কালের পুরাণ-আদালত ভুল স্বীকার করলেন, রাজনীতিকেরা করবেন কি? by সোহরাব হাসান

সংবিধানের মৌল নীতি বা কাঠামো নিয়ে ৩৯ বছর ধরে যে বিতর্ক ও বিরোধ চলে আসছিল, মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ে তার অবসান হবে কি না, সে প্রশ্নের উত্তর একমাত্র ভবিষ্যৎই দিতে পারে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাকের মতো রাজনৈতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাকও সাধারণ মানুষকে যেমন নিয়ত উদ্বিগ্ন রাখে, তেমনি দেশের অগ্রযাত্রাকেও করে ব্যাহত।


বাংলাদেশে সবকিছু ঘটে আকস্মিক ও অস্বাভাবিক কায়দায়। বাহাত্তর সালে যখন নব আনন্দে নতুন দেশ গড়ার মহান ব্রত নিয়ে সুমহান সংবিধান প্রণীত হয়েছিল, তখন কেউ ভাবতেও পারেনি যে ২৬ মাসের মাথায় তার খোলনলচে পাল্টে দেওয়া হবে। কায়েম হবে একদলীয় শাসন। এ জন্য তৎকালীন শাসক দল না বিরোধী শিবিরের অতিবিপ্লবীরা বেশি দায়ী, সে বিতর্কে না গিয়েও যে কথাটি বলা প্রয়োজন তা হলো, এর দায় আমরা কেউ এড়াতে পারি না।
আবার ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার সময়ও কারও ভাবনায় ছিল না, আট মাসের ব্যবধানে এ দেশে ঘটবে ইতিহাসের ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ড, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যিনি স্থপতি, তাঁরই রক্তে রঞ্জিত হবে মাটি, নিষিদ্ধ হবে তাঁর নাম। কারও ভাবনায় ছিল না, ঘাতকেরা এভাবে উল্লাসে ফেটে পড়বে, খলনায়কেরা সূর্যসন্তানের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে। এ জন্য কি কেবল ‘উর্দি পরা ছয় মেজর’ই দায়ী? মনে হয় না। দুই মাস আগে ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে যাঁরা বাকশালে যোগদানের জন্য লম্বা লাইন দিয়েছিলেন, তাঁদেরই অনেকে ১৫ আগস্টের হত্যাযজ্ঞকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। জাতি হিসেবে, মানুষ হিসেবে কত ছোট আমরা!
পরের ইতিহাস ছিল রক্তাক্ত, বেদনাহত। ক্ষমতা গ্রহণের ৮১ দিনের মধ্যে ১৫ আগস্টের ক্যুদাতাদের পায়ের নিচের মাটি সরে যায়, দেশে-বিদেশে তাঁরা সমর্থন হারায়। ২ নভেম্বর যে খালেদ মোশাররফ সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দৃশ্যপটে আসেন, সাধারণ জওয়ানদের সমর্থনের অভাবে তাঁকেও বিদায় নিতে হয় ভারতীয় ক্রীড়নকের মিথ্যে অপবাদ নিয়ে। একাত্তরের রণাঙ্গনের সবচেয়ে সাহসী যোদ্ধাকে কারা এবং কেন হত্যা করল, আজও তা রহস্যাবৃত। কেউ দায়িত্ব স্বীকার করেনি, এমনকি সিপাহি বিপ্লবের তথাকথিত নায়কেরাও খালেদ মোশাররফের প্রশ্নটি সযত্নে এড়িয়ে যান। ৭ নভেম্বর কর্নেল আবু তাহের ও জিয়াউর রহমান যখন যৌথভাবে সিপাহি বিপ্লবের গৌরবের দাবি করেন, খোলা জিপে সেনাদের সতর্ক করে দিচ্ছেন দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র সম্পর্কে, তখন তাদের জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে সেনানিবাসে চলছিল অফিসার হত্যার পালা। নির্বিচার মানুষ হত্যা যদি বিপ্লব হয়, বাংলাদেশের মানুষ বহুবার তা প্রত্যক্ষ করেছে।
১৯৭৭ সালের গণভোটে জিয়াউর রহমানের হ্যাঁ বাক্সে যখন ৯৮ শতাংশ ভোট পড়ে, তখন কি কেউ ভাবছিলেন, তাঁকে রোজকেয়ামতের আগে কেউ ক্ষমতা থেকে নামাতে পারবে? যে সেনাবাহিনী তাঁর ক্ষমতার উৎস ছিল, সেই সেনাবাহিনীর একাংশ তাঁকে হত্যা করে ১৯৮১ সালের ৩০ মে। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ, যেদিন হুসেইন মুহম্মদ নামের এক সেনাপতি ক্ষমতা দখল করেন, সেদিন কি কেউ ভেবেছিলেন, ১০ বছর তিনি দেশ শাসন করতে পারবেন? কীভাবে পারলেন? পারলেন রাজনীতিকদের অনৈক্য ও সুবিধাবাদিতার কারণে। ১৯৯০-এ এক গণ-অভ্যুত্থানে তাঁকে বিদায় নিতে হয়। পৃথিবীর কোনো দেশে পরিত্যক্ত স্বৈরশাসকেরা রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে দাপট দেখাতে পারেন না। এরশাদ দেখাচ্ছেন। তাও রাজনীতিকদের কারণে। কখনো এ দল তাঁকে কাছে টানে, কখনো ও দল।
