গন্তব্য ঢাকা-গ্রামে তো আর ফিরতে পারি না by শর্মিলা সিনড্রেলা
নেত্রকোনার কাকলীতলা নামে ছোট্ট একটি গ্রাম। গ্রামেরই এক কোণে একটি দোকান। সেই দোকানে বসে সকাল থেকে রাত অবধি ১২ থেকে ১৪ বছরের ছেলেটি বিক্রি করে চলে নিত্যপ্রয়োজনীয় টুকিটাকি জিনিস। গ্রামে এমন দোকান আর নেই বলে বিক্রিও চলে অবিরত।
যখন যার যা দরকার হয় সে তা-ই নিয়ে যায় এই দোকান থেকে যথার্থ দাম দিয়ে। আর সেই বালকটি? তার মনে তো সুখের ছোঁয়া। হোক না সারা দিনের কাজ, কিন্তু আয় তো কম হচ্ছে না। আর গ্রামের স্বচ্ছ-সুন্দর পরিবেশে বসে থেকে কাজ করতেও তো কষ্ট হচ্ছে না।
গ্রামের শান্ত-স্নিগ্ধ পরিবেশে দিনভর কাজ করলেও মনে থাকে প্রশান্তি। কিন্তু সেই সুখ আর সইল কোথায়! একটু বেশি বেচাকেনা হয় দেখে দুর্বৃত্তদের নজর পড়ল। ছয়-ছয়বার ডাকাতি হলো বাড়িতে। মমতাময়ী মা ছেলের প্রতি কুদৃষ্টির কথা চিন্তা করে বললেন, ‘যাউক বাবা, আর করণ লাগত না ব্যবসা।’ ব্যস শেষ হলো দোকানদারির পাট। সেই মমতাময়ী মা আর নেই, নেই সেই সুখের জীবনও।
নিজের গ্রামীণজীবনের কথা শোনাচ্ছিলেন নুরুল ইসলাম। চার ভাই এক বোনের মধ্যে তিনি বড়। বাবা বড় শখ করে চার ভাইয়ের নামেই রেখেছিলেন ‘নুরু’ শব্দটি। ‘হ, আমার ছোট ভাইয়ের নাম নুরুল আমিন। তার পরেরটার নাম নুরুজ্জামান। আর সবচেয়ে ছোট ভাইটির নাম নুরুল হক।’ একই ধরনের নাম হওয়ায় সবাই সম্পূর্ণ নাম ধরে ডাকত তাঁদের।
নুরুল ইসলাম তখন খুব ছোট। তাঁর সন্তানহীন ফুপু তাঁকে নিয়ে যান নিজের কাছে, ঈশ্বরগঞ্জে। সেখানেই এক মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেন তাঁকে। এরপর কয়েকটা বছর, শুরু হলো যুদ্ধ। ভয়ে মা যেন আর থাকতে পারলেন না। নিয়ে এলেন ছেলেকে নিজের কাছে। ছেলের চিন্তায় মা-বাবা বিভোর। কত দিন আর ছেলে ঘুরবে ইতস্তত। যুদ্ধের সময় কয়েকজন হিন্দু জমি-জায়গা ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন। তাদেরই একটা ঘর মাত্র ৪০০ টাকায় কিনে নিলেন বাবা। তারপর সেখানেই দোকান তুলে দিলেন ছেলেকে। সেই শুরু তাঁর ব্যবসায়িক জীবনের। আর হয়ে ওঠেনি পড়াশোনা।
স্ত্রী রত্নার বাড়ি ছিল কিশোরগঞ্জে। বাবাই সাধ করে বিয়ে দিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। তাঁদের এক ছেলে তিন মেয়ে। দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে কিন্তু ছোট মেয়েটিকে আর টাকার অভাবে পড়ানো সম্ভব হলো না। ‘যুদ্ধের পর বাবা হইছিল গ্রাম-সরকার। মা তো আগেই মরে গেছিল। বাবাও একসময় আমাগোরে রেখে চলে গেল। কিছু করার জন্য আইলাম ঢাকায়। আমার এক মামাশ্বশুরের বাড়িতে উঠলাম। পরে কাজ নিলাম একটা। একদিন গুলিস্তানে এসে দেখি অনেকে গেঞ্জি বিক্রি করে। গ্রামে বাবাও একসময় গেঞ্জি বিক্রি করত। তাই কিস্তি নিয়ে শুরু করলাম এই কাজ। এহনও তা-ই করছি। ’
