একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন ও মাতৃভাষা চর্চা by বদরুদ্দীন উমর

একুশে ফেব্রুয়ারি এখন সব ধরনের মধ্যবিত্ত সুবিধাবাদী ও সুবিধাভোগীদের বাংলা ভাষার জন্য কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণের দিবস। ছাত্রছাত্রী, তরুণ-তরুণীদের মুখমণ্ডল, হাতে রং-তুলিতে ক খ গ ঘ এঁকে বাংলা ভাষার শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের দিবস। বর্ণমালা, শহীদ মিনারসহ নানা ধরনের ছাপ মারা কাপড় পরে উৎসবে মত্ত হওয়ার দিবস। মাথায় পট্টি বেঁধে ঘোরাফেরার দিবস। কিছু ধরাবাঁধা কথার চর্বিত চর্বণ করে বুদ্ধিজীবীদের শূন্যগর্ভ বক্তৃতার দিবস। স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলা ভাষার জন্য তাদের হায় হায় করার দিবস।
১৯৫৩ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপিত হতো প্রতিরোধ ও সংগ্রামের দিবস হিসেবে। সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসেবে শুরু হয়ে ভাষা আন্দোলন বিকশিত হয়েছিল রাজনৈতিক আন্দোলনে। তখন একুশে ফেব্রুয়ারির রাজনৈতিক পরিচয় ছিল খুব উচ্চারিত। একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে ছাত্রছাত্রী, তরুণ-তরুণীরা নিজেদের স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগে বের করতেন অসংখ্য একুশে ফেব্রুয়ারি সংকলন, যাতে থাকত তাদের নিজেদের লেখা। সেগুলোর মধ্যে থাকত গম্ভীরতা, যা সংগ্রামের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপনে তখন জনগণের উদ্যোগ ও প্রাধান্যই ছিল উল্লেখযোগ্য। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সব অনুষ্ঠানের কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ থাকত জনগণের নানা সংগঠনের। তাতে সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ থাকত না। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পর ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট সরকার এবং পরে আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ একুশে উদযাপনের ক্ষেত্রে ছিল না, যদিও সে উপলক্ষে সরকারি অনুষ্ঠানও হতো। কিন্তু ১৯৭২ সাল থেকে একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন দাঁড়াল অন্যরকম। আগে যেখানে এ দিবসটি ছিল প্রতিরোধ ও সংগ্রামের এক রাজনৈতিক দিবস, তাকে ঘোষণা করা হল শোক দিবস। বলা হল, স্বাধীন বাংলাদেশে প্রতিরোধ ও রাজনৈতিক সংগ্রাম নিষ্প্রয়োজনীয়। কাজেই এ দিবস পালন করা দরকার শোক দিবস হিসেবে। শোকের মধ্যে যে প্রতিরোধ বা সংগ্রামের কোনো প্রেরণা বা উপাদান থাকে না, তা বলাই বাহুল্য। একুশে ফেব্র“য়ারির ভোরবেলা ঢাকাজুড়ে যে প্রভাতফেরি বের হতো গান গেয়ে গেয়ে, তা বাস্তবত উঠে গেল এক সরকারি সিদ্ধান্তে। ভোরবেলার পরিবর্তে মধ্যরাতে, বারোটার সময়, শুরু হল প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে। প্রভাতফেরি নামে এখন যা চালিয়ে দেয়া হয় তার সঙ্গে আগেকার প্রভাতফেরির কোনো মিল আর থাকল না। ১৯৭২ সাল থেকে একুশে উপলক্ষে ছাত্রছাত্রী, তরুণ-তরুণীদের সংকলন প্রকাশের রেওয়াজ উঠে গেল। নামে শোক দিবস হলেও একুশে ফেব্র“য়ারি পরিণত হল এক বিচিত্র উৎসবে। সরকারি তৎপরতার মাধ্যমে একুশে ফেব্রুয়ারির সংগ্রামী ঐতিহ্য হারিয়ে গেল।
