জন্মদিন-শতায়ু হোন এম আর খান by নান্টু রায়
এমন একটা সময় ছিল, যখন একজন চিকিত্সকই সব ধরনের চিকিত্সা করতেন। তিনি শিশুদের চিকিত্সক, বড়দেরও। এখন পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে। দীর্ঘ শ্রমে ও দীর্ঘদিনের অধ্যবসায়ে এই উন্নতিরেখাটি তিনি তৈরি করেছেন।
জন্ম ১৯২৮ সালের ১ আগস্ট, তত্কালীন সাতক্ষীরা মহকুমার রসুলপুর গ্রামে। বাবা মোহাম্মদ আবদুল বারী খান ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯১৪ সালের এন্ট্রান্স পাস। সেসময় তাঁকে দেখতে দশ গ্রামের লোক ছুটে এসেছিল, কত বড় ‘পাস’ তিনি দিয়েছেন! মা জায়রা খানম ছিলেন সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান। স্কুলে যাননি ঠিকই, কিন্তু বাড়িতেই আরবি শিক্ষার পাশাপাশি বাংলা ও সাধারণ জ্ঞান শিখে নিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন বিদ্যানুরাগী। নিজের চার সন্তানকে তো বটেই, একান্নবর্তী বৃহত্ খান পরিবারের শিশুদের, এমনকি প্রতিবেশী কিশোর-কিশোরী-তরুণদের পড়ালেখায় তিনি নানাভাবে সাহায্য করতেন।
খান পরিবারের দ্বিতীয় ছেলেটি পড়ালেখায় খুবই ভালো। সাতক্ষীরা থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে তিনি কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হলেন। তখন মুসলমান ছাত্র ছিল হাতে গোনা। এরপর প্রথম বিভাগে আইএসসি পাস করে ভর্তি হলেন কলকাতা মেডিকেল কলেজে, ১৯৪৬ সালে। কৃতিত্বের সঙ্গে এমবিবিএস পাস করে কিছুদিন সাতক্ষীরায় প্র্যাকটিস করলেন। ফি ৪ টাকা। সুদর্শন ও দীর্ঘকায় পুরুষ তিনি। ইতিমধ্যে বিয়ে করেছেন। একটি কন্যাসন্তানও হয়েছে। স্থানীয় পৌরসভা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেন। রাজনীতি বরাবরই পিচ্ছিল জায়গা। মহকুমা প্রশাসকের কারসাজিতে নির্বাচনে তো হারলেনই, এমনকি মাসখানেক মিথ্যা মামলায় জেলও খাটলেন। ভাগ্যিস তিনি জেল খেটেছিলেন! না হলে উত্তরজীবনে কৃতবিদ্য একজন শিশু বিশেষজ্ঞকে আমরা পেতাম না, যাঁর ছোঁয়ায় শিশুর অর্ধেক রোগ ভালো হয়ে যায়, আর চিকিত্সায় পুরোটা। বাংলাদেশে শিশু চিকিত্সার এই পথিকৃত্ নিজেকে এমন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন যে তাঁকে ধন্বন্তরী বললে বেশি বাড়িয়ে বলা হয় না।
যাহোক, জেল খেটে অনেকটা অভিমানে ১৯৫৬ সালে তিনি চিকিত্সাবিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা নিতে বিলাত গেলেন। পড়াশোনার পাশাপাশি লন্ডনের বিভিন্ন হাসপাতালে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কাজ করে শিখলেন অনেক কিছু। এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমআরসিপি ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরলেন ১৯৬৩ সালে। সহকারী অধ্যাপক পদে যোগ দিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এক বছর পর রাজশাহী মেডিকেল কলেজে বদলি হয়ে এলেন। খুললেন তাঁর প্রিয় পেডিয়াট্রিকস (শিশু চিকিত্সা) বিভাগ। চার শয্যার মিনি ওয়ার্ড তাঁর হাতযশে ৩০ শয্যায় উন্নীত হলো। তখন রাজশাহী ছোট্ট শহর—কাদার শহর, মশা-মাছির শহর। স্ত্রীর শরীর খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু তিনি নীতিবান মানুষ, বদলির তদবির করতে বিবেকে বাধে। পাঁচ বছর রাজশাহীতে ‘অজ্ঞাতবাস’ করে ঢাকা মেডিকেলে ফিরলেন ১৯৬৯ সালে। ১৯৭০ সালে পেলেন ঈপ্সিত সম্মান, অধ্যাপক পদ। তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে তিনিই পেডিয়াট্রিকসের প্রথম অধ্যাপক।