দুর্নীতি ও দুঃশাসনে পীড়িত মানুষ ক্ষমতার হাতবদলে খুশি হয়, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। ভাবে, এবারে তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে। রাজনীতিকদের ভাগ্য বদল হয়, সামরিক-বেসামরিক আমলাদের ভাগ্য বদল, ব্যবসায়ীদের চেহারায় ঔজ্জ্বল্য ফিরে আসে। কিন্তু সাধারণ মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয় না।
সুপ্রিম কোর্টের এই ঐতিহাসিক রায় আগের, বর্তমান ও ভবিষ্যতের শাসকদের জন্য এক লালসংকেত হিসেবে চিহ্নিত হবে। এই রায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল পর্যন্ত সব সামরিক ফরমান ও অধ্যাদেশকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন। সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন, কোনো অবস্থায়ই সামরিক শাসন জারি বা সংবিধান স্থগিত করা যাবে না। আদালত তিন ব্যক্তিকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন, খোন্দকার মোশতাক আহমদ, বিচারপতি মোহাম্মদ সায়েম ও জিয়াউর রহমান। তাঁরা প্রয়াত। তাঁদের বিচার করার সুযোগ নেই। কিন্তু আরেকজন সেনাশাসক এখনো জীবিত আছেন, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তিনি একনাগাড়ে সর্বাধিক সময় ক্ষমতায় ছিলেন। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর। আমরা যত দূর জানি, এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে একটি রিট করা হয়েছিল। সেটি আমলে নিয়ে মহামান্য আদালত আরেকটি ঐতিহাসিক রায় দিতে পারেন। সংবিধান লঙ্ঘনের দায়ে মোশতাক, সায়েম ও জিয়া অভিযুক্ত হলে এরশাদ ছাড়া পাবেন কেন? পঞ্চম সংশোধনী অন্তত একদলীয় শাসন থেকে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করেছিল। হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের রায়ে তা উল্লেখও করা হয়েছে। কিন্তু সপ্তম সংশোধনীতে এ ধরনের ভালো কাজের উদাহরণ নেই। বরং ১৯৮৮ সালে ভোটারবিহীন সংসদে এরশাদ গদি রক্ষার শেষ অবলম্বন হিসেবে রাষ্ট্রধর্ম বিল পাস করিয়েছিলেন। সামরিক আইন জারি ও সংবিধান সংশোধনের দায়ে পূর্ববর্তী তিন শাসক নিন্দিত হলে চতুর্থ শাসক নন্দিত হবেন কেন?
আদালতে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করার বড় কারণ, সংবিধানের মৌল কাঠামো পরিবর্তন। রাষ্ট্রীয় চার মৌল নীতির অন্যতম ধর্মনিরপেক্ষতা। এর বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মূল সংবিধানে সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা, রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মের রাজনৈতিক মর্যাদা দান, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার, কোনো বিশেষ ধর্মপালনকারী শক্তির প্রতি বৈষম্য, তার ওপর নিপীড়ন বিলোপ করার কথা বলা হয়েছে (অনুচ্ছেদ-১২)। পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে এই ধারাটি বাতিল করা হয়েছিল। সপ্তম সংশোধনীতে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এর অর্থ, অন্যান্য ধর্মাবলম্বী দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক এবং তারা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পাবে না। এ ধরনের আইন যেমন বৈষম্যমূলক তেমনি মানবতাবিরোধীও। এ আইন বহাল রেখে বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়।
আদালত এই রায়ের মাধ্যমে কেবল সামরিক শাসনকেই অবৈধ বলে চিহ্নিত করেননি, তাঁরা নিজেদের দোষও স্বীকার করেছেন। আদালত বলেছেন, ‘অতীতে সুপ্রিম কোর্ট ভুল করে সামরিক শাসনকে বৈধতা দিয়েছেন।’ এই প্রথম বাংলাদেশে উচ্চ আদালত অতীত কাজের সমালোচনা করলেন। এ জন্য আদালতকে অভিনন্দন জানাই।
নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে আইনি লড়াই চলে আসছে সেই পাকিস্তানি আমল থেকে। ১৯৫৫ সালে গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ যখন পাকিস্তান গণপরিষদ ভেঙে দিলেন, তখন তাঁর বিরুদ্ধে স্পিকার তমিজউদ্দিন খান মামলা করেছিলেন। লাহোর হাইকোর্ট এই পদক্ষেপকে বেআইনি ঘোষণা করলেও সুপ্রিম কোর্ট বৈধতা দিয়েছিলেন। এভাবে আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান, জিয়াউল হক ও পারভেজ মোশাররফের সামরিক শাসনও বৈধতা পেয়ে যায়।
বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের পনেরোই আগস্ট, যেদিন দেশের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করে কিংবা ১৯৮২ সালে যখন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে সরিয়ে উচ্চাভিলাষী সেনানায়ক ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন, তখন যদি উচ্চ আদালত তাঁর বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতেন, তাহলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস হয়তো ভিন্ন হতো। বারবার সামরিক শাসনের জগদ্দল পাথর দেশবাসীর ওপর চেপে বসতে পারত না। পাকিস্তানের কাছ থেকে আমরা সামরিক শাসনসহ অনেক অপকীর্তি উত্তরাধিকারসূত্রে বয়ে বেড়াচ্ছি। পাকিস্তানের প্রথম সেনাশাসক আইয়ুব খান থেকে শুরু করে সব সেনাশাসকই নিজেদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে গণভোটের আশ্রয় নিয়েছিলেন। আপিল বিভাগের রায়ে গণভোটকে বাতিল করা হয়েছে। ফলে তথাকথিত গণভোটের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত শাসনও বাতিল হয়ে গেল। অতীতে সামরিক শাসনকে বৈধতা দিতে রাজনীতিকেরা এক পায়ে খাড়া ছিলেন, বিচারকেরাও পিছিয়ে ছিলেন না। জিয়ার রাজনীতির প্রধান পরামর্শক ছিলেন বিচারপতি সাত্তার। বিচারপতি সায়েমের দায়িত্ব গ্রহণকে পরিস্থিতির প্রয়োজন হিসেবে দেখা গেলেও বিচারপতি আহসান উদ্দিন আহমেদের বিষয়টি কীভাবে নেওয়া হবে? তাঁকে তো ধরে-বেঁধে কেউ রাষ্ট্রপতি করেননি। সামরিক শাসকেরা প্রয়োজনে সিভিলিয়ানদের রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দেন, আবার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে তাদের ছুড়ে ফেলে দিতেও দ্বিধা করেন না। জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বিচারপতি সায়েমের বিরোধ কিংবা এরশাদের শাসনামলে আতাউর রহমান খানের প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণ ও বিদায়ের পেছনেও এই কূটকৌশল কাজ করেছে।
সম্প্রতি পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদও এক আইনে জিয়াউল হকের সামরিক শাসন তথা অষ্টম সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশের সংবিধানে কালো ক্ষতের মতো লেপ্টে থাকা অষ্টম সংশোধনী কবে বাতিল হবে, সেটাই প্রশ্ন। রাজনীতিকেরা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে যতটা পশ্চাৎপদ ভাবছেন, আসলে তারা ততটা পশ্চাৎপদ নয়। এত দিন রাজনীতিকেরা সংবিধানের সংশোধনী নিয়ে কথা বলতে ভয় পেতেন, শব্দচয়নে অতি সতর্ক ছিলেন, এমনকি ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটিও মুখে আনতেন না। বলতেন অসাম্প্রদায়িকতা। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের রায়ে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে যখন ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিস্থাপন করা হলো, তখন জনগণের মধ্যে কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়নি। বাংলাদেশের মানুষ যে রাজনীতিকদের চেয়ে অগ্রগামী, তা আবারও প্রমাণিত হলো।
আগের জরুরি কথাটি সবার শেষে বলতে চাই। আদালত তাঁর ঐতিহাসিক রায়ে নিজেদের ভুল স্বীকার করেছেন। প্রশ্ন হলো, রাজনীতিকেরা কবে তাঁদের ভুলটি স্বীকার করবেন? রাজনীতিকদের ভুলের কারণেই সাংবিধানিক শাসন ব্যাহত হয়। ভুল স্বীকার না করলে ভুল শুধরানোরও প্রশ্ন আসে না। ব্যক্তি ভুল করলে তার জন্য হয়তো একজনকেই কাফফারা দিতে হয়। কিন্তু রাজনীতিকেরা ভুল করলে তার জন্য কাফফারা দিতে হয় সমগ্র জাতিকে। আদালত অতীতের ভুলের জন্য রাজনীতিকদের ভর্ৎসনা করেছেন, আশা করি রাজনীতিকেরা এমন কোনো ভুল করবেন না, যাতে ভবিষ্যতেও তাঁদের একইভাবে ভর্ৎসনা শুনতে হয়।
সোহরাব হাসান: সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.