চারদিক-নৌকাবাইচ by আকমল হোসেন
‘ছাড়িলাম হাসনের নাওরে/ হাসন রাজার নাওরে...।’ হাসন রাজার নাও কি না, সেটা বলা মুশকিল। একেক নৌকার একেক নাম। কখনো কোনো গ্রাম বা এলাকার নামে, কখনো শুধু একক কোনো ব্যক্তির—যে কিনা সেই নৌকার মালিক। তবু নাও তো! আর সেই নাও তো আর যেই-সেই নাও না।
এই নাও যাত্রী পারাপার করে না, যাত্রী টানে না, টানে না পণ্য। নৌকার যেমন অনেক নাম থাকে, খেয়া নৌকা, ডিঙি, পানসি, মাছ ধরা—যার যেমন ব্যবহার। তেমনি এই নাওয়েরও একটা নাম আছে ‘দৌড়ের নাও’।
তা এই দৌড়ের নাওয়ের কাজটা কী? এটা হয়তো এই প্রজন্মের অনেক তরুণ-তরুণী, কিংবা শিশু-কিশোর, যাদের বসবাস এখনো গ্রাম অথবা নদীপাড়ে—তারাও ঠিকঠাক বলতে পারবে না। এর একটা কারণ আছে। অনেক দিন হয়তো তারা দেখেনি তাদের কোনো নদীর বুকে, হাওরের বুকে বা ভাসান পানিতে হইচই আর তরতর করে পানি কেটে এগিয়ে যাওয়া এই ‘দৌড়ের নাও’। অথবা ‘নৌকাবাইচ’। কথাটা খুব করে মনে পড়ল, সম্প্রতি মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার ব্রাহ্মণবাজার ইউনিয়ন এলাকায় হাকালুকি হাওরের ভাসান পানিতে একটি নৌকাবাইচ হতে দেখে। হাজারো মানুষ নৌকাবাইচ দেখতে এসেছে। বৈঠার টানে কার নৌকা আগে বাড়ে।
এই নৌকাবাইচ শুধু মৌলভীবাজারই না, বৃহত্তর সিলেটের সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ বা সিলেটেও একটা জন-আনন্দের উৎস ছিল (যদিও এখনো নৌকাবাইচের আনন্দ ফিকে হয়ে যায়নি)। যখন বর্ষা আসে, নদী ও হাওর পানিতে ভরে ওঠে। চারদিকে পানি আর পানি। এমনকি বন্যার পানিতে হয়তো তলিয়ে গেছে ফসলের খেত। কারও ঘরবাড়ি ডুবে গেছে। পরিবার-পরিজন নিয়ে ঠাঁই নিয়েছে কোনো আত্মীয় বাড়ি বা আশ্রয়কেন্দ্রে। একদিকে ফসল হারানোর বেদনা, অন্যদিকে ঘরছাড়ার দুর্ভোগ। তবু দেখা গেছে, থেমে নেই মানুষ। অতল কষ্টের নীল জল থেকেও যেন তারা মাথা তুলে খোলা হাওয়া বুকে নিতে একটুও দ্বিধাগ্রস্ত নয়। হাতে কাজ নেই। হয়তো কারও ঘরে খাবারও ঠিকমতো নেই। রাস্তাঘাট ডুবে আছে। ছুটে বেড়ানোর উপায় নেই। অফুরন্ত অবসর। এর মধ্যেই সব কষ্ট ছুড়ে ফেলা ভাসান জলে নেমেছে মানুষ। সঙ্গী তাদের ‘দৌড়ের নাও’।
