চারদিক-পাতাম বানানোর গ্রাম by মৃত্যুঞ্জয় রায়
গ্রামের নামটা রাধামাধবপুর না হয়ে কামারপাড়া বা কামারগ্রাম হলেই ভালো হতো। কামারগাতী হলেও চলত। কেননা, ওই গ্রামে ঢুকলে চারদিক থেকে কেবল হাতুড়ি পেটানোর শব্দ, লোহা-লক্কড়ের ঝনঝন আওয়াজ আর হাপরের বাতাস এসে কানে লাগে। যে গ্রামের অধিকাংশ লোকই কামার, সে গ্রামের নাম রাধামাধবপুর ঠিক মানায় না।
কিন্তু গ্রামের নাম কী ইচ্ছে করলেই বদলানো যায়? শত শত বছর ধরে লোকেরা ওই গ্রামকে রাধামাধবপুর বলেই জানে। অথচ ভূগোলের কি তামাশা! এ গাঁয়ের পাশের গ্রামের নামই কামারগাতী, যেখানে কোনো কামার নেই। কেন নেই, তার উত্তর আমারও জানা নেই।
খুলনার খালিশপুরের ক্রিসেন্ট ঘাট দিয়ে ভৈরব নদ পার হয়ে মোটর বাইক ছুটে চলল সরু রাস্তা বেয়ে ওই গাঁয়ের দিকেই। রাস্তার দুই ধারে মৃত পাটকলগুলোর শবদেহ। আহা কী রোশনাই না ছিল একদিন ওই পাটকলগুলোর! লোকে লোকারণ্য, ছাপরা-ছাউনিতে গিজ গিজ করত পাটকল এলাকা। কিন্তু কিসে যে কী হয়ে গেল! পাটকলগুলো একে একে বন্ধ হলো, লোকজন চাকরি হারাল, নদী দিয়ে পাটভর্তি নৌকার আনাগোনাও থেমে গেল। শিল্পনগর খুলনার এ অংশে নেমে এল অন্ধকার। পাটের সুদিন ফিরে এলেও খুলনার এ অঞ্চলের সেই সুদিন আর ফিরে আসবে কি না, তা কেউ জানে না। এসব ভাবতে ভাবতে সরওয়ার কাকার মোটর বাইকে সওয়ার হয়ে ছুটে চললাম দিঘলিয়া উপজেলার ওই গ্রামটির দিকে। দুই পাশে আমনের খেত, পানের বরোজ, ইট বিছানো রাস্তা। অবশেষে ঘন গাছগাছালির ছায়াময় সে গ্রামটিতে গিয়ে হাজির হলাম। গাঁয়ের কোলে ভৈরব সেখানে বেশ প্রশস্ত, আকাশে টলটল আষাঢ়ের মেঘ।
ভৈরবের কূলে অসংখ্য নারকেল-সুপারির বীথি। পাড় ভাঙছে, বুড়ো মানুষের দাঁতের মতো গোড়া নড়ছে কোনো কোনো গাছগাছালির। তারই ছায়ায় বসে বুড়ো মতোন এক ছুতোর নৌকা গড়ে চলেছেন। নৌকার গলুই তৈরির জন্য পাট পাট করে তক্তা জোড়ার কাজ চলছে। জোড়া দেওয়া হচ্ছে পেরেক বা ফেভিকল দিয়ে না, এক বিশেষ বস্তু দিয়ে। ইস্পাতের সে বস্তুটার নাম পাতাম। প্রায় আড়াই ইঞ্চি লম্বা চ্যাপ্টা পুরু ইস্পাতের পাত দিয়ে তৈরি করা হয়েছে পাতাম। পাতামের দুই প্রান্ত তেরছা করে কাটা। দুই প্রান্ত দুটি তক্তার জোড়ার মুখে ঢুকিয়ে পিটিয়ে সিঁধিয়ে দেওয়া হচ্ছে পাতাম। ঘন ঘন করে ওটা দিয়েই একের পর এক তক্তা জুড়ে শেষে বানানো হচ্ছে নৌকা। নৌকার দেশে ওই পাতাম তৈরির কারিগর আর গ্রামের খোঁজেই এত দূর আসা। যত দূর খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই বস্তুটা এ গ্রাম ছাড়া আর কোথাও তৈরি হয় না।
