গোধূলির ছায়াপথে-একটি বড় শূন্য by মুস্তাফা জামান আব্বাসী
অভিনেতা থেকে নেতা আসাদুজ্জামান নূর। পাশে বসে জিজ্ঞেস করলাম, কোনটা মজার? বললেন, দুটোই। দুটো দুই রকমের। নীলফামারীর হাটুরে বাহেরা যখন ছুটে এসে ভালোবাসা জানায় তখন এক রকম, নাটকে অভিনয়ের পর দর্শকের ভালোবাসার আপ্লুত দৃষ্টি যখন, তখন আরেক রকম।
বাবা আব্বাসউদ্দীনের ইচ্ছে ছিল আমি অভিনেতা হই, তাঁর জীবনের দুটি ইচ্ছার একটি। প্রথম জীবনে ব্যারিস্টার অভিমুখী ও পরের জীবনে অভিনেতা হওয়ার ইচ্ছা। তাঁর প্রথম ছেলে ব্যারিস্টার ও দ্বিতীয় ছেলে বিভিন্ন মঞ্চে অভিনয় করার শেষেও অভিনেতা হওয়ার স্বপ্ন থেকে দূরে।
পরিচালক এহেতশাম ১৯৫৯-এ চলচ্চিত্রে নায়কের ভূমিকায় অভিনয়ের অফার দিয়ে বসেন আমাকে দুম্ করে। নায়ক নাদিম তখনো নাজির বেগ, ঘোরাফেরা করছেন জীবিকার সন্ধানে। তখনো অফার পাননি, আমি পেয়েছিলাম। বাবা মৃত্যুশয্যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া শেষ হয়নি। জীবন থেকে অভিনয় সরে গেল। দূর থেকে বহু দূরে।
আবু হেনা মোস্তফা কামাল আমার সমসাময়িক। কবি-সুগায়ক, পরে অধ্যাপক। বললেন, সুজিতকে গানের লাইনে দিলাম। এ দেশে গানকে পেশা করা বেশ সাহসের ব্যাপার। বললাম, চিন্তা করবেন না। সময় বদলেছে। সুজিত পারবে। আসফুদ্দৌলা, আনোয়ারউদ্দিন খান ও আমি গানের লাইনে থেকেও পেশা হিসেবে নিতে পারিনি। আজও শিল্পী হইনি, অভিনেতা হইনি। কী হলাম? কিছুই না, একটি বড় শূন্য, এ বিগ জিরো।
শূন্যের কথা বলতে বসেছি। ’৬২ সালে সিএসএস পরীক্ষায় জিজ্ঞেস করলেন অনুসন্ধানী চোখ, জীবনের লক্ষ্য কী তোমার? বললাম, মানুষ হব, ভালো মানুষ। বললেন, বুঝলাম, কী ধরনের মানুষ? বললাম, শিল্পী হব, সাহিত্যিক হব। আটজোড়া চোখ একে অন্যের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। আমার উত্তর খাপছাড়া, লক্ষ্যশূন্য। বুঝতে পারছি, ফলাফল এগোচ্ছে শূন্যের দিকে। লিখিত পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেলেও মৌখিকে পেলাম জিরোর কাছাকাছি। অর্থাৎ টায়ে টায়ে পাস, তাতে চাকরি হয় না।
বড় চাকরি পেলাম হাইসন্স কোম্পানিতে। জেনারেল ম্যানেজার, ঈর্ষণীয় সুবিধা। বাদ সাধল কপাল। ৭০ জন কর্মচারী এসে বললেন, দেশ এখন স্বাধীন। এই বিশাল সম্পত্তি সরকারের কাছে নয়, লিখে দিন আমাদের নামে। দিইনি। নালিশ ঠুকে দিলেন সর্বোচ্চ ঠিকানায়। হলাম জিরো।
নিজের কোম্পানি খুললাম। দিন কতক ভালোই গেল। স্বাধীন হওয়ার প্রথম দিন থেকে যারা ঘর বেঁধেছে অসৎ চিন্তায়, তারা এগোতে পারবে কেমন করে। সামনে মিষ্টি হাসি, পেছনে ছুরি। বড় অফিসার আপ্লুত কণ্ঠে বললেন, আব্বাসী সাহেব, আমি আপনার বাবার ঘনিষ্ঠ, তাঁর গান বাজিয়েই আমার সকাল। আরেকজন বললেন, আপনার ভগ্নি জাতির সম্পদ। আরেকজন বললেন, আপনার ভাওয়াইয়া-ভাটিয়ালি আমি খুবই শ্রদ্ধার চোখে দেখি। যাঁরা যত ভালো ব্যবহার করেছেন, ব্যবসায়ী জীবনে (তিরিশ বছর) তাঁদের কাছ থেকে পেয়েছি ততটাই শূন্য। তাঁরা সবাই অসৎ তা বলছি না, সাহায্য পেয়েছি সামান্যই। কোটির ব্যবসায় ঘুষের প্রত্যক্ষ অংশীদারদের নামধাম বলে না দিয়েও ঘটনা জেনেছি ‘জীবন নদীর উজানে’-তে। সৎ থেকে অসৎকে পৃথক করা না পর্যন্ত পেছনে পড়ে থাকব আমরা। চুপ করে থেকে হজম না করার জন্য উপদেশ দিয়েছিলাম বন্ধুদের, যখন ছিলাম ঢাকা চেম্বারে পরিচালক, চার বছর। কেউ আমল দেয়নি সেদিন, দায়ে পড়ে আজ কিছুটা সোচ্চার।
