সাদাসিধে কথা-ল্যাপটপে লেখাপড়া? by মুহম্মদ জাফর ইকবাল
অনেক দিন থেকেই একটা বিষয় আমাদের ভেতর খচখচ করছে—এই দেশের ছেলেমেয়েদের বিজ্ঞান পড়ায় আগ্রহ আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে। দেশের নামীদামি স্কুলের দিকে তাকালে সেটা বোঝা যাবে না—কিন্তু সারা দেশের বিজ্ঞানের মোট ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা দেখলে সেটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে যাবে—কয়েক বছরে সংখ্যাটি ৩০ শতাংশের মতো কমে গেছে।
দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে যাঁরা চিন্তাভাবনা করেন, এই তথ্যটিতে তাঁদের ঘুম হারাম হয়ে যাওয়ার কথা।
একটা সমস্যাকে যখন সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তখনই তার ৮০ ভাগ সমাধান হয়ে যায় বলে আমার বিশ্বাস। (যানজটকে কেউ এখনো সমস্যা হিসেবে দেখছে না—রাস্তাঘাটে দুর্ঘটনাকেও কেউ সমস্যা হিসেবে দেখছে না—অন্তত সেটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে বলে মনে হচ্ছে না। তাই এগুলোর কোনো সমাধানও এখনো চোখে পড়ছে না।) কাজেই আমি খুবই আনন্দিত হয়েছিলাম যখন দেখতে পেলাম বিজ্ঞান শিক্ষায় কেন ছাত্রছাত্রীদের উৎসাহ কমে যাচ্ছে সেটা নিয়ে আলোচনা করার জন্য একটা সভা ডাকা হয়েছে। আমি আরও বেশি আনন্দিত হলাম দুই কারণে—এক. সভায় শিক্ষামন্ত্রী নিজেই থাকবেন—নিজের কানে সভার আলোচনা শুনবেন এবং দুই. সভায় শুধু আমাদের মতো দু-চারজন সবজান্তা বুদ্ধিজীবীকে ডাকা হয়নি, স্কুল-কলেজের শিক্ষক—যাঁরা সরাসরি এ ব্যাপারটির সঙ্গে জড়িত, তাঁদেরও ডাকা হয়েছে।
সভাটি মোটামুটিভাবে তথ্যবহুল একটা সভা ছিল। বিজ্ঞানে ছাত্রছাত্রীদের আগ্রহ কেন কমে যাচ্ছে তার বেশ কয়েকটা কারণ খুঁজে পাওয়া গেল, বিজ্ঞান শিক্ষায় সমস্যাগুলো কী কী সেটাও মোটামুটি বের হয়ে এল। সভার শেষদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বিজ্ঞান মন্ত্রণালয় লেখাপড়ার ব্যাপারে তথ্যপ্রযুক্তি দিয়ে সাহায্য করার ব্যাপারে কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে (বা নেবে) তারও একটা ধারণা দেওয়া হলো।
সভাশেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বুয়েটের দুজন প্রফেসরের সঙ্গে আমি হেঁটে হেঁটে বের হয়ে আসছি। সভায় আলোচনা করা হয়েছে এ রকম একটা বিষয় আমাকে খানিকটা দুশ্চিন্তার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে এবং আমি আবিষ্কার করলাম সেই একই ব্যাপার অন্য দুজন প্রফেসরকেও খানিকটা দ্বিধার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। আমি শুনলাম একজন বললেন, ‘সবার ধারণা, স্কুলে স্কুলে ল্যাপটপ এবং মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর দিয়ে দিলেই সেই স্কুলে প্রচণ্ড লেখাপড়া শুরু হয়ে যাবে! ল্যাপটপ আর মাল্টিমিডিয়ার সঙ্গে লেখাপড়ার কোনো সম্পর্ক নেই—ভালো লেখাপড়ার জন্য দরকার ভালো শিক্ষক, এই সহজ ব্যাপারটা কেউ বোঝে না কেন?’