‘বাবার জমি-জায়গা কিছু ছিল না। আমিই করছিলাম কিছু জমি। কিছু আমাগো গ্রামে আর কিছু নেত্রকোনা শহরে। আমার ভাইরা আমার গ্রামের জমিটুকু নিয়ে নিয়েছে। আর শহরে যেটুক ছিল ঋণ শোধ করতে তো তাও বেইচ্চা ফালাইছি। এহন তো আমার আর কিছুই নাই। গ্রামেও এহন যাওয়া হয় কম।’ কষ্টে, রাগে, দুঃখে চোখ ভিজে আসে নুরুল ইসলামের।
গুলিস্তানের গোলাপ শাহ্ মাজার থেকে বঙ্গবাজারের দিকে আসতে গেলে বটতলার পাশেই স্যান্ডো গেঞ্জি, মোজা নিয়ে রোজ সকাল আটটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত বসেন নুরুল ইসলাম। কারও কিছু পছন্দ বা প্রয়োজন হলে কিনে নিয়ে যায়। বিক্রি করতে পেরে একটু খুশি হন নুরুল ইসলাম। কিন্তু দিনশেষে হিসাব যেন মেলে না। সারা দিন ধুলাবালুতে বসে থেকে লাভ হয় ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। তা ছাড়া ‘পুঁজিও এখন নাই। রোজ এর-ওর কাছ থেকে ধার করে মাল লয়ে আসি।’ আর সেই প্রশান্তি তো কবেই গেছে।
দুঃখ যেন বাসা বেঁধেছে নুরুল ইসলামের জীবনে। লাভ যত সীমিতই হোক এই কাজ করেই খাচ্ছিলেন নুরুল ইসলাম। কিন্তু সেটাও যেন সইল না। তিনি দিনভর যে চৌকিতে বসে বিক্রি করেন তা রাতে কাজ শেষে ফিরে যাওয়ার সময় একটা শিকল দিয়ে বেঁধে রেখে যান। কিন্তু কারা যেন শিকলটা চুরি করে নিয়ে গেছে আর ভেঙে রেখে গেছে চৌকিটা।
‘খুব কষ্টে আছি। এহন তো বইসাও কাম করতে পারি না। সারা দিন খাড়ায়া খাড়ায়া বিক্রি করি। চৌকি কিনতে গেলে এখন এক হাজার টাকা লাগব। কোথায় পামু। কোনো টুলও তো নাই আমার কাছে। শরীরটাও ভালা না। ছেলেটা কুরিয়ার সার্ভিসে কাজ করত, সেই কাজটাও নাই। আমাগো দিকে চাওনের মতো কেউই নাই। শুনছি বুড়া লোকদের টাকা দেওয়া হয়। কই, আমি তো পাইতাছি না। ঢাকায় যদি এখন মরি, তাইলে তো দাফনের কাপড়টুকুও মিলব না। আর গ্রামেও তো যাইতে পারতাছি না।’
তিনি বিড়বিড় করে বলতে থাকেন নিজের কষ্টগুলো। আমি নির্বাক শুনতে থাকি। জবাব দেওয়ার সামর্থ্য আমার নেই।
গ্রামের শান্ত-স্নিগ্ধ পরিবেশে দিনভর কাজ করলেও মনে থাকে প্রশান্তি। কিন্তু সেই সুখ আর সইল কোথায়! একটু বেশি বেচাকেনা হয় দেখে দুর্বৃত্তদের নজর পড়ল। ছয়-ছয়বার ডাকাতি হলো বাড়িতে। মমতাময়ী মা ছেলের প্রতি কুদৃষ্টির কথা চিন্তা করে বললেন, ‘যাউক বাবা, আর করণ লাগত না ব্যবসা।’ ব্যস শেষ হলো দোকানদারির পাট। সেই মমতাময়ী মা আর নেই, নেই সেই সুখের জীবনও।
নিজের গ্রামীণজীবনের কথা শোনাচ্ছিলেন নুরুল ইসলাম। চার ভাই এক বোনের মধ্যে তিনি বড়। বাবা বড় শখ করে চার ভাইয়ের নামেই রেখেছিলেন ‘নুরু’ শব্দটি। ‘হ, আমার ছোট ভাইয়ের নাম নুরুল আমিন। তার পরেরটার নাম নুরুজ্জামান। আর সবচেয়ে ছোট ভাইটির নাম নুরুল হক।’ একই ধরনের নাম হওয়ায় সবাই সম্পূর্ণ নাম ধরে ডাকত তাঁদের।
নুরুল ইসলাম তখন খুব ছোট। তাঁর সন্তানহীন ফুপু তাঁকে নিয়ে যান নিজের কাছে, ঈশ্বরগঞ্জে। সেখানেই এক মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেন তাঁকে। এরপর কয়েকটা বছর, শুরু হলো যুদ্ধ। ভয়ে মা যেন আর থাকতে পারলেন না। নিয়ে এলেন ছেলেকে নিজের কাছে। ছেলের চিন্তায় মা-বাবা বিভোর। কত দিন আর ছেলে ঘুরবে ইতস্তত। যুদ্ধের সময় কয়েকজন হিন্দু জমি-জায়গা ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন। তাদেরই একটা ঘর মাত্র ৪০০ টাকায় কিনে নিলেন বাবা। তারপর সেখানেই দোকান তুলে দিলেন ছেলেকে। সেই শুরু তাঁর ব্যবসায়িক জীবনের। আর হয়ে ওঠেনি পড়াশোনা।
