খোলা চোখে-মেয়েরা এগিয়ে রয়েছে by হাসান ফেরদৌস

গত ১৬ জুলাই প্রথম আলোয় একদম প্রথম পাতায় তিন কলামজুড়ে একটি অসাধারণ ছবি ছাপা হয়েছে। ঢাকার হলিক্রস কলেজ থেকে ছবিটি তোলা, এ বছরের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর তাদের সাফল্যে এই কলেজের মেয়েরা আনন্দে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে নেচে উঠেছে।


মেয়েদের মুখের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখুন। সেখানে কেবল আনন্দচিহ্নই নয়, নিশ্চিত প্রত্যয়ের ছাপও রয়েছে। যেন মেয়েগুলো বলছে, ‘দেখেছ কী, আরও কিছুদিন অপেক্ষা করো। দেখবে, আমরা কোথায়, কত দূর যেতে পারি।’
গত কয়েক বছর থেকেই মেয়েদের অগ্রগতি নজরে পড়েছে। এ বছর দেশের মোট আটটি শিক্ষা বোর্ডের চারটিতে শতকরা হিসাবে ছেলেদের তুলনায় উত্তীর্ণ মেয়েদের সংখ্যা অধিক। মোট পাসের নিরঙ্কুশ সংখ্যা হিসাব করলে সামান্য ব্যবধানে হলেও সারা দেশে মোটের ওপর মেয়েরাই এগিয়ে। কিন্তু শুধু শুকনো অঙ্কের হিসাবে মেয়েদের এই সাফল্য বিবেচনা করলে ভুল হবে। বাংলাদেশে মেয়েদের কী রকম দৈনন্দিন বৈষম্যের ভেতর দিয়ে যেতে হয়, সে কথা আমাদের অজানা নয়। আমাদের দেশে মেয়েশিশু এখনো অনাকাঙ্ক্ষিত। একটি ভাই থাকলে অন্য সব বোনকে উপেক্ষা করে পরিবারের সকল যত্ন, সকল মনোযোগ তার ওপরেই বর্তায়। আহারের সময় দুধটা কলাটা জোটে ছেলেদের, মেয়েদের বেলায় উচ্ছিষ্ট। পয়সার অভাবে স্কুলে পাঠানো কঠিন হয়ে পড়লে সবার আগে নাম কাটা যায় বোনদের। বাড়ির পাশে হাইস্কুল নেই, কয়েক ক্রোশ হেঁটে—কখনো কখনো নদী সাঁতরে স্কুলে যেতে হয়। অনেক স্কুল আছে, যেখানে মেয়েদের জন্য আলাদা কোনো শৌচাগার নেই। অধিকাংশ শিক্ষক এখনো পুরুষ, তাঁদের চোখে মেয়েদের মূল্য যৎসামান্যই। এর ওপর রয়েছে সমাজের চাপ, ধর্মের চাপ, পাড়ার বখাটে ছেলেদের চাপ। সব মিলিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই মা-বাবা মেয়েদের স্কুলে পাঠানোর চিন্তা বাতুলতা বলে ধরে নেন।
এত বাধা সত্ত্বেও মেয়েরাই লেখাপড়ায় এগিয়ে, এমন কথা পড়ার পর তাদের নামে ‘থ্রি চিয়ার্স’ না বলে উপায় নেই।
পৃথিবীর এমন কোনো দেশ নেই, যেখানে মেয়েরা বৈষম্যের শিকার নয়, কিন্তু তার পরেও তাদের আটকে রাখা কঠিন। কেবল বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই মেয়েরা লেখাপড়ায় এখন এগিয়ে। প্রতিবেশী ভারতে পাস-ফেলের হিসাবে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় (সেন্ট্রাল বোর্ড অব সেকেন্ডারি এডুকেশন) মেয়েরা কম করে হলেও ১০ শতাংশ হারে এগিয়ে (৭৭ শতাংশ বনাম ৮৬ শতাংশ)। একই ছবি ইংলান্ডে। সেখানেও কয়েক লাখ ছেলেমেয়েকে নিয়ে পরিচালিত এক দীর্ঘ সমীক্ষার মোদ্দা সিদ্ধান্ত ছিল: লেখাপড়ার প্রতিটি ক্ষেত্রেই মেয়েরা ছেলেদের পিছে ফেলে দিচ্ছে। এ কথা বিশেষভাবে সত্যি প্রাথমিক স্তরে। ওপরের স্তরে ওঠার পর এ ছবিটা বদলাতে শুরু করে, তার কারণ এই নয় যে মেয়েরা জটিল বিষয়সমূহ বুঝতে অক্ষম। উচ্চশিক্ষার জন্য মেয়েদের সুযোগ কম, স্কুল থেকে সরে আসার জন্য তাদের ওপর চাপ বেশি, সকল প্রতিযোগিতায় ছেলেদের অগ্রাধিকার প্রদানের নিয়ম এখনো অপরিবর্তিত।