আবু হেনা মোস্তফা কামালের কথায় আবার আসি। তিনি ছিলেন আমাদের কালের একজন জিনিয়াস, যেমন অধ্যাপনা, তেমনি কাব্য সাধনা, তেমনি মিষ্টি তাঁর গীত রচনা। একদিন বললেন, সকালে তোমার জন্য গান লিখেছি। দেখ, পছন্দ হয় কি না:
‘স্বপ্নঝরা নদীর বাঁকে আকাশ যখন কপোল রাখে সেইক্ষণে
তোমায় আমি দেখেছিলাম আমার চোখের অঞ্জনে’
এরপর:
‘মহুয়ার বনে বনে মৌমাছি ওড়ে মনবিলাসে
ঝিকিমিকি রোদ লাগে পলাশে’
আনোয়ারউদ্দিন খানের সুরে গানগুলো ফিরে আসে নতুন ব্যঞ্জনা নিয়ে যখন গাইতে বসি।
সবচেয়ে মজার হতো হেনা ভাইয়ের তীর্যক মন্তব্য। বেঁচে থাকলে আজ হয়তো আমার মতো কলাম লিখতেন। যা লিখতেন না পড়ে নিতে হতো তাঁর চোখের ভাষায়। একদিন একজন শিল্পীকে উপস্থাপনা করছেন টেলিভিশনে। প্রশংসাবাক্য ছুড়ে দিতে কার্পণ্য নেই তাঁর। সামনে পড়তেই তাকালেন আমার দিকে। আমার প্রশ্ন তাঁর চোখে চোখে, এই শিল্পীর জন্য এত প্রশংসা? আর ওঁর উত্তর ছিল চোখে চোখে, এ তো গানই শেখেনি। একটু বাড়িয়ে বললাম আর কী।
একদিন বললেন: জীবনে সবই পেলাম, পেলাম না জীবনকে।
ভাবছিলাম, আজ কেন তাঁর এই উদাসীন দার্শনিকতা। শূন্যতাবোধ মাঝেমধ্যে জীবন ছুঁয়ে যায় বৈকি। এ বিগ জিরো বা একটি বড় শূন্য আমি নিজেই। অপরিসীম শূন্যতার মাঝে জীবনের অন্বেষায় ব্যাপৃত।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: লেখক ও সংগীতব্যক্তিত্ব
mabbasi@dhaka.net
পরিচালক এহেতশাম ১৯৫৯-এ চলচ্চিত্রে নায়কের ভূমিকায় অভিনয়ের অফার দিয়ে বসেন আমাকে দুম্ করে। নায়ক নাদিম তখনো নাজির বেগ, ঘোরাফেরা করছেন জীবিকার সন্ধানে। তখনো অফার পাননি, আমি পেয়েছিলাম। বাবা মৃত্যুশয্যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া শেষ হয়নি। জীবন থেকে অভিনয় সরে গেল। দূর থেকে বহু দূরে।
আবু হেনা মোস্তফা কামাল আমার সমসাময়িক। কবি-সুগায়ক, পরে অধ্যাপক। বললেন, সুজিতকে গানের লাইনে দিলাম। এ দেশে গানকে পেশা করা বেশ সাহসের ব্যাপার। বললাম, চিন্তা করবেন না। সময় বদলেছে। সুজিত পারবে। আসফুদ্দৌলা, আনোয়ারউদ্দিন খান ও আমি গানের লাইনে থেকেও পেশা হিসেবে নিতে পারিনি। আজও শিল্পী হইনি, অভিনেতা হইনি। কী হলাম? কিছুই না, একটি বড় শূন্য, এ বিগ জিরো।
শূন্যের কথা বলতে বসেছি। ’৬২ সালে সিএসএস পরীক্ষায় জিজ্ঞেস করলেন অনুসন্ধানী চোখ, জীবনের লক্ষ্য কী তোমার? বললাম, মানুষ হব, ভালো মানুষ। বললেন, বুঝলাম, কী ধরনের মানুষ? বললাম, শিল্পী হব, সাহিত্যিক হব। আটজোড়া চোখ একে অন্যের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। আমার উত্তর খাপছাড়া, লক্ষ্যশূন্য। বুঝতে পারছি, ফলাফল এগোচ্ছে শূন্যের দিকে। লিখিত পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেলেও মৌখিকে পেলাম জিরোর কাছাকাছি। অর্থাৎ টায়ে টায়ে পাস, তাতে চাকরি হয় না।
