স্মরণ-জননেতা নূরুল ইসলাম by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
গণতন্ত্রী পার্টির একসময়ের সভাপতি, ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের প্রাণপুরুষ এবং চৌদ্দ দলের প্রথম সারির সংগঠক জননেতা নূরুল ইসলামের আজ ৬৮তম জন্মবার্ষিকী। বেঁচে থাকলে তাঁকে আজ জাতীয় সংসদেও সক্রিয় দেখা যেত, যেমন দেখা যেত সংসদের বাইরে।
জনজীবনের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোয়, দরিদ্র এবং অধিকারবঞ্চিত মানুষের সংগ্রামে, তাদের পাশে। তাঁর সক্রিয়তার পরিসমাপ্তি ঘটল তাঁর লালমাটিয়ার ফ্ল্যাটে ২০০৮ সালে ডিসেম্বরের ৩ তারিখের এক মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ডে এবং একমাত্র ছেলে তমোহর ইসলামসহ তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এই মৃত্যুর ভয়াবহতা অকল্পনীয়, এই মৃত্যুর শোক অবহনযোগ্য। তার পরও যদি আগুনের ঘটনাটি হতো বৈদ্যুতিক কোনো দুর্ঘটনা অথবা অসাবধানতা থেকে, তাহলে হয়তো একটা দূরবর্তী সান্ত্বনা থাকত, সেই মৃত্যুকে জীবনচক্রের একটি অপ্রত্যাশিত পরিণতি হিসেবে মেনে নেওয়া যেত। কিন্তু প্রাথমিক তদন্তসহ যতগুলো তদন্ত হয়েছে, দেখা গেছে, আগুনের ঘটনাটি পরিকল্পিত। অর্থাৎ কেউ নূরুল ইসলামের মৃত্যু চেয়েছে, মৃত্যু ঘটানোর জন্য পরিকল্পনা করেছে এবং এই পরিকল্পনা সফল হয়েছে। নূরুল ইসলামকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তমোহরকেও সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
২০০৮ সালের ৩ ডিসেম্বর নূরুল ইসলামের ফ্ল্যাটে যে আগুন লাগে, তার দুটি কারণ তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশের দু-এক কর্তাব্যক্তিকে উল্লেখ করতে দেখেছি (দেখেছি, অর্থাৎ টিভি চ্যানেলে, সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে)। এর একটি হচ্ছে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট এবং অন্যটি একটি ফ্রিজের কম্প্রেসর বিস্ফোরণ। ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির কয়েকজন পরিদর্শক একসময় শর্টসার্কিটের পক্ষে অবস্থান নেন। ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে তাঁরা জানান, ফ্রিজ ও টেবিল ল্যাম্পের জন্য ব্যবহূত মাল্টিপ্লাগ এক্সটেনশন কর্ডটি তাঁরা ভস্মীভূত অবস্থায় দেখেন, কাজেই তাঁদের ধারণা এই মাল্টিপ্লাগ থেকে শর্টসার্কিটের মাধ্যমে আগুন লাগতে পারে। অবশ্য অগ্নিকাণ্ডের দুই সপ্তাহ পর এই পরিদর্শক দলটিই জানাচ্ছে, ফ্ল্যাটের মেইন সার্কিট ব্রেকারটি ও দুটি সিঙ্গেল সার্কিট ব্রেকার ট্রিপ অর্থাৎ বন্ধ অবস্থায় পাওয়া গেছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত ফ্রিজের সকেট পয়েন্টের ভেতর তার জ্বলা