অধ্যাপক রফি খান, এফআরসিপি (লন্ডন)। এই নামে আত্মীয়স্বজনেরাও তাঁকে চিনবেন কি না, সন্দেহ। ডা. এম আর খান নামেই তিনি সমধিক পরিচিত। একবার হলো কি, রাজশাহীতে বেড়াতে গেছেন এক আত্মীয়। রাত আটটার দিকে রেলস্টেশনে নেমে রিকশাওয়ালাকে বললেন, ডা. রফি খানের বাসায় চলেন। তিনি তো চেনেন না। একে একে সবাইকে জিজ্ঞেস করলেন। কেউ চেনেন না। অনন্যোপায় হয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ থেকে বাসার ঠিকানা নিয়ে রাত সাড়ে ১১টায় গলদঘর্ম হয়ে তাঁর বাসায় পৌঁছালেন ওই আত্মীয়। অথচ এম আর খান বললে নিমেষেই কাজ হয়ে যেত!
১৯৭১ সালে বুদ্ধিজীবী নিধন তালিকায় তাঁর নামও ছিল। ভাগ্য ভালো, রাজাকারেরা তাঁর নাগাল পায়নি। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এল ডিসেম্বরে। নতুন দেশ। তখন আইপিজিএমআর ঢাকা মেডিকেল কলেজের একটি প্রকল্প। পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত শাহবাগ হোটেলে আইপিজিএমআর পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কার্যক্রম শুরু করল। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত চিকিত্সক প্রফেসর নূরুল ইসলাম হলেন এর পরিচালক। তাঁর অবর্তমানে ভারপ্রাপ্ত হলেন প্রফেসর এম আর খান। সেই যে পিজির হাল ধরলেন, ছাড়লেন টানা ১৮ বছর পর, ১৯৮৮ সালে। এর মধ্যে এডিনবরা থেকে এফআরসিপি ডিগ্রিও অর্জন করলেন।
অবসর নেওয়ার পর অধিকাংশ মানুষ বুড়িয়ে যায়। শরীর চলতে চায় না, মন থাকে অবসাদগ্রস্ত। অথচ এম আর খানের বেলায় হলো উল্টো। তাঁর দিন শুরু হয় ভোর পাঁচটায়। ভোরের নামাজ শেষে বাড়ির ছাদে কিছুক্ষণ পায়চারি করেন। সেখানে একটি পাত্রে তিনি পাখির জন্য পানি ঢেলে রাখেন। কাক, শালিক, চড়ুই এসে বসে। ইতিমধ্যে তাঁর সহধর্মিণী তাঁদের কিছু খাবার দেন। ছাদে কিছু গাছগাছালি আছে, দুজনে এগুলোর পরিচর্যা করেন। নিচে নেমে কিছুক্ষণ কোরআন শরিফ ও হাদিস পড়েন। এরপর নাশতা শেষে টেলিভিশনে খবর দেখতে দেখতে দৈনিক পত্রিকা পড়ে ফেলেন। নয়টার মধ্যেই ঢুকে পড়েন নৈমিত্তিক কর্মযজ্ঞে—নিবেদিতা নার্সিং হোম, সেন্ট্রাল হাসপাতাল, মহিলা মেডিকেল কলেজ ও শিশু স্বাস্থ্য ফাউন্ডেশনে যান রোগী দেখতে। এসব প্রতিষ্ঠান তাঁর হাতেগড়া। এর বাইরেও রোগী দেখেন আইসিডিডিআরবির মতো আন্তর্জাতিক চিকিত্সা গবেষণাকেন্দ্রে।
সমাজসেবা তাঁর ব্রত। অবসর নেওয়ার পর পেনশনের টাকা দিয়ে মা ও শিশুদের জন্য গড়ে তোলেন ডা. এম আর খান ও আনোয়ারা ট্রাস্ট। বাংলাদেশ সরকার তাঁকে জাতীয় অধ্যাপক সম্মাননায় ভূষিত করেছে, পেয়েছেন একুশে পদক। সহূদয়, সদালাপি, সমাজহিতৈষী ডা. খানের পথচলা ক্লান্তিহীন। সততা, একনিষ্ঠতা, উদারতা, আত্মবিশ্বাস, অধ্যবসায় ও নিরন্তর সাধনায় প্রায় একক প্রচেষ্টায় তিনি পৌঁছেছেন সাফল্যের স্বর্ণশিখরে। আমাদের সমবেত প্রার্থনা, তাঁর আয়ুরেখা শতাব্দী উত্তীর্ণ হোক।