অন্য প্রফেসর হেসে বললেন, ‘আমার কাছে সব ছাত্র দলবেঁধে এসে অনুরোধ করেছে আমি যেন শিক্ষকদের মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ব্যবহার করে ক্লাস নেওয়া বন্ধ করে দিই।’
আমি দুজনের কথা শুনে একটুও অবাক হলাম না। আমি অন্য দুজন প্রফেসরের মতো সৌভাগ্যবান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর নই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে তীব্র শিক্ষকসংকট। আমি সপ্তাহের ৪০ ঘণ্টার মধ্যে ৩৪ ঘণ্টাও ক্লাস নিয়েছি! কিন্তু আমার কখনোই মনে হয়নি মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ব্যবহার করে ক্লাস নেওয়া যাক। একজন শিক্ষক যখন ক্লাসে পড়ান তখন তাঁর প্রয়োজন ব্ল্যাকবোর্ড ও চক এবং পৃথিবীর এই আদি ও অকৃত্রিম পদ্ধতির কোনো বিকল্প নেই। আমি যখন পড়াই তখন ছাত্রছাত্রীদের মুখের দিকে তাকিয়ে অনুমান করার চেষ্টা করি তারা আমার কথা বুঝেছে কি না। যদি মনে হয় বোঝেনি, তখন বোর্ডে আমি আরও কিছু লিখি, আরও ব্যাখ্যা করি, আরও ছবি আঁকি। দরকার হলে পুরোটা মুছে ফেলে আবার অন্যভাবে শুরু করি। মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরে এগুলো কিছু করা যায় না। ঘরে বসে চকচকে ফন্ট ব্যবহার করে যে কথাগুলো লেখা হয়, ছাত্রদের দর্শক হয়ে সেগুলো দেখতে হয়। তাদেরও আর কিছু করার নেই। কিন্তু বোর্ডে আমি যখন লিখি, ছাত্রছাত্রীরাও সেটা তাদের খাতায় লেখে। মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরে যেটা দেখানো হয়, সেটা কেউ কখনো লিখতে পারে না। তার কারণ, সেটা তাদের দেখার কথা, লেখার কথা নয়। শুধু তা-ই নয়, সেমিনার দেওয়ার জন্য আমি যে কয়েকবার মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ব্যবহার করেছি, ততবারই লক্ষ করেছি, আমার কথা শোনার জন্য কেউ ভুলেও আমার মুখের দিকে তাকাচ্ছে না, সবাই তাকিয়ে আছে স্ক্রিনের দিকে। পৃথিবীর যেকোনো শিক্ষক জানেন, ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় না করে কোনো দিন ক্লাসে পড়ানো যায় না। মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর অত্যন্ত চমকপ্রদ একটি যন্ত্র, কিন্তু সবাইকে মনে রাখতে হবে, এটি ক্লাসে ছাত্রছাত্রী পড়ানোর যন্ত্র নয়।
যখন ওয়ার্ল্ড কাপ খেলা চলছিল তখন ছাত্রছাত্রীদের ফাইনাল খেলা দেখানোর জন্য আমি তীব্রভাবে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের গুরুত্ব অনুভব করেছি। শিক্ষাসফরের পর সেখানে তোলা ছবি দেখানোর জন্য মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের দরকার হয়। আলবদরের পাশবিক অত্যাচারের ওপর তৈরি একটা ভিডিও আমরা মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর দিয়ে দেখেছি। পাট জিনোমের গবেষক, যুক্তরাষ্ট্রের একজন বিজ্ঞানী যখন সেমিনার দিয়েছেন তখনও তাঁর একটা মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের দরকার হয়েছিল। তাই বলে ছাত্রছাত্রী পড়ানোর জন্য—তাও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের নয়, স্কুল পর্যায়ের ছাত্রছাত্রীদের পড়ানোর জন্য বাংলাদেশের সব স্কুলে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর (এবং ল্যাপটপ) দেওয়া হবে, শুনেই কেন জানি আমরা চমকে উঠি। আমার বুঝতে একটু দেরি হয় না যে যাঁরা এ রকম সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাঁরা তাঁদের জীবনে অনেক বড় বড় কাজ করেছেন কিন্তু নিশ্চিতভাবেই কখনো কোনো স্কুলে কোনো ছাত্রছাত্রীদের পড়াননি।
২.
সেই একই সভায় বিজ্ঞান মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলও জানাল তারা কী করছে। তাদের মুখ থেকে আমরা জানতে পারলাম তারা বাংলাদেশের এক হাজার ৮০০ স্কুলে কম্পিউটার ল্যাব তৈরি করে দিয়েছে। খুব বেশি কম্পিউটারের ল্যাব নয়, কিন্তু ল্যাব! কাজ চলছে, আরও স্কুলে আরও ল্যাব তৈরি হবে। শুনে আমি চমৎকৃত হলাম। আমরা সবাই এটা করব, সেটা করব এ ধরনের ভবিষ্যৎ কালের ভাষায় কথা শুনে অভ্যস্ত। এই প্রথমবার অতীত কালের ভাষায় কথা শুনলাম। ‘এক হাজার ৮০০ ল্যাব তৈরি হবে’ নয়, ইতিমধ্যে ‘এক হাজার ৮০০ স্কুলে কম্পিউটার ল্যাব তৈরি হয়ে গেছে!’ এই ল্যাবগুলোতে যদি ছাত্রছাত্রীরা সময় কাটাতে পারে, তাহলে আমরা তার চমৎকার একটা ফল দেখতে পাব তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
এই সরকার দেশের মানুষের কাছে দুটো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকার করে ক্ষমতায় এসেছিল। একটি হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীর বিচার, অন্যটি হচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন। ডিজিটাল বাংলাদেশের সঙ্গে স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েদের তথ্যপ্রযুক্তিতে জ্ঞান অর্জনের একটা সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। সম্ভবত সে কারণেই সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই আমরা একটা চিঠি পেয়েছিলাম। সেখানে আমাদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, মাধ্যমিক পর্যায়ে তথ্যপ্রযুক্তি নাম দিয়ে ৫০ নম্বরের নতুন একটা বিষয় খুলে দিলে কেমন হয়? কোনো কম্পিউটারে হাত দেবে না, শুধু বইয়ে কম্পিউটারের কথা