প্রতিক্রিয়া-‘কেন এই নিষ্ঠুরতা’ by মোশাহিদা সুলতানা ও মাহা মির্জা
গত সপ্তাহে সাহিত্যিক ও সাংবাদিক আনিসুল হক ‘কেন এই নিষ্ঠুরতা’ শিরোনামের লেখাটিতে তরুণদের স্বপ্ন ও আদর্শহীনতাকে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। তাঁর প্রশ্ন ছিল, কেন আমাদের তরুণেরা এমন হলো? কেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ধারালো অস্ত্র নিয়ে একজন আরেকজনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে? এই বয়সে তো তাদের দুর্দান্ত সব স্বপ্ন দেখার কথা!
সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী এবং অপরাধবিজ্ঞানীদের কাছে আনিসুল হক উত্তর চেয়েছেন। জানতে চেয়েছেন, এই উন্মত্ততার পেছনে কোন গভীর অসুখ কাজ করছে। কিন্তু এই অসুখ কি কোনো অজানা গ্রহ থেকে আসা বিশেষ ধরনের ক্যানসার? এটি হঠাৎ হাজির হওয়া সমস্যা নয়। এর গোড়ার কারণটিতে নজর দেওয়া দরকার এবং যতই অস্বস্তিকর হোক না কেন তা খোঁজার দায়ভার আমাদের ওপরেই বর্তায়।
ছাত্ররাজনীতির এই ভয়ংকর বিপন্ন অবস্থাটি সমাজবিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। বরং এটাই স্বাভাবিক, এমনই হওয়ার কথা ছিল। এমনই যেন হয় আমরা সেই ব্যবস্থাই কি করে আসিনি এত দিন ধরে? স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের শাসকগোষ্ঠী তাদের নিজেদের স্বার্থে এই ছাত্রদেরই তো ব্যবহার করে আসছে।
আমরা শিক্ষাকে পণ্য করেছি, আমরা চিকিৎসাসেবাকে পণ্য করেছি। আমরা মুক্ত আকাশের নামে লাগামছাড়া অশ্লীলতাকে লালন করেছি, আমরা মানুষে মানুষে অদ্ভুত বৈষম্য, অন্যায়, ভেদাভেদ আপন করে নিয়েছি। আবার সেই বৈষম্যকে পুঁজি করেই তথাকথিত উন্নয়নের ভিত গড়েছি। আমরা প্রতিনিয়ত শিক্ষার্থীদের শিখিয়েছি, কীভাবে পণ্য বিক্রির মতো নিজেকেও বিক্রি করতে হয়। অথচ আমরা আবার এটাও আশা করছি, রাজনীতি করলে ইতিবাচক রাজনীতিই করা উচিত।
ইতিবাচক রাজনীতি করার জন্য যে ত্যাগ, নিষ্ঠা, দায়িত্বশীলতা আর নিঃস্বার্থ মানবপ্রেম প্রয়োজন, সেই সংকল্পে উদ্বুদ্ধ করার মতো প্রতিটি ক্ষেত্রকে এই আমরাই আবার উন্নয়নের নামে, আধুনিকতার নামে, মুক্তবাজারের নামে তিলে তিলে ধ্বংস করেছি। আজ সেই শূন্যতা ভরাট করেছে ক্ষমতা ও অর্থলোভী একদল তরুণ, যাদের সঙ্গে বৃহত্তর ছাত্রসমাজের কোনো সম্পর্কই নেই। এখন সবকিছুকে পণ্য করে, বিকিয়ে দিয়ে আমরা হা-হুতাশ করছি: কেন আমাদের ছাত্ররা এমন আদর্শহীন, স্বপ্নহীন? ধরে নিলাম দৈববলে সেই ভয়ংকর ছাত্রদের মধ্যে ফিরে এল আদর্শ, তারা শুরু করল স্বপ্ন দেখা। প্রশ্ন হলো, কী স্বপ্ন দেখবে তারা? একটি বহুজাতিক কোম্পানির চাকরি? অজস্র পণ্যের মালিক হওয়ার সামর্থ্য? আমাদের স্বপ্নটা আসলে কী হওয়া উচিত, সেটাও তো নির্ধারণ করে দিচ্ছে মুঠোফোনের বিজ্ঞাপনের ভাষা। স্বপ্ন দেখার মতো আর কী-ই বা আমরা অবশিষ্ট রেখেছি? আমাদের ধানের জমিগুলোকে, নদীগুলোকে, খেলার মাঠগুলোকে আমরা কি আর ফিরে পাব? আমরা কি এই শহরের বুকে আর কোনো দিন ফিরিয়ে আনতে পারব বিশুদ্ধ পানি ও সবুজ গাছগাছালি? আমরা কি উন্নয়নের ভুল সংজ্ঞা বাতিল করতে রাজি? স্বপ্ন দেখতে বা দেখাতে হলে তো আবার সেই শেকড়ের কাছাকাছি ফিরতে হবে আমাদের। মানুষে মানুষে বীভৎস ফারাক ঘোচাতে হবে। মুনাফাকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে তৈরি করা অ-সভ্যতার গ্যাঁড়াকল থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমরা যে লাগামছাড়া স্বার্থপরতার হাতে নিজেদের সঁপে দিয়েছি, মানুষের বদলে মুনাফা আর প্রেমের বদলে পণ্য যেভাবে আমাদের ওপরে আসর করেছে, তাকে বিসর্জন দিতে কি আমরা প্রস্তুত? ছাত্র নামধারী নিষ্ঠুর ক্যাডারদের আবির্ভাব ঘটে এমন পরিবেশেই।
যা হতে পারত বা যা হওয়া উচিত ছিল, তা থেকে আমরা এতটাই দূরে যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছেলে যখন চাঁদাবাজি আর খুনখারাবির নেশায় মত্ত হয়, তখন বলতে ইচ্ছা করে, ওরা তো এমনই করবে, এতে অবাক হওয়ার কী আছে? মুনাফাবাদের ইন্ধনে গড়ে ওঠা অরাজকতা যখন দেশে-বিদেশে সর্বত্র প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত, সারা পৃথিবীতে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো যখন সভ্যতা আর সুশীলতার মুখোশ পরে গোগ্রাসে লুটপাট চালাচ্ছে, তখন এই লোভের চক্র থেকে গা বাঁচিয়ে চলার যুক্তিটা কী?