মেয়েরা লেখাপড়ায় এগোচ্ছে এই আমেরিকাতেও। সম্প্রতি সেন্টার ফর এডুকেশন রিসার্চ আমেরিকাজুড়ে নেওয়া এক সমীক্ষার পর জানিয়েছে, প্রাথমিক পর্যায়ের সব ক্ষেত্রেই ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা ভালো করছে। ভাবা হতো, মেয়েরা বুঝি অঙ্কে ও বিজ্ঞানে অনগ্রসর। দেখা যাচ্ছে, স্কুল পর্যায়ে ওই দুই ক্ষেত্রেও মেয়েরা এগিয়ে। এই এগিয়ে থাকা শুধু মোট সংখ্যার হিসাবে নয়, গুণগতভাবেও। প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুসারে, হাইস্কুলে ছেলেরা যেখানে মোট স্কোর পেয়েছে ২ দশমিক ৮৬, সেখানে মেয়েদের স্কোর গড়ে ৩ দশমিক ০৯।
একই সমীক্ষায় মেয়েদের জন্য ভালো খবর আরও আছে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নেওয়া লিখিত পরীক্ষায় ‘লিখন’-এ দক্ষ এমন মেয়েদের সংখ্যা ৩২ শতাংশ, আর ছেলেদের মোটে ১৬ শতাংশ। মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের স্কুলে লেখাপড়া শেষ না করার পরিমাণ (অর্থাৎ ড্রপ-আউট রেট) এক-তৃতীয়াংশ বেশি। আবার মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের স্কুল থেকে বহিষ্কারের সংখ্যাও প্রায় দেড় গুণ। এই সমীক্ষায় অবশ্য এ কথাও বলা হয়েছে, উচ্চপর্যায়ে এসে অঙ্কে মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের সাফল্যের পরিমাণ অধিক। কিন্তু ওই এক ক্ষেত্রে! বাকি সব ক্ষেত্রেই মেয়েরা এগিয়ে। বস্তুত, আমেরিকায় এখন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মোট ছাত্রছাত্রীর ৬০ শতাংশই মেয়ে।
আমেরিকায় এ ব্যাপারটা পিতামাতা ও শিক্ষা কর্মকর্তাদের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে। কেউ কেউ গেল গেল ডাক তুলে ছেলেদের রক্ষায় অধিক মনোযোগী হওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে দাবি তুলেছেন। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় বিখ্যাত কলাম লেখক নিকলাস ক্রিস্টফ ‘হচ্ছেটা কী?’ এই প্রশ্ন তুলে তাঁর আতঙ্ক প্রকাশ করেছেন। দেশের প্রতিটি নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্রে পুরুষদের আধিপত্য। আইন পরিষদ, সরকার, বিচারব্যবস্থাসহ দেশের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যেখানে পুরুষদের সংখ্যাধিক্য নেই। তারা সংখ্যায় বেশি হবে, কিন্তু গুণগতভাবে হবে অনগ্রসর, তাহলে দেশের বারোটা বাজা ঠেকানো কঠিন হবে, নিকলাস ক্রিস্টফ প্রকারান্তরে সে কথাই বলেছেন। আসলে আমেরিকার মতো দেশের বর্তমান যে হাল, তার একটা কারণ বোধ হয় দেশের নৌকোর মাঝিরা প্রায় সবাই পুরুষ। ভাবুন তো, অবস্থা যদি বদলে যায়, অর্থাৎ দেশের নীতিনির্ধারণের ও তার বাস্তবায়নের দায়িত্ব মেয়েদের হাতে তুলে দেওয়া হয়, তাহলে অবস্থার কি নাটকীয় পরিবর্তন ঘটা সম্ভব?
