শিক্ষার সংকট-প্রশ্নটা বেতন-ফির নয়, বিশ্ববিদ্যালয় বাঁচানোর by ফারুক ওয়াসিফ

মানুষের মধ্যে দুই জাত আছে। একদল লাঠিপেটা করে, আরেক দল লাঠিপেটা খায়। লাঠির একমাত্র বৈধ ‘প্র্যাকটিশনার’ হলো পুলিশ, আর সেই বৈধ লাঠির বৈধ শিকারদের মধ্যে ছাত্র আর শ্রমিকেরাই প্রধান। লাঠি তাঁদের ভালোবাসে, তাঁদের মাথা-পিঠ-পা- পশ্চাদ্দেশে আদর না করলে লাঠিজীবনের সার্থকতা আসে না।


বাংলাদেশের ছাত্র ও শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস তাই লাঠিপেটারও ইতিহাস। লাঠিপেটা খাওয়াই তাঁদের ঐতিহ্য। লাঠিপেটা হলো ডালভাত, বড় ভোজ হলে সঙ্গে কাঁদানে গ্যাস, ছররা গুলি, রাবার বুলেট মায় গুলি-বারুদের তরকারিও থাকে। গত সোমবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীকে এমন মহাভোজ খেতে হয়েছে। মেয়েদের জমায়েতকে চারদিক থেকে ঘিরে মনের সুখে পুরুষ পুলিশের লাঠিপেটা করার ছবি পত্রিকায় ছাপাও হয়েছে। কয়েক শ আহত আর আটক হয়েছে প্রায় আড়াই শ শিক্ষার্থী।
জ্বরের চিকিৎসা হয় না। কারণ জ্বর রোগ নয়, রোগের প্রকাশ। চিকিৎসকের কাজ হলো কেন জ্বর আসছে সেটা বের করে তার চিকিৎসা করা। হালে দেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়েই বিভিন্ন রকম জ্বরে ভুগতে দেখা গেছে। গত মাসে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সন্ত্রাসের বন্যা বয়ে গেছে। কদিন আগে সেখানকারই এক ছাত্র সেশনজটের হতাশায় টেকনাফের সমুদ্রে ডুবে আত্মহত্যা করেছেন। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে বহিষ্কার ও পুলিশ দিয়ে দমন করা হয়েছে। আর এখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ও দেখা হলো। সব কটি ঘটনাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গভীর, গভীরতর অসুখেরই লক্ষণ। জ্বর বা ব্যথা বাড়লে প্যারাসিটামল বা পেইনকিলার খাইয়ে সাময়িক আরাম হয়। কিন্তু যে অসুখ গভীরে তা এভাবে সারার নয়।
একরকম বেহুঁশ দশার মধ্যেই আমাদের উচ্চশিক্ষা এবং তার প্রধান কেন্দ্র হিসেবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ধীরমৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে। স্রোতহীন নদী যেমন দূষিত হয়ে যায়, তেমনি প্রাণহীন-মানহীন উচ্চশিক্ষা হয়ে উঠছে সন্ত্রাস আর দুর্বৃত্তগিরির অভয়ারণ্য। ছাত্রছাত্রীরা তো কোন ছার, শিক্ষক-উপাচার্যদেরও ভয়ে কাঁপাতে পারার মতো ছাত্রনেতা পয়দা হচ্ছে সেখানে। সরকারি দলের লেঙ্গুড় হওয়ায় অস্ত্র আর দাপট তাদের ক্ষমতার শোভা। শিক্ষকদের অনেকে বাধ্য হয়ে, অনেকে ক্ষমতার দুধ-মধুর আকর্ষণে দলবাজিতে নেমেছেন। দুর্নীতিসহ যৌন নিপীড়নের অভিযোগও উঠছে আর পড়ছে। কোনো কোনো উপাচার্যের আচরণ যত না শিক্ষাবিদসুলভ, তার থেকে বেশি জমিদারসুলভ। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষায় এঁরা কাজে আসেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের কথা বলে সেই স্বাধীনতাকে এঁরা ক্ষমতার সেবায় লাগান। শিক্ষক নিয়োগ, অর্থব্যয় এবং শিক্ষা ও শিক্ষার্থী দলনের ব্যাপারে এঁরা আসলেই স্বাধীন, জবাবদিহির ঊর্ধ্বে।
দ্বিতীয় বিপদ হলো উচ্চশিক্ষার বাণিজ্যিকায়ন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ‘টাকা যার সার্টিফিকেট তার’ নীতি ধীরে ধীরে কায়েম হচ্ছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও। আশির দশক থেকেই শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা খাত থেকে রাষ্ট্র তার দায় কমাতে শুরু করে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুরুত্বও কমতে থাকে। বিশ্বব্যাংকের নীতি অনুসারে শুরু হয়ে যায় শিক্ষা-পুঁজিবাদের জমিন তৈরির কাজ। শিক্ষা-গবেষণা ইত্যাদি খাতে অনুদান কমে এবং বাড়তে থাকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন-ফি। অনেকে বলে থাকেন, ১৫ টাকার জায়গায় ৩০ টাকা বেতন হওয়া আর এমন কি! ভর্তির সময় ও নতুন ক্লাসে ওঠার সময় ১৫-২০ হাজার টাকা দেওয়ার সামর্থ্য তো অনেকেরই আছে। কথা সত্য। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেবল মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্তদের সন্তানদের জন্য সংরক্ষিত রাখতে চাইলে মেধার জায়গায় বিত্তের প্রতিযোগিতা রাখাই উত্তম। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষা তাই আসলে অবস্থাপন্নদের সন্তানদের মধ্যকার প্রতিযোগিতা ছাড়া আর কী? জন্মে সমান হলেও দারিদ্র্য অনেককেই যে আর বিকশিত হতে দেয় না, সেই প্রশ্ন তবু এড়ানো যায় না।
মানি, সবাইকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেই হবে এমন কোনো কথা নেই। কিন্তু রাষ্ট্র যেভাবে দিনকে দিন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভালোভাবে চালানোর আর্থিক দায়দায়িত্ব থেকে সরে আসছে, যেভাবে বাজারি মতবাদ অনুসারে শিক্ষাকে পণ্যে পরিণত করে শিক্ষা-ব্যবসাপ্রতিষ্ঠার এন্তেজাম চলছে, তাতে অচিরেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রাইভেট হবে এবং সেখানে পড়ানোর সামর্থ্য নিম্নমধ্যবিত্ত মধ্যবিত্তের ছেলেমেয়েরা হারাবে। অথবা তাদের তখন আমেরিকার মতো শিক্ষা-ঋণ নিয়ে পড়ালেখা করে সেই ঋণের ঘানি টানতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেতন-ফি আর তেমন কী বাড়ছে, এটা ভেবে যারা আশ্বস্ত হচ্ছেন, তাঁদের আশির দশক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাণিজ্যিকায়নের রেখাটি অনুসরণ করতে বলি। সেটি ক্রমেই ওপরে উঠছে। একই সঙ্গে যদি ছাত্রছাত্রীদের অর্থনৈতিক উৎসটি খেয়াল করি তো দেখব, গ্রাম-মফস্বলের কৃষক ও নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোর ছেলেমেয়েরা ইতিমধ্যেই সেখানে বিরল প্রজাতির দশা পেয়েছে।
এই বাণিজ্যিকায়ন আর এই স্বেচ্ছাচারী শিক্ষা-প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রতিষ্ঠান হিসেবে অগণতান্ত্রিক এবং বৈষম্যের কারখানা বানিয়ে ফেলছে। এই বাস্তবতায় নিশ্চিন্ত বোধ করা উটপাখির মতো বালুতে মুখ গুঁজে থাকার সমান। অবশ্য কেউ কেউ মুখ গোঁজার জন্য টেলিভিশনকেও বেছে নিতে পারেন।
কলেজ পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার কাজ হলো কাজ চালানোর মতো কর্মী তৈরি করা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতি, উন্নত গবেষণা ও উন্নত মানুষ তৈরির জন্য। মাধ্যমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে তাঁরাই আসবেন, যাঁরা দেশ-রাষ্ট্র-রাজনীতি-অর্থনীতি ক্ষেত্রে পথ দেখাবেন। কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য কিছু চাকরিজীবী জোগানো ছাড়া দেশের দুর্বল অর্থনীতি, রাজনীতি, প্রযুক্তি বা সমাজ পরিচালনায় তাঁদের দ্বারা তেমন কোনো উন্নতি ঘটছে বলা যায় না। উচ্চশিক্ষা নামেই কেবল উচ্চ। এককথায়, উচ্চশিক্ষায় শিক্ষাদানের ধার আর শিক্ষার মান দুই-ই একটানা ক্ষয়ে যাচ্ছে। বলিউডি ছবি থ্রি ইডিয়টসে এই দুরবস্থার কথাই চমৎকার করে রটিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস লিখেছেন, শিক্ষা চলবে রাষ্ট্রের খাতে কিন্তু থাকবে সমাজের হাতে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যাবতীয় ব্যয় রাষ্ট্রই করবে ভবিষ্যতের জনসম্পদ তৈরির বিনিয়োগ হিসেবে, জ্ঞান ও নীতির সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার স্বার্থে। উচ্চশিক্ষার সঙ্গে তুলনীয় হলো উচ্চ আদালত। আদালতের ব্যয় মেটানোর জন্য বাণিজ্যিকায়নের কথা তো কেউ বলে না কিংবা তার স্বাধীনতায় হাত দেওয়ার চিন্তা করে না। কেউ তো বলে না, সেনাবাহিনীকে তাদের ব্যয় নিজেদেরই জোগাতে হবে। তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় কী দোষ করল?