পড়বে, সে জন্য নতুন করে আরও বাড়তি ৫০ নম্বর পরীক্ষা দিতে হবে। আমরা তাতে রাজি হইনি। এর কিছুদিন পর পাঠ্য বইয়ে মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত ভুল এবং বানোয়াট তথ্যগুলো সরানোর জন্য একটি কমিটি তৈরি করা হলো, অন্যদের সঙ্গে আমিও তার একজন সদস্য ছিলাম। সেই কমিটি থেকে তখন নতুন করে অনুরোধ করা হলো, স্কুলের ছেলেমেয়েদের যেন কম্পিউটার বা তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে কিছু লেখালেখি ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। পাঠ্য বইগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস তুলে ধরার সঙ্গে সঙ্গে আমরা তথ্যপ্রযুক্তির কথাও লিখে দিয়েছিলাম। সদস্যদের মধ্যে আমি যেহেতু এই লাইনের মানুষ, তাই আমাকে আলাদাভাবে বেশ কিছু লেখা লিখতে হয়েছিল। মাথায় রাখতে হয়েছিল প্রত্যন্ত গ্রামের একটি ছেলে, যে জীবনে কখনো একটি কম্পিউটার দেখেনি, সে যেন এ লেখাটি পড়েই কম্পিউটার সম্পর্কে একটা ধারণা করতে পারে। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো একটা কথা আছে, এটা তার থেকেও কঠিন। দুধের স্বাদ চুন গোলানো পানি দিয়ে মেটানোর অবস্থা।
এর আগে আমি কখনো পাঠ্য বইয়ের জন্য কিছু লিখিনি। সত্যি কথা বলতে কি এ ব্যাপারটিতে সব সময়ই আমার এক ধরনের অনিচ্ছা কাজ করেছে। আমি জানি, আমাদের দেশের স্কুলে (এমনকি কলেজেও) শিক্ষকেরা নিয়মিতভাবে, নির্দয়ভাবে ছাত্রছাত্রীদের বেত দিয়ে পেটান। এবং আমি মাঝেমধ্যেই কল্পনা করি, নিষ্ঠুর টাইপের একজন শিক্ষক ক্লাসে এসে জিজ্ঞেস করছেন, ‘বলো দেখি, অন্য যন্ত্রের সঙ্গে কম্পিউটারের পার্থক্য কোথায়?’ ছাত্রছাত্রীরা তার উত্তর দিতে পারছে না এবং শিক্ষক নির্দয়ভাবে ছাত্রছাত্রীদের পেটাচ্ছেন। আমার লেখার কারণে ছাত্রছাত্রীরা পিটুনি খাচ্ছে এবং আমার লেখার সঙ্গে সঙ্গে আমার প্রতিও তাদের একটা বিতৃষ্ণার জন্ম হচ্ছে, এ ধরনের একটা বিষয় কল্পনা করে আমি খানিকটা মানসিক যন্ত্রণায় ভুগি। (এই দেশের ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলের ছেলেমেয়েরা নাকি বাংলা পড়তে চায় না। তাদের বাংলায় উৎসাহী করার জন্য অনেক সময় জোর করে আমার লেখা কিশোর উপন্যাস পড়ানো হয় বলে শুনেছি। শুনে আতঙ্ক অনুভব করেছি। শখ করে পড়া আর জোর করে পড়ার মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য!)
যা-ই হোক, বাংলাদেশের স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের কম্পিউটার সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার জন্য শুধু পাঠ্য বইয়ে তার ছবি এবং বর্ণনার ওপর আমাদের ভরসা করে থাকতে হবে না। তারা আসলে সত্যিকার কম্পিউটারে হাত বুলিয়ে দেখতে পাবে, সেটি আমার জন্য খুব আনন্দের একটা ব্যাপার ছিল। তার একটা কারণ আছে এবং অনেকেই সেটা নিশ্চয়ই জানেন।
আমাদের দেশের যেসব নানা-নানি এবং দাদা-দাদি মোবাইল টেলিফোন ব্যবহার করেন, তাঁরা ইতিমধ্যে আবিষ্কার করেছেন মোবাইল ফোনের কোনো একটা দুর্বোধ্য ব্যাপার বোঝার সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে তাদের আট-দশ বছর নাতি কিংবা নাতনির শরণাপন্ন হওয়া। এই শিশুগুলো চোখের পলকে দুর্বোধ্য ফিচারের মর্মোদ্ধার করে দেয়। যেসব পরিবারে কম্পিউটার আছে, তারাও নিশ্চয়ই আবিষ্কার করেছে যে বাসার সবচেয়ে ছোট সদস্যটি সবার আগে কম্পিউটার চালানো শিখে ফেলে। যে শিশুটির এখনো অক্ষরজ্ঞান হয়নি, সেও কম্পিউটারে জটিল ফাইল সিস্টেমের মর্মোদ্ধার করতে পারে, মাউস ঘুরিয়ে ছবি আঁকতে পারে। (কম্পিউটারে গেম খেলা আমি ভালো উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করি না, তাই তার কথা বললাম না)। কাজেই যদি বাংলাদেশের স্কুলে স্কুলে ছোট ছোট কম্পিউটার ল্যাব তৈরি করে দেওয়া হয় এবং সেই স্কুল যদি পর্যায়ক্রমে তাদের ছাত্রছাত্রীদের সেই ল্যাব ব্যবহার করতে দেয়, আমার ধারণা, ধীরে ধীরে প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীই কম্পিউটার ব্যবহার করা শিখে যাবে। বলা যেতে পারে, এটা হবে একটা যুগান্তকারী ব্যাপার।
তবে সবাইকে মনে রাখতে হবে, কম্পিউটার একটা যন্ত্র এবং সেই যন্ত্রটা চালাতে বিদ্যুৎ লাগে। বাংলাদেশে বিদ্যুৎ এখনো সোনার হরিণ—গ্রামাঞ্চলের কথা তো ছেড়েই দিলাম। শুধু তা-ই নয়, এই যন্ত্র অন্য যেকোনো যন্ত্রের মতো মাঝেমধ্যে নষ্ট হয় এবং তখন সেটা সারাতে হয়। কাজেই কোনো স্কুলে কম্পিউটার ল্যাব তৈরি করার সঙ্গে সঙ্গে যদি কম্পিউটার সারানোর একটা পথ তৈরি করে দেওয়া না হয় তাহলে দেখব, বছরখানেকের মধ্যে বেশির ভাগই অকেজো হয়ে পড়ে আছে। (তবে সৌভাগ্যের কথা, ডেস্কটপ কম্পিউটার সারানো সহজ। ল্যাপটপ কম্পিউটার সারানো অনেক খরচসাপেক্ষ। সে জন্য আমরা এখনো আমাদের ল্যাবে ল্যাপটপ কম্পিউটার দিতে সাহস পাই না। সবচেয়ে ভয়ংকর হচ্ছে, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, তার ভেতরে প্রখর আলোর যে বাল্বটি রয়েছে, তার দাম ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা! বাল্ব নেভানোর পর সেটাকে যদি ফ্যান ঘুরিয়ে ধীরে ধীরে ঠান্ডা না করা হয়, তাহলে তার ফিলামেন্ট কেটে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, তাই সেটাকে মোটামুটি সম্মান করে ব্যবহার করতে হয়!)
