ভ্রান্তিবিলাসে আর কতকাল? by একেএম শাহনাওয়াজ

লিখতে ভালো লাগছে না, বলতে ভালো লাগছে না, ভাবতেও ভালো লাগছে না; তবুও সত্য এড়িয়ে যাওয়ার উপায় কী! বিবেক বলছে, কথা বলতেই হবে। ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, ভবিষ্যতের ইতিহাসবিদ দূর অতীতের বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে লিখতে গিয়ে একুশ শতকের বাংলাদেশের কলুষিত রাজনীতি ও কলংকিত রাজনীতিকদের কথা লিখবেন। তাতে বাংলাদেশের সুদূর অতীতের ঔজ্জ্বল্য অনেকটাই ঢাকা পড়ে যাবে। দেশটি লাঞ্ছিত হবে কিছুসংখ্যক অমানবিক, অসংস্কৃতবান, স্বার্থপর, লোভী রাজনীতিক আর তাদের পদলেহী কিছুসংখ্যক পেশাজীবীর কারণে। ইতিহাসের কাঠগড়ায় যদিও তারাই দাঁড়াবেন। তারপরও বাংলাদেশের মানুষের দীর্ঘদিনের লালিত অহমিকা কি ভূলুণ্ঠিত হবে না?
আমাদের ক্ষমতার রাজনীতিকদের বারবারই মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। গণতন্ত্রের বুলি শুনেছে; কিন্তু এর প্রায়োগিক ভূমিকা দেখেনি। সব পক্ষের শাসনকালেই সুশাসন সুদূরপরাহত হয়েছে। সাধারণ মানুষকে আগ বাড়িয়ে বলার দরকার হয়নি- বিবদমান পক্ষগুলোই একে অন্যকে চোর, দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী, খুনি বলেছে- বলে যাচ্ছে। দেশপ্রেমের বদলে দলপ্রেম এবং নেতৃত্বের একনায়কতান্ত্রিক আচরণ প্রত্যক্ষ করেছে মানুষ। নির্লোভ, দেশপ্রেমিক, প্রকৃত গণতান্ত্রিক চেতনা আশ্রয়ী কোনো নেতৃত্বের সংঘশক্তি দৃশ্যমান না থাকায় সুন্দরের পক্ষে মানুষ ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি। ফলে একই বৃত্তে দাপটের সঙ্গে
ক্ষমতাপ্রিয় দলগুলোই আবর্তিত হচ্ছে বারবার। তবুও মানুষ অগত্যা মন্দের ভালো নিয়ে তুষ্ট থাকতে চেয়েছে। একপক্ষ রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকলে অন্যপক্ষ দাপটের সঙ্গে বিরোধী পক্ষে থাকবে এটিই স্বাভাবিক রীতি। এতে বজায় থাকবে শক্তির ভারসাম্য।
সরকার পক্ষ স্বৈরাচারী মনোভাব বজায় রাখতে পারবে না।
এবার আন্দোলনের নামে টানা অবরোধ-হরতাল কর্মসূচি ও সহিংসতার কারণে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে যে ক্ষতিগ্রস্ত হল তাতে এখন সে সম্ভাবনাও তিরোহিত হয়ে যাচ্ছে। বিএনপি একটি বড় জনপ্রিয় দল। এ দলের কর্মী, সমর্থক এবং তৃণমূলের অনেক নেতাও- যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় ভাগ বসান না, নিজ দলকে গণতান্ত্রিক অবয়বেই দেখতে চান- তারা জামায়াতি চেহারায় সন্ত্রাসী দল হিসেবে আপন দলকে দেখতে চাননি। ব্যক্তি ও পরিবারের স্বার্থ রক্ষার জন্য দল কলংকতিলক কপালে পড়ুক, তা উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বিএনপি নেতাকর্মীর কাম্য নয়। তাই এবার বিএনপি জোটের দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচির কারণে অনেক কর্মী-সমর্থক দিন দিন হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। এর প্রমাণ দেখা গেল ১৪ ফেব্রুয়ারিতে।