অবস্থায় পাওয়া গেলেও ভেতরের অংশের ইনসু্যুলেশন ও তার অক্ষত অবস্থায় রয়েছে। পরিদর্শক দলের মতামত ছিল, যেহেতু বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়েছে, সেহেতু বিদ্যুৎ সরবরাহ থেকে আগুন লাগার আশঙ্কা নেই। টিভি চ্যানেলগুলোর খবর যাঁরা শুনেছেন ও দেখেছেন, অথবা ওই ফ্ল্যাটে যাঁরা গেছেন তাঁরা জানেন, ফ্রিজের কম্প্রেসর বিস্ফোরণের প্রশ্নই আসে না, যেহেতু ফ্রিজটি পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল এবং কম্প্রেসরটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। আগুনের তীব্রতা এমনই স্থানিক ছিল যে, সিলিংয়ের পাখার ব্লেড বেঁকে গেছে, অথচ সোফার ফোমের গদিতে সেই আগুনের আঁচ লাগেনি, এই আগুনের ঘটনা নিয়ে কয়েকজন বিশেষজ্ঞ তাঁদের মতামত দিয়েছেন এবং তাতে নাশকতামূলক কোনো বিস্ফোরণ ঘটানোর ব্যাপারে তাঁরা জোর দিয়েছেন। বিস্ফোরণটি ছিল তীব্র এবং তা থেকে প্রচুর ধোঁয়া নির্গত হয়েছিল। বিস্ফোরণের ঝাপটা যেদিকে গেছে, সেদিকটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অন্যদিকে কোনো প্রভাব পড়েনি। নূরুল ইসলাম ও তমোহর মারা গেছেন বিষাক্ত ধোঁয়া এবং আগুনের তাপে।
এই মৃত্যু নিয়ে একটি মামলা হয়েছিল। মামলা হলে তদন্ত হয়, এ ক্ষেত্রেও তদন্ত হয়েছে। এবং তদন্ত সচরাচর যে রকম হয়, সে রকম ঢিমেতালেই হয়েছে। একসময় মামলাটির গুরুত্ব বিবেচনা করে সেটিকে চাঞ্চল্যকর মামলা হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু তাতে চঞ্চলতা বাড়েনি, সেই একই তালে এটি চলছে। কবে নাগাদ এই মামলার নিষ্পত্তি হবে, প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে এবং যে সন্দেহ ক্রমশ তীব্র হচ্ছে আগুন লাগার ঘটনাটি পরিকল্পিত, তা প্রমাণিত অথবা অপ্রমাণিত হবে, আর প্রমাণিত হলে যারা এটি ঘটিয়েছে, তারা শাস্তি পাবে, আমরা তা জানি না। তবে সকল দেশবাসীর সঙ্গে আমরা আশা করব, সরকার এ ব্যাপারে আরও আন্তরিক হবে। এর আগে শাহ মোহাম্মদ কিবরিয়ার হত্যা ঘটনাটিরও কোনো নিষ্পত্তি হয়নি অথচ কত বৃহস্পতিবার নীল পোশাক পরে ‘শান্তির সপক্ষে নীলিমা’ এই চেতনায় মানববন্ধন করল তাঁর পরিবার ও গুণগ্রাহীরা। রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার বাংলাদেশে হয় না—এটি খুবই বেদনাদায়ক।
এই লেখার শুরুতে নূরুল ইসলামের রাজনৈতিক পরিচয়টিই তুলে ধরেছি, কিন্তু তিনি তো শুধু একজন রাজনীতিবিদই ছিলেন না, ছিলেন সন্তান, স্বামী, পিতা, ভাই, বন্ধু। এই প্রতিটি পরিচয়ে তাঁর ছিল অসামান্য সফলতা। আমরা যারা তাঁর সান্নিধ্যে এসেছি, কাছ থেকে তাঁকে দেখেছি, তারা জানি, কী অসাধারণ সারল্য আর বিনয় ছিল মানুষটির, কী অসীম ধৈর্য এবং ভালোবাসা। একজন অগ্রজের স্নেহে অনেক দাবি তিনি অনেকের মেটাতেন, বিপদে-আপদে সঙ্গী হতেন। অথচ যখন তাঁর প্রয়োজন ছিল এক বা দুজন সঙ্গীর, ফ্ল্যাটের দরজাটা যারা ভাঙবে, বাইরে সজীব বাতাসে নিয়ে যাবে তাঁকে ও তমোহরকে, তখন কেউ ছিল না। হয়তো একটি জীবনেরই বড় একটি আয়রনি। কিন্তু নূরুল ইসলাম আজীবন মানুষের বিপদে সে রকম সঙ্গী হওয়ারই সাধনা করেছেন।