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গণজোয়ারের পেছনে এই চেতনা ও বাস্তবতা কাজ করছে বলে ধারণা করি। তাঁদের আন্দোলনের মূলে ছিল বাণিজ্যিকায়ন ও প্রশাসনিক স্বেচ্ছাচার বন্ধ করা। দারোগার চোখ দিয়ে দেখলে বিক্ষোভকারীরা শৃঙ্খলাভঙ্গকারী। কিন্তু সাদা চোখে তরুণ শিক্ষার্থীরা সন্ত্রাস ও প্রশাসনিক স্বেচ্ছাচারের শিকার।
একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের হাতে থাকে অগাধ ক্ষমতা। শিক্ষার্থীদের জীবনকে তাঁরা যেমন আলোর দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে পারেন, তেমনি ভুল শিক্ষাপদ্ধতি, নিম্নমানের ক্লাস-বক্তৃতা, সিলেবাস প্রণয়ন এবং সে অনুযায়ী ক্লাস-পরীক্ষা নেওয়ায় গাফিলতি, পক্ষপাত, অবহেলা-অপমান ইত্যাদি দিয়ে তাঁরা তরুণদের সবুজ মন ও মস্তিষ্ককে ভোঁতাও করে দিতে পারেন। চলমান সব কটি শিক্ষা আন্দোলনেই শিক্ষার্থীরা দেশবাসী ও সরকারকে এই বিপর্যয়ের বার্তাটিই দিতে চেয়েছে। কিন্তু না প্রশাসন, না সরকার, না দেশের শিক্ষাবিদেরা, কেউই তাঁদের ডেকে বা তাঁদের কাছে গিয়ে তাঁদের মনের কথা শুনতে চায়নি। উল্টো আমরা দেখলাম, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রের গভীর গভীরতর অসুখের বার্তাবাহকদের লাঠিপেটা, বহিষ্কার ও মামলা-হামলা করে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। গত এক বছরে সব কটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাঁরা বহিষ্কৃত হয়েছেন, তাঁদের কতজন সন্ত্রাসী আর কতজন শিক্ষা আন্দোলনের কর্মী তার হিসাব নিলেই এটা প্রমাণ হবে।
এই আন্দোলনগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয় বাঁচানোর গঠনমূলক আন্দোলনে এগিয়ে নেওয়া দরকার। সেটা সম্ভব শিক্ষকসমাজ এবং প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে সাধারণ শিক্ষার্থীদের জোটবদ্ধ দেওয়া-নেওয়ায়, যৌথ পথসন্ধানে। এর বাইরে যাঁরা বাণিজ্যিকীকরণে তালে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ব্যয়বহুল করায় মত দিচ্ছেন কিংবা পাবলিকের চাকরি করে প্রাইভেটে আগ্রহী হয়ে উঠছেন, শেষপর্যন্ত তাঁরা শিক্ষাবিদ থেকে পরিণত হবেন শিক্ষা-ব্যবসার খোরাক তথা পুঁজির ব্লু কলার শ্রমিকে। তাঁরা হারাবেন তাঁদের সম্মান, সঙ্গে জ্ঞানের স্বাধীনতাটুকুও যাবে। পাবলিক-প্রাইভেটের ছাত্র-শিক্ষকদের নিজস্ব স্বার্থেই তাই একসঙ্গে কাজ করা দরকার।
ওই ‘থ্রি ইডিয়ট’ ছবিরই একটি বার্তা হলো ভারতের বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো মৌলিক চিন্তা করতে সক্ষম স্নাতক তৈরির বদলে কর্পোরেট ব্যবসা ও ব্যাংকগুলোর জন্য নতুন ধরনের আমলা তৈরির কাজেই ব্যস্ত। বাংলাদেশও সেই পথই ধরেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বাঁচানোর এই আন্দোলন এখন বিশ্বব্যাপীই হচ্ছে। ইউরোপের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্যিকায়ন ও অগণতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের আন্দোলন চলছে। ২০০ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয় যেভাবে স্বাধীন থেকে রাষ্ট্রের সহায়তায় জ্ঞানের প্রদীপ জ্বালিয়ে মানবজাতিকে পথ দেখিয়েছে, কীভাবে তা রক্ষা করা যায়, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা হচ্ছে।
এই বাস্তবতায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ছাত্র সোহানের আত্মহত্যাকে তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রাতিষ্ঠানিক আত্মহত্যার যাত্রার প্রতীক মনে হয়। মৃত্যুর আগে তিনি লিখে গেছেন, ‘আমার সুইসাইডের জন্য ইউনিভার্সিটি দায়ী’। টনক নামের কোনো বস্তু যদি থাকে আমাদের, তাহলে পাগলা ঘণ্টির মতো এখনই তা নড়ে ওঠা উচিত।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.