ভুল রাজনীতির কারণে বিএনপি নেতৃত্ব যখন ব্যর্থ হচ্ছিল, তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল পরবর্তী কর্মসূচিতে যাওয়ার আগে কর্মী-সমর্থকদের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো বাস্তব অবস্থা যাচাই করার। এ কারণেই টেস্ট কেস হিসেবে দেশব্যাপী বিক্ষোভ কর্মসূচির ডাক দিয়েছিল ১৪ ফেব্রুয়ারি। পাঁচ-দশটি এলাকায় ঝটিকা মিছিল ছাড়া এবারও কর্মীদের মাঠে নামাতে ব্যর্থ হয়েছে বিএনপি জোট। আশা করেছিলাম, এদিন অন্তত খালেদা জিয়া তার অনুসারীদের নিয়ে পথে দাঁড়িয়ে বিক্ষোভ করবেন। কিন্তু তারা সে উদাহরণ রাখেননি। ভাবখানা এমন, ঝড়-ঝাপটা যা যাওয়ার তা সাধারণ কর্মী-সমর্থকদের ওপর দিয়ে যাক। অতি জ্ঞানীরা বলে থাকেন, এমন পুলিশি অত্যাচার থাকলে কেমন করে পথে নামবেন নেতা-নেত্রীরা! মুক্তচিন্তার মানুষ উত্তরে বলবেন, আমাদের এ ধারার বুর্জোয়া রাজনীতিতে কবেইবা বিরোধী দলের রাজনীতির পথে ফুল
বিছানো ছিল? যারা আন্দোলন করেছে, তারা কণ্টক বিছানো পথে পা ক্ষতবিক্ষত হবে জেনেই নেমেছে। আর এ বাস্তবতা পেতে চাইলে দলের কর্মসূচির বস্তুনিষ্ঠতার প্রতি সমর্থকদের আস্থা থাকতে হবে।
কিন্তু সেই আস্থার জায়গাটি নষ্ট হয়ে গেছে। আমরা মনে করি, ১৪ ফেব্রুয়ারির পরীক্ষায় ফলাফল ইতিবাচক না হওয়ায় পরিণতি নিয়ে বিএনপির নতুন করে উদ্বেগ বেড়েছে। ১৫ ফেব্রুয়ারি আমি ক্যাম্পাসের ব্যাংকে গিয়েছিলাম। ম্যানেজার সাহেব সজ্জন মানুষ। বললেন, স্যার আপনি তো কাগজে লেখেন। এ অবস্থা আর কতকাল চলবে? আমি আমার বিবেচনা মতো বললাম, কেরোসিনের কুপিতে ততক্ষণই আলো জ্বলে যতক্ষণ তেল থাকে। তেল ফুরিয়ে গেলে ধপ করে নিভে যায়। আমার ধারণা, তেল ফুরিয়ে যাওয়ার সময় এসে যাচ্ছে। তবে ধপ করে নিভে যাওয়াটা বিএনপির জন্য মঙ্গলের হবে না। দলীয় স্বার্থেই জেতা-হারার লড়াইয়ে না থেকে সমাধানের পথে বিএনপিকে নেমে আসতে হবে। সুবিধাজনক আসনে বসে যদি সরকার পক্ষের হাতে স্টিয়ারিং থাকে, তবে আমাদের রাজনীতির
বাস্তবতায় সরকার পক্ষ নেমে আসবে না। তাছাড়া কর্মসূচির নামে মানবতাবিরোধী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে বিএনপি নেতারাই তো সরকার পক্ষকে শক্ত হয়ে থাকতে রসদ জুগিয়েছেন।
দলীয় প্রস্তুতির অনেক আগেই সংবাদকর্মীদের পীড়াপীড়িতে খালেদা জিয়ার হঠাৎ লাগাতার অবরোধ কর্মসূচির ঘোষণায় আমরা অনেকেই চমকে গিয়েছিলাম। এ নিয়ে বিশ্লেষণ সে সময় কাগজে আমরা অনেকেই করেছি। আমাদের বারবার মনে হয়েছে, এমন অপরিণামদর্শিতার ফল বিএনপির জন্য শুভ হবে না। নেতাকর্মী ও গণমানুষকে আন্দোলনের পক্ষে মাঠে না নামাতে পারলে সে আন্দোলন কখনও সফল হয় না। ভেবেছিলাম, ভুল সংশোধন করে এ অসময়ের অপরিপক্ব আন্দোলন থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ খুঁজবে বিএনপি। দু’বার সুযোগ এসেছিল। প্রথমবার ছিল বিশ্ব ইজতেমা সামনে রেখে সরকারকে ভবিষ্যৎ আন্দোলনের অগ্রিম হুমকি দিয়ে প্যাভেলিয়নে ফিরে আসা। দ্বিতীয়বারের সুযোগটি ছিল এসএসসি পরীক্ষা শুরু হওয়ার সময়। অনেকটা পানি ঘোলা করার পরও বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করে এসএসসি পরীক্ষাকে উসিলা ধরে ফিরে আসতে পারত
তারা। এ পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে বিএনপির আন্দোলন মুলতবি করার সুযোগ ছিল। এভাবে এক্সপ্রেস ট্রেন ও লোকাল ট্রেন দুটোই মিস করল বিএনপি।
সবচেয়ে দুর্ভাগ্য, কাঠামোগত দিক থেকে এবং প্রচারিত আদর্শের বিচারে বিএনপি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। জঙ্গিবাদী জামায়াতের সঙ্গে রাজনৈতিক বন্ধুত্ব থাকলেও লাখ লাখ বিএনপি নেতাকর্মী-সমর্থক তাদের দলকে জঙ্গি দল মনে করে না। ৫ জানুয়ারি ২০১৪-এর নির্বাচন ঠেকাতে জামায়াতের হাতে জঙ্গি আচরণের দায়িত্ব দিয়ে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে নিজের অনেক ক্ষতি করেছিল। সচেতন মানুষ মনে করেছিল, এ শিক্ষাটি বিএনপি মনে রাখবে। তা ছাড়া এদেশের দীর্ঘ ইতিহাস বিচার করলেও বিএনপি নেতৃত্বের বোঝা উচিত ছিল গণমানুষের অংশগ্রহণ ছাড়া সন্ত্রাসী তৎপরতায় সরকারের পতন সম্ভব নয়। আর আওয়ামী লীগের মতো প্রতিপক্ষকে দুর্বল করতে হলে প্রকৃত গণআন্দোলনের শক্তিই ছড়িয়ে দিতে হবে।
বিএনপি নেতৃত্বের ভ্রান্তিবিলাসে এসব শিক্ষা কাজে এলো না। আমাদের ধারণা নিকট অতীতে জামায়াত সুচতুরভাবে নিজেদের ওপর বিএনপিকে নির্ভরশীল করে তুলেছিল। বলা যায়, নিজ লভ্যাংশ ঘরে তোলার জন্য জামায়াত সুনিপুণভাবে বিএনপিকে ব্যবহার করল। অবশ্য আমরা বিশ্বাস করি, এক্ষেত্রে বিএনপির প্রভাবশালী কোনো কোনো নেতা-নেত্রীর সমর্থন পেয়েছে জামায়াত।
বিএনপির দেশজুড়ে যে জনসমর্থন, আমরা বারবার সে শক্তিকে ব্যবহার করে দলটিকে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পথে হাঁটতে অনুরোধ করেছিলাম। বিএনপি নেতৃত্ব সে পথে হাঁটেননি। এবার জামায়াতি ফর্মুলা গণতান্ত্রিক দলকে জঙ্গিবাদী দর্শনে ঠেলে দিল। আমাদের ধারণা, বিএনপি ভেবেছিল এভাবে পেট্রলবোমা আর ককটেল ছুড়ে সরকারকে অসহায় করে তুলবে। এতে নাশকতা দমনে সরকার ব্যর্থ বলে সাধারণ মানুষ আওয়ামী লীগ সরকারের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। অন্যদিকে চাপে পড়ে সরকার বিএনপির সঙ্গে একটি আপসরফায় আসবে। মধ্যবর্তী নির্বাচন নিয়ে কথা বলবে।
আমাদের ধারণাগুলো যদি সত্যি হয় তাহলে বলতে হবে, বিএনপি নেতৃত্ব প্রতিপক্ষের রাজনৈতিক কৌশলের ক্ষমতাকে ঠিকমতো মাপতে পারেনি। অন্যদিকে অবরোধের মাঝখানে প্রায় বিরতিহীন হরতাল ডেকে মানুষের জীবন-জীবিকাকে যখন হুমকির মুখে নিয়ে এলো, তখনই সরকারের দিকে ছোড়া তীর বিএনপির দিকে বুমেরাং হয়ে ফিরতে লাগল। এর সঙ্গে যুক্ত হল পেট্রলবোমার বীভৎসতা। বার্ন ইউনিটে অসহায় মানুষের আর্তচিৎকার। কৃষক আর শ্রমজীবী মানুষের জীবিকা ছিনতাই করা। রেললাইন উপড়ে ফেলা। অর্থনীতির ধস নামানো। এসএসসি পরীক্ষার্থীদের অনিশ্চয়তার মধ্যে ছুড়ে ফেলা। বিএনপি নেতারা যত কথাই বলুন,
সাধারণ মানুষের চোখে এসবের দায় জামায়াত-বিএনপির ওপরই বর্তেছে। এভাবে মানুষের
সহানুভূতি লাভ করতে গিয়ে বিএনপি গণআস্থা
থেকে অনেক দূর সরে গেছে। রাজনৈতিক সুবিধা
লাভ করতে গিয়ে রাজনীতির হিংসাত্মক পথটি বেছে নিয়ে নিজের যাত্রাপথ নিজেই কণ্টকাকীর্ণ করে ফেলেছে।
নিজ রাজনৈতিক পথে হাঁটতে গিয়ে বিএনপি বারবার চোরাবালিতে পা রেখেছে আর পরিত্রাণ পেতে চেয়েছে বিদেশী রাষ্ট্র ও কূটনীতিকদের করুণা নিয়ে। কিন্তু এবার তাতেও সংকট তৈরি হয়েছে। পেট্রলবোমাসহ নানা নাশকতা করতে গিয়ে এ মহলের সহানুভূতি পাওয়ার সম্ভাবনাটুকুও হারাতে বসেছে। প্রতি সপ্তাহে ঠুনকো কারণ দেখিয়ে হরতাল ডাকাটা সাধারণ মানুষ এখন ভীষণ বাড়াবাড়ি হিসেবে দেখছে। সাধারণ মানুষের স্বার্থের বিরুদ্ধে একটি রাজনৈতিক দল এভাবে দাঁড়াতে পারে, এটি কেউ ভাবতে পারেনি।
দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় ব্যবসায়ী সংগঠনসহ সাধারণ মানুষ এখন আইন করে হরতাল-অবরোধ বন্ধ করার দাবি জানাচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে ১৫ ফেব্র“য়ারি হাইকোর্ট হরতাল-অবরোধের নামে নৈরাজ্য রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি নির্দেশ জারি করেছেন। একই সঙ্গে এমন নৃশংস অবরোধ কেন অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে একটি রুলও জারি করা হয়েছে। আসলে জল ঘোলা করলে এমনটিই হয়। আন্দোলনের নামে বিএনপির নৈরাজ্য দমনে এবার সরকার একটি আইনগত ভিত্তিও পেয়ে গেল। নাগরিক সমাজের কোনো কোনো জ্ঞানী মানুষের আপত্তি থাকলেও বিপন্ন মানুষ হরতাল-অবরোধ আহ্বানকারীদের সন্ত্রাসী তৎপরতা থেকে মুক্তি পেতে সরকারকে আরও কঠোর হওয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছিলেন। সরকারের কাছে সাধারণ মানুষের চাওয়া জীবনের নিরাপত্তা, শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখা, অর্থনীতির চাকা গতিশীল রাখা। এজন্য সরকারের গৃহীত সব পদক্ষেপে মানুষের সমর্থন থাকবে।
আর বেশি না হারিয়ে বিএনপির উচিত বাস্তবতার আলোয় এসে দাঁড়ানো। তারা অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে যত তাড়াতাড়ি নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথে হাঁটবে, তত দেশ ও জাতির মঙ্গল এবং দল হিসেবে বিএনপিরও মঙ্গল। অসংখ্য দলপ্রেমিক সমর্থক থাকার পরও বিএনপি নেতৃত্ব কেন নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথে হাঁটতে চাইছে না, সে এক রহস্য।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawaz7b@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.