৩.
আমি শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির একজন সদস্য হিসেবে কাজ করেছি। আমার মনে আছে, আমরা তথ্যপ্রযুক্তিকে শিক্ষানীতিতে খুব গুরুত্ব দিয়েছি। কিন্তু তার একটা বড় সমস্যা সমাধান করতে পারিনি। বাংলাদেশের প্রায় ৬০ হাজার স্কুলে কম্পিউটার কেমন করে পৌঁছে দেওয়া হবে? আমরা তাই অনুমান করে নিয়েছিলাম সত্যিকারের কম্পিউটারে হাত চালানোর আগে তারা হয়তো বইপত্রেই তার বর্ণনা পড়বে। কোনো বড় ধরনের হইচই না করেই বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল প্রায় দুই হাজার স্কুলে কম্পিউটার ল্যাব তৈরি করে দিয়েছে, সেটি একটি অসাধারণ ব্যাপার। এখন আমার কাছে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের সব স্কুলেই কম্পিউটার পৌঁছে দেওয়া হয়তো অসম্ভব কোনো ব্যাপার নয়। স্কুল কর্তৃপক্ষ যদি ছাত্রছাত্রীদের সেই কম্পিউটার ব্যবহার করতে দেয়, তাহলে আমরা কিছুদিনের মধ্যেই এই দেশের একটি তরুণ প্রজন্ম পেয়ে যাব, যাদের সবাই কম্পিউটার ব্যবহার করতে জানে। সেটি হবে একটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার।
আমরা সবাই মিলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা স্কুল তৈরি করেছিলাম। সেই স্কুলে একটা লাইব্রেরি তৈরি করা হলো। লাইব্রেরির সব বইয়ে বারকোড দেওয়া হলো এবং সব ছাত্রছাত্রীকে বারকোড দেওয়া আইডি কার্ড দেওয়া হলো। তখন বই দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপারটি হয়ে গেল পানির মতো সহজ। একজন ছাত্র একটা বই নেওয়ার জন্য হাজির হলে বারকোড রিডার দিয়ে একবার তার আইডি কার্ডে ক্লিক করতে হয়, একবার বইয়ে ক্লিক করতে হয়। সঙ্গে সঙ্গেই কম্পিউটারের ডেটাবেইসে কে কবে কোন বইটি নিয়েছে সেটা লেখা হয়ে যায়। যেহেতু ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল মাত্র কয়েক শ এবং বই মাত্র কয়েক হাজার, তাই কাজটি করা সম্ভব হয়েছিল এবং আমরা কৌতুক করে বলতাম, এটা হচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ কম্পিউটারাইজড লাইব্রেরি। কিন্তু আমি এই লাইব্রেরির গল্প শোনানোর জন্য বিষয়টি অবতারণা করিনি। আমি বিষয়টির অবতারণা করেছি অন্য কারণে। এই লাইব্রেরিটি চালাতো স্কুলের বাচ্চা ছেলেমেয়েরা, কোনো শিক্ষক তার দায়িত্বে ছিলেন না। ক্লাস ফোর-ফাইভের ছেলেমেয়েরা পালাক্রমে লাইব্রেরিয়ানের দায়িত্ব পালন করে কম্পিউটার এবং বারকোড রিডার দিয়ে বই ইস্যু করত, বই জমা নিত, তাদের কখনো কোনো সমস্যা হয়নি! ছোট বাচ্চাদের সুযোগ দেওয়া হলে তারা কী করতে পারে, এটাই হচ্ছে তার একটা উদাহরণ। (জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর আমাদের সবাইকে স্কুল কমিটি থেকে সরিয়ে দিল। তারপর আর সেই স্কুলের ধারে-কাছে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। খবর পেয়েছি, লাইব্রেরি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, দেয়ালে টাঙানো বড় বড় মনীষীর ছবি নামিয়ে ফেলা হয়েছে—মানুষের ছবি যে ঘরে থাকে, সেই ঘরে নাকি নামাজ পড়া যায় না!) পাঠকদের মন খারাপ করার কারণ নেই, স্কুলটিকে আবার দাঁড় করানো হচ্ছে।
৪.
