সরল গরল-পাকিস্তানের পুনরাবৃত্তি বাংলাদেশে by মিজানুর রহমান খান
সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বাহাত্তরের সংবিধানের যেটুকু ফিরে এসেছে, তা মতাদর্শগত। সুশাসনগত কোনো অর্জন এতে নেই। হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগ বারবার পাকিস্তান ও ভারতকে টেনে এনেছেন। পাকিস্তানের কাছ থেকে নিয়েছেন সামরিক শাসনকে অবৈধ ঘোষণার মডেল, আর ভারতের সুপ্রিম কোর্টের কাছ থেকে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোগত বিষয়।
মৌলিক কাঠামো মানে হলো, লিখিত সংবিধানের এমন কতগুলো বিধান, যা ‘চিরস্থায়ী’। একবার জনগণ অনুমোদন করে দিলে তা আর বদলানো চলে না। এমনকি জনগণও তা বদলাতে পারে না। আমাদের দেশে প্রথম এই মতবাদ এল এরশাদের আমলে। সুপ্রিম কোর্ট বিভক্ত করা হয়েছিল। অষ্টম সংশোধনীখ্যাত মামলায় আপিল বিভাগ বললেন, এতে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো নষ্ট হয়েছে। সুতরাং এটা বাতিল। এমন সংশোধনী আনা ছিল সংসদের জন্য অনধিকারচর্চা। সেই মামলায় বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান একটি সরস মন্তব্য করেন, যার সারকথা হলো, এই জিনিস কিন্তু উপাদেয় নয়। এটা এমন সব সমাজে বাসা বাঁধে, যেখানে সংসদ জনমত পাত্তা দেয় না। হুটহাট সংবিধানে সংশোধনী আনে। কোনো সবুজ কিংবা শ্বেতপত্রের ধার ধারে না। সোজা কথায়, তাঁর ইঙ্গিতে বাংলাদেশ তেমন একটি রাষ্ট্র, যেখানে ‘মধ্যরাতের নাটক’ ছাড়া কখনো সংবিধান পাস হয়নি। সুতরাং, আমরা যখন সুপ্রিম কোর্টকে ধন্যবাদ দিচ্ছি, তখন আমরা যেন মনে রাখি, এই অনুশীলন যথেষ্ট স্বাস্থ্যকর নয়।
অষ্টম সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারকে সংবিধানের অন্যতম মৌলিক কাঠামো বলা হয়েছিল। আমরা ১৯৯১ সালে তা বদলে দিয়েছি। তার মানে আমরা প্রমাণ রেখেছি, মৌলিক কাঠামো ঘোষণাদান শেষ কথা নয়। সংসদীয় কমিটি যুক্তি দিচ্ছে, আমরা রায়ের আলোকে কমিটি করেছি। সংবিধান সংশোধন করছি। কারণ যাতে পরে কেউ এসে এসব বদলাতে না পারে। কিন্তু প্রশ্নটা অনেক বেশি রাজনৈতিক, আইনগত নয়। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট মৌলিক কাঠামোসংক্রান্ত তিনটি মামলায় রায় দেন। এর মধ্যে ১৯ জনের মত হলো, সংবিধান সংশোধনে সংসদের অসীম ক্ষমতা আছে। ১৫ জন বিচারক বলেছেন, না, নেই। সংসদের ক্ষমতা সীমিত। আমাদের সুপ্রিম কোর্ট শেষোক্ত ১৫ জনের মতামতের ওপর নির্ভর করেই রায় লিখেছেন।
বাহাত্তরের সংবিধানেই গণতন্ত্র নামের প্রতিষ্ঠান ব্যক্তির হাতে চলে যায়। এবার হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের রায়ের ধূসর দিক হলো, এই অপ্রিয় সত্য উচ্চারণ না করা। আমাদের সুপ্রিম কোর্ট তাঁদের রায়ে ধর্মনিরপেক্ষতাসহ কয়েকটি বিষয়কে মৌলিক কাঠামো বলেন। এর একটি তাঁদের ভাষায় ‘গণতান্ত্রিক ধরনের সরকার’। অপরটি ‘সেপারেশন অব পাওয়ার’। এর মানে রাষ্ট্রের তিন স্তম্ভের মধ্যে ক্ষমতার বণ্টন।
সরকারের গণতান্ত্রিক ধরন মানে সংসদীয় পদ্ধতি নয়। রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি হলেও তা গণতান্ত্রিক হতে পারে। আবার সংসদীয় পদ্ধতি মানেই গণতান্ত্রিক নয়। যেমন আমাদের পদ্ধতি সংসদীয়। নামকাওয়াস্তে। এখানে ছদ্মবেশী স্বৈরতন্ত্র আছে। সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র বাহাত্তরের ৪ নভেম্বর থেকেই কায়েম আছে। হাইকোর্টের রায় সুদীর্ঘ। আপিল বিভাগের রায় দীর্ঘ। এতে যথেষ্টভাবে রাজনৈতিক বিষয় পর্যালোচনা করা হয়েছে। কোন অনুচ্ছেদ গণতন্ত্রের জন্য উপকারী, কোনটি নয়, তা বলা আছে। সংবিধানের মৌলিক কাঠামো হিসেবে ‘সরকারের গণতান্ত্রিক ধরন’ স্বীকৃত হয়েছে। অথচ বাংলাদেশের সংবিধানে গণতান্ত্রিক সরকারের ধরনটা যে প্রায় শতভাগ অনুপস্থিত, তা স্বীকৃত হয়নি। বরং বিষয়টি হয়তো অসাবধানতায় গণতান্ত্রিক উল্লিখিত হয়েছে। তাই প্রতীয়মান হতে পারে, আমাদের সংবিধানকে গণতান্ত্রিক মনে করেন সুপ্রিম কোর্ট। অন্য কথায় পরিবর্তিত সংবিধানকে তাঁরা মৌলিক কাঠামোসম্মত মনে করেন সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু তা কি সত্য?