লোকজন জানান, দৌড়ের নাওগুলো বানানোও হয় বিশেষভাবে। কখনো এলাকাবাসী বা কোনো ক্লাব। কখনো কোনো একক ব্যক্তি তৈরি করেন শখের এই দৌড়ের নাও। আর তাতে মাঝি ও পাইক হন সেই এলাকারই লোকজন। কোনো দলাদলি নেই, কুটকচাল নেই (নিজেদের নৌকা বা এলাকার প্রতি সমর্থন ছাড়া নেই হিংসা-বিদ্বেষ)। কোনো ক্লাব বা নৌকাবাইচের জন্য তৈরি কমিটির উদ্যোগে কোনো একদিন নদী, হাওর বা ভাসান জলে আয়োজন করা হয় নৌকাবাইচের। প্রচার চলে। অনেক দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসে হাজারো মানুষ। বর্ষাকালে এটা এই অঞ্চলের বিনোদনের অন্যতম একটা দিক। হয়তো অনেকে মনে মনে এই সময়টার জন্য গোপন প্রতীক্ষায় সময় পার করেন। প্রতীক্ষা না হলে কি নৌকা তৈরি হতো, তৈরি থাকতেন মাঝি ও পাইকেরা! প্রতিযোগিতার প্রতিটি মুহূর্ত রোমাঞ্চ আর উত্তেজনায় ঠাসা। প্রতিটি নৌকাই অন্য নৌকাকে ছাড়িয়ে যেতে রাগি সাপের মতো তীব্র গতিতে ছোটে। পানিতে তখন বৈঠার ছপাত ছপাত শব্দ। নৌকায় বাজে ঢোল-করতাল। আর সবার মুখেই থাকে গান। কত রকমের গান। একটা গান তো অনেকেই বলেন, ‘বলো হরি হরি/ অজ্ঞান ঠাকুরের নাও যাইতো অন্তেহরি...।’ নৌকাবাইচ আর এই গানগুলো মিলেমিশে ছিল। বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমের একটি গানেও আছে ‘গাইয়া সারি গান নাও দৌড়াইতাম/ আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম...।’ আর পুরস্কার—নারকেল, না হয় মেষ। এখন যুক্ত হয়েছে টেলিভিশন (তবে পুরস্কারটা কী, তা নিয়ে কারও কোনো বাড়তি পীড়ন নেই। জেতাটাই লক্ষ্য)। প্রতিযোগিতার দিন প্রতিটি নৌকার কর্তৃপক্ষ মাঝি-মাল্লা বা পাইকের জন্য খাসি জবাই করে খানাপিনার আয়োজন করে। উৎসবের হইচই তখন ঘরে, পাড়ায়, গ্রামে।
দেখতে দেখতে কেমন করে যেন এই নৌকাবাইচ সংস্কৃতির লুপ্ত ঐতিহ্যের অংশ হয়ে উঠছে। তবে কি এখন বর্ষা নেই? নদী নেই? হাওর নেই? ভাসান পানি নেই! না, বর্ষাও আছে। আছে নদী ও হাওর। কিন্তু কখনো কখনো বর্ষাও তার আসল সৌন্দর্য খুলে ধরতে পারছে না। অথৈ পানি তার স্বাভাবিকতা হারিয়ে কখনো হয়ে উঠছে আগ্রাসী। নদী ও হাওর ভরাট হয়ে হারিয়েছে তার প্রকৃত রূপ। হাওরে, নদীতে এখানে-সেখানে তৈরি হয়েছে বাঁধ। চাইলেই আর অবাধে নৌকা ছোটাতে পারে না। হয়তো জলবায়ুর পরিবর্তন সরল বিনোদনের এই জগৎটিতেও ছোবল দিয়েছে। এ ছাড়া মানুষও হয়তো জীবন-জীবিকার অনিশ্চয়তার দৌড়ে কিছুটা ক্লান্ত, দিশেহারা। রাজনীতি, আধিপত্যের দাপট, কর্তৃত্ব—এসবও এই সরল সুন্দরকে অজগরের হাঁতে ঢুকিয়ে ফেলছে! যদিও মানুষ তার আপন শক্তিতে যেকোনো দুর্যোগে উঠে দাঁড়ায়। এখন হয়তো বর্ষা এলে আগের মতো চারদিকে ঢাকঢোল বেজে ওঠে না নৌকাবাইচের। তবু তো কোথাও না কোথাও জলে নামে দৌড়ের নাও। আছে বর্ষা, আছে নদী ও হাওর। আছে নৌকা। হয়তো আরও অনেক দিন শুধু পেটের ক্ষুধা নিবারণ নয়, মনের আনন্দের এই উৎসটাকেও মনে রাখবে মানুষ।