আমরা সব সময়ই কম্পিউটার-সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি করে ফেলি। এটি চমৎকার একটি যন্ত্র কিন্তু এটা কিন্তু মোটেও শিক্ষার বিকল্প নয়। কাজেই কম্পিউটার আমাদের বুঝতে হবে বাংলাদেশের প্রতিটা স্কুলের একজন শিক্ষককে ল্যাপটপ আর মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর দিয়ে দিলেই লেখাপড়ার উন্নতি হতে শুরু করবে না।
কিন্তু আমি মোটামুটি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, কম্পিউটারের মতো এই চমৎকার যন্ত্রটি (tool) যদি ছাত্রছাত্রীদের হাতে তুলে দেওয়া যায়, আমরা তার একটা ফল পাবই পাব।
আমরা কিন্তু এর মধ্যেই সেটা দেখতে শুরু করেছি।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল: লেখক। অধ্যাপক শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
একটা সমস্যাকে যখন সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তখনই তার ৮০ ভাগ সমাধান হয়ে যায় বলে আমার বিশ্বাস। (যানজটকে কেউ এখনো সমস্যা হিসেবে দেখছে না—রাস্তাঘাটে দুর্ঘটনাকেও কেউ সমস্যা হিসেবে দেখছে না—অন্তত সেটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে বলে মনে হচ্ছে না। তাই এগুলোর কোনো সমাধানও এখনো চোখে পড়ছে না।) কাজেই আমি খুবই আনন্দিত হয়েছিলাম যখন দেখতে পেলাম বিজ্ঞান শিক্ষায় কেন ছাত্রছাত্রীদের উৎসাহ কমে যাচ্ছে সেটা নিয়ে আলোচনা করার জন্য একটা সভা ডাকা হয়েছে। আমি আরও বেশি আনন্দিত হলাম দুই কারণে—এক. সভায় শিক্ষামন্ত্রী নিজেই থাকবেন—নিজের কানে সভার আলোচনা শুনবেন এবং দুই. সভায় শুধু আমাদের মতো দু-চারজন সবজান্তা বুদ্ধিজীবীকে ডাকা হয়নি, স্কুল-কলেজের শিক্ষক—যাঁরা সরাসরি এ ব্যাপারটির সঙ্গে জড়িত, তাঁদেরও ডাকা হয়েছে।
সভাটি মোটামুটিভাবে তথ্যবহুল একটা সভা ছিল। বিজ্ঞানে ছাত্রছাত্রীদের আগ্রহ কেন কমে যাচ্ছে তার বেশ কয়েকটা কারণ খুঁজে পাওয়া গেল, বিজ্ঞান শিক্ষায় সমস্যাগুলো কী কী সেটাও মোটামুটি বের হয়ে এল। সভার শেষদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বিজ্ঞান মন্ত্রণালয় লেখাপড়ার ব্যাপারে তথ্যপ্রযুক্তি দিয়ে সাহায্য করার ব্যাপারে কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে (বা নেবে) তারও একটা ধারণা দেওয়া হলো।
সভাশেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বুয়েটের দুজন প্রফেসরের সঙ্গে আমি হেঁটে হেঁটে বের হয়ে আসছি। সভায় আলোচনা করা হয়েছে এ রকম একটা বিষয় আমাকে খানিকটা দুশ্চিন্তার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে এবং আমি আবিষ্কার করলাম সেই একই ব্যাপার অন্য দুজন প্রফেসরকেও খানিকটা দ্বিধার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। আমি শুনলাম একজন বললেন, ‘সবার ধারণা, স্কুলে স্কুলে ল্যাপটপ এবং মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর দিয়ে দিলেই সেই স্কুলে প্রচণ্ড লেখাপড়া শুরু হয়ে যাবে! ল্যাপটপ আর মাল্টিমিডিয়ার সঙ্গে লেখাপড়ার কোনো সম্পর্ক নেই—ভালো লেখাপড়ার জন্য দরকার ভালো শিক্ষক, এই সহজ ব্যাপারটা কেউ বোঝে না কেন?’
অন্য প্রফেসর হেসে বললেন, ‘আমার কাছে সব ছাত্র দলবেঁধে এসে অনুরোধ করেছে আমি যেন শিক্ষকদের মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ব্যবহার করে ক্লাস নেওয়া বন্ধ করে দিই।’
আমি দুজনের কথা শুনে একটুও অবাক হলাম না। আমি অন্য দুজন প্রফেসরের মতো সৌভাগ্যবান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর নই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে তীব্র শিক্ষকসংকট। আমি সপ্তাহের ৪০ ঘণ্টার মধ্যে ৩৪ ঘণ্টাও ক্লাস নিয়েছি! কিন্তু আমার কখনোই মনে হয়নি মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ব্যবহার করে ক্লাস নেওয়া যাক। একজন শিক্ষক যখন ক্লাসে পড়ান তখন তাঁর প্রয়োজন ব্ল্যাকবোর্ড ও চক এবং পৃথিবীর এই আদি ও অকৃত্রিম পদ্ধতির কোনো বিকল্প নেই। আমি যখন পড়াই তখন ছাত্রছাত্রীদের মুখের দিকে তাকিয়ে অনুমান করার চেষ্টা করি তারা আমার কথা বুঝেছে কি না। যদি মনে হয় বোঝেনি, তখন বোর্ডে আমি আরও কিছু লিখি, আরও ব্যাখ্যা করি, আরও ছবি আঁকি। দরকার হলে পুরোটা মুছে ফেলে আবার অন্যভাবে শুরু করি। মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরে এগুলো কিছু করা যায় না। ঘরে বসে চকচকে ফন্ট ব্যবহার করে যে কথাগুলো লেখা হয়, ছাত্রদের দর্শক হয়ে সেগুলো দেখতে হয়। তাদেরও আর কিছু করার নেই। কিন্তু বোর্ডে আমি যখন লিখি, ছাত্রছাত্রীরাও