রাষ্ট্রের তিন স্তম্ভ—নির্বাহী বিভাগ, সংসদ ও বিচার বিভাগ। সংসদ সমাজের চাহিদামতে আইন করবে। নির্বাহী বিভাগ সে মতে প্রশাসন চালাবে। বিচার বিভাগ আইন ও সংবিধান সমুন্নত রাখবে। বিচারপতি খায়রুল হক এটা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, তিন অঙ্গের মধ্যে চেকস অ্যান্ড ব্যালেন্সেস বা নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য বজায় রাখাই হলো ক্ষমতার বণ্টনতত্ত্বের মূল কথা। ফরাসি দার্শনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মন্টেস্কুর এই মতবাদ নিয়েছিলেন মার্কিন সংবিধানের জনক জেমস মেডিসন। মার্কিন সংবিধান ক্ষমতা বণ্টনের এক আদর্শ দৃষ্টান্ত। এই তত্ত্ব আধুনিক সংবিধানে অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে ব্যবহূত হচ্ছে। এ কথা আমরা আরও আগে অ্যারিস্টটলের কাছ থেকেও পেয়েছিলাম।
বিচারপতি খায়রুল হক লিখেছেন, ‘মার্কিন সংবিধানপ্রণেতারা সর্বাত্মক যত্ন ও সতর্কতা নিয়েছিলেন, যাতে প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতা এক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের হাতে কুক্ষিগত না হয়।’ আমাদের সংবিধানে ঠিক উল্টো। একানব্বইয়ের সংবিধানপ্রণেতারা বাহাত্তরের অগণতান্ত্রিক বিধানাবলি ধারণ করেই ক্ষান্ত হননি, তাঁরা সর্বাত্মক যত্ন ও সতর্কতা নিয়েছিলেন, যাতে প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতা এক ব্যক্তির হাতে কুক্ষিগত হয়। সাংসদ, বিচারক ও সচিব—প্রত্যেকের প্রবেশ-প্রস্থানের চাবি ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রীর হাতে। এমন কোনো আইনি বা বাস্তব অবস্থা সৃষ্টি করা হয়নি, যা এসব ক্ষেত্রে ন্যূনতম ‘নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য’ বজায় রাখতে পারে। তাই বাংলাদেশের সংবিধানে সেপারেশন অব পাওয়ার নামে কোনো মৌলিক কাঠামো আমরা স্বীকার করি না। থাকলেও তা বিকৃত ও বিধ্বস্ত। মন্টেস্কুু বলেছেন, ‘যখন তিন ক্ষমতা (আইন তৈরি, তা বাস্তবায়ন ও তা সমুন্নত রাখা) এক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের হাতে ন্যস্ত হয়, তখন তা মহাপ্রলয় ঘটায়। আমরা এই বাংলাদেশে এমনকি কেবিনেট নামের কোনো প্রতিষ্ঠান নয়, নিরঙ্কুশ অর্থে সব ক্ষমতা ব্যক্তির হাতে তুলে দিয়েছি। আর তাতেই ক্ষান্ত থাকিনি। ব্যক্তি যাতে না বদলায়, নির্দিষ্ট দুজনের মধ্যে সীমিত থাকে, তাও মোটামুটি স্থির করে দিয়েছি। আমি নিশ্চিত, মন্টেস্কু প্রকারান্তরে এমনটা হলে সে দেশে কী হবে, তা কল্পনা করতে অপারগ ছিলেন!
বিচারপতি খায়রুল হক মার্কিন সংবিধানের সঙ্গে বাংলাদেশের সংবিধানের তুলনা করেছেন। মার্কিন সংবিধানের তৃতীয় অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রের বিচারিক ক্ষমতা নির্দিষ্টভাবে সুপ্রিম কোর্টের হাতে ন্যস্ত করা আছে। বাংলাদেশের সংবিধানে এমন কোনো অনুচ্ছেদ নেই। সংসদীয় কমিটি এটা দেবে কি?
বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ফাতিহাপাঠের ক্ষমতাধর। তাঁর ওপর অভিশংসনের খড়্গ আছে। অথচ সর্বময় নির্বাহী ক্ষমতা ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রীর হাতে। তাঁর জন্য অনাস্থা প্রস্তাব আনার মতো একটি কাতুকুতু ব্যবস্থা আছে। ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে তা একটা প্রহসন ছাড়া কিছু নয়। পঞ্চম সংশোধনীর রায়ে এই অস্বচ্ছ দিকগুলোর কোনো প্রতিফলন নেই।
টি এইচ খান মন্তব্য করেছেন, সুপ্রিম কোর্টের যেটুকু ভালো লেগেছে, সেটুকু তাঁরা নিয়েছেন। এটা ঠিক যে একধরনের ‘পিক অ্যান্ড চুজ’ বা পছন্দমাফিক অনুচ্ছেদ বাছাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। এটা পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়ের সীমাবদ্ধতা। অষ্টম সংশোধনীর মামলার রায়েরও সীমাবদ্ধতা ছিল। সুপ্রিম কোর্ট তখনো মৌলিক কাঠামো ঠিক করেছিলেন। অথচ সে সময়ে সংবিধানে ৯২ক নামে একটি কালো অনুচ্ছেদ ছিল, যেটিকে বিচারপতি খায়রুল হক মধ্যযুগীয় ইংল্যান্ডের স্বৈরশাসক জেনারেল ক্রমওয়েলের ক্ষমতার চেয়ে নিকৃষ্ট বলে যথার্থ মন্তব্য করেন। আপিল বিভাগ তা সমর্থনও করেছেন। তাঁরা বলেছেন, এই বিধানটির ফলে জিয়াউর রহমান ‘সবচেয়ে ক্ষমতাধর প্রধান নির্বাহী’ হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু যেটা লক্ষণীয় তা হলো, অষ্টম সংশোধনী মামলায় সেই নিকৃষ্টতম অগণতান্ত্রিক বিষয়টি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোবিধ্বংসী বলে চিহ্নিত করা হয়নি।
আজ আপিল বিভাগের মাইলফলক রায়ে ছয়জন বিচারপতির পর্যবেক্ষণেও বর্তমান সাংবিধানিক স্বৈরশাসকের স্বীকৃতি নেই। তাঁরা লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের সংসদ ব্রিটেনের সংসদের মতো সর্বশক্তিমান নয়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির মতো প্রধান নির্বাহী নন। কিন্তু ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান।’ আমাদের মোসাহেবরা কি এর সুযোগ নেবেন? তাঁরা কি বলবেন কোথায় স্বৈরতন্ত্র? আমাদের আপিল বিভাগই তো বলে দিয়েছেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাংবিধানিক ক্ষমতা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর মতো!
ব্রিটেনের রানি যেমন, আমাদের রাষ্ট্রপতিও তেমন। রানিই ক্ষমতার আধার। কিন্তু তিনি প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভার পরামর্শে চলেন। মন্ত্রিসভার পরামর্শের বাইরে রানি কাজ করেছেন, এমন ঘটনা অন্তত ১০০ বছর আগে সবশেষ ঘটে থাকবে। কিন্তু আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার কাছে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী নস্যি।
আমাদের সংবিধানে দুটি গুরুতর গলদ। এ রকম গলদ পাকিস্তানেও ছিল। কিন্তু তারা তা শুধরে নিতে বিলম্ব করেছে। ব্যক্তির হাতে সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করা হলো ফ্যাসিবাদী শাসনের অনিবার্য প্রবণতা। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল সমন্বিত শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে এটা পুরোপরি আছে।
প্রথমত, এর নামকরণ সংসদীয় ব্যবস্থা। তাই নির্বাহী ক্ষমতা থাকতে হবে রাষ্ট্রপতির হাতে। যেমন ভারতে আছে। নির্বাহী ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির কাছে। সেই ক্ষমতা তিনি ‘প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভার পরামর্শে’ প্রয়োগ করেন। বাহাত্তরে শেখ মুজিবের দিকে তাকিয়ে নির্বাহী ক্ষমতাটা তুলে দেওয়া হলো প্রধানমন্ত্রীর হাতে। তখনো ওই মডেল সভ্য দুনিয়ার কোথাও ছিল না। এখনো নেই। পাকিস্তানে ভুট্টো এক বছর পর তিয়াত্তরে নতুন সংবিধান দিলেন। সেখানে সংসদীয় ব্যবস্থা চালু করা হলো। কিন্তু জিয়াউল হক এসে রাষ্ট্রপতির হাতে সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করলেন। সংসদ ও মন্ত্রিসভা বিলোপের ক্ষমতা নিলেন। ঠিক এখনকার বাংলাদেশি প্রধানমন্ত্রীর মতো। সেখানে এর পরিণতি হলো ভয়ংকর। চকচকে রাস্তাঘাট ও দালানকোঠা বাড়ল, কিন্তু ক্রমশ দুর্বল হতে শুরু করল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো। পাকিস্তান যে আজ ব্যর্থ রাষ্ট্র, তার অন্যতম বড় কারণ তাদের নির্বাচিত আমলে গণতন্ত্রচর্চা যেটুকু হয়েছে, তাও সেনাশাসকদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেই। আমার বিবেচনায় এর অন্যতম বড় দোষ ছিল সংবিধানে। আমাদের অবস্থাও তথৈবচ। সামরিক শাসন যায়। জরুরি অবস্থা যায়। কিন্তু কোনো সাংবিধানিক বা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী হয় না। এমনকি তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যায় না।