বিজ্ঞানীরা বিস্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর এখন বলছেন, লেখাপড়ায় মেয়েরা যে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে বিস্ময়ের কিছুই নেই। তাদের এগোনোরই কথা, কারণ শারীরিকভাবে ছেলেদের তুলনায় তাদের একাধিক সুবিধা রয়েছে। সবচেয়ে বড় সুবিধা, তাদের উন্নত মস্তিষ্ক। ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের ‘করপাস কালোসাম’ অর্থাৎ সেসব টিস্যু, যা মস্তিষ্কের দুই ভাগকে জোড়া লাগায়—পরিমাণে প্রায় এক-চতুর্থাংশ বেশি। এর ফলে মাথার দুই ভাগের মধ্যে আদান-প্রদানের ব্যাপারে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা অধিক চটপটে। মস্তিষ্কের কোষের গঠনগত বৈশিষ্ট্যের কারণে মেয়েদের স্মৃতিশক্তিও বেশি। স্মৃতি জমিয়ে রাখার জন্য যে ‘নিউরাল কানেকটার’ ও ‘হিপোক্যাম্পাস’ চাই, ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের তা বড়। এর ফলে তাদের স্মৃতিশক্তিই বেশি নয়, জটিল বিষয় বিশ্লেষণের ক্ষমতাও বেশি। ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের মস্তিষ্ক-অগ্রভাগের করটেক্স (প্রি-ফ্রন্টাল করটেক্স) অধিক কর্মক্ষম এবং অধিকতর কম বয়সে পরিণত আকার ধারণ করে।
ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা যে অধিক বিবেচক ও পরিণত বলে ভাবা হয়, তার কারণ মস্তিষ্কের এই গঠনগত বৈশিষ্ট্য। একই কারণে ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা অনেক কম আবেগনির্ভর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে। তাদের মস্তিষ্কে রক্ত চলাচলের পরিমাণ বেশি হওয়ায় ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা ‘মাল্টিটাস্ক’ বা একই সঙ্গে একাধিক কাজ করার ক্ষমতা রাখে।
সোজা কথায়, প্রকৃতিই মেয়েদের এমনভাগে গঠন করেছে যে তাদেরই এগিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তব সত্য হলো, পৃথিবীর সব দেশেই পুরুষদের তুলনায় মেয়েরা পিছিয়ে। দু-চারটে আলো ঝলমলে উদাহরণ হয়তো আছে, কিন্তু তারা ব্যতিক্রম। মেয়েরা যে এগোয় না তার কারণ আমরা পুরুষেরা যেভাবে পারি, তাদের টেনে ধরে রাখি। মেয়েরা এগিয়ে যাওয়া মানে তাদের জন্য জায়গা ছেড়ে দেওয়া। এ কাজটি স্বেচ্ছায় পুরুষবাবাজিরা করবে, এ কথা ভাবার কোনো কারণ নেই। সকল দণ্ডমুণ্ডের তারাই হর্তাকর্তা। মন্দির-মসজিদ তাদের দখলে, আইন বানায় তারা, শাসকের ডান্ডাও তাদের হাতে। এত দিন পর্যন্ত তারাই সে ডান্ডা ঘুরিয়ে এসেছে। কিন্তু ক্রমশ অবস্থাটা বদলাতে শুরু করেছে।