আনিসুল হক বলেছেন, এই বয়সের ছেলেমেয়েরা শরৎচন্দ্র পড়ে কাঁদবে, পথের পাঁচালি দেখে কয়েক রাত ঘুমাতে পারবে না! অবাক না হয়ে পারি না! একটি বিপণিবিতানকেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থায় হাজার রকমের বিলাসী পণ্য যেখানে উন্মত্ত হয়ে হাতছানি দিচ্ছে, যেখানে বিশুদ্ধ পানি, বিশুদ্ধ বাতাস, বিশুদ্ধ নদী আর সবুজ মাঠের বদলে বিদেশি মোবাইল, ব্র্যান্ডের জিনস আর ফাস্টফুড সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রণ করছে তরুণের মানসিকতাকে, সেখানে একটি ছেলে বা মেয়ে শরৎচন্দ্র পড়বেই বা কেন! আর যদি ভুলক্রমে দু পাতা পড়ে ফেলেই, তার অর্থ, তার আকুতি বোঝার মতো মনটাই বা সে কোথায় পাবে? যে মনকে আমরা কেবল পণ্য আর ভোগ খুঁজতে শিখিয়েছি, যে মনকে আমরা শিখিয়েছি স্বার্থপরভাবে উন্নতি করাই জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য, যে মনকে কাবু করেছে বিজ্ঞাপনের চটুল ভাষা; সেই মন দুর্গার মৃত্যুতে হঠাৎ দুফোঁটা চোখের জল ফেললেই না আমাদের আশ্চর্য হওয়ার কথা!
আনিসুল হক তাঁর লেখার সমাপ্তি ঘটিয়েছেন আরেকটি যুক্তিসংগত কথা দিয়ে। তাঁর মতে, তারুণ্যের সামনে কর্মযজ্ঞ সৃষ্টির রূপকল্প করতে হলে চাই স্বপ্ন, সৃষ্টিশীলতা ও কঠোরতা। কিন্তু এই কঠোরতা কোন নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে, কোন নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে বা কোন আইন ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে? প্রায়ই দেখে ও শুনে থাকি, এসবের নিরাময় হিসেবে দেওয়া হয় গতানুগতিক প্রেসক্রিপশন—‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে কঠোর করো’, ‘ক্যাম্পাসকে ছাত্ররাজনীতি মুক্ত করো’ ইত্যাদি। যে ভোগবাদী সমাজব্যবস্থাকে আমরা এত দিন ধরে লালন করেছি তাকে অরক্ষিত রেখে, সহমর্মিতাবিহীন, ভালোবাসাবিহীন, মুনাফাসর্বস্ব, পণ্যসর্বস্ব একটি ব্যবস্থাকে পেলে-পুষে বড় করে, শুধু ছাত্রদের প্রতি কঠোর হয়ে আর কিছু তরুণের আদর্শহীনতাকে, নিষ্ঠুরতাকে আলাদা করে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে আমরা কি উল্লিখিত ক্যানসারের ভুল চিকিৎসাই শুধু করব না? জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ছেলেগুলো আজ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে, আমাদের সবার মধ্যে যে আদর্শহীনতা বিরাজ করছে তার নগ্ন প্রকাশ কতটুকু ভয়ংকর। আমরা আফসোস করতে পারি, কিন্তু অবাক যেন না হই।
তবে আমরা সত্যিই অবাক হই, যখন দেখি এই চরম দৈন্যতা, এই ভয়ানক আদর্শহীনতার মধ্যেও আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছেলেমেয়েরা প্রতিনিয়ত নির্লোভ, নিঃস্বার্থ আদর্শের লড়াই চালিয়ে যায়। আমাদের তখন বলতে ইচ্ছা করে, কে বলে আমাদের ছাত্রদের আদর্শের অভাব? ছাত্রলীগ আর ছাত্রদল ছাড়া আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কি আর কোনো ছাত্র সংগঠন নেই? সাংস্কৃতিক সংগঠন নেই? সাধারণ ছাত্ররাই বা কম কিসে? এটা ঠিক যে সাধারণ ছাত্ররা এবং প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলো প্রায়শই সন্ত্রাসী, দখলদারির চাপে কোণঠাসা থাকে। কিন্তু তাদের আন্দোলনকেও তো কখনো থেমে থাকতে দেখি না। অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অনাচারের বিরুদ্ধে, এই ভোগবাদী সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে কোনো রকমের স্বার্থ ছাড়া, মুনাফা ছাড়া এই ছেলেমেয়েগুলোকে ছাড়া আর তো কাউকে আমরা ফুঁসে উঠতেও দেখি না আজকাল। আমরা তাই এত কিছুর পরেও আশাবাদী।
মোশাহিদা সুলতানা: প্রভাষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
মাহা মির্জা: গবেষক ও সাংস্কৃতিক কর্মী।
No comments