রাধামাধবপুর গাঁয়ে পাতাম তৈরির একটা ইতিহাস আছে। পাতাম কারিগর সুভাষ বালা বললেন, তাঁর বাবা পুলিন বালা ভারতের ইছাপুরে বন্দুকের ফ্যাক্টরিতে কাজ করতেন। বন্দুক বানাতেন। বন্দুকের গুলিও বানাতেন। সেটা ব্রিটিশ-পাকিস্তান আমলের কথা। সাতচল্লিশের পর একসময় চাকরি ছেড়ে দিয়ে এ দেশে চলে আসেন। তখন কলকাতাতেই ছেনি দিয়ে ইস্পাতের পাত কেটে পাতাম তৈরি করা হতো। সেসব পাতাম আসত এ দেশে। তিনি এসে এ দেশে প্রথম পাতাম তৈরির কাজ শুরু করেন। এ গাঁয়েই কয়েকজনকে নিয়ে গড়ে তোলেন পাতাম তৈরির কাজ। তখন মেশিন ছিল না, ইস্পাতের পাত ছেনি দিয়ে কেটে কেটে পাতাম তৈরি করা হতো। তাই অনেক কারিগর লাগত। এভাবে এ গাঁয়ে পাতাম তৈরির কারিগর ও কারখানা বাড়তে লাগল। পাতামের চাহিদাও বাড়তে লাগল। ধীরে ধীরে রাধামাধবপুর পরিণত হলো পাতাম তৈরির গাঁয়ে। তাঁর বাবা এখন বেঁচে নেই, কিন্তু বাবাকে নিয়ে তাঁর অনেক গর্ব। কেননা, একাত্তরে তিনি ওই হাতুড়ে পাতাম তৈরির কারখানাতেই মুক্তিযোদ্ধাদের বন্দুক মেরামত করে দিতেন, এমনকি কয়েকটা নতুন বন্দুকও তৈরি করে দিয়েছিলেন। একাত্তরে জীবনের ঝুঁকি নিয়েও তিনি পাতাম তৈরির আড়ালে দেশের জন্য ওটুকু কাজ করতেন পরম উৎসাহে।
এখন এ গাঁয়ে ২০ ঘর লোক আছে, যাদের প্রত্যেকের পাতাম তৈরির মেশিন আছে এবং নিয়মিত পাতাম তৈরি করে চলেছেন। সারা দেশে পাতামের এত চাহিদা যে মাত্র ২০ ঘর লোকে পাতাম তৈরি করে এখন কুলিয়ে ওঠা যাচ্ছে না। সুভাষ বালা দাবি করেন, দেশের মধ্যে একমাত্র রাধামাধবপুরেই পাতাম তৈরি হয়। ভাদ্র থেকে জ্যৈষ্ঠ পর্যন্ত পাতামের চাহিদা থাকে সবচেয়ে বেশি। ও সময় তৈরি করা পাতাম মোটেই ঘরে জমে থাকে না। বছরের অন্য সময় একটু কম চলে। খুলনার শেখপাড়া থেকে জাহাজের স্ক্র্যাপ কিনে তারা মেশিনে কেটে পাতাম তৈরি করেন। খুলনাতেই বিক্রি। ৬০ টাকা কেজি দরে ইস্পাত পাত কিনে ৭৫ থেকে ৮০ টাকা কেজি দরে পাতাম বিক্রি করেন। পাতাম কাটার সময় প্রতি টনে প্রায় ৮০ কেজি ঘাটতি হয়। বাকিটা লাভ। প্রতিদিন একটা মেশিনে প্রায় ৫০০ থেকে ৮০০ কেজি পাতাম কাটা যায়। এভাবে ২০ ঘর থেকে দিনে কমপক্ষে ১০ টন পাতাম তৈরি হয়, যার মূল্য প্রায় সাড়ে সাত থেকে আট লাখ টাকা। প্রায় ৫০ বছর ধরে এ গাঁয়ের লোকেরা বংশপরম্পরায় এ কাজই করে আসছেন।