সেটা তাদের খাতায় লেখে। মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরে যেটা দেখানো হয়, সেটা কেউ কখনো লিখতে পারে না। তার কারণ, সেটা তাদের দেখার কথা, লেখার কথা নয়। শুধু তা-ই নয়, সেমিনার দেওয়ার জন্য আমি যে কয়েকবার মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ব্যবহার করেছি, ততবারই লক্ষ করেছি, আমার কথা শোনার জন্য কেউ ভুলেও আমার মুখের দিকে তাকাচ্ছে না, সবাই তাকিয়ে আছে স্ক্রিনের দিকে। পৃথিবীর যেকোনো শিক্ষক জানেন, ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় না করে কোনো দিন ক্লাসে পড়ানো যায় না। মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর অত্যন্ত চমকপ্রদ একটি যন্ত্র, কিন্তু সবাইকে মনে রাখতে হবে, এটি ক্লাসে ছাত্রছাত্রী পড়ানোর যন্ত্র নয়।
যখন ওয়ার্ল্ড কাপ খেলা চলছিল তখন ছাত্রছাত্রীদের ফাইনাল খেলা দেখানোর জন্য আমি তীব্রভাবে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের গুরুত্ব অনুভব করেছি। শিক্ষাসফরের পর সেখানে তোলা ছবি দেখানোর জন্য মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের দরকার হয়। আলবদরের পাশবিক অত্যাচারের ওপর তৈরি একটা ভিডিও আমরা মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর দিয়ে দেখেছি। পাট জিনোমের গবেষক, যুক্তরাষ্ট্রের একজন বিজ্ঞানী যখন সেমিনার দিয়েছেন তখনও তাঁর একটা মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের দরকার হয়েছিল। তাই বলে ছাত্রছাত্রী পড়ানোর জন্য—তাও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের নয়, স্কুল পর্যায়ের ছাত্রছাত্রীদের পড়ানোর জন্য বাংলাদেশের সব স্কুলে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর (এবং ল্যাপটপ) দেওয়া হবে, শুনেই কেন জানি আমরা চমকে উঠি। আমার বুঝতে একটু দেরি হয় না যে যাঁরা এ রকম সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাঁরা তাঁদের জীবনে অনেক বড় বড় কাজ করেছেন কিন্তু নিশ্চিতভাবেই কখনো কোনো স্কুলে কোনো ছাত্রছাত্রীদের পড়াননি।
২.
সেই একই সভায় বিজ্ঞান মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলও জানাল তারা কী করছে। তাদের মুখ থেকে আমরা জানতে পারলাম তারা বাংলাদেশের এক হাজার ৮০০ স্কুলে কম্পিউটার ল্যাব তৈরি করে দিয়েছে। খুব বেশি কম্পিউটারের ল্যাব নয়, কিন্তু ল্যাব! কাজ চলছে, আরও স্কুলে আরও ল্যাব তৈরি হবে। শুনে আমি চমৎকৃত হলাম। আমরা সবাই এটা করব, সেটা করব এ ধরনের ভবিষ্যৎ কালের ভাষায় কথা শুনে অভ্যস্ত। এই প্রথমবার অতীত কালের ভাষায় কথা শুনলাম। ‘এক হাজার ৮০০ ল্যাব তৈরি হবে’ নয়, ইতিমধ্যে ‘এক হাজার ৮০০ স্কুলে কম্পিউটার ল্যাব তৈরি হয়ে গেছে!’ এই ল্যাবগুলোতে যদি ছাত্রছাত্রীরা সময় কাটাতে পারে, তাহলে আমরা তার চমৎকার একটা ফল দেখতে পাব তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
এই সরকার দেশের মানুষের কাছে দুটো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকার করে ক্ষমতায় এসেছিল। একটি হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীর বিচার, অন্যটি হচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন। ডিজিটাল বাংলাদেশের সঙ্গে স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েদের তথ্যপ্রযুক্তিতে জ্ঞান অর্জনের একটা সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। সম্ভবত সে কারণেই সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই আমরা একটা চিঠি পেয়েছিলাম। সেখানে আমাদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, মাধ্যমিক পর্যায়ে তথ্যপ্রযুক্তি নাম দিয়ে ৫০ নম্বরের নতুন একটা বিষয় খুলে দিলে কেমন হয়? কোনো কম্পিউটারে হাত দেবে না, শুধু বইয়ে কম্পিউটারের কথা পড়বে, সে জন্য নতুন করে আরও বাড়তি ৫০ নম্বর পরীক্ষা দিতে হবে। আমরা তাতে রাজি হইনি। এর কিছুদিন পর পাঠ্য বইয়ে মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত ভুল এবং বানোয়াট তথ্যগুলো সরানোর জন্য একটি কমিটি তৈরি করা হলো, অন্যদের সঙ্গে আমিও তার একজন সদস্য ছিলাম। সেই কমিটি থেকে তখন নতুন করে অনুরোধ করা হলো, স্কুলের ছেলেমেয়েদের যেন কম্পিউটার বা তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে কিছু লেখালেখি ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। পাঠ্য বইগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস তুলে ধরার সঙ্গে সঙ্গে আমরা তথ্যপ্রযুক্তির কথাও লিখে দিয়েছিলাম। সদস্যদের মধ্যে আমি যেহেতু এই লাইনের মানুষ, তাই আমাকে আলাদাভাবে বেশ কিছু লেখা লিখতে হয়েছিল। মাথায় রাখতে হয়েছিল প্রত্যন্ত গ্রামের একটি ছেলে, যে জীবনে কখনো একটি কম্পিউটার দেখেনি, সে যেন এ লেখাটি পড়েই কম্পিউটার সম্পর্কে একটা ধারণা করতে পারে। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো একটা কথা আছে, এটা তার থেকেও কঠিন। দুধের স্বাদ চুন গোলানো পানি দিয়ে মেটানোর অবস্থা।
এর আগে আমি কখনো পাঠ্য বইয়ের জন্য কিছু লিখিনি। সত্যি কথা বলতে কি এ ব্যাপারটিতে সব সময়ই আমার এক ধরনের অনিচ্ছা কাজ করেছে। আমি জানি, আমাদের দেশের স্কুলে (এমনকি কলেজেও) শিক্ষকেরা নিয়মিতভাবে, নির্দয়ভাবে ছাত্রছাত্রীদের বেত দিয়ে পেটান। এবং আমি মাঝেমধ্যেই কল্পনা করি, নিষ্ঠুর টাইপের একজন শিক্ষক ক্লাসে এসে জিজ্ঞেস করছেন, ‘বলো দেখি, অন্য যন্ত্রের সঙ্গে কম্পিউটারের পার্থক্য কোথায়?’ ছাত্রছাত্রীরা তার উত্তর দিতে পারছে না এবং শিক্ষক নির্দয়ভাবে ছাত্রছাত্রীদের পেটাচ্ছেন। আমার লেখার কারণে ছাত্রছাত্রীরা পিটুনি খাচ্ছে এবং আমার লেখার সঙ্গে সঙ্গে আমার প্রতিও তাদের একটা বিতৃষ্ণার জন্ম হচ্ছে, এ ধরনের একটা বিষয় কল্পনা করে আমি খানিকটা মানসিক যন্ত্রণায় ভুগি। (এই দেশের ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলের ছেলেমেয়েরা নাকি বাংলা পড়তে চায় না। তাদের বাংলায় উৎসাহী করার জন্য অনেক সময় জোর করে আমার লেখা কিশোর উপন্যাস পড়ানো হয় বলে শুনেছি। শুনে আতঙ্ক অনুভব করেছি। শখ করে পড়া আর জোর করে পড়ার মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য!)
যা-ই হোক, বাংলাদেশের স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের কম্পিউটার সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার জন্য শুধু পাঠ্য বইয়ে তার ছবি এবং বর্ণনার ওপর আমাদের ভরসা করে থাকতে হবে না। তারা আসলে সত্যিকার কম্পিউটারে হাত বুলিয়ে দেখতে পাবে, সেটি আমার জন্য খুব আনন্দের একটা ব্যাপার ছিল। তার একটা কারণ আছে এবং অনেকেই সেটা নিশ্চয়ই জানেন।
আমাদের দেশের যেসব নানা-নানি এবং দাদা-দাদি মোবাইল টেলিফোন ব্যবহার করেন, তাঁরা ইতিমধ্যে আবিষ্কার করেছেন মোবাইল ফোনের কোনো একটা দুর্বোধ্য ব্যাপার বোঝার সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে তাদের আট-দশ বছর নাতি কিংবা নাতনির শরণাপন্ন হওয়া। এই শিশুগুলো চোখের পলকে দুর্বোধ্য ফিচারের মর্মোদ্ধার করে দেয়। যেসব পরিবারে কম্পিউটার আছে, তারাও নিশ্চয়ই আবিষ্কার করেছে যে বাসার সবচেয়ে ছোট সদস্যটি সবার আগে কম্পিউটার চালানো শিখে ফেলে। যে শিশুটির এখনো অক্ষরজ্ঞান হয়নি, সেও কম্পিউটারে জটিল ফাইল সিস্টেমের মর্মোদ্ধার করতে পারে, মাউস ঘুরিয়ে ছবি আঁকতে পারে। (কম্পিউটারে গেম খেলা আমি ভালো উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করি না, তাই তার কথা বললাম না)। কাজেই যদি বাংলাদেশের স্কুলে স্কুলে ছোট ছোট কম্পিউটার ল্যাব তৈরি করে দেওয়া হয় এবং সেই স্কুল যদি পর্যায়ক্রমে তাদের ছাত্রছাত্রীদের সেই ল্যাব ব্যবহার করতে দেয়, আমার ধারণা, ধীরে ধীরে প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীই কম্পিউটার ব্যবহার করা শিখে যাবে। বলা যেতে পারে, এটা হবে একটা যুগান্তকারী ব্যাপার।
তবে সবাইকে মনে রাখতে হবে, কম্পিউটার একটা যন্ত্র এবং সেই যন্ত্রটা চালাতে বিদ্যুৎ লাগে। বাংলাদেশে বিদ্যুৎ এখনো সোনার হরিণ—গ্রামাঞ্চলের কথা তো ছেড়েই দিলাম। শুধু তা-ই নয়, এই যন্ত্র অন্য যেকোনো যন্ত্রের মতো মাঝেমধ্যে নষ্ট হয় এবং তখন সেটা সারাতে হয়। কাজেই কোনো স্কুলে কম্পিউটার ল্যাব তৈরি করার সঙ্গে সঙ্গে যদি কম্পিউটার সারানোর একটা পথ তৈরি করে দেওয়া না হয় তাহলে দেখব, বছরখানেকের মধ্যে বেশির ভাগই অকেজো হয়ে পড়ে আছে। (তবে সৌভাগ্যের কথা, ডেস্কটপ কম্পিউটার সারানো সহজ। ল্যাপটপ কম্পিউটার সারানো অনেক খরচসাপেক্ষ। সে জন্য আমরা এখনো আমাদের ল্যাবে ল্যাপটপ কম্পিউটার দিতে সাহস পাই না। সবচেয়ে ভয়ংকর হচ্ছে, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, তার ভেতরে প্রখর আলোর যে বাল্বটি রয়েছে, তার দাম ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা! বাল্ব নেভানোর পর সেটাকে যদি ফ্যান ঘুরিয়ে ধীরে ধীরে ঠান্ডা না করা হয়, তাহলে তার ফিলামেন্ট কেটে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, তাই সেটাকে মোটামুটি সম্মান করে ব্যবহার করতে হয়!)