স্ত্রী রত্নার বাড়ি ছিল কিশোরগঞ্জে। বাবাই সাধ করে বিয়ে দিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। তাঁদের এক ছেলে তিন মেয়ে। দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে কিন্তু ছোট মেয়েটিকে আর টাকার অভাবে পড়ানো সম্ভব হলো না। ‘যুদ্ধের পর বাবা হইছিল গ্রাম-সরকার। মা তো আগেই মরে গেছিল। বাবাও একসময় আমাগোরে রেখে চলে গেল। কিছু করার জন্য আইলাম ঢাকায়। আমার এক মামাশ্বশুরের বাড়িতে উঠলাম। পরে কাজ নিলাম একটা। একদিন গুলিস্তানে এসে দেখি অনেকে গেঞ্জি বিক্রি করে। গ্রামে বাবাও একসময় গেঞ্জি বিক্রি করত। তাই কিস্তি নিয়ে শুরু করলাম এই কাজ। এহনও তা-ই করছি। ’
‘বাবার জমি-জায়গা কিছু ছিল না। আমিই করছিলাম কিছু জমি। কিছু আমাগো গ্রামে আর কিছু নেত্রকোনা শহরে। আমার ভাইরা আমার গ্রামের জমিটুকু নিয়ে নিয়েছে। আর শহরে যেটুক ছিল ঋণ শোধ করতে তো তাও বেইচ্চা ফালাইছি। এহন তো আমার আর কিছুই নাই। গ্রামেও এহন যাওয়া হয় কম।’ কষ্টে, রাগে, দুঃখে চোখ ভিজে আসে নুরুল ইসলামের।
গুলিস্তানের গোলাপ শাহ্ মাজার থেকে বঙ্গবাজারের দিকে আসতে গেলে বটতলার পাশেই স্যান্ডো গেঞ্জি, মোজা নিয়ে রোজ সকাল আটটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত বসেন নুরুল ইসলাম। কারও কিছু পছন্দ বা প্রয়োজন হলে কিনে নিয়ে যায়। বিক্রি করতে পেরে একটু খুশি হন নুরুল ইসলাম। কিন্তু দিনশেষে হিসাব যেন মেলে না। সারা দিন ধুলাবালুতে বসে থেকে লাভ হয় ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। তা ছাড়া ‘পুঁজিও এখন নাই। রোজ এর-ওর কাছ থেকে ধার করে মাল লয়ে আসি।’ আর সেই প্রশান্তি তো কবেই গেছে।
দুঃখ যেন বাসা বেঁধেছে নুরুল ইসলামের জীবনে। লাভ যত সীমিতই হোক এই কাজ করেই খাচ্ছিলেন নুরুল ইসলাম। কিন্তু সেটাও যেন সইল না। তিনি দিনভর যে চৌকিতে বসে বিক্রি করেন তা রাতে কাজ শেষে ফিরে যাওয়ার সময় একটা শিকল দিয়ে বেঁধে রেখে যান। কিন্তু কারা যেন শিকলটা চুরি করে নিয়ে গেছে আর ভেঙে রেখে গেছে চৌকিটা।
‘খুব কষ্টে আছি। এহন তো বইসাও কাম করতে পারি না। সারা দিন খাড়ায়া খাড়ায়া বিক্রি করি। চৌকি কিনতে গেলে এখন এক হাজার টাকা লাগব। কোথায় পামু। কোনো টুলও তো নাই আমার কাছে। শরীরটাও ভালা না। ছেলেটা কুরিয়ার সার্ভিসে কাজ করত, সেই কাজটাও নাই। আমাগো দিকে চাওনের মতো কেউই নাই। শুনছি বুড়া লোকদের টাকা দেওয়া হয়। কই, আমি তো পাইতাছি না। ঢাকায় যদি এখন মরি, তাইলে তো দাফনের কাপড়টুকুও মিলব না। আর গ্রামেও তো যাইতে পারতাছি না।’
তিনি বিড়বিড় করে বলতে থাকেন নিজের কষ্টগুলো। আমি নির্বাক শুনতে থাকি। জবাব দেওয়ার সামর্থ্য আমার নেই।
No comments