সভ্যতা-সংস্কৃতি, পানের বরজের নিচে...
দশ বছর আগেও যেখানে অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক নরেশ চন্দ্র দাসের পানের বরজ ছিল; প্রত্নতাত্তি্বক অনুসন্ধানে সেখানেই মিলছে হাজার বছরের পুরনো বৌদ্ধ নগরী_ মঙ্গলবারের সমকালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে এমন সূচনা আমাদের রাজা বিক্রমাদিত্যের সেই বত্রিশ পুতুল সিংহাসনের কথা মনে করিয়ে দেয়। অধুনা মুন্সীগঞ্জ জেলা যে আদি বিক্রমপুর অঞ্চলের অংশ এবং সেখানকারই টঙ্গিবাড়ী উপজেলার নাটেশ্বর গ্রামে প্রত্নতাত্তি্বক খনন কাজ চলছে কয়েক বছর ধরে; আমরা জানি। এই ধারণাও ব্যাপকভাবে প্রচলিত যে, পুরাণে যে একাধিক 'বিক্রমাদিত্য' উলি্লখিত, তাদের অন্তত একজনের রাজধানী ছিল আজকের মুন্সীগঞ্জে। এদের একজনের রাজ্যে এক কৃষকের অগাধ 'জ্ঞান' লোকজনকে বিস্মিত করত। তবে বন্যপ্রাণীর হাত থেকে রক্ষার জন্য নিজের তৈরি মাচায় বসে ক্ষেতের ফসল পাহারা দেওয়ার সময়ই কেবল তার এই পাণ্ডিত্য প্রকাশ পেত। অন্য সময় নেহাত আর দশজন চাষাভূষার সঙ্গে পার্থক্য থাকত না। রাজা বিক্রমাদিত্য বিষয়টি শুনে বাঁশের মাচার নিচের ভূমি খুঁড়ে বত্রিশটি পুতুলের মাথায় বসানো একটি সিংহাসন পান। পরে পুতুলগুলো ওই সিংহাসনের আদি অধিকর্তার নানা রাজসিক গুণের কথা তুলে ধরে। ওই কৃষকের বাঁশের মাচার মতো পানের বরজের নিচে খুঁড়ে যেভাবে একের পর এক বেরিয়ে আসছে বৌদ্ধ মন্দির, অষ্টকোণ আকৃতির স্তূপ, চার মিটার প্রশস্ত সীমানা প্রাচীরসহ বিস্ময়কর সব স্থাপনা, তাতে বিক্রমপুরের উন্নত সভ্যতা তথা জ্ঞান-বিজ্ঞানেরই আভাস পাই আমরা। বাংলার প্রাচীন সভ্যতার এসব আবিষ্কার নিঃসন্দেহে এ দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যে নতুন মাত্রা যুক্ত করবে। বৌদ্ধ সভ্যতার এসব নিদর্শন বাংলাদেশের সীমানার বাইরে ভারত, নেপাল, ভুটান, চীন, মিয়ানমার ছাড়াও পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে আমাদের সাংস্কৃতিক সম্পর্কেরও নতুন পথরেখা তৈরি করবে। আমরা জানি, 'অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশন' ২০১০ সালে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় এ অঞ্চলে প্রথম প্রত্নতাত্তি্বক খননের উদ্যোগ গ্রহণ করে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এ খনন কাজে অংশ নেন। গত পাঁচ বছর ধারাবাহিক খনন ও গবেষণায় সেখানে আবিষ্কৃৃত হয়েছে একটি বৌদ্ধ বিহারের অংশবিশেষ। ২০১৩ ও ২০১৪ সালে টঙ্গিবাড়ী ইউনিয়নের নাটেশ্বর দেউল থেকে আবিষ্কৃৃত হয় মন্দির ও স্তূপ স্থাপত্যের অংশবিশেষ। এ বছর এই অনুসন্ধান প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছে চীনের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ইউনান প্রাদেশিক ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক চাই হুয়াংবোর নেতৃত্বে চার সদস্যের গবেষক দল। এর আগে নরসিংদীর উয়ারি-বটেশ্বর গ্রামেও আমরা প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন পেয়েছি। দেশের অন্যান্য অংশেও রয়েছে আদি বাংলার সভ্যতা-সংস্কৃতির নিদর্শন। আমরা চাইব, আরও অনুসন্ধান চলবে। এ জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দিতে কার্পণ্য করবে না সরকার। প্রয়োজনে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকেও যুক্ত করা হবে। কথা হচ্ছে, মাটির নিচে চাপা পড়া এসব প্রত্নতাত্তি্বক অনুসন্ধানের সঙ্গে সঙ্গে ভূমির ওপরে থাকা সভ্যতা ও সংস্কৃতির নিদর্শনগুলোও সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণে মনোযোগ দিতে হবে। যেমন নাটেশ্বর গ্রামের স্কুলশিক্ষকের ওই পানের বরজও কিন্তু আমাদের আদি সভ্যতা ও সংস্কৃতির নিদর্শন_ মনে রাখতে হবে। হাজার বছর ধরে পান মানুষের মুখ ও চিত্তরঞ্জন করে চলেছে। বৌদ্ধ সংস্কৃতির মতো পানও ছড়িয়ে রয়েছে বাংলা থেকে দক্ষিণ এশিয়া হয়ে পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত। ভারতে চলছে পান সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণের উদ্যোগ। আমরাও কি করতে পারি না? ওপরের পানের বরজ ও নিচের বৌদ্ধ সভ্যতা_ দুটিই গুরুত্বপূর্ণ বৈকি!
No comments