লাল-সবুজের পাশে-নীল টুপি, লাল-সবুজ হূদয় by আনিসুল হক

আবিদজান থেকে শুরু করেছিলাম যাত্রা। আবার এসে পৌঁছালাম আইভরি কোস্টের এই বাণিজ্যিক রাজধানীতে। মধ্যখানে ছয় দিনে আমরা সড়কপথে ভ্রমণ করেছি দুই হাজার কিলোমিটার—টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ার মধ্যকার দূরত্বের দ্বিগুণ।
আবিদজানে আছে বাংলাদেশের নৌবাহিনীর দুটো নৌযান।


১৪ জন সদস্য এই নৌ কন্টিনজেন্টের। কমান্ডার হলেন লে. কর্নেল আল আমিন মজুমদার। আবিদজান শহরটি ঘেরা জলাধার দিয়ে। সেখানেই বিচরণ এই নৌযান দুটোর। জাতিসংঘের দপ্তর পাহারা দেওয়ার কাজে নিয়োজিত ব্যানসাপোর্ট ব্যাটালিয়নেরই অংশ তাঁরা।
এরই মধ্যে তাঁরা তাঁদের ভালো কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন জাতিসংঘের আইভরি কোস্ট বাহিনীর কমান্ডার জেনারেল নাকুদে বেরেনার প্রশংসাপত্র। ২০১১ সালের ১৫ অক্টোবর গ্র্যান্ড বাসাম খালে নৌকাডুবি হয়। বাসাম শহরের ডেপুটি মেয়রসহ ওই নৌকায় সাতজন যাত্রী ছিলেন। খবর আসে বাংলাদেশের নৌসেনাদের কাছে। কিন্তু তাঁদের নৌযান দুটো যে লেগুনে, সেখান থেকে ওই খালের সংযোগ নেই। তবু তাতে হতবুদ্ধি হলেন না নৌসেনারা। তাঁরা ছুটে গেলেন ওই খালের পাড়ে। বেসরকারি নৌযান ভাড়া করে রওনা হলেন ঘটনাস্থলে। শুরু করলেন উদ্ধারের তৎপরতা।
৫ আগস্ট একটা বাস ব্রিজ ভেঙে পানিতে পড়ে যায়। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা তাঁদের নৌযান নিয়ে উদ্ধারকাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। দেশ-বিদেশের প্রচারমাধ্যমে এই উদ্ধার-তৎপরতার খবর প্রকাশিত হয়।
আবিদজানে জাতিসংঘের দাপ্তরিক কাজ করেন যাঁরা, তাঁরা থাকেন বাংলা হাউস নামের একটা ভাড়া করা বাসায়। নৌবাহিনীর কর্নেল সাইদুজ্জামানসহ প্রায় ১০ জন থাকেন ওই বাড়িতে। ওই এলাকাটা আমাদের গুলশান-বনানীর মতো, কিছুটা। গাছপালায় ঢাকা আবাসিক এলাকা। সেখানে দেখা হলো আরেক আফ্রিকান তরুণ সোলেমানের সঙ্গে, যে কিনা অনর্গল বাংলা বলতে পারে। তাঁর ভাষ্য হলো, বাগবো আসলে ফ্রান্সের খবরদারি বন্ধ করতে চেয়েছিলেন। তাই ফ্রান্স তাঁকে সরিয়ে দিয়েছে। তবে বাগবো ভালো লোক ছিলেন না। কারণ, তিনি শুধু নিজের আর নিজের পরিবারের স্বার্থ দেখেছেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট ওয়াতারা ভালো মানুষ। তিনি দেশের অর্থনীতিকে দাঁড় করাতে চান, যাতে আইভরি কোস্টের সব মানুষেরই উন্নতি হয়। তবে তিনি ফ্রান্সের সঙ্গে মিলেমিশে চলতে চান।
আমাদের ঘরে ফেরার সময় হয়ে এল। আজ ১ ফেব্রুয়ারি আমরা ঢাকার উদ্দেশে আবিদজান শহর ছেড়ে উড়াল দেব।
এই কয়েক দিনে নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। বন্ধুত্ব হয়েছে। কত নতুন জায়গা দেখা হলো। যখনই আমরা একেকটা ক্যাম্প থেকে বিদায় নিচ্ছিলাম, তখন যাঁরা আমাদের বিদায় দিচ্ছিলেন তাঁদের চোখের কোণে চিকচিক করছিল মায়ার জল। আমরা চলে যাব। তাঁদের থাকতে হবে—কেউ হয়তো থাকবেন কয়েক দিন, কেউ কয়েক মাস; কেউ বা কেবল এলেন, থাকবেন পুরো বছর। একেকটা অচেনা-অজানা জায়গায় গাছ কেটে মাটি খুঁড়ে অনেকেই ক্যাম্প বানিয়েছেন। সেই সব ক্যাম্প পুরোনো হয়ে গেছে। এখন যাঁরা আসবেন, তাঁরা থাকবেন তৈরি ক্যাম্পে। তবু স্বজন-স্বদেশ ছেড়ে এত দূরে থাকা সহজ ব্যাপার নয়। প্রত্যেকেই আসলে দেশে ফেরার সময় গুনছেন; কেউ গুনছেন ঘণ্টার হিসাবে, কেউ গুনছেন মাসের হিসাবে।
প্রবাসের কষ্টকর জীবন আনন্দময় করার জন্য তাঁরা পয়লা বৈশাখ, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস পালন করেন; খেলাধুলা করেন, দেয়ালপত্রিকা প্রকাশ করেন। আর যুদ্ধ-সংঘাতের উত্তেজনা তো আছেই।
বিদেশের মাটিতে নীল টুপি মাথায় দিয়ে তাঁরা জাতিসংঘের হয়ে শান্তিরক্ষার কাজ করে চলেন নিষ্ঠার সঙ্গে, পেশাদারির সঙ্গে। শৃঙ্খলাভঙ্গ, নৈতিকতাবিরোধী কোনো কাজের অভিযোগ বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের সম্পর্কে শোনা যায় না। তাঁরা জানেন, মাথায় নীল ক্যাপ থাকলেও তাঁদের বাহুতে আছে লাল-সবুজ ব্যাজ; তাঁদের হূদয়ে আছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের মাথা তাঁরা কিছুতেই নিচু হতে দিতে পারেন না।

No comments

Powered by Blogger.