তিনি বেঁচে থাকলে রাজনীতিতে কতখানি অবদান রাখতে পারতেন, সে অনুমানে যাব না—কেননা রাজনীতি আমাদের সুস্থ নয়। নূরুল ইসলাম নিজেও অসুস্থ রাজনীতির বলি। কিন্তু তিনি যে বিবেকের ও ন্যায়বোধের পক্ষে একজন শক্তি হয়েই থাকতেন, এ কথাটা নিশ্চিন্তভাবে বলা যায়।
নূরুল ইসলামের স্মৃতি জেগে থাকবে যত দিন তাঁর বিশ্বাসের মানুষজন এই বাংলাদেশে থাকবে। তাঁকে আমার শ্রদ্ধা।
২০০৮ সালের ৩ ডিসেম্বর নূরুল ইসলামের ফ্ল্যাটে যে আগুন লাগে, তার দুটি কারণ তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশের দু-এক কর্তাব্যক্তিকে উল্লেখ করতে দেখেছি (দেখেছি, অর্থাৎ টিভি চ্যানেলে, সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে)। এর একটি হচ্ছে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট এবং অন্যটি একটি ফ্রিজের কম্প্রেসর বিস্ফোরণ। ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির কয়েকজন পরিদর্শক একসময় শর্টসার্কিটের পক্ষে অবস্থান নেন। ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে তাঁরা জানান, ফ্রিজ ও টেবিল ল্যাম্পের জন্য ব্যবহূত মাল্টিপ্লাগ এক্সটেনশন কর্ডটি তাঁরা ভস্মীভূত অবস্থায় দেখেন, কাজেই তাঁদের ধারণা এই মাল্টিপ্লাগ থেকে শর্টসার্কিটের মাধ্যমে আগুন লাগতে পারে। অবশ্য অগ্নিকাণ্ডের দুই সপ্তাহ পর এই পরিদর্শক দলটিই জানাচ্ছে, ফ্ল্যাটের মেইন সার্কিট ব্রেকারটি ও দুটি সিঙ্গেল সার্কিট ব্রেকার ট্রিপ অর্থাৎ বন্ধ অবস্থায় পাওয়া গেছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত ফ্রিজের সকেট পয়েন্টের ভেতর তার জ্বলা অবস্থায় পাওয়া গেলেও ভেতরের অংশের ইনসু্যুলেশন ও তার অক্ষত অবস্থায় রয়েছে। পরিদর্শক দলের মতামত ছিল, যেহেতু বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়েছে, সেহেতু বিদ্যুৎ সরবরাহ থেকে আগুন লাগার আশঙ্কা নেই। টিভি চ্যানেলগুলোর খবর যাঁরা শুনেছেন ও দেখেছেন, অথবা ওই ফ্ল্যাটে যাঁরা গেছেন তাঁরা জানেন, ফ্রিজের কম্প্রেসর বিস্ফোরণের প্রশ্নই আসে না, যেহেতু ফ্রিজটি পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল এবং কম্প্রেসরটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। আগুনের তীব্রতা এমনই স্থানিক ছিল যে, সিলিংয়ের পাখার ব্লেড বেঁকে গেছে, অথচ সোফার ফোমের গদিতে সেই আগুনের আঁচ লাগেনি, এই আগুনের ঘটনা নিয়ে কয়েকজন