব শাসকের যত ভুলভ্রান্তি হয়েছে, তা ঠিকঠাক করার ব্রত নিয়ে এসেছেন ২০০৯-এর সরকার। হাইকোর্টের একটি রায়কে পেয়েছেন তাঁরা জাদুর কাঠি হিসেবে। জনাব খায়রুল হক সাহেব ও জনাব ফজলে কবির শাহেবই হবেন মানবজাতির ইতিহাসে দুই জজ, যাঁরা একটি জাতির, একটি রাষ্ট্রের ইতিহাসের গতি সম্পূর্ণ ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দিলেন, যা পারেননি কোনো রাজনীতিক, রুশ বিপ্লবের পর মহামতি লেনিন, তুরস্কে কামাল আতাতুর্ক, চীনে মাও সে-তুং, তাঁরা তাই পারলেন। তাঁদের রায় সুপ্রিম কোর্ট অনুমোদন করেছেন। ২৮ জুলাইয়ের পর থেকে বাঙালি জাতি বদলে গেল। ইতিহাসে নতুন যাত্রা শুরু করল বাংলাদেশ। এই ইতিহাস লিখবেন তিন শ বছর পর অনাগত কালের রমেশ বাবুরা।
সংবিধান নিয়ে কথা বলার অধিকার শুধু আদালতের নয়, প্রতিটি সাধারণ নাগরিকের রয়েছে। সুতরাং আমারও আছে। ২৮ জুলাই প্রকাশিত রায়টি পাঠ করে আমি তাতে বহু অসংগতি দেখতে পেয়েছি। বড় বড় সংবিধানবিশেষজ্ঞ বলেছেন, রায়ের পর সংবিধান সংশোধন হয়ে গেছে। সাম্প্রদায়িকতা বাদ দিয়ে সংবিধানকে ধর্মনিরপেক্ষ করতে এত দিন যাঁরা মালকোচা মেরে হইচই করেছেন, এখন তাঁরাও নীরব। দলীয় রাজনীতিতে বাধা পড়লে যা হয়! আমি যদি অমুসলমান বা আদিবাসী হতাম, এ সংশোধনের প্রতিবাদ করতাম। আইনমন্ত্রীর ব্যাখ্যা অনুসারে যদি জামায়াত ইসলামী, ইসলামী ঐক্যজোট, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ, খেলাফত আন্দোলন নিষিদ্ধ হয়ে গিয়ে থাকে, তা হলেই বা কী হলো?
রায়ের ভিত্তিতে সংশোধিত সংবিধানের যে রূপ ধারণ করেছে, তাকে যদি কেউ আমাকে একজন মানুষের সঙ্গে তুলনা করতে বলেন, তার প্রতিকৃতি হবে এ রকম: লোকটির মাথায় কিস্তি টুপি, এক হাতে তসবি, অন্য হাতে কাস্তে, মুখে চুরুট, গলায় টাই বাঁধা, গায়ে আচকান, পরনে লুঙ্গি।
বঙ্গীয় সমাজে বাহাত্তর খুব খারাপ শব্দ। কাউকে যদি বাহাত্তরে পায়, তার আর রক্ষা নেই। বার্ধক্যজনিত বুদ্ধিনাশ নয়, কোনোকিছুর প্রতি অতি অনুরাগবশত উন্মত্ততার নাম বাহাত্তরে পাওয়া। আজ বাঙালি বাম ও বুদ্ধিজীবীরাই শুধু নয়, সব শ্রেণীর শিক্ষিতদেরই বাহাত্তরে ধরেছে। সুতরাং এর পরিণতিও বাঙালিই ভোগ করবে—আর কেউ নয়।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
রমেশ মজুমদারের ভারী ভারী ইতিহাসবিষয়ক বইগুলোর কথা সবাই জানেন। তিনি যে অর্থ উপার্জনের জন্য অথবা অনুরুদ্ধ হয়ে স্কুলপাঠ্য বই লিখেছিলেন, তা ঢাকা ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের বিখ্যাত অধ্যাপকেরাও জানেন না। আমি যে বইটির কথা বলছি, তা ছিল পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীদের জন্য লেখা। লিখেছিলেন ১৯২০-এর দশকে, তিনি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।