নান্টু রায়: সম্পাদক, ভারত বিচিত্রা।
খান পরিবারের দ্বিতীয় ছেলেটি পড়ালেখায় খুবই ভালো। সাতক্ষীরা থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে তিনি কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হলেন। তখন মুসলমান ছাত্র ছিল হাতে গোনা। এরপর প্রথম বিভাগে আইএসসি পাস করে ভর্তি হলেন কলকাতা মেডিকেল কলেজে, ১৯৪৬ সালে। কৃতিত্বের সঙ্গে এমবিবিএস পাস করে কিছুদিন সাতক্ষীরায় প্র্যাকটিস করলেন। ফি ৪ টাকা। সুদর্শন ও দীর্ঘকায় পুরুষ তিনি। ইতিমধ্যে বিয়ে করেছেন। একটি কন্যাসন্তানও হয়েছে। স্থানীয় পৌরসভা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেন। রাজনীতি বরাবরই পিচ্ছিল জায়গা। মহকুমা প্রশাসকের কারসাজিতে নির্বাচনে তো হারলেনই, এমনকি মাসখানেক মিথ্যা মামলায় জেলও খাটলেন। ভাগ্যিস তিনি জেল খেটেছিলেন! না হলে উত্তরজীবনে কৃতবিদ্য একজন শিশু বিশেষজ্ঞকে আমরা পেতাম না, যাঁর ছোঁয়ায় শিশুর অর্ধেক রোগ ভালো হয়ে যায়, আর চিকিত্সায় পুরোটা। বাংলাদেশে শিশু চিকিত্সার এই পথিকৃত্ নিজেকে এমন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন যে তাঁকে ধন্বন্তরী বললে বেশি বাড়িয়ে বলা হয় না।
যাহোক, জেল খেটে অনেকটা অভিমানে ১৯৫৬ সালে তিনি চিকিত্সাবিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা নিতে বিলাত গেলেন। পড়াশোনার পাশাপাশি লন্ডনের বিভিন্ন হাসপাতালে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কাজ করে শিখলেন অনেক কিছু। এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমআরসিপি ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরলেন ১৯৬৩ সালে। সহকারী অধ্যাপক পদে যোগ দিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এক বছর পর রাজশাহী মেডিকেল কলেজে বদলি হয়ে এলেন। খুললেন তাঁর প্রিয় পেডিয়াট্রিকস (শিশু চিকিত্সা) বিভাগ। চার শয্যার মিনি ওয়ার্ড তাঁর হাতযশে ৩০ শয্যায় উন্নীত হলো। তখন রাজশাহী ছোট্ট শহর—কাদার শহর, মশা-মাছির শহর। স্ত্রীর শরীর খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু তিনি নীতিবান মানুষ, বদলির তদবির করতে বিবেকে বাধে। পাঁচ বছর রাজশাহীতে ‘অজ্ঞাতবাস’ করে ঢাকা মেডিকেলে ফিরলেন ১৯৬৯ সালে। ১৯৭০ সালে পেলেন ঈপ্সিত সম্মান, অধ্যাপক পদ। তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে তিনিই পেডিয়াট্রিকসের প্রথম অধ্যাপক।
অধ্যাপক রফি খান, এফআরসিপি (লন্ডন)। এই নামে আত্মীয়স্বজনেরাও তাঁকে চিনবেন কি না, সন্দেহ। ডা. এম আর খান নামেই তিনি সমধিক পরিচিত। একবার হলো কি, রাজশাহীতে বেড়াতে গেছেন এক আত্মীয়। রাত আটটার দিকে রেলস্টেশনে নেমে রিকশাওয়ালাকে বললেন, ডা. রফি খানের বাসায় চলেন। তিনি তো চেনেন না। একে একে সবাইকে জিজ্ঞেস করলেন। কেউ চেনেন না। অনন্যোপায় হয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ থেকে বাসার ঠিকানা নিয়ে রাত সাড়ে ১১টায় গলদঘর্ম হয়ে তাঁর বাসায় পৌঁছালেন ওই আত্মীয়। অথচ এম আর খান বললে নিমেষেই কাজ হয়ে যেত!
