যুক্তরাষ্ট্রের তিন লক্ষ্য by মেহেদী হাসান

দক্ষিণ চীন সাগর ও খনিজ সম্পদ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে চীনের বিরোধ, অর্থনৈতিক সম্ভাবনা এবং একক পরাশক্তি হিসেবে স্থায়ীভাবে প্রভাব বিস্তারের আকাঙ্ক্ষা- প্রধানত এ তিন উদ্দেশ্যে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র মোট নৌশক্তির ৬০ ভাগ মোতায়েন করতে চায়। অন্তত এমনটাই ব্যাখ্যা আন্ত্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের।


তাঁদের মতে, দক্ষিণ চীন সাগরে বিরোধে মিত্রদের পক্ষ নিয়ে শক্তির মহড়া দেওয়াই যুক্তরাষ্ট্রের তাৎক্ষণিক লক্ষ্য। অন্য লক্ষ্যগুলো দীর্ঘমেয়াদি কৌশলের অংশ। আর ওয়াশিংটনের এই উপস্থিতিতে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত যেমন হতে পারে, আছে লাভবান হওয়ারও সুযোগ।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম এ হাফিজ গতকাল রবিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিওন প্যানেটা নৌশক্তির সিংহভাগ এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিয়ে আসার যে পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন তার প্রধান কারণ চীনের উত্থান, বিশেষ করে দক্ষিণ চীন সাগরের কর্তৃত্ব নিয়ে বিরোধ। এম এ হাফিজ বলেন, দৃশ্যত চীন একতরফাভাবেই দক্ষিণ চীন সাগরে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে। এতে ক্ষতির শিকার হচ্ছে ফিলিপাইন ও তাইওয়ানের মতো যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররা। বিরোধপূর্ণ এলাকায় তেলসহ নানা খনিজ সম্পদ পাওয়া গেছে, যা যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আরো বলেন, নৌশক্তি বা নৌবহর মোতায়েনের অর্থ যুদ্ধ ঘোষণা নয়। এটি শক্তির মহড়া।
এম এ হাফিজ মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের নীতি বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও অগ্রগতির ভরকেন্দ্রকে ঘিরে আবর্তিত হয়। একসময় বিশ্বে প্রবৃদ্ধির কেন্দ্র ছিল ইউরোপ। পরে তা যুক্তরাষ্ট্রে স্থানান্তরের পর তা এশিয়ায় চলে এসেছে। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ ধীরে ধীরে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চলে আসছে। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সম্পদ, জনশক্তি পশ্চিমা দেশগুলোর চেয়ে অনেক বেশি। যুক্তরাষ্ট্র এখানে স্থায়ীভাবে তার প্রভাব বিস্তার করতে চায়।
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন মনে করেন, এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি বৃদ্ধি পেলে অবশ্যই ভারত ও চীনের মতো দেশগুলোর সঙ্গে স্বার্থের দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে। আর এ দ্বন্দ্ব সহযোগিতা বা ছাড় দেওয়ার মাধ্যমে নিরসন হবে নাকি বৈরিতায় গড়াবে, তা জানার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
ড. দেলোয়ার মনে করেন, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি জোরদার হলে বাংলাদেশ লাভবান হবে না ক্ষতিগ্রস্ত হবে তাও নির্ভর করবে এ দেশের পররাষ্ট্রনীতির ওপর। তিনি বলেন, বঙ্গোপসাগরের ভাগ্য বাংলাদেশের মতো দেশের হাতে নেই। বড় বড় শক্তি এর নিয়ন্ত্রক। বড় শক্তিগুলো যখন এখানে আসবে তখন অনেক ধরনের চাপ আসতে পারে। শীতল যুদ্ধের সময় অনেক দেশ তাদের নীতির জন্য লাভবান হয়েছে। বাংলাদেশ দূরদৃষ্টি দিয়ে তার পররাষ্ট্রনীতি ঠিক করলে এ থেকে যেমন লাভবান হতে পারে, তেমনি নীতিতে ভুল করলে চরম ক্ষতির শিকারও হতে পারে।
বঙ্গোপসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের নৌশক্তির উপস্থিতি অনেক বিতর্ক সৃষ্টি করতে পারে বলে মনে করছেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা হাফিজও। তিনি বলেন, ভারতের নিজস্ব কিছু লক্ষ্য আছে। দেশটি পশ্চিমা নৌবাহিনীকে তার এত কাছাকাছি দেখতে চাইবে না। অন্যদিকে বাংলাদেশের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের নৌশক্তির উপস্থিতি নিয়ে মনস্তাত্ত্বিক স্পর্শকাতরতা রয়েছে। কেননা এই নৌশক্তি দিয়েই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে পরাস্ত করতে চেয়েছিল।
এম এ হাফিজ আরো বলেন, বাংলাদেশের অবস্থান চীন থেকে খুব দূরে নয়। তাই এখানেও যুক্তরাষ্ট্রের অনেক আগ্রহ থাকবে। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নৌশক্তি বৃদ্ধির পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ থাকলেও সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো ক্ষমতা নেই বলেও তিনি মনে করেন।
হাফিজ আরো বলেন, দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের বিপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তির মহড়া দেওয়ার ক্ষেত্রেও মিত্র দেশগুলোর সমর্থন থাকবে। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের অনেক নীতির ব্যাপারে প্রকাশ্যে বা আড়ালে সমর্থন দিলেও তার উপস্থিতি চায়নি।
অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে প্রভাব জোরদারের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের সুস্পষ্ট স্বার্থ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি বা তারও বেশি হাইপার পাওয়ার অথবা স্মার্ট পাওয়ার যা-ই বলা হোক না কেন সারা বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিটি দেশ এবং সে দেশে তার স্বার্থ কী, তা নিয়ে কাজ করে। এ ছাড়া ওই দেশ যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে না বিপক্ষে তার ওপর ভিত্তি করে পররাষ্ট্র দপ্তর দেশওয়ারি নীতি প্রণয়ন করে। গত ১০ বছরে বিশ্বে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। চীন ও ভারত বিশ্বে উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, সারা বিশ্বই এখন এশিয়ামুখী হচ্ছে।
ড. দেলোয়ার আরো বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে ভবিষ্যৎ কাজের পরিকল্পনা ঠিক করে তা হয়তো অনেক দেশই করে না। তাই দেশটি আগে থেকেই এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ক্রমবর্ধমান গুরুত্বের কথা চিন্তা করে নিজের স্বার্থ নিশ্চিত করতে চাইছে।
প্রেসিডেন্ট ওবামা অনেক আগেই যুক্তরাষ্ট্রকে প্রশান্ত মহাসাগরীয় শক্তি হিসেবে ঘোষণা করেছেন- এ কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে অধ্যাপক দেলোয়ার বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নৌশক্তি মূলত আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে ঘিরে। আটলান্টিক থেকে শক্তি কমিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরে বাড়ানোর ক্ষেত্রেও ভারত মহাসাগর বিশেষ গুরুত্ব পাবে। তিনি বলেন, ভারত মহাসাগরের একদিকে ভারত, অন্যদিকে গুরুত্বপূর্ণ আরব কয়েকটি দেশ রয়েছে। বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার ও মালয়েশিয়ার সঙ্গে সিঙ্গাপুরের ভালো যোগাযোগ রয়েছে। ভারত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি জোরদার হলে এশিয়ায় যে শক্তির প্রতিযোগিতা তা আরো দৃশ্যমান হবে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, এ অঞ্চল নিয়ে অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য রয়েছে। বর্তমান বিশ্বে যে কয়টি দেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা রয়েছে তার বেশির ভাগই এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে। মূলত পাঁচ ভাগে ভাগ হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নৌশক্তি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে রয়েছে। এর মধ্যে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মোতায়েন আছে ইউএস প্যাসিফিক কমান্ড (ইউএসপ্যাকম)। ওই কমান্ডের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী তাদের মূলমন্ত্র 'উদ্দেশ্য নিয়েই উপস্থিতি' (প্রেজেন্স উইদ অ্যা পারপাস)। গত ৪ এপ্রিল জাপানের টোকিওতে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনার সময় ইউএসপ্যাকমের অ্যাডমিরাল তৃতীয় স্যামুয়েল জে লকলিয়ার বলেছেন, 'আমরা এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় রাষ্ট্র। আমরা এশীয়-মহাসাগরীয় শক্তি। বিশ্বের এ অংশে আমাদের অনেক বন্ধু ও মিত্র আছে। আমরা অনেক অনেক বছর ধরে আমাদের বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখতে চাই।'
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, শান্তিপূর্ণ সময়গুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের নৌকমান্ড তার মিত্র দেশগুলোকে নানা ধরনের সাহায্য ও প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। ইউএসপ্যাকম সন্ত্রাস দমন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণ, পরিকল্পনা প্রণয়ন ও মহড়া আয়োজনের মাধ্যমে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সামরিক বাহিনীকে সহযোগিতা দিচ্ছে। ইউএসপ্যাকম মৈত্রী জোরদার ও অংশীদারি বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কূটনীতিক গতকাল বিকেলে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব বেশ আগে থেকেই এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে গুরুত্ব দিয়ে আসছে। দক্ষিণ কোরিয়াকে রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা রয়েছে। অস্ট্রেলিয়া ও ফিলিপাইনের সঙ্গেও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সম্পর্ক বেশ জোরালো।'
এই কূটনীতিক আরো বলেন, 'এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নৌশক্তির ৬০ ভাগ স্থানান্তরের খবরটি সাময়িকভাবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ মনে হতে পারে। কিন্তু দেশওয়ারি হিসাব করলে দেখা যাবে, এ অঞ্চলে প্রায় ৫০টি দেশ আছে। এগুলোর কয়েকটিকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ আছে। আবার অনেকগুলোকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সামনে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন আছে। তা ছাড়া আগামী শতক যেহেতু এ অঞ্চলের তাই দুর্যোগ মোকাবিলায় সহযোগিতাই হোক কিংবা বাণিজ্য বা সমুদ্রপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নামেই হোক, বড় শক্তিগুলো এখানে নিজেদের সম্পৃক্ত করতেই চাইবে।'

No comments

Powered by Blogger.