চলতি মাসে আটলান্টিক মান্থলি পত্রিকায় হানাহ রোসিন সে কথাটা নানা উপাত্ত দিয়ে বলার চেষ্টা করেছেন। তাঁর প্রতিবেদনের শিরোনাম ‘দ্য এন্ড অব মেন’, অর্থাৎ ছেলেদের খেল খতম। এমন কথা বলার কারণও আছে। আমেরিকায় এখন মোট শ্রমিকের বৃহদাংশ মেয়ে। আগামী দশকে অধিকতর কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে এমন ১৫টি ক্ষেত্রের মাত্র দুটিতে পুরুষদের আধিপত্য থাকবে, বাকি সবগুলোতে মেয়েদের। ম্যানেজারের দায়িত্বে আছে এমন মেয়েদের সংখ্যা ইতিমধ্যেই ছেলেদের চেয়ে বেশি। এই সংখ্যা আরও বাড়বে। এখন প্রতি দুজন ছেলে যদি কলেজ ডিগ্রি পায়, তো একই সময়ে তিনজন মেয়ে কলেজ ডিগ্রি নিচ্ছে। শুধু আমেরিকায় বা পশ্চিম ইউরোপীয় দেশে নয়, উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও মেয়েদের ভূমিকার নাটকীয় পরিবর্তন আসা শুরু করেছে। বছর বিশেক আগেও দক্ষিণ কোরিয়ায় অধিকাংশ পিতামাতা ছেলেশিশুর প্রতি অধিক আগ্রহী ছিলেন। এখন সেই সংখ্যা কমে মাত্র ১৫ শতাংশে এসে ঠেকেছে।
মেয়েদের যদি শুধু হেঁশেলে আটকে না রেখে বাইরে বেরিয়ে আসতে দেওয়া হয়, তাহলে পৃথিবীর চেহারাটাই বদলে যেতে পারে। শিল্পোন্নত দেশসমূহের সংস্থা ওইসিডি ১৬২টি দেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার সমীক্ষা করে ২০০৬ সালে বলেছিল, পৃথিবীর যেখানেই মেয়েদের হাতে শাসনভার তুলে দেওয়া হয়েছে, সেখানেই অধিক অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। পুরুষেরা না হয়ে যদি মেয়েরা রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকে, তাহলে যুদ্ধবিগ্রহের সংখ্যাও কমে আসে। ধর্মের নামে সন্ত্রাস, তাও পুরুষের হাতে। আগ্রাসন নয়, নতুন সময়ের চাহিদা হলো কূটনৈতিক সমঝোতার, আলাপ-আলোচনার। এ কাজেও ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের যোগ্যতা অধিক, এ কথা এখন প্রমাণিত সত্য। শুধু দেশ চালানোর মতো বড় কাজ নয়, ছোটখাটো অনেক কাজেই দেখা যাচ্ছে মেয়েদের যোগ্যতা অধিক। বিশ্বব্যাংক জানাচ্ছে, খয়রাতি অনুদান বা ক্ষুদ্রঋণের টাকা যখন মেয়েদের হাতে থাকে, তারও সদ্ব্যবহার হয় বেশি।
এসবই ঠিক, কিন্তু এ কথাও তো ঠিক, তাদের সকল যোগ্যতা সত্ত্বেও মেয়েরা শুধু আমাদের দেশেই নয়, পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই এখনো পুরুষদের পদানত। হাতের ছড়িখানা এখনো পুরুষের হাতে, টাকার গোছাটা তাদের পকেটে, বন্দুকের নলটা তাদের পিছ পকেটে।
আমি প্রথম আলোর ওই ছবিটা দেখছি আর ভাবছি, আর কত দিন বাপু, তোমরা ছড়ি ঘোরাবে?
নিউইয়র্ক
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.