খুলনার খালিশপুরের ক্রিসেন্ট ঘাট দিয়ে ভৈরব নদ পার হয়ে মোটর বাইক ছুটে চলল সরু রাস্তা বেয়ে ওই গাঁয়ের দিকেই। রাস্তার দুই ধারে মৃত পাটকলগুলোর শবদেহ। আহা কী রোশনাই না ছিল একদিন ওই পাটকলগুলোর! লোকে লোকারণ্য, ছাপরা-ছাউনিতে গিজ গিজ করত পাটকল এলাকা। কিন্তু কিসে যে কী হয়ে গেল! পাটকলগুলো একে একে বন্ধ হলো, লোকজন চাকরি হারাল, নদী দিয়ে পাটভর্তি নৌকার আনাগোনাও থেমে গেল। শিল্পনগর খুলনার এ অংশে নেমে এল অন্ধকার। পাটের সুদিন ফিরে এলেও খুলনার এ অঞ্চলের সেই সুদিন আর ফিরে আসবে কি না, তা কেউ জানে না। এসব ভাবতে ভাবতে সরওয়ার কাকার মোটর বাইকে সওয়ার হয়ে ছুটে চললাম দিঘলিয়া উপজেলার ওই গ্রামটির দিকে। দুই পাশে আমনের খেত, পানের বরোজ, ইট বিছানো রাস্তা। অবশেষে ঘন গাছগাছালির ছায়াময় সে গ্রামটিতে গিয়ে হাজির হলাম। গাঁয়ের কোলে ভৈরব সেখানে বেশ প্রশস্ত, আকাশে টলটল আষাঢ়ের মেঘ।
ভৈরবের কূলে অসংখ্য নারকেল-সুপারির বীথি। পাড় ভাঙছে, বুড়ো মানুষের দাঁতের মতো গোড়া নড়ছে কোনো কোনো গাছগাছালির। তারই ছায়ায় বসে বুড়ো মতোন এক ছুতোর নৌকা গড়ে চলেছেন। নৌকার গলুই তৈরির জন্য পাট পাট করে তক্তা জোড়ার কাজ চলছে। জোড়া দেওয়া হচ্ছে পেরেক বা ফেভিকল দিয়ে না, এক বিশেষ বস্তু দিয়ে। ইস্পাতের সে বস্তুটার নাম পাতাম। প্রায় আড়াই ইঞ্চি লম্বা চ্যাপ্টা পুরু ইস্পাতের পাত দিয়ে তৈরি করা হয়েছে পাতাম। পাতামের দুই প্রান্ত তেরছা করে কাটা। দুই প্রান্ত দুটি তক্তার জোড়ার মুখে ঢুকিয়ে পিটিয়ে সিঁধিয়ে দেওয়া হচ্ছে পাতাম। ঘন ঘন করে ওটা দিয়েই একের পর এক তক্তা জুড়ে শেষে বানানো হচ্ছে নৌকা। নৌকার দেশে ওই পাতাম তৈরির কারিগর আর গ্রামের খোঁজেই এত দূর আসা। যত দূর খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই বস্তুটা এ গ্রাম ছাড়া আর কোথাও তৈরি হয় না।