পঞ্চম সংশোধনী মামলায় আমরা যে মাইলফলক রায় পেলাম, তার মূল ভিত্তি হলো আসমা জিলানির মামলা। ওই মামলার রায়ে পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট প্রথম জেনারেল ইয়াহিয়াকে জবরদখলকারী বলেন। এর আগে রাষ্ট্র বনাম দোসো মামলায় পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট আটান্নতে ইস্কান্দার মির্জাসূচিত আইয়ুব খানের সামরিক শাসনকে সফল বিপ্লব বলে বৈধতা দেন। এর ১৪ বছর পর ১৯৭২ সালে আসমা জিলানির রায় আসে।
আমাদের আদালত ও সংসদের সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগের মধ্যে পাকিস্তানি ইতিহাসের অনেকটা পুনরাবৃত্তি দেখতে পাচ্ছি। সংবিধানের মৌলিক কাঠামো পাকিস্তানের সংসদে আলোচনা হয়নি, বাংলাদেশেও হলো না। আসমা জিলানির রায়ের পর পাকিস্তানের গণমাধ্যম সুপ্রিম কোর্টকে ধন্য ধন্য করল। একই রায় পুনর্ব্যক্ত করতে তাঁদের সময় লাগল ৩৭ বছর। একই কারণে ২০০৯ সালে আবার ধন্যবাদ পেলেন পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট।
জিলানির রায় যখন এল, তখন ইয়াহিয়া রিক্ত। ক্ষমতাহীন। জিলানির রায়ের আলোকে ভুট্টো সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নেন। এখানেও মিল। আমাদের আপিল বিভাগ বলেছেন, অবৈধ ক্ষমতা দখল ঠেকাতে আইন হোক। অথচ আমাদের দণ্ডবিধিতে অবৈধ ক্ষমতা দখল ও সরকার উৎখাতের শাস্তির বিধান আছে। যাবজ্জীবন দণ্ড। এর প্রয়োগ নেই। আমরা মূর্খ নই। কিন্তু ভান করি।
জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে মতিঝিল থানায় হাসানুল হক ইনুর মামলা করা আছে। এরশাদের প্রতিনিধি আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও ইনু দুজনই এখন সংবিধান সংশোধন কমিটির সদস্য। তাঁরা এখন একমত হবেন সংবিধান সংশোধনে। অবৈধ ক্ষমতা ঠেকাতে পণ করবেন। অনুমান করতে পারি, সংসদীয় কমিটি ভুট্টোর ৬ অনুচ্ছেদটা আমদানি করবে। সেখানে ভুট্টো যা লিখেছেন, আমাদের সুপ্রিম কোর্ট ইতিমধ্যে তা-ই লিখেছেন। সংবিধান লঙ্ঘন করা হবে চরম বিশ্বাসঘাতকতা। সেই অনুচ্ছেদ বুটের তলায় রেখে এসেছিলেন জেনারেল জিয়াউল হক। জিয়াউলের ক্ষমতা দখলের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করলেন নুসরাত ভুট্টো। পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট আসমা জিলানির নন্দিত রায় উল্টে দিলেন। জিয়া তখন ক্ষমতায়। শূকরের মাংস হারাম, খেলে পাপ নেই, যদি তুমি অনন্যোপায় হয়ে পড়ো। সূরা আল-বাকারার বরাত দিলেন বিচারকেরা। এরপর এলেন জেনারেল পারভেজ মোশাররফ। সংবিধানে কিন্তু ওই ৬ অনুচ্ছেদ যথারীতি বহাল। পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট আবার বৈধতা পরখ করতে বসলেন। ২০০০ সাল। জেনারেল পারভেজের হাতে তখনো বন্দুক। তিনি বৈধতা পেলেন। আসমা জিলানির রায় আবার লজ্জায় মুখ লুকাল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট আসমা জিলানির ঝান্ডা তুলে ধরলেন। শুধু তফাত হলো, তত দিনে গণেশ উল্টেছে। পারভেজ গদিচ্যুত। ট্রিগারে হাত নেই। ৩১ জুলাই ২০০৯। বর্তমান প্রধান বিচারপতি ইফতেখার মোহাম্মদ চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্ট মোশাররফকে চরম বিশ্বাসঘাতক হিসেবে নিন্দা করলেন। তাঁরা বলেছেন, মোশাররফ জবরদখলকারী। তাঁর অপরাধ অমার্জনীয়। তাঁরা স্মরণ করেছেন, জিলানি মামলায় বিচারপতি ইয়াকুবের সেই উক্তি: ‘ক্ষমতাচ্যুত হওয়ামাত্র তাঁর সব কাজ অবৈধ হবে। বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে।’ এখন পাকিস্তান পতিত জেনারেলের বিচার নিয়ে ফাঁপরে আছেন। একই দশায় বাংলাদেশ।
আমরা জেনারেল এরশাদকে দুর্নীতির দায়ে দণ্ড দিয়েছি। আবার জবরদখলকারী হিসেবে তাঁকে বিচারের ঊর্ধ্বে রাখছি। অবিভক্ত পাকিস্তানের সাবেক দুই অংশে একই সময়ে প্রায় একই ঘটনা ঘটছে। এই পুনরাবৃত্তি নিশ্চয় অবাক বিস্ময়ে দেখছে অবশিষ্ট বিশ্ব।