৩.
আমি শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির একজন সদস্য হিসেবে কাজ করেছি। আমার মনে আছে, আমরা তথ্যপ্রযুক্তিকে শিক্ষানীতিতে খুব গুরুত্ব দিয়েছি। কিন্তু তার একটা বড় সমস্যা সমাধান করতে পারিনি। বাংলাদেশের প্রায় ৬০ হাজার স্কুলে কম্পিউটার কেমন করে পৌঁছে দেওয়া হবে? আমরা তাই অনুমান করে নিয়েছিলাম সত্যিকারের কম্পিউটারে হাত চালানোর আগে তারা হয়তো বইপত্রেই তার বর্ণনা পড়বে। কোনো বড় ধরনের হইচই না করেই বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল প্রায় দুই হাজার স্কুলে কম্পিউটার ল্যাব তৈরি করে দিয়েছে, সেটি একটি অসাধারণ ব্যাপার। এখন আমার কাছে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের সব স্কুলেই কম্পিউটার পৌঁছে দেওয়া হয়তো অসম্ভব কোনো ব্যাপার নয়। স্কুল কর্তৃপক্ষ যদি ছাত্রছাত্রীদের সেই কম্পিউটার ব্যবহার করতে দেয়, তাহলে আমরা কিছুদিনের মধ্যেই এই দেশের একটি তরুণ প্রজন্ম পেয়ে যাব, যাদের সবাই কম্পিউটার ব্যবহার করতে জানে। সেটি হবে একটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার।
আমরা সবাই মিলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা স্কুল তৈরি করেছিলাম। সেই স্কুলে একটা লাইব্রেরি তৈরি করা হলো। লাইব্রেরির সব বইয়ে বারকোড দেওয়া হলো এবং সব ছাত্রছাত্রীকে বারকোড দেওয়া আইডি কার্ড দেওয়া হলো। তখন বই দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপারটি হয়ে গেল পানির মতো সহজ। একজন ছাত্র একটা বই নেওয়ার জন্য হাজির হলে বারকোড রিডার দিয়ে একবার তার আইডি কার্ডে ক্লিক করতে হয়, একবার বইয়ে ক্লিক করতে হয়। সঙ্গে সঙ্গেই কম্পিউটারের ডেটাবেইসে কে কবে কোন বইটি নিয়েছে সেটা লেখা হয়ে যায়। যেহেতু ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল মাত্র কয়েক শ এবং বই মাত্র কয়েক হাজার, তাই কাজটি করা সম্ভব হয়েছিল এবং আমরা কৌতুক করে বলতাম, এটা হচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ কম্পিউটারাইজড লাইব্রেরি। কিন্তু আমি এই লাইব্রেরির গল্প শোনানোর জন্য বিষয়টি অবতারণা করিনি। আমি বিষয়টির অবতারণা করেছি অন্য কারণে। এই লাইব্রেরিটি চালাতো স্কুলের বাচ্চা ছেলেমেয়েরা, কোনো শিক্ষক তার দায়িত্বে ছিলেন না। ক্লাস ফোর-ফাইভের ছেলেমেয়েরা পালাক্রমে লাইব্রেরিয়ানের দায়িত্ব পালন করে কম্পিউটার এবং বারকোড রিডার দিয়ে বই ইস্যু করত, বই জমা নিত, তাদের কখনো কোনো সমস্যা হয়নি! ছোট বাচ্চাদের সুযোগ দেওয়া হলে তারা কী করতে পারে, এটাই হচ্ছে তার একটা উদাহরণ। (জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর আমাদের সবাইকে স্কুল কমিটি থেকে সরিয়ে দিল। তারপর আর সেই স্কুলের ধারে-কাছে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। খবর পেয়েছি, লাইব্রেরি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, দেয়ালে টাঙানো বড় বড় মনীষীর ছবি নামিয়ে ফেলা হয়েছে—মানুষের ছবি যে ঘরে থাকে, সেই ঘরে নাকি নামাজ পড়া যায় না!) পাঠকদের মন খারাপ করার কারণ নেই, স্কুলটিকে আবার দাঁড় করানো হচ্ছে।
৪.
আমরা সব সময়ই কম্পিউটার-সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি করে ফেলি। এটি চমৎকার একটি যন্ত্র কিন্তু এটা কিন্তু মোটেও শিক্ষার বিকল্প নয়। কাজেই কম্পিউটার আমাদের বুঝতে হবে বাংলাদেশের প্রতিটা স্কুলের একজন শিক্ষককে ল্যাপটপ আর মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর দিয়ে দিলেই লেখাপড়ার উন্নতি হতে শুরু করবে না।
কিন্তু আমি মোটামুটি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, কম্পিউটারের মতো এই চমৎকার যন্ত্রটি (tool) যদি ছাত্রছাত্রীদের হাতে তুলে দেওয়া যায়, আমরা তার একটা ফল পাবই পাব।
আমরা কিন্তু এর মধ্যেই সেটা দেখতে শুরু করেছি।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল: লেখক। অধ্যাপক শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments