সমান্তরাল ভালোবাসা by মোজাম্মেল বাবু
১.
হিব্রু মিথলজির বর্ণনা অনুসারে- ঈশ্বর সব প্রাণিকুলকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি
করে তাদের নামকরণের ভার দেন আদমকে। সূর্যকণা থেকে জন্ম নেওয়ায় তার আরেক নাম
‘অর্ক’। অন্য প্রাণীদের যুগল প্রেমের দৃশ্যে অভিভূত হয়ে আদম নিজের জন্যও
ঈশ্বরের কাছে একজন সঙ্গিনী প্রার্থনা করেন। একই নক্ষত্রকণিকা দিয়ে
সৃষ্টিকর্তা তৈরি করেন ‘লিলিথ’কে। প্রথম মিলনেই মিশনারি পজিশনে অস্বীকৃতি
জানিয়ে আদমকে ছেড়ে চলে যায় লিলিথ। আদমের শূন্যতা দূর করতে তাকে সঙ্গে নিয়েই
প্রভু তৈরি করেন ‘দ্বিতীয়া’ আরেক সুন্দরী। সবই ছিল তার, ছিল না কেবল চমক!
তাই তার প্রতি সেদিন আকৃষ্ট হননি আদম। তবে এ নিয়েও আদম নিশ্চয়ই পরে আফসোস
করেছেন অনেক। শেষ প্রচেষ্টায় ঘুমন্ত আদমের পাঁজরের একটি হাড় খুলে নিয়ে
ঈশ্বর সৃষ্টি করেন ‘ইভ’কে। তার হাতেই আদমের ভালোবাসায় হাতেখড়ি এবং এই নশ্বর
পৃথিবীতে নির্বাসন। বশ্যতা মানা প্রেমময়ী ইভের ভালোবাসায় আপ্লুত হয়েও আদম
জন্মজন্মান্তর ধরে খুঁজে ফেরেন অধরা সেই লিলিথকে। অন্যদিকে জন্ম-মৃত্তিকার
দুর্বার আকর্ষণে লিলিথ বার বার আদমের কাছে ছুটে গেলেও বাধা পড়ে আছে চিরন্তন
বিরহের আবর্তে। প্রতিটি মানুষের জীবনেই রয়েছে একজন ‘ইভ’ এবং আরেকজন
‘লিলিথ’- কখনো সে তাকে খুঁজে পায়, কখনো পায় না। অন্যদিকে, প্রতিটি নারীর
ভিতরে একই সঙ্গে বাস করে একজন ‘ইভ’ এবং আরেকজন ‘লিলিথ’- কখনো সে তাকে
আবিষ্কার করতে পারে, কখনো পারে না। অনিবার্য অর্ক ও লিলিথের মিলন, সেই
সঙ্গে অনিবার্য তাদের অনন্ত অপেক্ষা।
২. এ স্পেস-টাইমে অর্ক ও লিলিথের দেখা হয় প্রথম যৌবনের দেড় যুগ পরে। বিষয়টি তদন্ত শেষে ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ওয়েলসের অ্যাসট্রোনমার জন ওয়েব মন্তব্য করেন ‘আলোর গতি শ্লথ হয়ে যাওয়াই এ বিলম্বের কারণ হয়ে থাকবে’। ওয়েবের যুগান্তকারী এ উদ্ভাবন ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিশ্বখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী পল ডেভিস বলেন, ‘কোয়াসার আলো বিচ্ছুরণকারী পরমাণুগুলোর গঠনে মানবদেহের পরমাণু থেকে উল্লেখযোগ্য কিছু ভিন্নতা লক্ষ্য করা গেছে, যা সত্য হলে আলোর গতির তারতম্যই হবে এ ভিন্নতার একমাত্র সম্ভাব্য কারণ’। সমগ্র মানব জাতির জন্য অত্যন্ত অর্থবহ এ অবজারভেশনটির ফলে হুমকির সম্মুখীন হবে আইনস্টাইনের কালজয়ী ‘থিওরি অব রিলেটিভিটি’, ‘কোনো বস্তুই আলোক-প্রতিবন্ধক অতিক্রম করতে পারে না’- এ সম্পর্কিত ‘টাইম ডায়লেশন’ সূত্র এবং আধুনিক