বড় চাকরি পেলাম হাইসন্স কোম্পানিতে। জেনারেল ম্যানেজার, ঈর্ষণীয় সুবিধা। বাদ সাধল কপাল। ৭০ জন কর্মচারী এসে বললেন, দেশ এখন স্বাধীন। এই বিশাল সম্পত্তি সরকারের কাছে নয়, লিখে দিন আমাদের নামে। দিইনি। নালিশ ঠুকে দিলেন সর্বোচ্চ ঠিকানায়। হলাম জিরো।
নিজের কোম্পানি খুললাম। দিন কতক ভালোই গেল। স্বাধীন হওয়ার প্রথম দিন থেকে যারা ঘর বেঁধেছে অসৎ চিন্তায়, তারা এগোতে পারবে কেমন করে। সামনে মিষ্টি হাসি, পেছনে ছুরি। বড় অফিসার আপ্লুত কণ্ঠে বললেন, আব্বাসী সাহেব, আমি আপনার বাবার ঘনিষ্ঠ, তাঁর গান বাজিয়েই আমার সকাল। আরেকজন বললেন, আপনার ভগ্নি জাতির সম্পদ। আরেকজন বললেন, আপনার ভাওয়াইয়া-ভাটিয়ালি আমি খুবই শ্রদ্ধার চোখে দেখি। যাঁরা যত ভালো ব্যবহার করেছেন, ব্যবসায়ী জীবনে (তিরিশ বছর) তাঁদের কাছ থেকে পেয়েছি ততটাই শূন্য। তাঁরা সবাই অসৎ তা বলছি না, সাহায্য পেয়েছি সামান্যই। কোটির ব্যবসায় ঘুষের প্রত্যক্ষ অংশীদারদের নামধাম বলে না দিয়েও ঘটনা জেনেছি ‘জীবন নদীর উজানে’-তে। সৎ থেকে অসৎকে পৃথক করা না পর্যন্ত পেছনে পড়ে থাকব আমরা। চুপ করে থেকে হজম না করার জন্য উপদেশ দিয়েছিলাম বন্ধুদের, যখন ছিলাম ঢাকা চেম্বারে পরিচালক, চার বছর। কেউ আমল দেয়নি সেদিন, দায়ে পড়ে আজ কিছুটা সোচ্চার।
আবু হেনা মোস্তফা কামালের কথায় আবার আসি। তিনি ছিলেন আমাদের কালের একজন জিনিয়াস, যেমন অধ্যাপনা, তেমনি কাব্য সাধনা, তেমনি মিষ্টি তাঁর গীত রচনা। একদিন বললেন, সকালে তোমার জন্য গান লিখেছি। দেখ, পছন্দ হয় কি না:
‘স্বপ্নঝরা নদীর বাঁকে আকাশ যখন কপোল রাখে সেইক্ষণে
তোমায় আমি দেখেছিলাম আমার চোখের অঞ্জনে’
এরপর:
‘মহুয়ার বনে বনে মৌমাছি ওড়ে মনবিলাসে
ঝিকিমিকি রোদ লাগে পলাশে’
আনোয়ারউদ্দিন খানের সুরে গানগুলো ফিরে আসে নতুন ব্যঞ্জনা নিয়ে যখন গাইতে বসি।
সবচেয়ে মজার হতো হেনা ভাইয়ের তীর্যক মন্তব্য। বেঁচে থাকলে আজ হয়তো আমার মতো কলাম লিখতেন। যা লিখতেন না পড়ে নিতে হতো তাঁর চোখের ভাষায়। একদিন একজন শিল্পীকে উপস্থাপনা করছেন টেলিভিশনে। প্রশংসাবাক্য ছুড়ে দিতে কার্পণ্য নেই তাঁর। সামনে পড়তেই তাকালেন আমার দিকে। আমার প্রশ্ন তাঁর চোখে চোখে, এই শিল্পীর জন্য এত প্রশংসা? আর ওঁর উত্তর ছিল চোখে চোখে, এ তো গানই শেখেনি। একটু বাড়িয়ে বললাম আর কী।
একদিন বললেন: জীবনে সবই পেলাম, পেলাম না জীবনকে।
ভাবছিলাম, আজ কেন তাঁর এই উদাসীন দার্শনিকতা। শূন্যতাবোধ মাঝেমধ্যে জীবন ছুঁয়ে যায় বৈকি। এ বিগ জিরো বা একটি বড় শূন্য আমি নিজেই। অপরিসীম শূন্যতার মাঝে জীবনের অন্বেষায় ব্যাপৃত।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: লেখক ও সংগীতব্যক্তিত্ব
mabbasi@dhaka.net
No comments