বিশেষজ্ঞ তাঁদের মতামত দিয়েছেন এবং তাতে নাশকতামূলক কোনো বিস্ফোরণ ঘটানোর ব্যাপারে তাঁরা জোর দিয়েছেন। বিস্ফোরণটি ছিল তীব্র এবং তা থেকে প্রচুর ধোঁয়া নির্গত হয়েছিল। বিস্ফোরণের ঝাপটা যেদিকে গেছে, সেদিকটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অন্যদিকে কোনো প্রভাব পড়েনি। নূরুল ইসলাম ও তমোহর মারা গেছেন বিষাক্ত ধোঁয়া এবং আগুনের তাপে।
এই মৃত্যু নিয়ে একটি মামলা হয়েছিল। মামলা হলে তদন্ত হয়, এ ক্ষেত্রেও তদন্ত হয়েছে। এবং তদন্ত সচরাচর যে রকম হয়, সে রকম ঢিমেতালেই হয়েছে। একসময় মামলাটির গুরুত্ব বিবেচনা করে সেটিকে চাঞ্চল্যকর মামলা হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু তাতে চঞ্চলতা বাড়েনি, সেই একই তালে এটি চলছে। কবে নাগাদ এই মামলার নিষ্পত্তি হবে, প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে এবং যে সন্দেহ ক্রমশ তীব্র হচ্ছে আগুন লাগার ঘটনাটি পরিকল্পিত, তা প্রমাণিত অথবা অপ্রমাণিত হবে, আর প্রমাণিত হলে যারা এটি ঘটিয়েছে, তারা শাস্তি পাবে, আমরা তা জানি না। তবে সকল দেশবাসীর সঙ্গে আমরা আশা করব, সরকার এ ব্যাপারে আরও আন্তরিক হবে। এর আগে শাহ মোহাম্মদ কিবরিয়ার হত্যা ঘটনাটিরও কোনো নিষ্পত্তি হয়নি অথচ কত বৃহস্পতিবার নীল পোশাক পরে ‘শান্তির সপক্ষে নীলিমা’ এই চেতনায় মানববন্ধন করল তাঁর পরিবার ও গুণগ্রাহীরা। রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার বাংলাদেশে হয় না—এটি খুবই বেদনাদায়ক।
এই লেখার শুরুতে নূরুল ইসলামের রাজনৈতিক পরিচয়টিই তুলে ধরেছি, কিন্তু তিনি তো শুধু একজন রাজনীতিবিদই ছিলেন না, ছিলেন সন্তান, স্বামী, পিতা, ভাই, বন্ধু। এই প্রতিটি পরিচয়ে তাঁর ছিল অসামান্য সফলতা। আমরা যারা তাঁর সান্নিধ্যে এসেছি, কাছ থেকে তাঁকে দেখেছি, তারা জানি, কী অসাধারণ সারল্য আর বিনয় ছিল মানুষটির, কী অসীম ধৈর্য এবং ভালোবাসা। একজন অগ্রজের স্নেহে অনেক দাবি তিনি অনেকের মেটাতেন, বিপদে-আপদে সঙ্গী হতেন। অথচ যখন তাঁর প্রয়োজন ছিল এক বা দুজন সঙ্গীর, ফ্ল্যাটের দরজাটা যারা ভাঙবে, বাইরে সজীব বাতাসে নিয়ে যাবে তাঁকে ও তমোহরকে, তখন কেউ ছিল না। হয়তো একটি জীবনেরই বড় একটি আয়রনি। কিন্তু নূরুল ইসলাম আজীবন মানুষের বিপদে সে রকম সঙ্গী হওয়ারই সাধনা করেছেন।
তিনি বেঁচে থাকলে রাজনীতিতে কতখানি অবদান রাখতে পারতেন, সে অনুমানে যাব না—কেননা রাজনীতি আমাদের সুস্থ নয়। নূরুল ইসলাম নিজেও অসুস্থ রাজনীতির বলি। কিন্তু তিনি যে বিবেকের ও ন্যায়বোধের পক্ষে একজন শক্তি হয়েই থাকতেন, এ কথাটা নিশ্চিন্তভাবে বলা যায়।
নূরুল ইসলামের স্মৃতি জেগে থাকবে যত দিন তাঁর বিশ্বাসের মানুষজন এই বাংলাদেশে থাকবে। তাঁকে আমার শ্রদ্ধা।
No comments