বাংলাদেশে যারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেন, তাদের শ্রেণী চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে এই পরিবর্তন ছিল সঙ্গতিপূর্ণ। ভোলার উপায় নেই যে, স্বাধীন বাংলাদেশে লুটপাট, চুরি-দুর্নীতি, মিথ্যাচার, প্রতারণা ও তার প্রয়োজনে সন্ত্রাসের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল নব্য শাসকশ্রেণীর শাসন। এই শাসনে শুধু যে মানুষের নৈতিক চরিত্রের দ্রুত অবক্ষয় শুরু হল তাই নয়, তার সঙ্গে দেখা দিল সমাজে অপরাধ প্রবণতা ও অপরাধের বিস্তার। সমাজবিষয়ক চিন্তার পরিবর্তে ব্যক্তিস্বার্থ চিন্তা হল নতুন শাসকশ্রেণীর ছত্রছায়ায় গড়ে উঠতে থাকা নব্য মধ্যবিত্ত ও নতুন প্রজন্মের সাংস্কৃতিক চিন্তাভাবনার নিয়ামক। গম্ভীর চিন্তার পরিবর্তে স্থূলতা ও লঘুত্বই আচ্ছন্ন করল বাংলাদেশের সমগ্র মধ্যশ্রেণীর ভাবনার জগৎকে। এর পরিণতিই আমরা দেখছি বর্তমান পরিস্থিতিতে। একুশে ফেব্রুয়ারির প্রতিদ্বন্দ্বী দিবস হিসেবে ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবসের আবির্ভাব, চিন্তা-চেতনার অবক্ষয় এবং গম্ভীরতার পরিবর্তে ফুর্তির প্রতি নতুন প্রজন্মের ক্রমবর্ধমান আকর্ষণ এই পরিণতির একটা উল্লেখযোগ্য দিক।
হঠাৎ করে এখন দেখা যাচ্ছে মাতৃভাষা দিবস হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপনের সময় বাংলাদেশের অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষার প্রতি দরদ! শোনা যাচ্ছে সব মাতৃভাষার সমান অধিকারের কথা!! আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে শুধু বাংলার প্রতি নয়, অন্যান্য ভাষার বিকাশও যে প্রয়োজন এ বিষয়টি আমলে আনার কারণেই এসব কথা শোনা যাচ্ছে। কোনো কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এ নিয়ে বিজ্ঞাপন দিয়ে ব্যবসা জমানোর চেষ্টাও করছে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে খোদ বাংলা ভাষাই যেখানে উপেক্ষিত, বাংলা ভাষা চর্চা যেখানে সংকটের সম্মুখীন, বাংলা ভাষার দুরবস্থার কথা বলে যেখানে লেখক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীরা হায় হায় করছে, সেখানে অন্য ভাষার চর্চা এবং উন্নতির কথা ভণ্ডামি ও ভাঁওতাবাজি ছাড়া আর কী? এটা এক ভণ্ডামি এ কারণও যে, বাংলাদেশের শাসক শ্রেণী প্রথম থেকেই এ দেশে বসবাসরত অন্যান্য জাতিসত্তার প্রতি শত্র“তামূলক আচরণই করে এসেছে এবং এখনও করছে। এই উগ্র জাতীয়তাবাদী শাসকরা এখন নির্দেশ জারি করেছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের সঙ্গে বিদেশীরা তো বটেই, এমনকি বাঙালি পর্যন্ত কথাবার্তা বা আলাপ-আলোচনা স্বাধীনভাবে করতে পারবে না! সেনাবাহিনী বা প্রশাসনের লোকদের উপস্থিতিতেই সেটা করতে হবে!! ১৯৭২ সালেই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান পার্বত্য চট্টগ্রামের নেতা সংসদ সদস্য মনিরেন্দ্র লারমাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন, বাঙালি ছাড়া অন্য কারও স্থান বাংলাদেশে নেই। সবাইকেই বাঙালি হয়ে
যেতে হবে!!! ওপরে যে সরকারি নির্দেশের কথা উল্লেখ করা হল, সে নির্দেশ যে শেখ মুজিবের এই ঘোষণার সঙ্গে ষোল আনা সঙ্গতিপূর্ণ এটা বলাই বাহুল্য।
ভাষার অধিকার মানুষের অন্যান্য অধিকারের সঙ্গেই সম্পর্কিত। কাজেই যেখানে বাঙালি ছাড়া অন্য কোনো জাতি বা জাতিসত্তার কোনো স্বতন্ত্র অস্তিত্বেরই স্বীকৃতি নেই, যেখানে তাদের জীবন ও জীবিকার কোনো নিরাপত্তা নেই, যেখানে তাদের জমিজমা ও ভিটেমাটি দখলের এক মহোৎসব দেখা যাচ্ছে শাসক শ্রেণীর রাজনৈতিক দল ও তাদের সঙ্গে সম্পর্কিতদের দ্বারা, সেখানে তাদের মাতৃভাষা চর্চা, মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার কথা বলা এক চরম ধাপ্পাবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়। এই ধাপ্পাবাজিই এখন জোরেশোরে শুরু হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা ও মারমা ভাষাই তুলনায় কিছু উন্নত, যদিও তার বিকাশ অনেক আগে থেকেই রুদ্ধ। মাতৃভাষায় শিক্ষার জন্য চাই সে ভাষায় বইপত্র, অন্তত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের বইপত্র। চাকমা ও মারমা ভাষায় সে রকম বইপত্র আজ পর্যন্ত নেই। তার কোনো চেষ্টাও সরকারিভাবে হয়নি এবং এক্ষেত্রে সরকারি নীতি, পরিপ্রেক্ষিতে কোনো বেসরকারি উদ্যোগও দেখা যায় না। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে লাখ লাখ সাঁওতালের বসবাস। বাংলাদেশে সাঁওতালী ভাষার চর্চা না হলেও ভারতে সাঁওতালী ভাষার লিপি আছে, রোমান ও বাংলালিপিতে সেখানে সাঁওতালী ভাষার বইপত্র পাওয়া যায়। বিহার ও পশ্চিম বাংলায় অনেক স্কুলে সাঁওতালী ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাও দেয়া হয়। এই সুবিধাজনক অবস্থায় বাংলাদেশে সাঁওতালী ভাষা চর্চার অনেক সুযোগ আছে। কিন্তু সে সুযোগ থেকে সাঁওতালরা সরকারি নীতি অনুযায়ীই বঞ্চিত। যেখানে তাদের জীবন-জীবিকার কোনো নিশ্চয়তা নেই, যেখানে তাদের জমিজমা ও ভিটেমাটির ওপর আক্রমণ এই মুহূর্তেও অব্যাহত আছে, সেখানে মাতৃভাষায় সাঁওতালদের শিক্ষা দান ব্যবস্থার কথা বলা এক বড় ভণ্ডামি এবং লোক দেখানো ব্যাপার ছাড়া আর কী?
বাংলা ভাষার যে দুরবস্থার কথা এখন শাসক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীরাও বলছেন, তার জন্য হায় হায় করছেন, সে অবস্থা বাংলাদেশের জনগণের দুর্নীতির সঙ্গে সম্পর্কিত। কারণ ভাষা এবং ভাষা চর্চা আকাশের ব্যাপার নয়। মাটির সঙ্গে, মানুষের জীবনের সঙ্গেই তার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। কাজেই বাংলাদেশে বাংলা ভাষার দুরবস্থার জন্য এ দেশের জনগণের অবস্থা, এ দেশে শিক্ষাব্যবস্থার দুরবস্থার দিকে ঠিকমতো তাকাতে হবে। কিন্তু এসব নিয়ে হায় হায় করার উৎসাহ লেখক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের যত আছে, এই দুরবস্থার কারণ বিশ্লেষণ ও চিহ্নিত করার কোনো ইচ্ছা ও ক্ষমতা এদের নেই। কারণ সে কাজ করতে গেলে এটা পরিষ্কার ধরা পড়বে যে, এর জন্য এই লেখক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীরা এবং এরা যে শাসক শ্রেণীর সঙ্গে সম্পর্কিত, তারাই দায়ী। কেঁচো খুঁড়তে সাপ বের হওয়ার আশংকাই এদেরকে এ প্রচেষ্টা থেকে বিরত রাখে।
২১.০২.২০১৫
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল

No comments

Powered by Blogger.