আসমা জিলানির রায় ঢাকায় আনতে সময় লেগেছে তিন দশকের বেশি। অবিভক্ত পাকিস্তান ও বর্তমান পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা কত নিবিড়, তার একটি নমুনা দিতে পারি। পঞ্চম সংশোধনী মামলায় হাইকোর্টের রায়ে নানাভাবে ‘পাকিস্তান’ শব্দটি এসেছে ১৮১ বার। আপিল বিভাগের রায়ে এসেছে ১০৫ বার। ভুল থেকে শিখব। অনুশোচনা করব। ভালোটুকু ধার নেব। এই তো গণতন্ত্রের শিক্ষা। পাকিস্তানের সংবিধান এ মুহূর্তে আমাদের চেয়ে অধিকতর গণতান্ত্রিক। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় তারা ভারসাম্য এনেছে। অত্যধিক ক্ষমতাধর প্রধান নির্বাহীর কিছু ক্ষমতা সংসদকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। মি. টেন পার্সেন্ট আসিফ জারদারি স্বেচ্ছায় ত্যাগ করেছেন। এটা কম কথা নয়। এমনকি শুধু প্রধানমন্ত্রীকে নয়, মন্ত্রিসভাকেও গুরুত্ব দিয়েছে সংবিধান। উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে সংবিধানে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন কমিশন সংযোজন করা হয়েছে। সেই নিয়োগ-প্রক্রিয়ায় সংসদকেও যুক্ত করা হয়েছে।
অবৈধ ক্ষমতা দখল ঠেকাতে আগে লেখা ছিল সংবিধান স্থগিত বা ধ্বংস করলে চরম বিশ্বাসঘাতকতা বলে গণ্য হবে। এবার তাতে যোগ করা হয়েছে, এসব যারা করবে, হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্ট তাদের বৈধতা দেবে না। কোলাবোরেটররা এখন থেকে পাকিস্তানেও নিন্দনীয় হবে। কারণ সংবিধানে লেখা হয়েছে, বলপূর্বক বা কোনো অসাংবিধানিক উপায়ে যাঁরা ক্ষমতা দখল করবেন, তাঁদের মদদদাতা ও কোলাবোরেটররাও বিশ্বাসঘাতক হিসেবে গণ্য হবেন। দণ্ড পাবেন।
আমাদের সংসদীয় কমিটি যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে অধিকতর ভালো কিছু পাব তেমন আশা এখনো করি না। তবে বিএনপির সঙ্গে আঁতাতের মাধ্যমে আরেকটি মধ্যরাতের নাটক হলে অবাক হব না। আমাদের দরকার ব্যাপকভিত্তিক সংবিধান সংস্কার। কিন্তু সংসদকেন্দ্রিক কোনো দলের মগজে তা আছে বলে প্রমাণ পাই না।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
অষ্টম সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারকে সংবিধানের অন্যতম মৌলিক কাঠামো বলা হয়েছিল। আমরা ১৯৯১ সালে তা বদলে দিয়েছি। তার মানে আমরা প্রমাণ রেখেছি, মৌলিক কাঠামো ঘোষণাদান শেষ কথা নয়। সংসদীয় কমিটি যুক্তি দিচ্ছে, আমরা রায়ের আলোকে কমিটি করেছি। সংবিধান সংশোধন করছি। কারণ যাতে পরে কেউ এসে এসব বদলাতে না পারে। কিন্তু প্রশ্নটা অনেক বেশি রাজনৈতিক, আইনগত নয়। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট মৌলিক কাঠামোসংক্রান্ত তিনটি মামলায় রায় দেন। এর মধ্যে ১৯ জনের মত হলো, সংবিধান সংশোধনে সংসদের অসীম ক্ষমতা আছে। ১৫ জন বিচারক বলেছেন, না, নেই। সংসদের ক্ষমতা সীমিত। আমাদের সুপ্রিম কোর্ট শেষোক্ত ১৫ জনের মতামতের ওপর নির্ভর করেই রায় লিখেছেন।
বাহাত্তরের সংবিধানেই গণতন্ত্র নামের প্রতিষ্ঠান ব্যক্তির হাতে চলে যায়। এবার হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের রায়ের ধূসর দিক হলো, এই অপ্রিয় সত্য উচ্চারণ না করা। আমাদের সুপ্রিম কোর্ট তাঁদের রায়ে ধর্মনিরপেক্ষতাসহ কয়েকটি বিষয়কে মৌলিক কাঠামো বলেন। এর একটি তাঁদের ভাষায় ‘গণতান্ত্রিক ধরনের সরকার’। অপরটি ‘সেপারেশন অব পাওয়ার’। এর মানে রাষ্ট্রের তিন স্তম্ভের মধ্যে ক্ষমতার বণ্টন।
সরকারের গণতান্ত্রিক ধরন মানে সংসদীয় পদ্ধতি নয়। রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি হলেও তা গণতান্ত্রিক হতে পারে। আবার সংসদীয় পদ্ধতি মানেই গণতান্ত্রিক নয়। যেমন আমাদের পদ্ধতি সংসদীয়। নামকাওয়াস্তে। এখানে ছদ্মবেশী স্বৈরতন্ত্র আছে। সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র বাহাত্তরের ৪ নভেম্বর থেকেই কায়েম আছে। হাইকোর্টের রায় সুদীর্ঘ। আপিল বিভাগের রায় দীর্ঘ। এতে যথেষ্টভাবে রাজনৈতিক বিষয় পর্যালোচনা করা হয়েছে। কোন অনুচ্ছেদ গণতন্ত্রের জন্য উপকারী, কোনটি নয়, তা বলা আছে। সংবিধানের মৌলিক কাঠামো হিসেবে ‘সরকারের গণতান্ত্রিক ধরন’ স্বীকৃত হয়েছে। অথচ বাংলাদেশের সংবিধানে গণতান্ত্রিক সরকারের ধরনটা যে প্রায় শতভাগ অনুপস্থিত, তা স্বীকৃত হয়নি। বরং বিষয়টি হয়তো অসাবধানতায় গণতান্ত্রিক উল্লিখিত হয়েছে। তাই প্রতীয়মান হতে পারে, আমাদের সংবিধানকে গণতান্ত্রিক মনে করেন সুপ্রিম কোর্ট। অন্য কথায় পরিবর্তিত সংবিধানকে তাঁরা মৌলিক কাঠামোসম্মত মনে করেন সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু তা কি সত্য?