তা এই দৌড়ের নাওয়ের কাজটা কী? এটা হয়তো এই প্রজন্মের অনেক তরুণ-তরুণী, কিংবা শিশু-কিশোর, যাদের বসবাস এখনো গ্রাম অথবা নদীপাড়ে—তারাও ঠিকঠাক বলতে পারবে না। এর একটা কারণ আছে। অনেক দিন হয়তো তারা দেখেনি তাদের কোনো নদীর বুকে, হাওরের বুকে বা ভাসান পানিতে হইচই আর তরতর করে পানি কেটে এগিয়ে যাওয়া এই ‘দৌড়ের নাও’। অথবা ‘নৌকাবাইচ’। কথাটা খুব করে মনে পড়ল, সম্প্রতি মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার ব্রাহ্মণবাজার ইউনিয়ন এলাকায় হাকালুকি হাওরের ভাসান পানিতে একটি নৌকাবাইচ হতে দেখে। হাজারো মানুষ নৌকাবাইচ দেখতে এসেছে। বৈঠার টানে কার নৌকা আগে বাড়ে।
এই নৌকাবাইচ শুধু মৌলভীবাজারই না, বৃহত্তর সিলেটের সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ বা সিলেটেও একটা জন-আনন্দের উৎস ছিল (যদিও এখনো নৌকাবাইচের আনন্দ ফিকে হয়ে যায়নি)। যখন বর্ষা আসে, নদী ও হাওর পানিতে ভরে ওঠে। চারদিকে পানি আর পানি। এমনকি বন্যার পানিতে হয়তো তলিয়ে গেছে ফসলের খেত। কারও ঘরবাড়ি ডুবে গেছে। পরিবার-পরিজন নিয়ে ঠাঁই নিয়েছে কোনো আত্মীয় বাড়ি বা আশ্রয়কেন্দ্রে। একদিকে ফসল হারানোর বেদনা, অন্যদিকে ঘরছাড়ার দুর্ভোগ। তবু দেখা গেছে, থেমে নেই মানুষ। অতল কষ্টের নীল জল থেকেও যেন তারা মাথা তুলে খোলা হাওয়া বুকে নিতে একটুও দ্বিধাগ্রস্ত নয়। হাতে কাজ নেই। হয়তো কারও ঘরে খাবারও ঠিকমতো নেই। রাস্তাঘাট ডুবে আছে। ছুটে বেড়ানোর উপায় নেই। অফুরন্ত অবসর। এর মধ্যেই সব কষ্ট ছুড়ে ফেলা ভাসান জলে নেমেছে মানুষ। সঙ্গী তাদের ‘দৌড়ের নাও’।
লোকজন জানান, দৌড়ের নাওগুলো বানানোও হয় বিশেষভাবে। কখনো এলাকাবাসী বা কোনো ক্লাব। কখনো কোনো একক ব্যক্তি তৈরি করেন শখের এই দৌড়ের নাও। আর তাতে মাঝি ও পাইক হন সেই এলাকারই লোকজন। কোনো দলাদলি নেই, কুটকচাল নেই (নিজেদের নৌকা বা এলাকার প্রতি সমর্থন ছাড়া নেই হিংসা-বিদ্বেষ)। কোনো ক্লাব বা নৌকাবাইচের জন্য তৈরি কমিটির উদ্যোগে কোনো একদিন নদী, হাওর বা ভাসান জলে আয়োজন করা হয় নৌকাবাইচের। প্রচার চলে। অনেক দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসে হাজারো মানুষ। বর্ষাকালে এটা এই অঞ্চলের বিনোদনের অন্যতম একটা দিক। হয়তো অনেকে মনে মনে এই সময়টার জন্য গোপন প্রতীক্ষায় সময় পার করেন। প্রতীক্ষা না হলে কি নৌকা তৈরি হতো, তৈরি থাকতেন মাঝি ও পাইকেরা! প্রতিযোগিতার প্রতিটি মুহূর্ত রোমাঞ্চ আর উত্তেজনায় ঠাসা। প্রতিটি নৌকাই অন্য নৌকাকে ছাড়িয়ে যেতে রাগি সাপের মতো তীব্র গতিতে ছোটে। পানিতে তখন বৈঠার ছপাত ছপাত শব্দ। নৌকায় বাজে ঢোল-করতাল। আর সবার মুখেই থাকে গান। কত রকমের গান। একটা গান তো অনেকেই বলেন, ‘বলো হরি হরি/ অজ্ঞান ঠাকুরের নাও যাইতো অন্তেহরি...।’ নৌকাবাইচ আর এই গানগুলো মিলেমিশে ছিল। বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমের একটি গানেও আছে ‘গাইয়া সারি গান নাও দৌড়াইতাম/ আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম...।’ আর পুরস্কার—নারকেল, না হয় মেষ। এখন যুক্ত হয়েছে টেলিভিশন (তবে পুরস্কারটা কী, তা নিয়ে কারও কোনো বাড়তি পীড়ন নেই। জেতাটাই লক্ষ্য)। প্রতিযোগিতার দিন প্রতিটি নৌকার কর্তৃপক্ষ মাঝি-মাল্লা বা পাইকের জন্য খাসি জবাই করে খানাপিনার আয়োজন করে। উৎসবের হইচই তখন ঘরে, পাড়ায়, গ্রামে।
দেখতে দেখতে কেমন করে যেন এই নৌকাবাইচ সংস্কৃতির লুপ্ত ঐতিহ্যের অংশ হয়ে উঠছে। তবে কি এখন বর্ষা নেই? নদী নেই? হাওর নেই? ভাসান পানি নেই! না, বর্ষাও আছে। আছে নদী ও হাওর। কিন্তু কখনো কখনো বর্ষাও তার আসল সৌন্দর্য খুলে ধরতে পারছে না। অথৈ পানি তার স্বাভাবিকতা হারিয়ে কখনো হয়ে উঠছে আগ্রাসী। নদী ও হাওর ভরাট হয়ে হারিয়েছে তার প্রকৃত রূপ। হাওরে, নদীতে এখানে-সেখানে তৈরি হয়েছে বাঁধ। চাইলেই আর অবাধে নৌকা ছোটাতে পারে না। হয়তো জলবায়ুর পরিবর্তন সরল বিনোদনের এই জগৎটিতেও ছোবল দিয়েছে। এ ছাড়া মানুষও হয়তো জীবন-জীবিকার অনিশ্চয়তার দৌড়ে কিছুটা ক্লান্ত, দিশেহারা। রাজনীতি, আধিপত্যের দাপট, কর্তৃত্ব—এসবও এই সরল সুন্দরকে অজগরের হাঁতে ঢুকিয়ে ফেলছে! যদিও মানুষ তার আপন শক্তিতে যেকোনো দুর্যোগে উঠে দাঁড়ায়। এখন হয়তো বর্ষা এলে আগের মতো চারদিকে ঢাকঢোল বেজে ওঠে না নৌকাবাইচের। তবু তো কোথাও না কোথাও জলে নামে দৌড়ের নাও। আছে বর্ষা, আছে নদী ও হাওর। আছে নৌকা। হয়তো আরও অনেক দিন শুধু পেটের ক্ষুধা নিবারণ নয়, মনের আনন্দের এই উৎসটাকেও মনে রাখবে মানুষ।
No comments