মজুমদারের শ দেড়েক পৃষ্ঠার ভারতবর্ষের ইতিহাস-এ যে মানুষগুলো সম্পর্কে লেখা, তাঁরা রবীন্দ্রনাথের রমেশ আর কমলার মতো নন। তাঁরা যে রক্ত-মাংস-অস্থিসর্বস্ব সাড়ে তিন হাত মানুষ নন, তাঁরা তিরিশ-পঁয়ত্রিশ হাত লম্বা মানুষ—উচ্চতায় তাঁরা বিধাতার কাছাকাছি। তাঁদের মাথায় মণি-মুক্তার মুকুট। তিনি লিখেছিলেন সৌর্য রাজবংশের চন্দ্রগুপ্তের কথা, সম্রাট অশোকের কথা, কুশাণ সাম্রাজ্যের রাখা কনিষ্কের কথা। আরও যাঁদের কথা লিখেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন গুপ্ত সাম্রাজ্যের সমুদ্রগুপ্ত, সুলতানি আমলের মুহম্মদ ঘুরী, শামসুদ্দিন ইলতুৎমিশ, আলাউদ্দিন খিলজি, মুহম্মদ বিন তুঘলক, মোগল সাম্রাজ্যের সম্রাট বাবর, শেরশাহ, হুমায়ুন, আকবর, আওরঙ্গজেবদের কথা। আলিবর্দি, সিরাজউদ্দৌলার সচিত্র কাহিনিও ছিল।
বিধাতার এ জগতে একদিকে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ, গ্রাম-বন্দর-জনপদে যাঁরা গিজ গিজ করে। এদের কেউ শৈশবে বই বগলে নিয়ে পাঠশালায় যায়, কেউ খেতে লাঙল চালাতে যায়, কেউ মাছ ধরে, কেউ কাপড় বোনে, হাট-বাজার ও অফিস-আদালত করে, যৌবনপ্রাপ্ত হলে বিয়ে করে, শালী এবং শালার বউয়ের সঙ্গে রসিকতা করে, কেউ যৌতুক না পেলে বউকে গলা টিপে মারে, তারপর জেলের ভাত খায়। এ জগতে আরেক প্রজাতি আছেন, যাঁদের কথা রমেশবাবু লিখেছেন। তাঁরা মানুষ নন—মানুষের ঊর্ধ্বে। তাঁরা শাসক।
জীবনে প্রথম আমি আমাদের শাসকদের চাক্ষুষ দেখার সুযোগ পাইনি—ছবিতে তাঁদের দেখেছি। মজুমদার যাঁদের কথা লিখেছেন, তাঁদেরই পাকিস্তানি সংস্করণের সঙ্গে পরিচিত হই শৈশবে একটি ফটোর মাধ্যমে। আমাদের বাড়িতে নানা রকম ছবি বাঁধাই করে টাঙানো ছিল। রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের ছবির পাশেই একটি আলোকচিত্র ছিল। খাজা নাজিমউদ্দিন যেদিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন, সেই দিনের শপথ অনুষ্ঠানের ছবি। মাঝখানে মধ্যমণি হিসেবে নতুন গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ লাঠিতে ভর দিয়ে বসা, পাশে স্যার নাজিমউদ্দিন ও মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্য। গ্রুপ পোর্ট্রেটটি ঢাকার একটি দৈনিকের ফটোগ্রাফারের কাছ থেকে সংগ্রহ করে আব্বা বাঁধাই করে রাখেন। বোধহয় তিনি মনে করেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী পূর্ববাংলার হওয়ায় এবার প্রদেশের প্রচণ্ড উন্নয়ন হবে।
ওই গ্রুপ পোর্ট্রেটের মানুষগুলোর কীর্তির কথা এখন ইতিহাসে লেখা হয়ে গেছে। ঢাকার মানুষ খাজা সাহেব প্রথম ধাক্কায়ই বাংলা ভাষাটাকে নাকচ করে দিলেন। গোলাম মোহাম্মদ রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে পাকিস্তানের রাজনীতিতে কী কীর্তি রেখে গেছেন, তা বলতে গেলে বমি আসে। তাঁর সম্পর্কে কিছু কথা জানা যায় কুদরতুল্লাহ শাহারের স্মৃতিকথা থেকে। এক ইরানি বংশোদ্ভূত সুন্দরী ছিলেন তাঁর সেক্রেটারি (মহিলা সিআইএর পক্ষে গোপনে কাজ করতেন)। ভীমরতিতে ধরা গভর্নর জেনারেল যুবতী সেক্রেটারিকে বলেছিলেন, ‘দ্যাখো হে, আমার বিরুদ্ধে কেউ গুজ গুজ করলে তা আমি ঠিকই কানে শুনি। তা ছাড়া অন্য সব কথা আমি ঠিকমতো শুনতে পাই না। তুমি আমার কানের কাছে মুখ এনে কথা বলবে। তীব্র সেন্ট লাগিয়ে সুন্দরী গোলাম মোহাম্মদের কানের কাছে মুখ নিলে, তিনি গজ গজ করতেন, মুখটা ঠোঁটের কাছে আনতে পারো না? তোমাকে আমি স্যাক করব।’