বিজ্ঞানের ভিত্তি- ‘আলোর গতির স্থিরতা’র তত্ত্বটিও। তবে ঈশ্বরের সাম্রাজ্যে সময় রাখতে না পারার এটাই প্রথম নজির নয়। মাতৃতান্ত্রিক মায়োকন্ড্রিয়াল ডিএনএ ও পিতৃতান্ত্রিক ওয়াই ক্রোমোজমের বংশপরম্পরা বিশ্লেষণ করে মলিক্যুলার বায়োলজিস্টরা সম্প্রতি নিশ্চিত হয়েছেন যে, মানব জাতির অভিন্ন পিতা-মাতা হিসেবে খ্যাত ‘আদম’ ও ‘ইভ’ পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছেন অন্তত ৯০ হাজার বছরের ব্যবধানে। পিছিয়ে পড়ে আদম বোধ করি লিলিথেরই তালাশ করে থাকবেন। আঠারো বছরের বিলম্ব মুছে ফেলতে পারেনি এ যুগের অর্ক ও লিলিথের প্রেম। হঠাৎ দেখার অকস্মাৎ আঙ্গুলের ছোঁয়ায় তাদের মধ্যে আবারও জ্বলে ওঠে জন্ম-মৃত্তিকার ভালোবাসা। অনুভূতির বিদ্যুৎস্পর্শ গলা, গ্রীবা ও চিবুক ছাড়িয়ে বিনির্মিত হয় শাশ্বত এক কাব্য। ‘কে বলে আগুন, এক ফালি চুম্বনই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার!’ তাপের কোনো বিনাশ নেই, কেবল অবস্থার পরিবর্তন ঘটে মাত্র- তাপের অবিনাশিতাবাদ এ সূত্র মেনে, একজনের ভালোবাসার আজন্ম উত্তাপে বাষ্পায়িত হতে থাকে আরেকজনের ভালোবাসা। ভালো বাসতে বাসতে ফতুর হয়ে যায় আদিম দুটি মানুষ। ততক্ষণে ‘ফেন্সিং’ খেলার মতো পেছন থেকে সুতা টেনে ধরে দুটি সংসার এবং সন্তানদের উজ্জ্বল মুখ।৩. বিদ্যমান বাস্তবতায় মিলনের কোনো সম্ভাবনা খুঁজে না পেয়ে অর্ক ও লিলিথ ‘টাইম টানেল’ বেয়ে ফিরে যায় দেড় যুগ আগে। ‘গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্স’ সূত্রমতে- অতীত ভ্রমণ করে কেউ যদি নিজের ‘বাবা’র জন্মের আগেই ‘দাদা’কে হত্যা করে ফেলে, তখন ‘বাবা’ এবং একই সঙ্গে তার নিজের অস্তিত্বও মিথ্যা হয়ে যাবে। অর্ক ও লিলিথ অতীতে ফিরে গিয়ে কোনো হত্যাকাণ্ড না ঘটিয়ে শুধু নিজেদের বিয়ে দুটো ভেঙে দিয়ে আবার বর্তমান পৃথিবীতে ফিরে আসে। সকালে ঘুম ভেঙে হাত মেলতেই অর্ক স্পর্শ করে লিলিথের পেলব শরীর। লিলিথও চোখ খুলে অর্ককে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়। কিন্তু কিছুক্ষণ না যেতেই কান্নায় ভেঙে পড়ে ওরা দুজন, সময়ের পর্দা থেকে ততক্ষণে বিলীন হয়ে গেছে তাদের প্রাণপ্রিয় সন্তানরা। বস্তুত অতীত কিংবা ভবিষ্যৎ ভ্রমণে কখনো এমন কিছু করা যাবে না যাতে ইতিহাসের ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ন হয়। পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলা হয়- ‘থিওরি অব আনইন্টারেপটেড ক্রোনোলজি’। বিলাপ করতে করতে ওরা দুজন আবার ছুটে যায় অতীতের কাছে, ফিরিয়ে দেয় কালের স্বাভাবিক পরম্পরা। অতীতে ফিরে গিয়ে ‘ভুল’ শুধরে নেবার কৌশলটি যথার্থ হলেও ‘পথ’ নির্বাচন তাদের সঠিক ছিল না। টাইম-টানেল বেছে না নিয়ে তাদের উচিত ছিল ওয়ার্মহোলের ওপর আস্থা রাখা। টাইম-টানেল ভ্রমণে ফিরে আসার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় ‘এনট্রপি’কে রিভার্স করা, যেখানে ‘ডিগ্রি ও ডিজঅর্ডার ইনক্রিজেস উইথ টাইম’। সর্বশেষ উদ্যোগে বিনাইন ওয়ার্মহোল সুড়ঙ্গ দিয়ে অর্ক ও লিলিথ পৌঁছে গেল সেই সময়-সন্ধিক্ষণে, যেখান থেকে ‘দুজনার দুটি পথ দুটি দিকে গিয়েছিল বেঁকে’। ‘ওয়ার্মহোল’ একধরনের ‘ব্ল্যাকহোল’ মাত্র। সাধারণ ব্ল্যাকহোল আলো পর্যন্ত গিলে খায়, সেখান থেকে কোনো কিছুই বের হয়ে আসতে পারে না। কিন্তু অর্ক ও লিলিথের প্রয়োজনে কালের দুই প্রান্তকে সংযোগের স্বার্থে ‘অ্যান্টি-গ্র্যাভেটি’ ম্যাটার দিয়ে তৈরি হয় একটি ‘বিনাইন’ অর্থাৎ অপ্রতিকূল প্রাকৃতিক গহ্বর। কার্ল সাগানের ‘কসমস’ গ্রন্থ ও চলচ্চিত্রে ওয়ার্মহোল ভ্রমণের বিশদ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা রয়েছে। শেষমেশ ওয়ার্মহোল পথ বেয়ে অর্ক ও লিলিথ অতীতে ফিরে গিয়ে ক্রসরোডে দাঁড়িয়ে নিজেদের আবদ্ধ করল গভীর এক চুম্বনে। আর তখনই ভালোবাসার প্রকাণ্ড শক্তিতে প্রচণ্ড এক ‘বিগ ব্যাং’ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে দুই ভাগে বিভক্ত করে ফেলল। অর্ক ও লিলিথের জন্য জন্ম নিল প্যারালাল দুটো ইউনিভার্স- একটি ‘বিরাজমান বাস্তবতার’ এবং আরেকটি ‘আকাক্সক্ষার বাস্তবতার’। একটির সঙ্গে অন্যটির কোনো বিরোধ নেই এবং দুটোই সমানভাবে সত্য। তবে প্যারালাল ইউনিভার্স থিওরিতে সমান্তরালভাবে বিরাজমান ইউনিভার্সের সংখ্যায় কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। আলোড়ন সৃষ্টিকারী ‘সুপার স্ট্রিং থিওরি’ অনুসারেও বিদ্যমান ১১টি স্পেস-টাইম ডায়মেনশনের প্রতিটিতেই পৃথক একটি ‘বাস্তবতা’ বিরাজ করতে পারে।৪. কিন্তু অর্ক ও লিলিথ পরস্পরকে চিনবে কী করে? ‘মিমিকিং’ এবং ‘ক্যামোফ্লেজ’ প্রাণিকুলের শাশ্বত সক্ষমতা। একেবারে ভিন্ন প্রজাতির একটি প্রাণীও জীবনের প্রয়োজনে শারীরিক গঠন বদলিয়ে অন্য প্রজাতির আরেকটি প্রাণীর দলে ঢুকে পড়তে পারে। পিঁপড়ার খাদ্যের সহজলভ্যতার লোভে অনেক সুবিধাবাদী প্রজাতিই পিঁপড়ার রূপ নিয়ে তাদের পালে ঢুকে পড়ে। অন্যদিকে গ্রাসহপাররা গায়ের রং বদলে সবুজ ঘাসের মধ্যে মিশে থেকে পেডেটারদের চোখ ফাঁকি দেয়। মানুষের ভিতরেও এমন সব ঘটনা ঘটা সম্ভব। এ পৃথিবীতে অর্ক কিংবা লিলিথের ছদ্মবেশ নিয়ে হাজির হওয়ার অধ্যায় ঘটেছে অনেক। রয়েছে নিজেকে লুকিয়ে রাখার উপাখ্যানও। আবার লিলিথ খোঁজার নামে একাধিক ‘দ্বিতীয়া’র অভিসারেও জড়িয়েছে অনেকে। একক নারীর সঙ্গে পেরে না ওঠা পুরুষের চরে বেড়ানোর স্বভাব তার ভিন্নতা অন্বেষণের তাগিদমাত্র, বায়োলজিক্যাল নিড নয়। ‘ঈশ্বর-বিশ্বাস’ যেমন মানুষের একেবারে অন্তর্গত, তেমনি ‘বহুগামিতা’ও সম্ভবত এত দিনে তাদের ‘ডিএনএ’তে হার্ডওয়্যারড হয়ে গেছে। অন্যদিকে নারীর ‘বুক ফাটে তো মুখ ফুটে না’ রক্ষণশীলতার কারণে তাকে বঞ্চিত হতে হয়েছে বহু স্বর্গীয় সান্নিধ্য থেকে। অর্ক কিংবা লিলিথের অনুসন্ধান, মানুষের কেবল ইন্দ্রিয়ের তাড়না নয়, জন্ম-মৃত্তিকার টান! যা মানুষকে মহাচুম্বকের মতো উড়িয়ে, ভাসিয়ে, কক্ষচ্যুত করে নিয়ে যায় অসীম ভালোবাসার এক দুনিয়ায়। তথাপি বাঁধা পড়ে থাকে অনন্ত প্রতীক্ষার আবর্তে।
২. এ স্পেস-টাইমে অর্ক ও লিলিথের দেখা হয় প্রথম যৌবনের দেড় যুগ পরে। বিষয়টি তদন্ত শেষে ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ওয়েলসের অ্যাসট্রোনমার জন ওয়েব মন্তব্য করেন ‘আলোর গতি শ্লথ হয়ে যাওয়াই এ বিলম্বের কারণ হয়ে থাকবে’। ওয়েবের যুগান্তকারী এ উদ্ভাবন ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিশ্বখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী পল ডেভিস বলেন, ‘কোয়াসার আলো বিচ্ছুরণকারী পরমাণুগুলোর গঠনে মানবদেহের পরমাণু থেকে উল্লেখযোগ্য কিছু ভিন্নতা লক্ষ্য করা গেছে, যা সত্য হলে আলোর গতির তারতম্যই হবে এ ভিন্নতার একমাত্র সম্ভাব্য কারণ’। সমগ্র মানব জাতির জন্য অত্যন্ত অর্থবহ এ অবজারভেশনটির ফলে হুমকির সম্মুখীন হবে আইনস্টাইনের কালজয়ী ‘থিওরি অব রিলেটিভিটি’, ‘কোনো বস্তুই আলোক-প্রতিবন্ধক অতিক্রম করতে পারে না’- এ সম্পর্কিত ‘টাইম ডায়লেশন’ সূত্র এবং আধুনিক বিজ্ঞানের ভিত্তি- ‘আলোর গতির স্থিরতা’র তত্ত্বটিও। তবে ঈশ্বরের সাম্রাজ্যে সময় রাখতে না পারার এটাই প্রথম নজির নয়। মাতৃতান্ত্রিক মায়োকন্ড্রিয়াল ডিএনএ ও পিতৃতান্ত্রিক ওয়াই ক্রোমোজমের বংশপরম্পরা বিশ্লেষণ করে মলিক্যুলার বায়োলজিস্টরা সম্প্রতি নিশ্চিত হয়েছেন যে, মানব জাতির অভিন্ন পিতা-মাতা হিসেবে খ্যাত ‘আদম’ ও ‘ইভ’ পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছেন অন্তত ৯০ হাজার বছরের ব্যবধানে। পিছিয়ে পড়ে আদম বোধ করি লিলিথেরই তালাশ করে থাকবেন। আঠারো বছরের বিলম্ব মুছে ফেলতে পারেনি এ যুগের অর্ক ও লিলিথের প্রেম। হঠাৎ দেখার অকস্মাৎ আঙ্গুলের ছোঁয়ায় তাদের মধ্যে আবারও জ্বলে ওঠে জন্ম-মৃত্তিকার ভালোবাসা। অনুভূতির বিদ্যুৎস্পর্শ গলা, গ্রীবা ও চিবুক ছাড়িয়ে বিনির্মিত হয় শাশ্বত এক কাব্য। ‘কে বলে আগুন, এক ফালি চুম্বনই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার!’ তাপের কোনো বিনাশ নেই, কেবল অবস্থার পরিবর্তন ঘটে মাত্র- তাপের অবিনাশিতাবাদ এ সূত্র মেনে, একজনের ভালোবাসার আজন্ম উত্তাপে বাষ্পায়িত হতে থাকে আরেকজনের ভালোবাসা। ভালো বাসতে বাসতে ফতুর হয়ে যায় আদিম দুটি মানুষ। ততক্ষণে ‘ফেন্সিং’ খেলার মতো পেছন থেকে সুতা টেনে ধরে দুটি সংসার এবং সন্তানদের উজ্জ্বল মুখ।৩. বিদ্যমান বাস্তবতায় মিলনের কোনো সম্ভাবনা খুঁজে না পেয়ে অর্ক ও লিলিথ ‘টাইম টানেল’ বেয়ে ফিরে যায় দেড় যুগ আগে। ‘গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্স’ সূত্রমতে- অতীত ভ্রমণ করে কেউ যদি নিজের ‘বাবা’র জন্মের আগেই ‘দাদা’কে হত্যা করে ফেলে, তখন ‘বাবা’ এবং একই সঙ্গে তার নিজের অস্তিত্বও মিথ্যা হয়ে যাবে। অর্ক ও লিলিথ অতীতে ফিরে গিয়ে কোনো হত্যাকাণ্ড না ঘটিয়ে শুধু নিজেদের বিয়ে দুটো ভেঙে দিয়ে আবার বর্তমান পৃথিবীতে ফিরে আসে। সকালে ঘুম ভেঙে হাত মেলতেই অর্ক স্পর্শ করে লিলিথের পেলব শরীর। লিলিথও চোখ খুলে অর্ককে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়। কিন্তু কিছুক্ষণ না যেতেই কান্নায় ভেঙে পড়ে ওরা দুজন, সময়ের পর্দা থেকে ততক্ষণে বিলীন হয়ে গেছে তাদের প্রাণপ্রিয় সন্তানরা। বস্তুত অতীত কিংবা ভবিষ্যৎ ভ্রমণে কখনো এমন কিছু করা যাবে না যাতে ইতিহাসের ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ন হয়। পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলা হয়- ‘থিওরি অব আনইন্টারেপটেড ক্রোনোলজি’। বিলাপ করতে করতে ওরা দুজন আবার ছুটে যায় অতীতের কাছে, ফিরিয়ে দেয় কালের স্বাভাবিক পরম্পরা। অতীতে ফিরে গিয়ে ‘ভুল’ শুধরে নেবার কৌশলটি যথার্থ হলেও ‘পথ’ নির্বাচন তাদের সঠিক ছিল না। টাইম-টানেল বেছে না নিয়ে তাদের উচিত ছিল ওয়ার্মহোলের ওপর আস্থা রাখা। টাইম-টানেল ভ্রমণে ফিরে আসার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় ‘এনট্রপি’কে রিভার্স করা, যেখানে ‘ডিগ্রি ও ডিজঅর্ডার ইনক্রিজেস উইথ টাইম’। সর্বশেষ উদ্যোগে বিনাইন ওয়ার্মহোল সুড়ঙ্গ দিয়ে অর্ক ও লিলিথ পৌঁছে গেল সেই সময়-সন্ধিক্ষণে, যেখান থেকে ‘দুজনার দুটি পথ দুটি দিকে গিয়েছিল বেঁকে’। ‘ওয়ার্মহোল’ একধরনের ‘ব্ল্যাকহোল’ মাত্র। সাধারণ ব্ল্যাকহোল আলো পর্যন্ত গিলে খায়, সেখান থেকে কোনো কিছুই বের হয়ে আসতে পারে না। কিন্তু অর্ক ও লিলিথের প্রয়োজনে কালের দুই প্রান্তকে সংযোগের স্বার্থে ‘অ্যান্টি-গ্র্যাভেটি’ ম্যাটার দিয়ে তৈরি হয় একটি ‘বিনাইন’ অর্থাৎ অপ্রতিকূল প্রাকৃতিক গহ্বর। কার্ল সাগানের ‘কসমস’ গ্রন্থ ও চলচ্চিত্রে ওয়ার্মহোল ভ্রমণের বিশদ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা রয়েছে। শেষমেশ ওয়ার্মহোল পথ বেয়ে অর্ক ও লিলিথ অতীতে ফিরে গিয়ে ক্রসরোডে দাঁড়িয়ে নিজেদের আবদ্ধ করল গভীর এক চুম্বনে। আর তখনই ভালোবাসার প্রকাণ্ড শক্তিতে প্রচণ্ড এক ‘বিগ ব্যাং’ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে দুই ভাগে বিভক্ত করে ফেলল। অর্ক ও লিলিথের জন্য জন্ম নিল প্যারালাল দুটো ইউনিভার্স- একটি ‘বিরাজমান বাস্তবতার’ এবং আরেকটি ‘আকাক্সক্ষার বাস্তবতার’। একটির সঙ্গে অন্যটির কোনো বিরোধ নেই এবং দুটোই সমানভাবে সত্য। তবে প্যারালাল ইউনিভার্স থিওরিতে সমান্তরালভাবে বিরাজমান ইউনিভার্সের সংখ্যায় কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। আলোড়ন সৃষ্টিকারী ‘সুপার স্ট্রিং থিওরি’ অনুসারেও বিদ্যমান ১১টি স্পেস-টাইম ডায়মেনশনের প্রতিটিতেই পৃথক একটি ‘বাস্তবতা’ বিরাজ করতে পারে।৪. কিন্তু অর্ক ও লিলিথ পরস্পরকে চিনবে কী করে? ‘মিমিকিং’ এবং ‘ক্যামোফ্লেজ’ প্রাণিকুলের শাশ্বত সক্ষমতা। একেবারে ভিন্ন প্রজাতির একটি প্রাণীও জীবনের প্রয়োজনে শারীরিক গঠন বদলিয়ে অন্য প্রজাতির আরেকটি প্রাণীর দলে ঢুকে পড়তে পারে। পিঁপড়ার খাদ্যের সহজলভ্যতার লোভে অনেক সুবিধাবাদী প্রজাতিই পিঁপড়ার রূপ নিয়ে তাদের পালে ঢুকে পড়ে। অন্যদিকে গ্রাসহপাররা গায়ের রং বদলে সবুজ ঘাসের মধ্যে মিশে থেকে পেডেটারদের চোখ ফাঁকি দেয়। মানুষের ভিতরেও এমন সব ঘটনা ঘটা সম্ভব। এ পৃথিবীতে অর্ক কিংবা লিলিথের ছদ্মবেশ নিয়ে হাজির হওয়ার অধ্যায় ঘটেছে অনেক। রয়েছে নিজেকে লুকিয়ে রাখার উপাখ্যানও। আবার লিলিথ খোঁজার নামে একাধিক ‘দ্বিতীয়া’র অভিসারেও জড়িয়েছে অনেকে। একক নারীর সঙ্গে পেরে না ওঠা পুরুষের চরে বেড়ানোর স্বভাব তার ভিন্নতা অন্বেষণের তাগিদমাত্র, বায়োলজিক্যাল নিড নয়। ‘ঈশ্বর-বিশ্বাস’ যেমন মানুষের একেবারে অন্তর্গত, তেমনি ‘বহুগামিতা’ও সম্ভবত এত দিনে তাদের ‘ডিএনএ’তে হার্ডওয়্যারড হয়ে গেছে। অন্যদিকে নারীর ‘বুক ফাটে তো মুখ ফুটে না’ রক্ষণশীলতার কারণে তাকে বঞ্চিত হতে হয়েছে বহু স্বর্গীয় সান্নিধ্য থেকে। অর্ক কিংবা লিলিথের অনুসন্ধান, মানুষের কেবল ইন্দ্রিয়ের তাড়না নয়, জন্ম-মৃত্তিকার টান! যা মানুষকে মহাচুম্বকের মতো উড়িয়ে, ভাসিয়ে, কক্ষচ্যুত করে নিয়ে যায় অসীম ভালোবাসার এক দুনিয়ায়। তথাপি বাঁধা পড়ে থাকে অনন্ত প্রতীক্ষার আবর্তে।
email : mozammelbabu@hotmail.com
No comments