রাষ্ট্রের তিন স্তম্ভ—নির্বাহী বিভাগ, সংসদ ও বিচার বিভাগ। সংসদ সমাজের চাহিদামতে আইন করবে। নির্বাহী বিভাগ সে মতে প্রশাসন চালাবে। বিচার বিভাগ আইন ও সংবিধান সমুন্নত রাখবে। বিচারপতি খায়রুল হক এটা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, তিন অঙ্গের মধ্যে চেকস অ্যান্ড ব্যালেন্সেস বা নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য বজায় রাখাই হলো ক্ষমতার বণ্টনতত্ত্বের মূল কথা। ফরাসি দার্শনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মন্টেস্কুর এই মতবাদ নিয়েছিলেন মার্কিন সংবিধানের জনক জেমস মেডিসন। মার্কিন সংবিধান ক্ষমতা বণ্টনের এক আদর্শ দৃষ্টান্ত। এই তত্ত্ব আধুনিক সংবিধানে অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে ব্যবহূত হচ্ছে। এ কথা আমরা আরও আগে অ্যারিস্টটলের কাছ থেকেও পেয়েছিলাম।
বিচারপতি খায়রুল হক লিখেছেন, ‘মার্কিন সংবিধানপ্রণেতারা সর্বাত্মক যত্ন ও সতর্কতা নিয়েছিলেন, যাতে প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতা এক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের হাতে কুক্ষিগত না হয়।’ আমাদের সংবিধানে ঠিক উল্টো। একানব্বইয়ের সংবিধানপ্রণেতারা বাহাত্তরের অগণতান্ত্রিক বিধানাবলি ধারণ করেই ক্ষান্ত হননি, তাঁরা সর্বাত্মক যত্ন ও সতর্কতা নিয়েছিলেন, যাতে প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতা এক ব্যক্তির হাতে কুক্ষিগত হয়। সাংসদ, বিচারক ও সচিব—প্রত্যেকের প্রবেশ-প্রস্থানের চাবি ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রীর হাতে। এমন কোনো আইনি বা বাস্তব অবস্থা সৃষ্টি করা হয়নি, যা এসব ক্ষেত্রে ন্যূনতম ‘নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য’ বজায় রাখতে পারে। তাই বাংলাদেশের সংবিধানে সেপারেশন অব পাওয়ার নামে কোনো মৌলিক কাঠামো আমরা স্বীকার করি না। থাকলেও তা বিকৃত ও বিধ্বস্ত। মন্টেস্কুু বলেছেন, ‘যখন তিন ক্ষমতা (আইন তৈরি, তা বাস্তবায়ন ও তা সমুন্নত রাখা) এক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের হাতে ন্যস্ত হয়, তখন তা মহাপ্রলয় ঘটায়। আমরা এই বাংলাদেশে এমনকি কেবিনেট নামের কোনো প্রতিষ্ঠান নয়, নিরঙ্কুশ অর্থে সব ক্ষমতা ব্যক্তির হাতে তুলে দিয়েছি। আর তাতেই ক্ষান্ত থাকিনি। ব্যক্তি যাতে না বদলায়, নির্দিষ্ট দুজনের মধ্যে সীমিত থাকে, তাও মোটামুটি স্থির করে দিয়েছি। আমি নিশ্চিত, মন্টেস্কু প্রকারান্তরে এমনটা হলে সে দেশে কী হবে, তা কল্পনা করতে অপারগ ছিলেন!
বিচারপতি খায়রুল হক মার্কিন সংবিধানের সঙ্গে বাংলাদেশের সংবিধানের তুলনা করেছেন। মার্কিন সংবিধানের তৃতীয় অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রের বিচারিক ক্ষমতা নির্দিষ্টভাবে সুপ্রিম কোর্টের হাতে ন্যস্ত করা আছে। বাংলাদেশের সংবিধানে এমন কোনো অনুচ্ছেদ নেই। সংসদীয় কমিটি এটা দেবে কি?
বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ফাতিহাপাঠের ক্ষমতাধর। তাঁর ওপর অভিশংসনের খড়্গ আছে। অথচ সর্বময় নির্বাহী ক্ষমতা ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রীর হাতে। তাঁর জন্য অনাস্থা প্রস্তাব আনার মতো একটি কাতুকুতু ব্যবস্থা আছে। ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে তা একটা প্রহসন ছাড়া কিছু নয়। পঞ্চম সংশোধনীর রায়ে এই অস্বচ্ছ দিকগুলোর কোনো প্রতিফলন নেই।
টি এইচ খান মন্তব্য করেছেন, সুপ্রিম কোর্টের যেটুকু ভালো লেগেছে, সেটুকু তাঁরা নিয়েছেন। এটা ঠিক যে একধরনের ‘পিক অ্যান্ড চুজ’ বা পছন্দমাফিক অনুচ্ছেদ বাছাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। এটা পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়ের সীমাবদ্ধতা। অষ্টম সংশোধনীর মামলার রায়েরও সীমাবদ্ধতা ছিল। সুপ্রিম কোর্ট তখনো মৌলিক কাঠামো ঠিক করেছিলেন। অথচ সে সময়ে সংবিধানে ৯২ক নামে একটি কালো অনুচ্ছেদ ছিল, যেটিকে বিচারপতি খায়রুল হক মধ্যযুগীয় ইংল্যান্ডের স্বৈরশাসক জেনারেল ক্রমওয়েলের ক্ষমতার চেয়ে নিকৃষ্ট বলে যথার্থ মন্তব্য করেন। আপিল বিভাগ তা সমর্থনও করেছেন। তাঁরা বলেছেন, এই বিধানটির ফলে জিয়াউর রহমান ‘সবচেয়ে ক্ষমতাধর প্রধান নির্বাহী’ হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু যেটা লক্ষণীয় তা হলো, অষ্টম সংশোধনী মামলায় সেই নিকৃষ্টতম অগণতান্ত্রিক বিষয়টি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোবিধ্বংসী বলে চিহ্নিত করা হয়নি।
আজ আপিল বিভাগের মাইলফলক রায়ে ছয়জন বিচারপতির পর্যবেক্ষণেও বর্তমান সাংবিধানিক স্বৈরশাসকের স্বীকৃতি নেই। তাঁরা লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের সংসদ ব্রিটেনের সংসদের মতো সর্বশক্তিমান নয়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির মতো প্রধান নির্বাহী নন। কিন্তু ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান।’ আমাদের মোসাহেবরা কি এর সুযোগ নেবেন? তাঁরা কি বলবেন কোথায় স্বৈরতন্ত্র? আমাদের আপিল বিভাগই তো বলে দিয়েছেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাংবিধানিক ক্ষমতা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর মতো!
