গণমাধ্যম-‘তোমাকেই খুঁজছে বাংলাদেশ’! by সুমন রহমান

আপনি কি সেলিব্রিটি? পাঠক, প্রশ্নটা আপনাকেই করছি। এই প্রশ্নে ভড়কে যাওয়ার কোনো কারণ নেই, বিশেষত অযুত গণমাধ্যম-অধ্যুষিত বাংলাদেশে। আপনার সামনে গোটাদশেক টেলিভিশন চ্যানেলের গোটা অর্ধশত রিয়েলিটি শোর যেকোনো একটিতে আপনি অংশগ্রহণ করতেই পারেন।


আপনি হতে পারেন ক্লোজ-আপ ওয়ান, শাহ সিমেন্ট নির্মাণ শ্রমিক কিংবা ম্যাজিক তিন চাকার তারকা, ইত্যাদি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের বিশেষ আকর্ষণ, রকমারি টক শোর নিয়মিত অতিথি, লাক্স-চ্যানেল আই সেরা সুন্দরী, প্রথম আলোর সেরা তারুণ্য, এফএম রেডিওর জকি এবং আরও বহু কিছু। আবার আপনি হতেই পারেন বাংলা ব্লগোস্ফিয়ারের গুরুত্বপূর্ণ লেখক, আপনার ফেসবুক নোট হতে পারে বহুলপঠিত, আপনার বানানো ভিডিও কিংবা আপনার তোলা আলোকচিত্র ইউটিউবে বা ফ্লিকারে আপনাকে প্রচুর জনপ্রিয়তার উপলক্ষ এনে দিতেই পারে। ফলে, আপনাকে স্রেফ আমার মতো নগণ্য লেখকের নাদান পাঠক ভাবার কোনো অবকাশ নেই, কোনো না কোনোভাবে দেখা যাবে আপনিও তারকা। সেলিব্রিটি।
তর্কের খাতিরে না হয় ধরেই নিই যে দুর্ভাগ্যবশত আপনি এখনো সেলিব্রিটি নন। আপনার গানের গলা ভালো না, গুছিয়ে ঠিক কথা বলতে পারেন না, লেখালেখির অভ্যাস নেই, ছবি তোলা বা ভিডিও করার বাতিকও নেই, ইন্টারনেটে যান না এবং দেখতেও ভালো নন। পাঠক, ভেবে দেখুন তো নিজের ওপরে ঠিক এতগুলো ‘না’ কবুল করতে মন চায় কি না? নিশ্চয়ই মানবেন, কোথাও না কোথাও আপনার সেলিব্রিটি হয়ে ওঠার দারুণ সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে, শুধু তার পরিচর্যা দরকার। এত দিন সে সুযোগ ছিল না, এখন তা আপনার দোরগোড়ায় এনে দিয়েছে গণমাধ্যম। তার এত রকমের রেসিপি, এর যেকোনো একটাতে আপনার খাপে-খাপ হয়ে যেতেই পারে। তখন আপনাকে ঠেকায় কে? আপনিই সেলিব্রিটি, আগামীর! আপনাকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে বাংলাদেশ!
আমি যেসব সেলিব্রিটির কথা এখানে বলছি, তাঁরা কেউ সাবেকি সেলিব্রিটিদের মতো বাক্সবন্দী নন। আপনি শপিং করছেন কোনো মলে, অপরিসর লিফটে দুয়েকজন লাক্সসুন্দরীর সঙ্গে আপনার মোলাকাত হয়ে যেতে পারে; খালি ভেবে ‘এই সিএনজি’ হাঁক দিতেই দেখলেন ভেতরে বসে আছেন ক্লোজ-আপ ওয়ান তারকা মাহাদী বা সালমা; চাকরি থেকে বছর দুই আগে অবসর নেওয়া আপনার শ্বশুরমশাই হঠাৎ করেই হয়ে উঠতে পারেন কোনো টক-শোর ব্যস্ততম অতিথি; আপনার বাড়িওয়ালার স্ত্রী হয়তো ইতিমধ্যেই বার-দুই ডাক পেয়েছেন সিদ্দিকা কবীরের রেসিপির অনুষ্ঠানে; আপনি রিকশায় উঠে দেখলেন যে সেটা চালাচ্ছেন তিন চাকার তারকা ওমর আলী; হরতালের দিন রিকশা শেয়ার করে যাচ্ছেন কোথাও, পাশের লোকটাকে খুব চেনা-চেনা লাগছে, হঠাৎই ধরতে পারলেন যে আপনার রিকশাসঙ্গী আর কেউ নন, এভারেস্ট-বিজয়ী মুসা ইব্রাহীম!
আপনার চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এই যে তারকারাজি, আটপৌরে-প্রায় সেলিব্রিটিসমাজ, এটা কিন্তু নতুন ঘটনা। গণমাধ্যম প্রতিনিয়ত তাদের উৎপাদন করছে। এটা একটা নিয়ত চলমান প্রক্রিয়া: ফলে আগের বছরের মলিন হয়ে যাওয়া এক সেট তারকার বদলে নতুন বছরে আপনি পাচ্ছেন ঝকঝকে নতুন এক সেট সেলিব্রিটি। যেমন, ক্লোজ-আপ ওয়ান-এর প্রথম ১০ জনের সবাই তারকাখ্যাতি পান। ২০০৫ থেকে চলমান এই অনুষ্ঠান সেই হিসেবে মাত্র চার বছরে গোটা চল্লিশেক তারকার জন্ম দিয়েছে। একই কথা খাটে লাক্স-চ্যানেল আইয়ের ক্ষেত্রেও। তবে, এই উৎপাদিত তারকাস্রোতকে অক্ষয় করে রাখার ব্রত গণমাধ্যম নেয় না। একজন যখন ক্লোজ-আপ তারকা হন, তিনি প্রথমে টেলিভিশনে নন্দিত হন, তারপর তার অডিও অ্যালবাম বেরোয়, কাগজে সাক্ষাৎকার আসে, টক-শোতে ডাক পান, লাইভ অনুষ্ঠানে গান গাইবার আমন্ত্রণ পান দেশে ও বিদেশে। এভাবে তিনি তাঁর অমরতার রাস্তা বানাতে থাকেন। সবাই পারেন না, অনেকেই ঝরে যান। ঝরে-পড়া তারাদের কথা আকাশই মনে রাখে না, গণমাধ্যম তো কোন ছার! সে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন তারকার উৎপাদনে ব্যস্ত। এই ঝরে-পড়া তার পরিকল্পনারই অংশ।
প্রশ্ন হচ্ছে, গণমাধ্যম হঠাৎ করে আমজনতার মধ্যে এমন গরুখোঁজার মতো তারকা খুঁজতে শুরু করল কেন? এক কথায় এর উত্তর দেওয়া কঠিন। গণমাধ্যম-বিশেষজ্ঞ জন হার্টলি মনে করেন এটা গণমাধ্যম এবং সমাজব্যবস্থার গণতন্ত্রায়ণের (democratic turn) ফলে ঘটছে। আবার গ্রায়েম টার্নারের মতে, গণমাধ্যম সাধারণ্যে মুখ ঘুরিয়েছে (demotic turn) সত্যি, কিন্তু এর মধ্যে ‘গণতান্ত্রিকতা’ কতটুকু আছে সন্দেহ। প্রথমত, আমজনতা থেকে প্রতিনিয়ত তারকা উৎপাদনের এই প্রক্রিয়া গণমাধ্যমে বিদ্যমান রিয়েলিটি শোগুলোকে স্থায়িত্ব দেয়। ফলে সে একদিকে যেমন ব্যয়-সাশ্রয়ী হয়ে ওঠে, অন্যদিকে তার দর্শকের মধ্যে উচ্চাভিলাষ জাগানোর মাধ্যমে আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। দ্বিতীয়ত, নতুন নতুন তারকাপ্রবাহ গণমাধ্যমকে সমাজের সাংস্কৃতিক পরিচয় বিনির্মাণের স্বাধীনতা দেয়। কারণ, এই নতুন সেলিব্রিটিরা স্বীয় গণমাধ্যমের পতাকা বাই-ডিফল্ট বহন করেন, ক্ষীণ আয়ুর কারণেই হয়তো তাঁদের ব্যক্তিত্ব গণমাধ্যমের রাজনীতির জন্য নিরাপদ থাকে। এভাবে, নতুন নতুন তারকাপ্রবাহের মাধ্যমে গণমাধ্যম প্রতিনিয়ত নিজের ভেতরে ঢুকে নিজেকেই পুনর্নির্মাণ করে চলেছে। জ্যাঁ বদ্রিয়াঁ যাকে বলেন ‘দ্য ইমপ্লোসন অব মিডিয়া’। আপনি নিশ্চয়ই মানবেন যে গণমাধ্যম ইদানীং শুধু ‘মাধ্যম’ নয় আর, পুরোদস্তুর নির্মাতা হয়ে উঠেছে। সমাজের সাংস্কৃতিক পরিচয় বিনির্মাণের দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছে সে নিজে নিজেই।
এই যে অসংখ্য রিয়েলিটি শো, অনন্ত বিস্তৃত ইন্টারনেটের স্বাধীন চারণভূমি, সেখানে আমজনতার এই তারকালীলা কিন্তু বাংলাদেশেই প্রথম শুরু হয়নি। বরং বাংলাদেশ খানিকটা পরেই সেই ইঁদুরদৌড়ে শামিল হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় রিয়েলিটি শো বিগ ব্রাদার বা আমেরিকান আইডল বিশ্বের নানান দেশে নানান উপায়ে পুনরুৎপাদন করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের তুলনামূলকভাবে কম বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থার একটি যোগাযোগ-প্রক্রিয়াকে ভারত কিংবা বাংলাদেশের মতো দেশের নির্বিচারে অনুসরণ করার বিপদ আছে অনেক। যুক্তরাষ্ট্রে ‘আমজনতা’ বলতে যা বোঝায়, আমাদের মতো প্রকট শ্রেণীবৈষম্য ও নানান স্তরের দারিদ্র্যের দেশে সেটা বোঝা মুশকিল। ২০০৮ সালে এটিএন বাংলা টেলিভিশনের আলোচিত অনুষ্ঠান তিন চাকার তারকা নিয়ে একটি প্রবন্ধে আমি দেখাতে চেষ্টা করেছি কীভাবে এই নবলব্ধ তারকাখ্যাতি গরিব রিকশাচালকদের দীর্ঘস্থায়ী পরিচয়সংকটে ফেলে দিয়েছে, তাঁদের বিদ্যমান দারিদ্র্যের কোনো উপশম না করেই। অবশ্য দারিদ্র্যের উপশম গণমাধ্যমের কাজ নয়, রাষ্ট্রের কাজ। এমনকি সাংস্কৃতিক পরিচয় বিনির্মাণকেও রাষ্ট্র নিজের এখতিয়ারভুক্ত কাজ ভাবে, যার ফলে সে সব সময় গণমাধ্যমকে তেরচা চোখে দেখে। নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। কিন্তু গণমাধ্যম রাবণের দশমুণ্ডুর মতো যেভাবে বিন্দু বিন্দু সম্ভাবনা ও প্রযুক্তির অগ্রগতিকে আঠারো আনা কাজে লাগিয়ে বিকশিত হয়ে চলেছে, মান্ধাতার আমলের রাষ্ট্রীয় পলিসি দিয়ে তার মতিগতি বোঝাই দুষ্কর, নিয়ন্ত্রণ তো পরের আলাপ। এই কিছুদিন আগেও জিপিও একটা ই-মেইল শাখা চালু করার তোড়জোড় করছিল, খোদা মালুম কেন!
যাক। সমাজের সাংস্কৃতিক পরিচয় বিনির্মাণ নিয়ে রাষ্ট্র ও গণমাধ্যমের মধ্যে এই বিসম্বাদ উত্তরোত্তর বাড়বে বলেই মনে হয়। কিন্তু তাতে আপনার সেলিব্রিটি হওয়া আটকাবে না। নানা রকম গণমাধ্যমের হাজারো রকম গলিঘুপচির ভেতর কোথাও না কোথাও আপনার জন্য চেয়ার পাতা আছে, সন্দেহ নেই। প্রিয় পাঠক, হে অদূর ভবিষ্যতের সেলিব্রিটি, আপনাকে আগাম সালাম!
ব্রিজবেন, অস্ট্রেলিয়া
সুমন রহমান: কবি, গল্পকার।

No comments

Powered by Blogger.