পার্বত্য চট্টগ্রাম-প্রথাগত মালিকানার স্বীকৃতি আগে, তারপর জরিপ by জোবাইদা নাসরীন

পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে রাষ্ট্রীয় ভাবনা বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। সাম্প্রতিককালে প্রজ্ঞাপন জারি করে ‘উপজাতি’ হিসেবে পরিচয় করানো এবং ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বিল’-এর নামকরণ এই এলাকার আদিবাসী জনগণের জন্য নতুন সংকট তৈরি করেছে।


এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বহু পুরোনো কিন্তু অতি জরুরি একটি প্রসঙ্গ—এই এলাকার ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি। ভূমি সমস্যার সমাধান পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগণের দীর্ঘদিনের দাবি। কিন্তু ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির কিছু প্রাথমিক শর্তকে পাশ কাটিয়ে আবারও তৃতীয় দফায় ভূমি জরিপের ঘোষণা দিয়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের চেয়ারম্যান। তাঁর ভূমি জরিপের ঘোষণার শুধু বিরোধিতাই নয়, এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সহায়তা কামনা করেছেন কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য বোমাং, মং এবং চাকমা সার্কেলের তিন রাজা (প্রথম আলো, ১৫ জুলাই ২০১০)। প্রথম আলোর প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, তাঁরা মনে করেন এখনই এই জরিপ হলে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সম্পাদিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির (ঘ) ধারা লঙ্ঘন করা হবে। এই ধারায় এই বিষয়ে স্পষ্টভাবে লেখা আছে, ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী, অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুর পুনর্বাসনের পর সরকার এই চুক্তি অনুযায়ী গঠিত আঞ্চলিক পরিষদের সঙ্গে আলোচনাক্রমেই পার্বত্য চট্টগ্রামের জরিপকাজ শুরু করবে। চুক্তি মোতাবেক আঞ্চলিক পরিষদের সঙ্গে আলোচনা করার কথা থাকলেও জরিপের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে সেটিকে অগ্রাহ্য করে কমিশনের চেয়ারম্যানের এই ঘোষণা রাষ্ট্রের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের সম্পর্ককে নতুন রূপ দিতে পারে। যে চুক্তিই হলো এই কমিশন গঠনের ভিত্তি, সেই চুক্তির ধারা অগ্রাহ্য করে কীভাবে কমিশন কাজ করছে?
এর আগে চলতি বছরের ১৭ মার্চ পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের সচিব আবদুল হামিদ স্বাক্ষরিত একটি গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। সেই বিজ্ঞপ্তিতে ভূমি সমস্যা সমাধানের জন্য শরণার্থীদের থেকে আবেদনপত্র আহ্বান করা হয় এবং আবেদনের সময়সীমা ৬০ দিন বেঁধে দেওয়া হয়। সেই বিজ্ঞপ্তি নিয়েও কমিশনের মধ্যেই পক্ষ-বিপক্ষ তৈরি হয়েছিল। কমিশনের বেশির ভাগ আদিবাসী সদস্যই দাবি করেছিলেন, তাঁরা এই বিজ্ঞপ্তির বিষয়ে কিছুই জানতেন না। তাঁদের সঙ্গে আলোচনা না করেই এবং তাঁদের সম্মতি ছাড়াই এই বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে। প্রশ্ন হলো, পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি বিরোধ কি শুধুই শরণার্থী বিষয়টির সঙ্গে যুক্ত? অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুরা কোথায় গেল? কেনইবা শুধু শরণার্থীদের আবেদন করতে বলা হলো?
আদিবাসীদের প্রথাগত আইনে জমির মালিকানার প্রসঙ্গটি এই সময়ে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। চুক্তির (ঘ) ৬ (খ) ধারা অনুযায়ী, কমিশন পার্বত্য চট্টগ্রামের আইন, রীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী বিরোধ নিষ্পত্তি করবেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগণের অধিকাংশেরই জমির কাগুজে মালিকানা নেই। তাদের বেশির ভাগই ভূমির মালিকানা প্রথাগত আইন অনুযায়ী, কাগজনির্ভর নয়। তাই তাঁদের মধ্যে যাঁরা জমি হারিয়েছেন কিংবা তাঁদের জমি অন্যের দখলে চলে গিয়েছে সেটি মীমাংসা না করে কীভাবে ভূমি জরিপ হবে? এ ক্ষেত্রে প্রথাগত মালিকানার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি আগে প্রয়োজন। ভূমি জরিপের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট জমির সীমানা, আয়তন এবং বর্তমানে ভোগকারী কিংবা দখলদারের পরিচয় পাওয়া যাবে, কিন্তু জমিটির সত্যিকার মালিকের পরিচয় বের করা কঠিন হবে। কাগুজে মালিকানাহীন জমি দখল করে কাগুজে দলিল তৈরি করে জমির মালিকানা পেয়েছেন অনেকেই, তাঁরা এই জরিপে জমির মালিক হিসেবে রাষ্ট্রীয় বৈধতা পাবেন—এই আশঙ্কা করছেন আদিবাসীরা। তাহলে বর্তমান দখলদারির পরিচয় জানা এবং রাষ্ট্রীয় দলিলে ঢুকে পড়ার জন্যই কি প্রথমেই ভূমি জরিপ করা? পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বিরোধ মীমাংসা জটিল ও সময়সাপেক্ষ। তাই জরিপের আগেই শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের ভূমি ফিরিয়ে দিতে হবে। তা না হলে ভূমির সত্যিকারের মালিকেরা চিরদিনের জন্য ভূমিহারা হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যাবে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে সমস্যা আরও গভীরতর হবে।
এর আগে দুই দফায় এই জরিপকাজের ঘোষণা দিয়েছিল কমিশন। সর্বশেষ এই জরিপের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল ১৫ অক্টোবর ২০০৯ থেকে ১৫ মার্চ ২০১০ (মোট পাঁচ মাস) পর্যন্ত। পার্বত্য চট্টগ্রামের মতো একটি জটিল ভূমি সমস্যা যেখানে রয়েছে, সেখানে ভূমি জরিপের জন্য পাঁচ মাস সময় নির্ধারণ কমিশনের বাঙালি সদস্যদের পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে অস্বচ্ছ ধারণার ইঙ্গিত বহন করে। বারবার ঘোষণা দেওয়া সত্ত্বেও সেটি শুরু করা যায়নি। কারণ এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে আদিবাসী জনগণের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির কতগুলো পূর্বশর্তকেই অগ্রাহ্য করা হয়েছিল। আদিবাসীরা প্রতিবাদ করেছিল। এবারও তার পুনরাবৃত্তি হয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায় যে কমিশনের চেয়ারম্যান বলেছেন, কমিশনের আইন অনুযায়ী দ্রুত রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে জরিপকার্য শুরু করতে হবে: ‘জরিপ শুরু না করলে কমিশনের কোনো কাজই থাকবে না।’ কথা হলো, কমিশনের কোনো কাজ না থাকলেই কি ভূমি জরিপ করতে হবে? আর ভূমি জরিপ ছাড়া কোনো কাজ নেই কমিশনের? কমিশনের আদিবাসী সদস্যদের মতামত উপেক্ষা করে চেয়ারম্যান যখন এককভাবে ভূমি জরিপের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন সে ক্ষেত্রে এই জরিপের ওপর আদিবাসী জনগণের কি আস্থা থাকবে? যদি চেয়ারম্যানের এই সিদ্ধান্তের প্রতি আদিবাসী জনগণের আস্থা এবং সমর্থন না থাকে তাহলে কি শুধু কাজের ধোঁয়া তোলার জন্যই এই ভূমি জরিপ?
জানা গেছে, আদিবাসীদের ভূমি ফিরিয়ে দেওয়ার আগে ভূমি জরিপের বিরোধিতা করেছেন কমিশনের আদিবাসী সব সদস্যই। যাদের সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ তাদের মতামতকে কেন উপেক্ষা করা হবে? যাদের ‘উন্নয়ন’ বা ‘মঙ্গলে’র জন্য এই কমিশন করা, তাদের আকাঙ্ক্ষা বা চাহিদাকে একেবারে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হলে আসলে কমিশনের মাধ্যমে ‘মঙ্গল’ কার হবে?
কমিশন এবং বিশেষ করে কমিশনের চেয়ারম্যানকে আরেকটি বিষয়ে নজর দেওয়া প্রয়োজন: ১৯৭৯ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত বিভিন্ন হত্যাকাণ্ড, সেনাবাহিনী-শান্তিবাহিনীর মধ্যকার সংঘর্ষ প্রভৃতি কারণে, পার্বত্য চট্টগ্রাম শরণার্থী বিষয়ক টাস্কফোর্সের হিসাব অনুযায়ী, প্রায় ৭৫ হাজার মানুষ শরণার্থী হয়েছেন। তাদের জমি হাতছাড়া হয়েছে। এর পাশাপাশি দফায় দফায় ‘উন্নয়নের’ নামে দরিদ্র বাঙালির রাষ্ট্রীয় বসতি (যেহেতু এখনো সরকার তাদের রেশন দিয়ে যাচ্ছে), ‘জাতীয় স্বার্থ’র নামে সেনাবাহিনীর জন্য ভূমি অধিগ্রহণসহ নানা কারণে সেখানকার আদিবাসীদের জমি ছাড়া হতে হয়েছে। তাঁরা অনেকেই হয়েছেন অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু। কাগুজে মালিকানা না থাকায় জমির অবৈধ দখল নেওয়া অনেক সুবিধাজনক। রাষ্ট্রীয় আইন এবং প্রথাগত আইনের ফারাকের সুযোগে ভূমিহীন হতে হয়েছে অনেক আদিবাসী পরিবারকে। তাই ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির আগে বিবেচনায় নিতে হবে ভূমি বিরোধের কারণগুলো। কোনোভাবেই তা ভূমি জরিপের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয়, আর জরিপের মাধ্যমে এগুলো সমাধানের পথও দেখা যাবে না।
তবে আশার কথা, কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি খাদেমুল ইসলাম চৌধুরী তাঁর আগের অবস্থান থেকে সরে এসে এখন বলছেন, ‘জরিপ আর বিরোধ নিষ্পত্তি কোনটি আগে-পরে হবে, সেটি আইনে লেখা নেই।’ তিনি এবং চাকমা সার্কেলের প্রধান রাজা দেবাশীষ রায় শিগগিরই পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান এবং কমিশনের সব সদস্যকে নিয়ে কমিশনের পূর্ণাঙ্গ বৈঠক অনুষ্ঠানের ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। (প্রথম আলো, ৩০ জুলাই ২০১০) আমাদের প্রত্যাশা, অবিলম্বে ভূমি জরিপের বর্তমান উদ্যোগ বন্ধ করে কমিশন আঞ্চলিক পরিষদের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে এবং কমিশনের আদিবাসী সদস্যদের মতামত এবং অন্যদের সমর্থন নিয়ে একটি আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির কাজে এগিয়ে যাবেন।
জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
zobaidanasreen@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.