রাধামাধবপুর গাঁয়ে পাতাম তৈরির একটা ইতিহাস আছে। পাতাম কারিগর সুভাষ বালা বললেন, তাঁর বাবা পুলিন বালা ভারতের ইছাপুরে বন্দুকের ফ্যাক্টরিতে কাজ করতেন। বন্দুক বানাতেন। বন্দুকের গুলিও বানাতেন। সেটা ব্রিটিশ-পাকিস্তান আমলের কথা। সাতচল্লিশের পর একসময় চাকরি ছেড়ে দিয়ে এ দেশে চলে আসেন। তখন কলকাতাতেই ছেনি দিয়ে ইস্পাতের পাত কেটে পাতাম তৈরি করা হতো। সেসব পাতাম আসত এ দেশে। তিনি এসে এ দেশে প্রথম পাতাম তৈরির কাজ শুরু করেন। এ গাঁয়েই কয়েকজনকে নিয়ে গড়ে তোলেন পাতাম তৈরির কাজ। তখন মেশিন ছিল না, ইস্পাতের পাত ছেনি দিয়ে কেটে কেটে পাতাম তৈরি করা হতো। তাই অনেক কারিগর লাগত। এভাবে এ গাঁয়ে পাতাম তৈরির কারিগর ও কারখানা বাড়তে লাগল। পাতামের চাহিদাও বাড়তে লাগল। ধীরে ধীরে রাধামাধবপুর পরিণত হলো পাতাম তৈরির গাঁয়ে। তাঁর বাবা এখন বেঁচে নেই, কিন্তু বাবাকে নিয়ে তাঁর অনেক গর্ব। কেননা, একাত্তরে তিনি ওই হাতুড়ে পাতাম তৈরির কারখানাতেই মুক্তিযোদ্ধাদের বন্দুক মেরামত করে দিতেন, এমনকি কয়েকটা নতুন বন্দুকও তৈরি করে দিয়েছিলেন। একাত্তরে জীবনের ঝুঁকি নিয়েও তিনি পাতাম তৈরির আড়ালে দেশের জন্য ওটুকু কাজ করতেন পরম উৎসাহে।
এখন এ গাঁয়ে ২০ ঘর লোক আছে, যাদের প্রত্যেকের পাতাম তৈরির মেশিন আছে এবং নিয়মিত পাতাম তৈরি করে চলেছেন। সারা দেশে পাতামের এত চাহিদা যে মাত্র ২০ ঘর লোকে পাতাম তৈরি করে এখন কুলিয়ে ওঠা যাচ্ছে না। সুভাষ বালা দাবি করেন, দেশের মধ্যে একমাত্র রাধামাধবপুরেই পাতাম তৈরি হয়। ভাদ্র থেকে জ্যৈষ্ঠ পর্যন্ত পাতামের চাহিদা থাকে সবচেয়ে বেশি। ও সময় তৈরি করা পাতাম মোটেই ঘরে জমে থাকে না। বছরের অন্য সময় একটু কম চলে। খুলনার শেখপাড়া থেকে জাহাজের স্ক্র্যাপ কিনে তারা মেশিনে কেটে পাতাম তৈরি করেন। খুলনাতেই বিক্রি। ৬০ টাকা কেজি দরে ইস্পাত পাত কিনে ৭৫ থেকে ৮০ টাকা কেজি দরে পাতাম বিক্রি করেন। পাতাম কাটার সময় প্রতি টনে প্রায় ৮০ কেজি ঘাটতি হয়। বাকিটা লাভ। প্রতিদিন একটা মেশিনে প্রায় ৫০০ থেকে ৮০০ কেজি পাতাম কাটা যায়। এভাবে ২০ ঘর থেকে দিনে কমপক্ষে ১০ টন পাতাম তৈরি হয়, যার মূল্য প্রায় সাড়ে সাত থেকে আট লাখ টাকা। প্রায় ৫০ বছর ধরে এ গাঁয়ের লোকেরা বংশপরম্পরায় এ কাজই করে আসছেন।
No comments