১৯৫৪ সাল থেকে আমাদের শাসকদের চাক্ষুষ দেখার সৌভাগ্য হচ্ছে। শেরেবাংলা ফজলুল হক ’৫৪ সালে পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন। গোলাম মোহাম্মদের মতো তিনি ষড়যন্ত্র করে ক্ষমতা দখল করেননি, মানুষের ভোটে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় যান। মুখ্যমন্ত্রী হয়ে তিনি এবং খাদ্যমন্ত্রী আবদুল লতিফ বিশ্বাস কোথাও যাচ্ছিলেন স্টিমারে। শিবালয় ঘাটে (এখন আরিচা) তাঁর স্টিমার থামে। তিনি জাহাজ থেকে হাত নাড়েন, ভাঙায় হাজারখানেক মানুষের সঙ্গে আমিও ছিলাম। প্রথম কোনো শাসককে চাক্ষুষ দেখলাম। কিন্তু তাঁকে বেশি সময় দেখা সম্ভব হলো না। গভর্নর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জার ধাক্কায় তিনি পড়ে গেলেন। বাংলার মাটি ফসল উৎপাদন ও ষড়যন্ত্রের জন্য অতি উর্বর। সেই ষড়যন্ত্রের শিকার কে কখন কীভাবে হয়, তা বিধাতা ছাড়া আর কেউ বলতে পারবে না। হক সাহেবের পর কিছুদিন অগণতান্ত্রিক গভর্নরের শাসন, তারপর পর্যায়ক্রমে আতাউর রহমান খান আর আবু হোসেন সরকার মুখ্যমন্ত্রী হলেন। শান্তিমতো কাজ করতে পারলেন না। করাচির কলকাঠি এমনভাবে নড়তে লাগল যে তাঁদের পাগল হওয়ার উপক্রম। পাগল তাঁরা হলেন না বটে, তবে ক্ষমতাচ্যুত হলেন।
শাসক কাকে বলে, তা টের পেলাম ’৫৮-এর অক্টোবরে। তাঁর নাম জেনারেল আইয়ুব খান। অশোক, চন্দ্রগুপ্ত, ইলতুৎমিশ ও আকবর তাঁর কাছে ছাড়। তাঁর ক্ষমতা গ্রহণের দুই হপ্তার মধ্যে আমাদের এলাকার পুকুর, খাল-বিল ও ছোট নদীতে যত কচুরিপানা ছিল, তা পরিষ্কার হয়ে গেল। পানা পরিষ্কারের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীতে আমিও ছিলাম। ফরমান জারি হয়েছিল: কারও বাড়ির আশপাশে ঝোপঝাড় এবং কারও পুকুরে পানা থাকলে ১০ বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও বেত্রাঘাত। আমাদের বাড়ির সংলগ্ন এক শতবর্ষী জঙ্গল ছিল। সেখানে সাপ, শেয়াল, খাটাশ প্রভৃতি যুগ যুগ ধরে শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান করত। সাত দিনে সেই জঙ্গল সাফ। মার্শাল ল শুধু মানুষের নয়, শেয়াল-খাটাশের জীবন পর্যন্ত দুর্বিষহ করে। সেই সামরিক শাসনে দেখেছিলাম, কেবল থোড় এসেছে এমন আমন ধানের খেতের মধ্যে একটি মড়া মুরগি শেয়াল ও কুকুরে ভাগাভাগি করে খাচ্ছে।
কচুরিপানা ও জঙ্গল সাফ করলে কোনো কথা ছিল না। মাস দুয়ের মধ্যে হাট-বাজার, ইউনিয়ন বোর্ডের অফিস, এলাকার বড় বড় গাছের গুঁড়ি, আমাদের বাংলাঘরের বেড়া ছেয়ে গেল পোস্টারে। তাতে কত শাসনকর্তার ছবি! বাঙালির মতো চোখ-মুখবসা হ্যাগার্ড তাঁরা নন। শাসকের মতোই বীরের চেহারা। কী সব সাংঘাতিক নাম: জেনারেল মোহাম্মদ মুসা, জেনারেল ওমরাও খান, জেনারেল আজম খান। কয়েক মাস না যেতেই দেখা গেল, ‘গণতন্ত্র’ শব্দটিতে তাঁদের পোষায় না, তাঁরা আমাদের উপহার দিলেন ‘মৌলিক গণতন্ত্র’। একপর্যায়ে তাঁরা দেখলেন, ‘মৌলিক’ শব্দটিতে হয় বাঙালিত্ব, না হয় হিন্দুয়ানি ভাব; সুতরাং তাঁরা প্রবর্তন করলেন ‘বুনিয়াদি গণতন্ত্র’। এক হেমন্তে তাঁরা ক্ষমতায় এসেছিলেন, অবিলম্বে দেখা দিল পাকিস্তানে গণতন্ত্রের শীতকাল। ১১ বছরের মধ্যে সেই শীত আর গেল না। আইয়ুব বললেন, পাকিস্তানের মঙ্গল তিনিই করবেন, আর কেউ নয়। আর কারও প্রয়োজন নেই, তবে একজন সহযোগী তিনি একপর্যায়ে খুঁজে পান, তাঁর নাম মোনায়েম খান।
আইয়ুবের প্রশস্তিমূলক উপসম্পাদকীয় লেখা হতে লাগল কাগজে, ঠিক যেমন হয়েছিল জিয়াউর রহমান ও তিনোদ্দীনের সরকারের সময়। চট্টগ্রাম থেকে পেশোয়ার পর্যন্ত আইয়ুবের মেহমান হিসেবে ট্রেনে সফর করলেন আমাদের সাংবাদিকেরা। সেই ভ্রমণকাহিনি যাঁরা লিখেছিলেন, এখনো তাঁরা কেউ বেঁচে আছেন। আমাদের প্রগতিশীল লেখকেরাও বসে রইলেন না। বুনিয়াদি গণতন্ত্র সম্পর্কে রচনা ও পুস্তিকা লিখলেন নূরুল মোমেন, হাসান জামানসহ অনেকে। অতি শ্রদ্ধেয় কেউ বেনামে। বাংলা ও উর্দু মিশিয়ে একটি ‘পাকিস্তানি ভাষা’ গড়ে উঠবে একদিন—সে প্রস্তাব করেও লিখলেন তাঁরা। নাটকের ওপর গবেষণা করতে গিয়ে অনেকে বুনিয়াদি গণতন্ত্র নিয়েও লিখলেন এবং রেডিওতে বললেন। ওই গণতন্ত্র যে ভারতের প্রথাগত গণতন্ত্রের চেয়ে উত্তম, তাও আমরা জানলাম। ভাসানী-মুজিবসহ সব নেতা জেলে। প্রগতিশীলরা দুর্বার গতিতে করে চললেন আইয়ুবের স্বর্ণযুগের প্রশংসা। তারপর একদিন আইয়ুব-ওমরাও খানরা বিদায় নিতে বাধ্য হলেন। বাংলার মাটি বিশ্বাসঘাতকদের তার বুকে ঠাঁই দেয় না। মোনায়েম খানের কবরের মাটিটুকুও জুটল না।
এলেন আরেক শাসনকর্তা—ইয়াহিয়া খান। শরিফ আদমি। ক্ষমতার লোভ বিন্দুমাত্র নেই। নিজে নির্বাচন করবেন না। নির্বাচন করিয়ে অন্যকে সরকারপ্রধান বানিয়ে নিজে আজীবন রাষ্ট্রপতি থাকতে চান। আমাদের নির্বাচনমুখী দলগুলো বগল বাজাতে লাগল। এমন শাসকই চাই! নিজে যেহেতু নির্বাচন করবেন না, সুতরাং তাঁকে গণতন্ত্রের মানসপুত্র বলা যায় না, তিনি হলেন গণতন্ত্রের মানসচাচা। চাচার আসল রূপ দেখলাম, পঁচিশে মার্চ থেকে ষোলোই ডিসেম্বর বেলা চারটা পর্যন্ত। তিনি হলেন আমার দেখা শেষ পাকিস্তানি শাসক।
বাহাত্তরে পেলাম একটি নতুন রাষ্ট্র এবং তার একটি নতুন সরকার। ওই সময়ের শাকদের শুধু দূর থেকে দেখলাম না, তাঁদের সঙ্গে চলাফেরার সুযোগ পেলাম। সুতরাং শুধু দেখলাম না, জানলামও। বাহাত্তরের ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়, আমার বিচারে সেটিই বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বৈধ ও শ্রেষ্ঠ সরকার। কারণ ওই সরকারের নেতারাই একটি রাষ্ট্র উপহার দেন। তাঁদের ভুলভ্রান্তি, দুর্বলতা ও দোষগুলো বড় করে দেখা উচিত নয়।
তেহাত্তরের মার্চে গঠিত সরকার প্রথম সাংবিধানিক সরকার। সুতরাং সেই সরকারের মর্যাদাও ঐতিহাসিক। কিন্তু সেই সরকার পঁচাত্তরের জানুয়ারিতে যে সরকারে রূপান্তরিত হলো, তা ছিল একটি গায়ের জোরের সরকার—যার ভেতরে জনগণের ইচ্ছার কোনো প্রতিফলন ছিল না। বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের শাসকেরা পথ হারালেন।
বাহাত্তরের সরকার যেমন ছিল সবচেয়ে বৈধ সরকার, তেমনি পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট-পরবর্তী মেজর-সমর্থিত মোস্তাকি সরকারটি ছিল বাঙালির ইতিহাসে সবচেয়ে অবৈধ সরকার। শেখ মুজিব একটি রাষ্ট্র উপহার দিয়েছিলেন, মোস্তাক একটি টুপি উপহার দিলেন। সে সরকারকেও খুব ভালো করে দেখলাম। দেখলাম তাঁদের সমর্থক রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীদেরও।
নভেম্বরের শুরুতেই শাসক বদলের হিড়িক পড়ে গেল। শাসকদেরও প্রমোশন হলো। আগস্টে ছিল মেজরদের সরকার, নভেম্বরে কয়েক ঘণ্টার জন্য পেলাম এক ব্রিগেডিয়ারকে। আর্মিতে জনসমর্থন না থাকায় ব্রিগেডিয়ার আওয়ামী লীগের মনোবলহীন নেতাদের বললেন: আমার পরিচয় হোক, আমি তোমাদেরই লোক, মেজররা পালানোর পথ খুঁজছিলেন, ব্রিগেডিয়ার তা করে দিলেন। তিনি অনেকগুলো কাজ করেন। মেজরদের বাঁচিয়ে দেন, জিয়াউর রহমানের উত্থানের পথ পরিষ্কার করেন, আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় যাওয়ার দরজা দুই দশকের জন্য বন্ধ করে দেন এবং নিজের মৃত্যু নিজে ডেকে আনেন। খালেদ ঘোঁটা না দিলে ৭ নভেম্বর সিপাহী জনতার ওই অভ্যুত্থান হতো না।
জিয়া যে চীনপন্থী কমিউনিস্ট, সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের পূর্ণ সমর্থন পেলেন তা-ই নয়, তাঁর খাল খাটার জন্য কাস্তে ও হাতুড়ি ফেলে মস্কোপন্থী কমিউনিস্টরাও কোদাল নিয়ে এগিয়ে গেলেন। সবাই মিলে সামরিক একনায়ককে অসামান্য জনপ্রিয় জননেতায় পরিণত করলেন।
সাত্তার নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তাঁকে ঠেলা দিয়ে ফেলে যিনি এলেন, কলকাতার দেশ পত্রিকার ভাষায়: তাঁর বন্দুকের নলের ডগায় বসা প্রজাপতি। তিনি ব্রিটিশ রাজকবি টেড হিউজেশসহ দেশি-বিদেশি কবিদের ঢাকায় জড়ো করলেন, নামজাদা কবিদের দিয়ে কবিতা লেখালেন, বন্যা-উপদ্রুত বস্তিতে গামবুট পায়ে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নিজের ‘লেখা’ গান গাইলেন। কবিতা ও গান লেখা নিয়ে থাকলেই হতো, তিনি সংবিধানও নতুন করে লিখলেন। যে সংবিধান সংশোধন নিয়ে আজ বাংলার আকাশ-বাতাস মুখরিত।
স্বৈরশাসন-পরবর্তী ১৫ বছরের ১০টি বছরই ছিল বিএনপি-জামায়াতের শাসনকাল। ওই দেশে যেমন ক্ষমতার উৎস হোয়াইট হাউস, আমরা পেয়েছিলাম ‘উইন্ড হাউস’—বাতাসের বাড়ি বা বায়ুঘর। ভবন তো নয়, যেন কোনো নগরী। সেখানে ছিলেন বঙ্গীয় আয়াতুল্লাহ। কেউ বলে তাঁকে ভাইয়া। তিনি নবযুগের শাসনকর্তা। এ কালের ইলতুৎমিশ বা আলাউদ্দিন খিলজি। বায়ুঘর পর্যন্তও ভালো ছিল, কিন্তু ওদিকে এক অপার্থিব রূহানি শাসনের হেডকোয়ার্টার মগবাজারে। ওখানে নির্দেশ আসে আরশ অথবা মধ্যপ্রাচ্য থেকে। সে নির্দেশ চাপিয়ে দেওয়া হয় বাংলার মানুষের ওপর ও মেয়েদের ওপর। খালেদা-নিজামী ও ভাইয়ার শাসনামলের শেষ দিকে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। একদিন তাঁরা গেলেন বটে, কিন্তু যাঁরা এলেন, তাঁরা মোহাম্মদ বিন তুঘলককে হার মানালেন।
ইলতুৎমিশ-তুঘলক থেকে তিনোদ্দীন পর্যন্ত সব শাসকের যত ভুলভ্রান্তি হয়েছে, তা ঠিকঠাক করার ব্রত নিয়ে এসেছেন ২০০৯-এর সরকার। হাইকোর্টের একটি রায়কে পেয়েছেন তাঁরা জাদুর কাঠি হিসেবে। জনাব খায়রুল হক সাহেব ও জনাব ফজলে কবির শাহেবই হবেন মানবজাতির ইতিহাসে দুই জজ, যাঁরা একটি জাতির, একটি রাষ্ট্রের ইতিহাসের গতি সম্পূর্ণ ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দিলেন, যা পারেননি কোনো রাজনীতিক, রুশ বিপ্লবের পর মহামতি লেনিন, তুরস্কে কামাল আতাতুর্ক, চীনে মাও সে-তুং, তাঁরা তাই পারলেন। তাঁদের রায় সুপ্রিম কোর্ট অনুমোদন করেছেন। ২৮ জুলাইয়ের পর থেকে বাঙালি জাতি বদলে গেল। ইতিহাসে নতুন যাত্রা শুরু করল বাংলাদেশ। এই ইতিহাস লিখবেন তিন শ বছর পর অনাগত কালের রমেশ বাবুরা।
সংবিধান নিয়ে কথা বলার অধিকার শুধু আদালতের নয়, প্রতিটি সাধারণ নাগরিকের রয়েছে। সুতরাং আমারও আছে। ২৮ জুলাই প্রকাশিত রায়টি পাঠ করে আমি তাতে বহু অসংগতি দেখতে পেয়েছি। বড় বড় সংবিধানবিশেষজ্ঞ বলেছেন, রায়ের পর সংবিধান সংশোধন হয়ে গেছে। সাম্প্রদায়িকতা বাদ দিয়ে সংবিধানকে ধর্মনিরপেক্ষ করতে এত দিন যাঁরা মালকোচা মেরে হইচই করেছেন, এখন তাঁরাও নীরব। দলীয় রাজনীতিতে বাধা পড়লে যা হয়! আমি যদি অমুসলমান বা আদিবাসী হতাম, এ সংশোধনের প্রতিবাদ করতাম। আইনমন্ত্রীর ব্যাখ্যা অনুসারে যদি জামায়াত ইসলামী, ইসলামী ঐক্যজোট, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ, খেলাফত আন্দোলন নিষিদ্ধ হয়ে গিয়ে থাকে, তা হলেই বা কী হলো?
রায়ের ভিত্তিতে সংশোধিত সংবিধানের যে রূপ ধারণ করেছে, তাকে যদি কেউ আমাকে একজন মানুষের সঙ্গে তুলনা করতে বলেন, তার প্রতিকৃতি হবে এ রকম: লোকটির মাথায় কিস্তি টুপি, এক হাতে তসবি, অন্য হাতে কাস্তে, মুখে চুরুট, গলায় টাই বাঁধা, গায়ে আচকান, পরনে লুঙ্গি।
বঙ্গীয় সমাজে বাহাত্তর খুব খারাপ শব্দ। কাউকে যদি বাহাত্তরে পায়, তার আর রক্ষা নেই। বার্ধক্যজনিত বুদ্ধিনাশ নয়, কোনোকিছুর প্রতি অতি অনুরাগবশত উন্মত্ততার নাম বাহাত্তরে পাওয়া। আজ বাঙালি বাম ও বুদ্ধিজীবীরাই শুধু নয়, সব শ্রেণীর শিক্ষিতদেরই বাহাত্তরে ধরেছে। সুতরাং এর পরিণতিও বাঙালিই ভোগ করবে—আর কেউ নয়।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments