বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতির সঙ্কট অত্যাসন্ন by অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী
আমরা শিব গড়তে চাইলে কী হবে, অন্যরা তাকে বানর বানিয়ে ছাড়বেই। এ কথাটির ঐতিহাসিক সত্যতা ভাষা আন্দোলনকে দিয়ে শুরু করছি। একটি জাতিসত্তাকে প্রথমত পাকিস্তানি বানাতে ও পরে তাকে বিলুপ্ত করার ষড়যন্ত্রের প্রেক্ষাপটেই মূলত ভাষা আন্দোলনের সূচনা।
আসলেই এই আন্দোলনটার উদ্দেশ্য ছিল বাঙালিত্ব রক্ষা। নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় তা অসম্ভব প্রমাণিত হওয়ায় আমরা ’৭১-এ অস্ত্র হাতে নিতে বাধ্য হলাম।
স্মরণ থাকতে পারে যে, আমাদের এক পর্যায়ের লড়াই ছিল উর্দুকে প্রতিহত করার। উর্দুকে প্রতিহত করতে না পারলেও আমরা বাংলাকে প্রতিষ্ঠার শর্তযুক্ত সুযোগ পেয়েছিলাম। তার পরের স্তর ছিল উর্দু কিংবা আরবি হরফে বাংলা লেখার আবদার। এতে ব্যর্থ হয়ে আমাদের ওপর রোমান হরফে বাংলা লেখার খায়েশ চাপানোর প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। ১৯৭১ সালের আগে তাকেও প্রতিহত করা হয়েছে। বিগত ৩৮ বছরের মধ্যে অনেক ধারার পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। এখন আমাদের সন্তান-সন্ততির হাতে মোবাইল ফোন। তা দিয়ে তারা মেইল করে এবং তা প্রায়ই করে বাংলায়; কিন্তু এখানে বাংলা বর্ণমালা নয় বরং ইংরেজি বর্ণমালা ব্যবহার করা হয়। ভাবছি, যে প্রয়াস পাকিস্তান আমলে সার্থক হয়নি আজ তা অনায়াসে হয়ে যাচ্ছে।
বাংলা ভাষার বানানে মূল সমস্যাগুলো হলো হ্রস্ব ইকার, দীর্ঘ ইকার, উকার, দীর্ঘ ঊকার, শ, স, ষ, মূর্ধন্য ণ, দন্ত ন। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য সুনীতি চট্টোপাধ্যায় রোমান হরফে বাংলা চালুর সুপারিশ করেছিলেন। সেটা ছিল একটা বাস্তব সমস্যার উদ্দেশ্যমূলক সমাধান। কিন্তু মতলববাজরা বিশেষত পাকিস্তানি মতলববাজরা বাংলা বর্ণমালা, তারপর বাংলা ভাষা ও ক্রমান্বয়ে হাজার বছরের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিলোপ এবং কয়েক হাজার বছরের বাঙালি জাতিসত্তাকে বিলুপ্ত করে কৃত্রিম পাকিস্তানি জাতিসত্তা সৃষ্টির প্রয়াস চালিয়েছিল। এখনও সে শঙ্কা বিদ্যমান।
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর আরও একটি সঙ্কট প্রকট হয়েছে। এখন ইংরেজির পাশাপাশি উর্দু, ফারসি, আরবিও পড়ানো হয়ে থাকে। যার ফলে বাংলা হয়ে যাচ্ছে আরবির সমমান, সমমর্যাদা ও সমমাত্রার ভাষা। একই সঙ্গে সমাজের একটি স্তরের মানুষ ইংরেজি মাধ্যমে তাদের সন্তানদের শিক্ষা দিচ্ছে। ফলে একই দেশে অনেক ভাষার ভিত্তি সৃষ্টি হচ্ছে কিংবা ভাষাভিত্তিক অনেকগুলো জাতীয়তার উন্মেষ হচ্ছে। হয়তো এ কারণে তাই আরবি ভাষাভিত্তিক মুসলিম জাতীয়তাবাদকে বেছে নেয়ার পর্যাপ্ত সুযোগ ও প্রেরণা অনেকে পাচ্ছে। পেট্রোডলারের জায়গায় দিনার বা দিরহাম দৌরাত্ম্যে আজ অনেকে কাবু। প্রয়োজনে এখন অনেকেই আরবি শিখছে। ফলে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোকে বাদ দিলেও কম করে তিনটি বৃহত্ স্বতন্ত্র জাতিসত্তার জন্ম হচ্ছে।
একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস করায় সম্ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে সমস্যাও মাথাচাড়া দিয়েছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস প্রবর্তিত হওয়ায় সারা বিশ্বে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার পথ সুগম হলেও বাংলাদেশে বহুজাতির উত্থানের পথ সুগম হচ্ছে। এ কথাগুলো আমাদের মনে রেখেই শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে মাতৃভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় শিক্ষা বন্ধ করতে হবে। দরকার হলে আইন করেই তা করতে হবে। ক্ষুদ্র জাতিসত্তাকে তার মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের সুযোগ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত রাখা যেতে পারে। তবে স্মরণ রাখতে হবে, তাদের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সুযোগ দিলে তা হবে ভয়ঙ্কর সঙ্কটময় পরিস্থিতি। আমার বিশ্বাস, যারা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উচ্চশিক্ষা নেবে, সেখানে শিক্ষার মাধ্যম হবে বাংলা ও ইংরেজি। এমনকি এ পর্যায়ে আরবি, উর্দু, ফারসি, জাপানি কিংবা চৈনিক ভাষাও রাখা যেতে পারে। ছাত্রছাত্রীরা তাদের আত্মোপলব্ধি ও প্রয়োজনের তাগিদে যে কোনো ভাষায় তাদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ কিংবা শুধু ভাষাজ্ঞান অর্জন করতে পারবে।
আগেই বলেছি, বাংলাদেশে কোনো কোনো শিক্ষার্থী বাংলা, ইংরেজি, উর্দু, ফার্সি ও আরবি শিখেছে। কেউ কেউ হিন্দি রপ্ত করে ফেলেছে। অনেক মানুষ আঞ্চলিক বাংলায় গল্প, কবিতা ও নাটক লিখছে। তাতে বাংলা বিশেষত প্রমিত বাংলা একটি প্রান্তিক ভাষায় রূপান্তরের আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাংলাদেশে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ৪৫ ভাষার পরিচর্যার এবং সঙ্গে যদি আঞ্চলিক ভাষার প্রাবল্য বা প্রাধান্য মেনে নেয়া হয় কিংবা তাদের বিকাশে পদক্ষেপ নেয়া হয়, তাহলে বাংলা ভাষার সঙ্কট আরও বাড়বে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের লক্ষ্য হচ্ছে বিদ্যমান বা প্রচলিত ভাষার সংরক্ষণ। সে কারণে বাংলার সংরক্ষণে প্রমিত বাংলার প্রাবল্য বা প্রাধান্য মেনে নিতে হবে। প্রয়োজনে আইন করে সাহিত্য সৃষ্টিতে কিংবা গণমাধ্যমে প্রমিত ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বাংলা ভাষার অন্য সঙ্কটটি বহু পুরনো।
অবিভক্ত ভারতের প্রেক্ষাপটে হিন্দি বা হিন্দুস্থানি ভাষা ছিল ভারতবর্ষের হিন্দুদের ভাষা আর উর্দু ছিল ভারতবর্ষের মুসলমানদের ভাষা। তাই পাকিস্তানি জাতীয়তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রবণতা লক্ষিত হয়েছিল। পূর্ব ও পশ্চিমের সীমাহীন বৈষম্য ও জাতিসত্তার নৃতাত্ত্বিক পার্থক্যের কারণে তা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ সৃষ্টির ফলে বাংলাকে হিন্দুর ভাষা ও বাঙালিকে হিন্দু বলে চিহ্নিত করার আগের প্রয়াস এখন আবার বলবত্ হচ্ছে। এই প্রবণতা রোধে বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের সঙ্গে সেতুবন্ধ বা মেলবন্ধন তৈরিতে কিংবা সামাজিকতার কারণে ইংরেজিকে এখন দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। একটা সময় আসতে পারে যখন আমাদের দেশে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি জঙ্গিবাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এক ধরনের রাজনৈতিক বা বাদশাহী ইসলাম কায়েমে নামতে পারে। তাদের কাছে কিন্তু লাকুম দীনুকুম বা ধর্মে কোনো জবরদস্তি নেই জাতীয় কোরআন বা সুন্নার আদর্শ অনেকটা অচল। তারা হৃদয় বা মগজ দখলের চেয়ে মাটি দখল বা ইহলৌকিক ব্যাপারটা তার সঙ্গে সংযুক্ত করে। তারা কস্মিন কালেও বিশ্বাস করে না যে আল্লাহ তায়ালা এমন কোনো জনপদ নেই যেখানে নবী বা রাসুল পাঠাননি এবং নবীরা সেখানকার মানুষের ভাষায় কথা বলেননি। তাদের উত্থানের কারণে বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতির সঙ্কট আরও বাড়বে।
প্রসঙ্গত অপর একটি বিষয়ের অবতারণা করছি। শুনেছি বাংলা নাকি বিশ্বের চতুর্থ ভাষা এবং সে কারণে আমরা বাংলাকে জাতিসংঘের অন্যতম ভাষা হিসেবে গ্রহণের কর্মযজ্ঞ ও প্রচেষ্টা চালিয়েছি। আমিও মাঝে মাঝে এ ব্যাপারে ওকালতি করে আসছি। আমাদের প্রধানমন্ত্রীও সম্প্রতি একথা প্রতিধ্বনিত করছেন। এখন আমার মনে প্রশ্ন—কোন্ বাংলা জাতিসংঘের ভাষা হবে—রোমান হরফে লেখা বাংলা, বানান চক্রে পড়ে খাবি খাওয়া বাংলা, আঞ্চলিক বাংলা না ইংরেজির মিশ্রণে বাংরেজি? এতসবের আবির্ভাব ঘটলে আমাদের বাংলাটি কি চতুর্থ অবস্থানে থাকতে পারবে? সে কারণেও বাংলা বর্ণে বাংলা লিখতে হবে, বানানের ব্যাপারে ঐকমত্যে আসতে হবে এবং প্রমিত বাংলার প্রচলনকে সর্বাধিক উত্সাহ দান করতে হবে। এ ব্যাপারে উদাসীনতা, অবহেলা বা অবিমৃষ্যকারিতার কোনো সুযোগ নেই।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও মুক্তিযোদ্ধা
স্মরণ থাকতে পারে যে, আমাদের এক পর্যায়ের লড়াই ছিল উর্দুকে প্রতিহত করার। উর্দুকে প্রতিহত করতে না পারলেও আমরা বাংলাকে প্রতিষ্ঠার শর্তযুক্ত সুযোগ পেয়েছিলাম। তার পরের স্তর ছিল উর্দু কিংবা আরবি হরফে বাংলা লেখার আবদার। এতে ব্যর্থ হয়ে আমাদের ওপর রোমান হরফে বাংলা লেখার খায়েশ চাপানোর প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। ১৯৭১ সালের আগে তাকেও প্রতিহত করা হয়েছে। বিগত ৩৮ বছরের মধ্যে অনেক ধারার পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। এখন আমাদের সন্তান-সন্ততির হাতে মোবাইল ফোন। তা দিয়ে তারা মেইল করে এবং তা প্রায়ই করে বাংলায়; কিন্তু এখানে বাংলা বর্ণমালা নয় বরং ইংরেজি বর্ণমালা ব্যবহার করা হয়। ভাবছি, যে প্রয়াস পাকিস্তান আমলে সার্থক হয়নি আজ তা অনায়াসে হয়ে যাচ্ছে।
বাংলা ভাষার বানানে মূল সমস্যাগুলো হলো হ্রস্ব ইকার, দীর্ঘ ইকার, উকার, দীর্ঘ ঊকার, শ, স, ষ, মূর্ধন্য ণ, দন্ত ন। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য সুনীতি চট্টোপাধ্যায় রোমান হরফে বাংলা চালুর সুপারিশ করেছিলেন। সেটা ছিল একটা বাস্তব সমস্যার উদ্দেশ্যমূলক সমাধান। কিন্তু মতলববাজরা বিশেষত পাকিস্তানি মতলববাজরা বাংলা বর্ণমালা, তারপর বাংলা ভাষা ও ক্রমান্বয়ে হাজার বছরের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিলোপ এবং কয়েক হাজার বছরের বাঙালি জাতিসত্তাকে বিলুপ্ত করে কৃত্রিম পাকিস্তানি জাতিসত্তা সৃষ্টির প্রয়াস চালিয়েছিল। এখনও সে শঙ্কা বিদ্যমান।
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর আরও একটি সঙ্কট প্রকট হয়েছে। এখন ইংরেজির পাশাপাশি উর্দু, ফারসি, আরবিও পড়ানো হয়ে থাকে। যার ফলে বাংলা হয়ে যাচ্ছে আরবির সমমান, সমমর্যাদা ও সমমাত্রার ভাষা। একই সঙ্গে সমাজের একটি স্তরের মানুষ ইংরেজি মাধ্যমে তাদের সন্তানদের শিক্ষা দিচ্ছে। ফলে একই দেশে অনেক ভাষার ভিত্তি সৃষ্টি হচ্ছে কিংবা ভাষাভিত্তিক অনেকগুলো জাতীয়তার উন্মেষ হচ্ছে। হয়তো এ কারণে তাই আরবি ভাষাভিত্তিক মুসলিম জাতীয়তাবাদকে বেছে নেয়ার পর্যাপ্ত সুযোগ ও প্রেরণা অনেকে পাচ্ছে। পেট্রোডলারের জায়গায় দিনার বা দিরহাম দৌরাত্ম্যে আজ অনেকে কাবু। প্রয়োজনে এখন অনেকেই আরবি শিখছে। ফলে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোকে বাদ দিলেও কম করে তিনটি বৃহত্ স্বতন্ত্র জাতিসত্তার জন্ম হচ্ছে।
একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস করায় সম্ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে সমস্যাও মাথাচাড়া দিয়েছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস প্রবর্তিত হওয়ায় সারা বিশ্বে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার পথ সুগম হলেও বাংলাদেশে বহুজাতির উত্থানের পথ সুগম হচ্ছে। এ কথাগুলো আমাদের মনে রেখেই শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে মাতৃভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় শিক্ষা বন্ধ করতে হবে। দরকার হলে আইন করেই তা করতে হবে। ক্ষুদ্র জাতিসত্তাকে তার মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের সুযোগ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত রাখা যেতে পারে। তবে স্মরণ রাখতে হবে, তাদের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সুযোগ দিলে তা হবে ভয়ঙ্কর সঙ্কটময় পরিস্থিতি। আমার বিশ্বাস, যারা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উচ্চশিক্ষা নেবে, সেখানে শিক্ষার মাধ্যম হবে বাংলা ও ইংরেজি। এমনকি এ পর্যায়ে আরবি, উর্দু, ফারসি, জাপানি কিংবা চৈনিক ভাষাও রাখা যেতে পারে। ছাত্রছাত্রীরা তাদের আত্মোপলব্ধি ও প্রয়োজনের তাগিদে যে কোনো ভাষায় তাদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ কিংবা শুধু ভাষাজ্ঞান অর্জন করতে পারবে।
আগেই বলেছি, বাংলাদেশে কোনো কোনো শিক্ষার্থী বাংলা, ইংরেজি, উর্দু, ফার্সি ও আরবি শিখেছে। কেউ কেউ হিন্দি রপ্ত করে ফেলেছে। অনেক মানুষ আঞ্চলিক বাংলায় গল্প, কবিতা ও নাটক লিখছে। তাতে বাংলা বিশেষত প্রমিত বাংলা একটি প্রান্তিক ভাষায় রূপান্তরের আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাংলাদেশে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ৪৫ ভাষার পরিচর্যার এবং সঙ্গে যদি আঞ্চলিক ভাষার প্রাবল্য বা প্রাধান্য মেনে নেয়া হয় কিংবা তাদের বিকাশে পদক্ষেপ নেয়া হয়, তাহলে বাংলা ভাষার সঙ্কট আরও বাড়বে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের লক্ষ্য হচ্ছে বিদ্যমান বা প্রচলিত ভাষার সংরক্ষণ। সে কারণে বাংলার সংরক্ষণে প্রমিত বাংলার প্রাবল্য বা প্রাধান্য মেনে নিতে হবে। প্রয়োজনে আইন করে সাহিত্য সৃষ্টিতে কিংবা গণমাধ্যমে প্রমিত ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বাংলা ভাষার অন্য সঙ্কটটি বহু পুরনো।
অবিভক্ত ভারতের প্রেক্ষাপটে হিন্দি বা হিন্দুস্থানি ভাষা ছিল ভারতবর্ষের হিন্দুদের ভাষা আর উর্দু ছিল ভারতবর্ষের মুসলমানদের ভাষা। তাই পাকিস্তানি জাতীয়তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রবণতা লক্ষিত হয়েছিল। পূর্ব ও পশ্চিমের সীমাহীন বৈষম্য ও জাতিসত্তার নৃতাত্ত্বিক পার্থক্যের কারণে তা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ সৃষ্টির ফলে বাংলাকে হিন্দুর ভাষা ও বাঙালিকে হিন্দু বলে চিহ্নিত করার আগের প্রয়াস এখন আবার বলবত্ হচ্ছে। এই প্রবণতা রোধে বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের সঙ্গে সেতুবন্ধ বা মেলবন্ধন তৈরিতে কিংবা সামাজিকতার কারণে ইংরেজিকে এখন দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। একটা সময় আসতে পারে যখন আমাদের দেশে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি জঙ্গিবাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এক ধরনের রাজনৈতিক বা বাদশাহী ইসলাম কায়েমে নামতে পারে। তাদের কাছে কিন্তু লাকুম দীনুকুম বা ধর্মে কোনো জবরদস্তি নেই জাতীয় কোরআন বা সুন্নার আদর্শ অনেকটা অচল। তারা হৃদয় বা মগজ দখলের চেয়ে মাটি দখল বা ইহলৌকিক ব্যাপারটা তার সঙ্গে সংযুক্ত করে। তারা কস্মিন কালেও বিশ্বাস করে না যে আল্লাহ তায়ালা এমন কোনো জনপদ নেই যেখানে নবী বা রাসুল পাঠাননি এবং নবীরা সেখানকার মানুষের ভাষায় কথা বলেননি। তাদের উত্থানের কারণে বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতির সঙ্কট আরও বাড়বে।
প্রসঙ্গত অপর একটি বিষয়ের অবতারণা করছি। শুনেছি বাংলা নাকি বিশ্বের চতুর্থ ভাষা এবং সে কারণে আমরা বাংলাকে জাতিসংঘের অন্যতম ভাষা হিসেবে গ্রহণের কর্মযজ্ঞ ও প্রচেষ্টা চালিয়েছি। আমিও মাঝে মাঝে এ ব্যাপারে ওকালতি করে আসছি। আমাদের প্রধানমন্ত্রীও সম্প্রতি একথা প্রতিধ্বনিত করছেন। এখন আমার মনে প্রশ্ন—কোন্ বাংলা জাতিসংঘের ভাষা হবে—রোমান হরফে লেখা বাংলা, বানান চক্রে পড়ে খাবি খাওয়া বাংলা, আঞ্চলিক বাংলা না ইংরেজির মিশ্রণে বাংরেজি? এতসবের আবির্ভাব ঘটলে আমাদের বাংলাটি কি চতুর্থ অবস্থানে থাকতে পারবে? সে কারণেও বাংলা বর্ণে বাংলা লিখতে হবে, বানানের ব্যাপারে ঐকমত্যে আসতে হবে এবং প্রমিত বাংলার প্রচলনকে সর্বাধিক উত্সাহ দান করতে হবে। এ ব্যাপারে উদাসীনতা, অবহেলা বা অবিমৃষ্যকারিতার কোনো সুযোগ নেই।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও মুক্তিযোদ্ধা
No comments