শ্রমশক্তি-বাংলাদেশের শ্রমিক কি অদক্ষ? by খোন্দকার সিদ্দিক-ই-রব্বানী

মাঝেমধ্যে বিভিন্ন মহল থেকে বলা হয় যে বাংলাদেশের শ্রমিকের উৎপাদনক্ষমতা পাশের অন্যান্য দেশ থেকে অনেক কম, যার ফলে এখানকার প্রকৃত শ্রমের মূল্য সস্তা নয়। বক্তব্যটি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনে হয়। একজন কৃষককে পাওয়ার টিলারের সাহায্যে জমি চাষ করতে দিয়ে তার ফলাফলকে কলের ট্রাক্টরের সাহায্যে কাজ


করতে দেওয়া আরেকজনের ফলাফলের সঙ্গে তুলনা করে যদি বলা হয় যে, কৃষকের উৎপাদনক্ষমতা অনেক কম, তা যেমন অযৌক্তিক, এ বিষয়টিও তাই। পাওয়ার টিলার দিয়ে একজন কৃষকের কাজ একই রকম পাওয়ার টিলার দিয়ে আরেকজন কৃষকের কাজের সঙ্গে তুলনা করা যুক্তিযুক্ত, কলের ট্রাক্টরের সাহায্যে করা কৃষকের কাজের সঙ্গে নয়। কিছুদিন আগে এক গ্রন্থাগারে বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান প্রাইসওয়াটারহাউস কুপারসের জরিপের ভিত্তিতে তৈরি একটি প্রতিবেদন দেখি। তাতে একেকটি শার্ট তৈরিতে বিভিন্ন দেশে যে পরিমাণ সময় লাগে এবং শ্রমমূল্য পড়ে তার একটি তুলনামূলক চিত্র হাজির করা হয়েছে। এ কাজে বাংলাদেশে সময় লাগে ৬১ মিনিট আর শ্রমমূল্য পড়ে ০.২৩ ডলার। অর্থাৎ, বাংলাদেশে ঘণ্টাপ্রতি শ্রমমূল্য দাঁড়ায় ০.২৩ ডলার। ভারতে সময় লাগে ৬৩ মিনিট এবং শ্রমমূল্য ০.৪৩ ডলার। অর্থাৎ, ভারতে ঘণ্টাপ্রতি শ্রমমূল্য পড়ে ০.৪১ ডলার। চীনে সময় লাগে ৬০ মিনিট এবং শ্রমমূল্য ০.৭৭ ডলার। অর্থাৎ, চীনে ঘণ্টাপ্রতি শ্রমমূল্য পড়ে ০.৭৭ ডলার। অন্যদিকে, ইতালিতে সময় লাগে মাত্র ৩৫ মিনিট কিন্তু শ্রমমূল্য পড়ে ৮.৫৯ ডলার। অর্থাৎ ইতালিতে ঘণ্টাপ্রতি শ্রমমূল্য দাঁড়ায় ১৪.৭১ ডলার। প্রতিবেদনটিতে জিনস তৈরিবিষয়ক তথ্যও সন্নিবেশিত করা হয়।
পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, ভারতের শ্রমিকদের তুলনায় বাংলাদেশের শ্রমিকেরা কম সময়ে একেকটি শার্ট ও জিনসের ট্রাউজার তৈরি করে। চীনের তুলনায় তা প্রায় সমান। ইতালিতে অনেক কম সময় লাগার কারণ হচ্ছে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার। উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের বিষয়টি শ্রমিকের হাতে নয়, এটি উদ্যোক্তার হাতে। তার পরও শার্ট বা জিনসপ্রতি প্রকৃত শ্রমমূল্যের বিচারে বাংলাদেশেরটি সবচেয়ে কম। এ জন্যই শুনি যে, পোশাক আমদানিকারক দেশগুলো বাংলাদেশের পণ্যের ওপর বেশি হারে কর আরোপ করে থাকে, যেন তাদের বাজারে সবার একটি প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান থাকে। এই করের টাকা না হলে ধনী দেশগুলোর কোনো যায় আসে না, তাই তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে আমাদের শ্রমিকের মূল্য কেন বাড়ানো যাবে না, তা আমার বোধগম্য নয়।
আমি একসময় নিজস্ব প্রযুক্তিতে একটি ক্ষুদ্র ইলেকট্রনিকস শিল্প গড়ে তুলেছিলাম। প্রতিটি প্রিন্টেড সার্কিট বোর্ডে (পিসিবি) প্রায় শতাধিক ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশ বসাতে হতো। এর অনেকগুলোই দেখতে একরকম, সেগুলোর ওপর দেওয়া বিভিন্ন রঙের কয়েকটি দাগ দেখে হিসাব করে আলাদা করতে হয়। একটির জায়গায় অন্যটি বসলে কাজ হবে না। কোনো কোনো যন্ত্রাংশের দুটি পা উল্টো করে লাগালে সার্কিটটি কাজ করবে না। যারা এ কাজগুলো করত, তারা বেশির ভাগই অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ে ট্রেড কোর্স পাস করা। তাদের আমি বলতাম, একটি তৈরি পিসিবি সামনে রেখে তারা যেন দেখে দেখে কাজ করে। কিন্তু কারখানায় গিয়ে দেখতাম যে তাদের কারও সামনেই দেখার জন্য তৈরি করা পিসিবি নেই। কিন্তু বকা দিতে পারতাম না এ কারণে যে, সারা বছরের উৎপাদনে তাদের ভুলের পরিমাণ ছিল শূন্য।
সৃষ্টিকর্তা আমাদের দেশের মানুষকে পৃথিবীর সেরা মনন ও মেধা দিয়ে তৈরি করেছেন। দরিদ্র দেশ হিসেবে আমাদের পরিচয় থাকার কথা নয়। আমাদের মূল দুর্বলতা হচ্ছে ব্যবস্থাপনায়, হোক সে ব্যবসায়ে কিংবা সরকারে। আর সরকারের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার একটি বড় ব্যর্থতা হচ্ছে আয়ের বিশাল বৈষম্যের সৃষ্টি। একই সমান সময় পরিশ্রম করে একজন আরেকজনের থেকে কয়েক শ গুণ, এমনকি হাজার গুণ বেশি আয় করছে একই দেশে বসে। এটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। এতে বেশি আয়ের মানুষও যে ভালো থাকবে, তা কিন্তু নয়, যা কবিগুরু বলে গেছেন অনেক আগে, ‘যাদের করেছ অপমান, অপমানে হতে হবে তাদের সবার সমান।’ পাশ্চাত্যের ভুল পরামর্শে আমরা আয় ও জীবনধারণের বৈষম্য কেবল বাড়িয়েই চলেছি, এখনই তার লাগাম টেনে পেছন দিকে নিতে হবে, না হলে কেউই এ দেশে ভালো থাকতে পারব না।
ড. খোন্দকার সিদ্দিক-ই-রব্বানী: অধ্যাপক ও চেয়ারপারসন, বায়োমেডিকেল ফিজিকস অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.