ব্রিটেনের রানি যেমন, আমাদের রাষ্ট্রপতিও তেমন। রানিই ক্ষমতার আধার। কিন্তু তিনি প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভার পরামর্শে চলেন। মন্ত্রিসভার পরামর্শের বাইরে রানি কাজ করেছেন, এমন ঘটনা অন্তত ১০০ বছর আগে সবশেষ ঘটে থাকবে। কিন্তু আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার কাছে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী নস্যি।
আমাদের সংবিধানে দুটি গুরুতর গলদ। এ রকম গলদ পাকিস্তানেও ছিল। কিন্তু তারা তা শুধরে নিতে বিলম্ব করেছে। ব্যক্তির হাতে সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করা হলো ফ্যাসিবাদী শাসনের অনিবার্য প্রবণতা। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল সমন্বিত শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে এটা পুরোপরি আছে।
প্রথমত, এর নামকরণ সংসদীয় ব্যবস্থা। তাই নির্বাহী ক্ষমতা থাকতে হবে রাষ্ট্রপতির হাতে। যেমন ভারতে আছে। নির্বাহী ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির কাছে। সেই ক্ষমতা তিনি ‘প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভার পরামর্শে’ প্রয়োগ করেন। বাহাত্তরে শেখ মুজিবের দিকে তাকিয়ে নির্বাহী ক্ষমতাটা তুলে দেওয়া হলো প্রধানমন্ত্রীর হাতে। তখনো ওই মডেল সভ্য দুনিয়ার কোথাও ছিল না। এখনো নেই। পাকিস্তানে ভুট্টো এক বছর পর তিয়াত্তরে নতুন সংবিধান দিলেন। সেখানে সংসদীয় ব্যবস্থা চালু করা হলো। কিন্তু জিয়াউল হক এসে রাষ্ট্রপতির হাতে সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করলেন। সংসদ ও মন্ত্রিসভা বিলোপের ক্ষমতা নিলেন। ঠিক এখনকার বাংলাদেশি প্রধানমন্ত্রীর মতো। সেখানে এর পরিণতি হলো ভয়ংকর। চকচকে রাস্তাঘাট ও দালানকোঠা বাড়ল, কিন্তু ক্রমশ দুর্বল হতে শুরু করল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো। পাকিস্তান যে আজ ব্যর্থ রাষ্ট্র, তার অন্যতম বড় কারণ তাদের নির্বাচিত আমলে গণতন্ত্রচর্চা যেটুকু হয়েছে, তাও সেনাশাসকদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেই। আমার বিবেচনায় এর অন্যতম বড় দোষ ছিল সংবিধানে। আমাদের অবস্থাও তথৈবচ। সামরিক শাসন যায়। জরুরি অবস্থা যায়। কিন্তু কোনো সাংবিধানিক বা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী হয় না। এমনকি তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যায় না।
পঞ্চম সংশোধনী মামলায় আমরা যে মাইলফলক রায় পেলাম, তার মূল ভিত্তি হলো আসমা জিলানির মামলা। ওই মামলার রায়ে পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট প্রথম জেনারেল ইয়াহিয়াকে জবরদখলকারী বলেন। এর আগে রাষ্ট্র বনাম দোসো মামলায় পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট আটান্নতে ইস্কান্দার মির্জাসূচিত আইয়ুব খানের সামরিক শাসনকে সফল বিপ্লব বলে বৈধতা দেন। এর ১৪ বছর পর ১৯৭২ সালে আসমা জিলানির রায় আসে।
আমাদের আদালত ও সংসদের সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগের মধ্যে পাকিস্তানি ইতিহাসের অনেকটা পুনরাবৃত্তি দেখতে পাচ্ছি। সংবিধানের মৌলিক কাঠামো পাকিস্তানের সংসদে আলোচনা হয়নি, বাংলাদেশেও হলো না। আসমা জিলানির রায়ের পর পাকিস্তানের গণমাধ্যম সুপ্রিম কোর্টকে ধন্য ধন্য করল। একই রায় পুনর্ব্যক্ত করতে তাঁদের সময় লাগল ৩৭ বছর। একই কারণে ২০০৯ সালে আবার ধন্যবাদ পেলেন পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট।
জিলানির রায় যখন এল, তখন ইয়াহিয়া রিক্ত। ক্ষমতাহীন। জিলানির রায়ের আলোকে ভুট্টো সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নেন। এখানেও মিল। আমাদের আপিল বিভাগ বলেছেন, অবৈধ ক্ষমতা দখল ঠেকাতে আইন হোক। অথচ আমাদের দণ্ডবিধিতে অবৈধ ক্ষমতা দখল ও সরকার উৎখাতের শাস্তির বিধান আছে। যাবজ্জীবন দণ্ড। এর প্রয়োগ নেই। আমরা মূর্খ নই। কিন্তু ভান করি।
জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে মতিঝিল থানায় হাসানুল হক ইনুর মামলা করা আছে। এরশাদের প্রতিনিধি আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও ইনু দুজনই এখন সংবিধান সংশোধন কমিটির সদস্য। তাঁরা এখন একমত হবেন সংবিধান সংশোধনে। অবৈধ ক্ষমতা ঠেকাতে পণ করবেন। অনুমান করতে পারি, সংসদীয় কমিটি ভুট্টোর ৬ অনুচ্ছেদটা আমদানি করবে। সেখানে ভুট্টো যা লিখেছেন, আমাদের সুপ্রিম কোর্ট ইতিমধ্যে তা-ই লিখেছেন। সংবিধান লঙ্ঘন করা হবে চরম বিশ্বাসঘাতকতা। সেই অনুচ্ছেদ বুটের তলায় রেখে এসেছিলেন জেনারেল জিয়াউল হক। জিয়াউলের ক্ষমতা দখলের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করলেন নুসরাত ভুট্টো। পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট আসমা জিলানির নন্দিত রায় উল্টে দিলেন। জিয়া তখন ক্ষমতায়। শূকরের মাংস হারাম, খেলে পাপ নেই, যদি তুমি অনন্যোপায় হয়ে পড়ো। সূরা আল-বাকারার বরাত দিলেন বিচারকেরা। এরপর এলেন জেনারেল পারভেজ মোশাররফ। সংবিধানে কিন্তু ওই ৬ অনুচ্ছেদ যথারীতি বহাল। পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট আবার বৈধতা পরখ করতে বসলেন। ২০০০ সাল। জেনারেল পারভেজের হাতে তখনো বন্দুক। তিনি বৈধতা পেলেন। আসমা জিলানির রায় আবার লজ্জায় মুখ লুকাল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট আসমা জিলানির ঝান্ডা তুলে ধরলেন। শুধু তফাত হলো, তত দিনে গণেশ উল্টেছে। পারভেজ গদিচ্যুত। ট্রিগারে হাত নেই। ৩১ জুলাই ২০০৯। বর্তমান প্রধান বিচারপতি ইফতেখার মোহাম্মদ চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্ট মোশাররফকে চরম বিশ্বাসঘাতক হিসেবে নিন্দা করলেন। তাঁরা বলেছেন, মোশাররফ জবরদখলকারী। তাঁর অপরাধ অমার্জনীয়। তাঁরা স্মরণ করেছেন, জিলানি মামলায় বিচারপতি ইয়াকুবের সেই উক্তি: ‘ক্ষমতাচ্যুত হওয়ামাত্র তাঁর সব কাজ অবৈধ হবে। বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে।’ এখন পাকিস্তান পতিত জেনারেলের বিচার নিয়ে ফাঁপরে আছেন। একই দশায় বাংলাদেশ।
আমরা জেনারেল এরশাদকে দুর্নীতির দায়ে দণ্ড দিয়েছি। আবার জবরদখলকারী হিসেবে তাঁকে বিচারের ঊর্ধ্বে রাখছি। অবিভক্ত পাকিস্তানের সাবেক দুই অংশে একই সময়ে প্রায় একই ঘটনা ঘটছে। এই পুনরাবৃত্তি নিশ্চয় অবাক বিস্ময়ে দেখছে অবশিষ্ট বিশ্ব।
আসমা জিলানির রায় ঢাকায় আনতে সময় লেগেছে তিন দশকের বেশি। অবিভক্ত পাকিস্তান ও বর্তমান পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা কত নিবিড়, তার একটি নমুনা দিতে পারি। পঞ্চম সংশোধনী মামলায় হাইকোর্টের রায়ে নানাভাবে ‘পাকিস্তান’ শব্দটি এসেছে ১৮১ বার। আপিল বিভাগের রায়ে এসেছে ১০৫ বার। ভুল থেকে শিখব। অনুশোচনা করব। ভালোটুকু ধার নেব। এই তো গণতন্ত্রের শিক্ষা। পাকিস্তানের সংবিধান এ মুহূর্তে আমাদের চেয়ে অধিকতর গণতান্ত্রিক। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় তারা ভারসাম্য এনেছে। অত্যধিক ক্ষমতাধর প্রধান নির্বাহীর কিছু ক্ষমতা সংসদকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। মি. টেন পার্সেন্ট আসিফ জারদারি স্বেচ্ছায় ত্যাগ করেছেন। এটা কম কথা নয়। এমনকি শুধু প্রধানমন্ত্রীকে নয়, মন্ত্রিসভাকেও গুরুত্ব দিয়েছে সংবিধান। উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে সংবিধানে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন কমিশন সংযোজন করা হয়েছে। সেই নিয়োগ-প্রক্রিয়ায় সংসদকেও যুক্ত করা হয়েছে।
অবৈধ ক্ষমতা দখল ঠেকাতে আগে লেখা ছিল সংবিধান স্থগিত বা ধ্বংস করলে চরম বিশ্বাসঘাতকতা বলে গণ্য হবে। এবার তাতে যোগ করা হয়েছে, এসব যারা করবে, হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্ট তাদের বৈধতা দেবে না। কোলাবোরেটররা এখন থেকে পাকিস্তানেও নিন্দনীয় হবে। কারণ সংবিধানে লেখা হয়েছে, বলপূর্বক বা কোনো অসাংবিধানিক উপায়ে যাঁরা ক্ষমতা দখল করবেন, তাঁদের মদদদাতা ও কোলাবোরেটররাও বিশ্বাসঘাতক হিসেবে গণ্য হবেন। দণ্ড পাবেন।
আমাদের সংসদীয় কমিটি যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে অধিকতর ভালো কিছু পাব তেমন আশা এখনো করি না। তবে বিএনপির সঙ্গে আঁতাতের মাধ্যমে আরেকটি মধ্যরাতের নাটক হলে অবাক হব না। আমাদের দরকার ব্যাপকভিত্তিক সংবিধান সংস্কার। কিন্তু সংসদকেন্দ্রিক কোনো দলের মগজে তা আছে বলে প্রমাণ পাই না।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
No comments