১৯৭১ সালে বুদ্ধিজীবী নিধন তালিকায় তাঁর নামও ছিল। ভাগ্য ভালো, রাজাকারেরা তাঁর নাগাল পায়নি। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এল ডিসেম্বরে। নতুন দেশ। তখন আইপিজিএমআর ঢাকা মেডিকেল কলেজের একটি প্রকল্প। পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত শাহবাগ হোটেলে আইপিজিএমআর পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কার্যক্রম শুরু করল। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত চিকিত্সক প্রফেসর নূরুল ইসলাম হলেন এর পরিচালক। তাঁর অবর্তমানে ভারপ্রাপ্ত হলেন প্রফেসর এম আর খান। সেই যে পিজির হাল ধরলেন, ছাড়লেন টানা ১৮ বছর পর, ১৯৮৮ সালে। এর মধ্যে এডিনবরা থেকে এফআরসিপি ডিগ্রিও অর্জন করলেন।
অবসর নেওয়ার পর অধিকাংশ মানুষ বুড়িয়ে যায়। শরীর চলতে চায় না, মন থাকে অবসাদগ্রস্ত। অথচ এম আর খানের বেলায় হলো উল্টো। তাঁর দিন শুরু হয় ভোর পাঁচটায়। ভোরের নামাজ শেষে বাড়ির ছাদে কিছুক্ষণ পায়চারি করেন। সেখানে একটি পাত্রে তিনি পাখির জন্য পানি ঢেলে রাখেন। কাক, শালিক, চড়ুই এসে বসে। ইতিমধ্যে তাঁর সহধর্মিণী তাঁদের কিছু খাবার দেন। ছাদে কিছু গাছগাছালি আছে, দুজনে এগুলোর পরিচর্যা করেন। নিচে নেমে কিছুক্ষণ কোরআন শরিফ ও হাদিস পড়েন। এরপর নাশতা শেষে টেলিভিশনে খবর দেখতে দেখতে দৈনিক পত্রিকা পড়ে ফেলেন। নয়টার মধ্যেই ঢুকে পড়েন নৈমিত্তিক কর্মযজ্ঞে—নিবেদিতা নার্সিং হোম, সেন্ট্রাল হাসপাতাল, মহিলা মেডিকেল কলেজ ও শিশু স্বাস্থ্য ফাউন্ডেশনে যান রোগী দেখতে। এসব প্রতিষ্ঠান তাঁর হাতেগড়া। এর বাইরেও রোগী দেখেন আইসিডিডিআরবির মতো আন্তর্জাতিক চিকিত্সা গবেষণাকেন্দ্রে।
সমাজসেবা তাঁর ব্রত। অবসর নেওয়ার পর পেনশনের টাকা দিয়ে মা ও শিশুদের জন্য গড়ে তোলেন ডা. এম আর খান ও আনোয়ারা ট্রাস্ট। বাংলাদেশ সরকার তাঁকে জাতীয় অধ্যাপক সম্মাননায় ভূষিত করেছে, পেয়েছেন একুশে পদক। সহূদয়, সদালাপি, সমাজহিতৈষী ডা. খানের পথচলা ক্লান্তিহীন। সততা, একনিষ্ঠতা, উদারতা, আত্মবিশ্বাস, অধ্যবসায় ও নিরন্তর সাধনায় প্রায় একক প্রচেষ্টায় তিনি পৌঁছেছেন সাফল্যের স্বর্ণশিখরে। আমাদের সমবেত প্রার্থনা, তাঁর আয়ুরেখা শতাব্দী উত্তীর্ণ হোক।
নান্টু রায়: সম্পাদক, ভারত বিচিত্রা।
No comments